আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উওর ইতিহাস অষ্টম শ্রেনী
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উওর ইতিহাস অষ্টম শ্রেনী ||
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান (হায়দরাবাদ, অযোধ্যা ও বাংলা) ও পলাশির যুদ্ধ
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান এই অধ্যায়ের সমস্ত রকমের প্রশ্ন উওর আলোচনা করা হয়েছে।
marks 5
ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান বড় প্রশ্ন উওর:
প্রশ্ন 1. মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণগুলি লেখো।
উওর:-
সূচনা: ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সময়ে সম্রাটদের অযোগ্যতাসহ নানা কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হয় ।
মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণসমূহ
[1] সম্রাটদের অযোগ্যতা: জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের সময় থেকেই মুঘল শাসন কাঠামোয় ছোটো-বড়ো সমস্যা দেখা দেয়। ঔরঙ্গজেবের আমলে এই সমস্যাগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের দক্ষতাও অযোগ্যতার জন্য এই সমস্যাগুলি সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে ।
[2] সামরিক ব্যবস্থার দুর্বলতা: আঠারো শতকের মুঘল সম্রাটরা বিশেষ কোনো সামরিক সংস্কার করেননি। ফলে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ আর বাইরের আক্রমণ উভয়েরই মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় মুঘল সেনারা। শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠাদের, নাদির শাহের নেতৃত্বে পারসিকদের এবং আহম্মদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে আফগানদের আক্রমণে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে।
[3] জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থার সংকট: জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থার সংকট মুঘল শাসন কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। ভূমিরাজস্বের হিসাবে নানা গরমিল সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ভালো জায়গির পাওয়ার লোভে মুঘল দরবারের অভিজাতদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে।
[4] কৃষিব্যবস্থায় সংকট: সাম্রাজ্যের আয়-ব্যয়ের গরমিল বাস্তবে কৃষিব্যবস্থায় সংকট তৈরি করে। একাধিক অঞ্চলে কৃষকবিদ্রোহ শুরু হলে মুঘল শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
[5] আঞ্চলিক শক্তির উত্থান: আঠারো শতকের প্রথমদিকে বাংলা, হায়দরাবাদ ও অযোধ্যাসহ বেশ কিছু আঞ্চলিক স্বশাসিত শক্তি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। এর ফলে মুঘল কেন্দ্ৰীয় ীয় শাসনের ঐক্য ও সংহতি ভেঙে পড়ে।
প্রশ্ন 2. অষ্টাদশ শতকে ভারতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের পিছনে মুঘল সম্রাটদের ব্যক্তিগত অযোগ্যতাই কেবল দায়ী ছিল? তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাও ৷
উওর:-
অনেকক্ষেত্রেই মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতিকে মুঘল সম্রাটের ব্যক্তিগত দক্ষতা-ব্যর্থতা দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। যদিও একটি সাম্রাজ্য তথা শাসনব্যবস্থা শুধুমাত্র ব্যক্তি সম্রাটের দক্ষতা-যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির জন্য আরও বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যায়।
মুঘল সম্রাটদের মধ্যে ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সময়ে শাসকগণ ছিলেন অযোগ্য। আসলে মুঘল শাসনকালের শেষের দিকে নানা কারণে মুঘল শাসন কাঠামোয় সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের সময় থেকে শুরু হয় এই সমস্যা যা ঔরঙ্গজেবের আমলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালের সম্রাটরা সামরিক সংস্কার না করায়, জায়গিরদারি ও মনসবদারি সংকট, কৃষি সংকট প্রভৃতির মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় আঞ্চলিক শক্তিগুলি মাথা চারা দেয়।
মুঘল শাসনকাঠামোর দুর্বলতার সুযোগে বাংলা, হায়দরাবাদ ও অযোধ্যার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলি প্রায় স্বাধীন হয়ে ওঠে। সবশেষে বলা যায়, ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল থেকে মুঘল সম্রাটের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার পাশাপাশি এই সমস্ত কারণগুলিও মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
প্রশ্ন 3 *মুরশিদকুলি খান ও আলিবর্দি খানের সময়ে বাংলার সঙ্গে মুঘল শাসনের সম্পর্কের চরিত্র কেমন ছিল ?
উওর:-
সূচনা: মুঘল শাসনাধীনে থাকলেও মুরশিদকুলি ও আলিবর্দি খানের সময় আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলা অনেকটাই স্বাধীন ছিল।
মুরশিদকুলি ও মুঘল শাসন
[1] বাংলার দেওয়ান হিসেবে সম্পর্ক: আঠারো শতকের শুরুতে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব মহম্মদ হাদিকে বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ করেন। দেওয়ান হিসেবে কৃতিত্ব দেখানোর জন্য ঔরঙ্গজেব তাকে মুরশিদকুলি খান উপাধি দেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি বাংলার রাজস্ব আদায় করে মুঘল কোশাগারে জমা দেন।
[2] সুবাদার হিসেবে সম্পর্ক: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ মুরশিদকুলিকে প্রথমে দাক্ষিণাত্যে বদলি করে দেন। কিন্তু দু-বছর পরে বাহাদুর শাহ মুরশিদকুলিকে বাংলায় দেওয়ান পদে পুনর্নিয়োগ করেন। মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়র দিল্লির সিংহাসনে বসলে মুরশিদকুলির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়।
তিনি বাদশাহের দয়ায় বাংলার সুবাদার হন। তাঁর সঙ্গে মুঘল বাদশাহের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় মুরশিদকুলি দেওয়ান ছাড়াও বাংলায় নায়েব সুবাদার পদ পান (১৭১৩ খ্রি.)। পরের বছর তাকে একই সঙ্গে উড়িষ্যার সুবাদার করা হয়।
পরবর্তীকালে (১৭১৭ খ্রি.) মুঘল মুরশিদকুলি খান সম্রাট ফারুকশিয়রের নির্দেশে বাংলার সুবাদার পদ লাভ করেন মুরশিদকুলি। এইভাবে মুঘলদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে তিনি একই সঙ্গে বাংলার সুবাদার ও দেওয়ান এবং উড়িষ্যার সুবাদার হয়েছিলেন।
আলিবর্দি ও মুঘল শাসন
[1] ফৌজদার হিসেবে সম্পর্ক; আলিবর্দি খানের পূর্বনাম ছিল মিরজা মহম্মদ। তিনি ঔরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহের অধীনে কাজ করতেন। পরেও আজম শাহ মারা গেলে মিরজা মহম্মদ উড়িষ্যায় চলে গিয়ে সেখানে সুজাউদ্দিনের অধীনে চাকরি নেন।
বাংলার সিংহাসনে যখন সুজাউদ্দিন ছিলেন, তখন মিরজা মহম্মদ আলি রাজমহলের ফৌজদার হন। ফৌজদার হিসেবে তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সুজাউদ্দিন তাঁকে আলিবর্দি খান উপাধি দেন।
[2] নায়েব নাজিম হিসেবে সম্পর্ক: বিহারকে বাংলার সঙ্গে যোগ করা হলে আলিবর্দি খান বিহারের নায়েব নাজিম বা সহকারী শাসনকর্তা হন। এসময়ে তিনি বিদ্রোহী জমিদারদের কঠোরভাবে দমন করে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।
আলিবর্দি খান সহকারী শাসনকর্তা হিসেবে আলিবর্দি খান মুঘলদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। মুঘলদের নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ে তিনি পারদর্শিতা দেখান। ফলে তাঁর সঙ্গে মুঘল শাসকদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রশ্ন 4 *ধরো তুমি নবাব আলিবর্দি খান-এর আমলে বাংলার একজন সাধারণ মানুষ। তোমার এলাকায় বর্গি আক্রমণ হয়েছিল। তোমার ও তোমার প্রতিবেশীর মধ্যে বর্গিহানার অভিজ্ঞতা বিষয়ে একটি কথোপকথন লেখো।
কথোপকথন: বিষয়—বর্গিহানার অভিজ্ঞতা
রাম : আরে বিপিন যে, কী খবর ভাই ?
বিপিন : আর খবরের কী আছে দাদা? বর্গিরাই তো আমাদের সব খবর শেষ করে দিয়ে গেল। গোটা এলাকা শূন্য। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি নবাব আলিবর্দির রাজধানী মুরশিদাবাদও বর্গি আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
রাম : বর্গিহানার ফলে আমাদের কৃষিক্ষেত্রের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল। বর্গিরা সাধারণ কৃষকদের ওপর যথেচ্ছাচার চালায়। এখনও মেদিনীপুর, হাওড়া অঞ্চলে মাটি খুঁড়লে নাকি পোড়ামাটির ছোটো গোলক পাওয়া যায়। বর্গিরা তাদের বাঁটুল দিয়ে এই গোলক ছুঁড়ে কৃষক ও তার পরিবারকে আহত করত বলে জনশ্রুতি আছে।
বিপিন : শুধু চাষবাস নয় রাম, তাঁতিপাড়ার তাঁতিরা সব পালিয়ে গেছে। বাংলায় তাঁতও আর চলবে না। কাটোয়া, বর্ধমান সব বেবাক লুঠ হয়ে গেছে।
রাম : এখন কী খেয়ে বেঁচে থাকব তাই ভাবছি। সব জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। সেরকম কিছু মিলছে না।
বিপিন : দেশটাকে যেন ভয়ভীতিতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেল ভাই। কেমন ছড়া তৈরি হয়েছে রাম শুনেছ? ‘ছেলে ঘুমোল পাড়া জুড়োল, বর্গি এল দেশে…’
রাম : শুধু ছড়া কেন বিপিন, কবি গঙ্গারাম ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’ নামে কাব্য লিখেছেন। সেই কাব্যে লিখেছে—‘যেই মাত্র পুনরপি ভাস্কর আইল।/তবে সরদার সকলে ডাকিয়া কহিল-/স্ত্রীপুরুষ আদি করি যতেক দেখিবা।/তলোয়ার খুলিয়া সব তাদের কাটিবা।/এতেক বচন যদি বলিল সরদার।/চতুর্দিকে লুটে কাটে বোলে ‘মার মার’।।” এতো সত্যিই গো রাম!
বিপিন
: তাই লিখেছে নাকি?
রাম : বর্গিদের লুঠপাট নিয়ে লিখেছে—’বাঙ্গালা চৌ-আরি যত বিষ্ণু মোত্তব।/ছোটো বড়ো ঘর আদি পোড়াইল সব।/এই মতে যত সব গ্রাম পোড়াইয়া।/চতুর্দিকে বর্গি বেড়ায়ে লুটিয়া।।”
বিপিন : শুনেছি বর্গিরা নাকি ব্রিটিশদের কামানকে ভয় পায়। আর সেই কারণেই ওরা এখনো কলকাতার দিকে ঘেঁষেনি। আমি ভাবছি পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যাব। আলিবর্দি খানের রাজ্যে আর আমাদের শান্তি নেই ।
রাম : ঠিকই বলেছ। ব্যাটারা সোনার বাংলা একেবারে শ্মশান করে দিয়ে গেল।
বিপিন : সত্যি ভাই, বাংলার এ এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় ৷
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান class 8:
প্রশ্ন 5 সিরাজের আগে পর্যন্ত বাংলার নবাব ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের বিবর্তন আলোচনা করো।
উত্তর:-
• সূচনা: বাংলার নবাবদের সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক বিভিন্ন সময় বদলায়।
বাংলার নবাব ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের বিবর্তন
[1] মুরশিদকুলি খানের আমলে: মুরশিদকুলি খানের সময় বাংলায় বাণিজ্যে লিপ্ত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মধ্যে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসি এই ৩টি কোম্পানি ছিল বেশি ক্ষমতাশালী। ফারুকশিয়রের ফরমান ব্যবহারকারী ব্রিটিশ কোম্পানির অধিকারকে মুরশিদকুলি খান সীমিত করতে চেয়েছিলেন।
তিনি এক ঘোষণায় বলেন—সরাসরি সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানি দ্রব্যগুলির শুল্ক মুকুব করা হলেও দেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে না । তিনি ব্রিটিশদের কলকাতার কাছাকাছি গ্রাম কেনায় মত দেননি এবং মুরশিদাবাদের টাঁকশাল ব্যবহারের সুবিধা দেননি। কোম্পানির বণিকরা ব্যক্তিগত ব্যাবসায় দস্তকের অপব্যবহার করে নবাবের শুল্ক ফাঁকি দিলে নবাবকোম্পানির সম্পর্ক নষ্ট হয়।
পাশাপাশি নবাবের অনেক কর্মচারী ব্রিটিশ বণিকদের থেকে নানা অজুহাতে টাকা-পয়সা দাবি করত। সেই দাবি পূরণ না করলে নবাবের কিছু কর্মচারী ব্রিটিশ কর্মচারীদের ওপর অত্যাচার চালাত। এইভাবে বাংলার নবাব ও ব্রিটিশ কোম্পানির মধ্যে বিরোধিতামূলক সম্পর্ক শুরু হয় ৷
[2] আলিবর্দি খানের আমলে : নবাব আলিবর্দি খান মনে করতেন বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্রিটিশ বণিকরা সাহায্য করছে। তাই ব্রিটিশ বণিকদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে নবাব খেয়াল রাখতেন। তা ছাড়া ফরাসিদের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানিকেও তিনি বাংলায় দুর্গ তৈরিতে বাধা দিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে তাঁর মত ছিল বিদেশি বণিকদের নবাব নিরাপত্তা দেবে তাই দুর্গের প্রয়োজন নেই। মারাঠা আক্রমণকালে (১৭৪৪ খ্রি.) আলিবর্দি খান ব্রিটিশ কোম্পানি থেকে ৩০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। কিন্তু কোম্পানি এই টাকা দিতে অস্বীকার করলে নবাব-কোম্পানি সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
ব্রিটিশ কোম্পানি একসময়ে (১৭৪৮ খ্রি.) আর্মেনীয় বণিকদের জাহাজ আটকে রাখলে নবাবের সাথে কোম্পানির সংঘাত বাঁধে।
প্রশ্ন ৬. বাংলার মসনদ দখলের ক্ষেত্রে ক্লাইভের ষড়যন্ত্র কীরূপ ছিল ?
O সূচনা: বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্লাইভ নবাবের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ সভাসদদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ।
ক্লাইডের ষড়যন্ত্র
[1] ষড়যন্ত্রের একপক্ষ—ব্রিটিশ: বাংলার নতুন নবাব সিরাজের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট বুঝেছিল যে, বাংলা থেকে ব্রিটিশ শক্তিকে উচ্ছেদ করাই হল সিরাজের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানিও সিরাজকেই তাদের প্রধান শত্রুরূপে চিহ্নিত করে। বাংলার মসনদ থেকে তাঁর উৎখাতকেই ব্রিটিশ কোম্পানি নিজেদের প্রাথমিক কর্তব্য বলে স্থির করে।
[2] ষড়যন্ত্রের অপরপক্ষ—নবাবের আত্মীয় ও কর্মচারীবর্গ; পলাশির ষড়যন্ত্র ছিল সম্পূর্ণরূপে মুরশিদাবাদের দরবারি অভিজাতদের সৃষ্টি। পূর্ণিয়ার শাসক শওকত জংকে দমনের জন্য জগৎ শেঠের কাছে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে সিরাজ তাকে ধর্মান্তরিত করার হুমকি দেন। আবার রায়দুর্লভকে দেওয়ান ও মিরজাফরকে বক্সির পদ থেকে সরানো হলে তাঁরাও সিরাজের ওপর ক্ষুব্ধ হন।
এ ছাড়া অপরিণামদর্শী তরুণ নবাবের উচ্ছৃঙ্খলতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তাঁর আত্মীয়পরিজনেরা মুরশিদাবাদের রাজকর্মচারী ও শেঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে তাঁরই সেনাপতি মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার ষড়যন্ত্র শুরু করে। ক্লাইভ এই পরিস্থিতির সুযোগে ষড়যন্ত্রের সাহায্যে কোম্পানির পথের কাঁটা সিরাজকে বাংলার মসনদ থেকে উপড়ে ফেলতে উদ্যোগী হন।
[3] গোপন চুক্তি: ক্লাইভ মিরজাফর, মানিকচাঁদ, জগৎ শেঠ, ইয়ারলতিফ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে বলা হয়—(i) সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার পর মিরজাফর বাংলার নবাব হবেন, (ii) বিনিময়ে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও অধিকতর বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে ।
প্রশ্ন 7 দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বলতে কী বোঝ ?
O সূচনা: ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ানি লাভ (১৭৬৫ খ্রি.) করার পর বাংলার গভর্নর লর্ড ক্লাইভ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটান। এতে নবাবের হাতে থাকা নিজামত, অর্থাৎ আইন শৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্ব আর কোম্পানির হাতে থাকে দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব।
কোম্পানির সৃষ্ট ব্যবস্থা
রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলার রেজা খাঁ ও বিহারের সীতাব রায়কে। রাজস্ব আদায় ছাড়াও শুল্ক আদায় এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমার ভারও তাদের ওপর ন্যস্ত হয়।
মুখোশের আড়ালে শাসন
এই শাসনব্যবস্থায় কোম্পানির হাতে সমস্ত ক্ষমতা থাকলেও রাজশাসনের কোনো দায়িত্ব কোম্পানি নেয়নি। অন্যদিকে নবাব রাজ্য শাসনের পূর্ণ দায়িত্ব পান। কিন্তু তাঁর হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না।
অর্থাৎ কোম্পানির পায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পান ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। নবাব ছিলেন নামমাত্র শাসক, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতেই। তাই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থাকে মুখোশের আড়ালে শাসন (Masked system) বলা হয় ।
ব্যর্থতা
ইতিহাসবিদ রামসে মুর বলেন যে, প্রথম থেকেই দ্বৈতশাসনের ব্যর্থতা ছিল সুনিশ্চিত। কারণ এসময়—
[1] কোম্পানির কর্মচারীদের অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্য ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।
[2] রাজস্বের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি করা হতে থাকে এবং যত বেশি সম্ভব ‘রাজস্ব’ আদায়ের জন্য ‘আমিনদার’ নামক কর্মচারীদের নিয়োগ করা হয়। এরা বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য মানুষের কাঝে জোরজুলুম করতে থাকে।
[3] শাসনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
[4] ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমি তৈরি হয়।
প্রশ্ন ৪. *মনে করো তুমি সিরাজ উদদৌলার শাসনকালে বাংলার একজন বাসিন্দা। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ে তোমার মনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত ডায়ারিতে লিখে রাখো।
উওর:-
৩ জুলাই, ১৭৫৭ খ্রি., ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ এখন আর শুধুমাত্র বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা বাংলার রাজনীতির ওপরেও হস্তক্ষেপে উদ্যত। আলিবর্দি খানের পর সিরাজ-উদদৌলা বাংলার নবাব হয়েছেন। সিরাজের নবাব হওয়ার বিরুদ্ধে রাজপরিবারের সদস্যরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল।
কোম্পানির প্রধান কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, মিরজাফর, মিরান প্রমুখ সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। শুনছি সিরাজকে সরিয়ে নাকি মিরজাফরকে বাংলার নবাব পদে বসানো হবে। সিরাজের কানে বোধ হয় ষড়যন্ত্রের এই সংবাদ পৌঁছেছিল। কিন্তু তিনি কেন কঠোর হাতে এই ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করেননি, তা বোঝা যাচ্ছে না।
সিরাজের এই অবহেলাই বোধ হয় তাঁর কাল হল। অচিরেই এই ষড়যন্ত্রের পরিণতি হিসেবে শুরু হল পলাশির যুদ্ধ। পলাশির আমবাগানে মাত্র তিন হাজার ইংরেজ সেনার সঙ্গে নবাবের সত্তর হাজার সেনার যুদ্ধ বাঁধল। কিন্তু অবাক কাণ্ড মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ারলতিফ প্রমুখ নবাবের সেনাপতিরা যুদ্ধক্ষেত্রে পুতুলের মতো দাড়িয়ে থাকলেন।
তাঁরা নবাবের সেনাদের যুদ্ধের জন্য কোনোরকম নির্দেশ পর্যন্ত দিলেন না। কেবল সেনাপতি মিরমদন ও মোহনলাল বীরের মতো যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলেন।(মিরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল।
পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয় ঘটল। বাংলায় সূচনা ঘটল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ। শুনলাম মিরজাফরের ছেলে মিরন নাকি সিরাজকে হত্যা করেছেন। মিরজাফরের নবাব পদের প্রতি এই লালসা বাংলার স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটাল। আমার মনে হয়, আগামী দিনে আর ইংরেজ শক্তির অগ্রগতিকে আটকানো সম্ভব হবে না ।
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান: বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি
marks 3
প্রশ্ন 1. অষ্টাদশ শতকে ভারতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের পিছনে মুঘল সম্রাটের ব্যক্তিগত অযোগ্যতাই কেবল দায়ী ছিল বলে মনে কর ?
উওর:-
অনেকক্ষেত্রেই মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতিকে বিভিন্ন মুঘল সম্রাটের ব্যক্তিগত দক্ষতা-ব্যর্থতা দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। যদিও একটি সাম্রাজ্য তথা শাসনব্যবস্থা শুধুমাত্র ব্যক্তি-সম্রাটের দক্ষতা-যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির জন্য আরও ‘বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা যায়।
এই কারণগুলির মধ্যে অন্যতম কয়েকটি ছিল জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থার সংকট, সাম্রাজ্যের আয়-ব্যয়ের গরমিল, কৃষকবিদ্রোহ, আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রভৃতি। তাই সব মিলিয়ে বলা যায়, ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল থেকে মুঘল সম্রাটের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার পাশাপাশি এইসমস্ত কারণগুলিও মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
প্রশ্ন 2 মুরশিদকুলি খানের নেতৃত্বে কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান ঘটে? অথবা, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান কীভাবে ঘটে?
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের প্রশাসনিক প্রতিনিধি হিসেবে মুরশিদকুলি খান বাংলায় আসেন।
বাংলার দেওয়ান: সম্রাট ফারুকশিয়র দেওয়ান পদে মুরশিদকুলির নিয়োগকে স্থায়ী করেন।
বাংলার নাজিম: মুরশিদকুলি খানকে পরবর্তী সময়ে (১৭১৭ খ্রি.) বাংলার নাজিম পদ দেওয়া হয়।
বাংলার উত্থান: দেওয়ান ও নাজিম যৌথ দায়িত্ব পাওয়ার জন্য সুবা বাংলায় মুরশিদকুলির ক্ষমতা চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। ফলে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলার উত্থান ঘটে।
প্রশ্ন 3 টীকা লেখো: জগৎ শেঠ।
মুরশিদাবাদে বণিক রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগৎ শেঠ।
উপাধি: মানিকচাঁদের ভাগ্নে ফতেহচাঁদ মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ‘জগতের শেঠ’ বা জগৎ শেঠ উপাধি পান। এই উপাধি বাংশানুক্রমিকভাবে চলতে থাকে। অর্থাৎ জগৎ শেঠ কোনো একজনের নাম নয়, নির্দিষ্ট একটি বণিক পরিবারের উপাধি ।
আর্থিক ক্ষমতা; নিজেদের মুদ্রা তৈরির ব্যাবসা, মহাজনি ব্যাবসা প্রভৃতির ফলে জগৎ শেঠদের বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল। তাদের হাত ধরে বাংলায় একধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
সিরাজের বিরোধিতা: সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার পাশাপাশি জগৎ শেঠদের সম্মতিতেই কোম্পানি মিরজাফরকে নবাব নির্বাচিত করে।
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান:
প্রশ্ন 4 আলিবর্দি খান কীভাবে মারাঠা বর্গিহানা আটকানোর চেষ্টা করেন ?
অঞ্চলে বর্গিরা ব্যাপক লুঠতরাজ চালায়। আলিবর্দি এই হানা আটকানোর চেষ্টা করেন। তিনি মারাঠা হানাদারদের প্রতিরোধের জন্য দ্রুতগতির সেনাবাহিনী নিয়ে নিজে সম্মুখসমরে উপস্থিত হন। তাঁর প্রতিরোধে মারাঠা হানাদাররা পিছু হঠে।
প্রশ্ন 5. কে, কবে, কীভাবে হায়দরাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন?
মুঘল আমলের শেষের দিকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে হায়দরাবাদের উত্থান ঘটে।
প্রতিষ্ঠা: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রি.) পর মুঘলদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মির কামার উদ্দিন সিদ্দিকি (যিনি চিন কুলিচ খান নামে পরিচিত) ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন হায়দরাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
পদ্ধতি: কামারউদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল কর্তৃত্বকে স্বীকার করে চলতেন। তিনি প্রশাসনেও মুঘল কাঠামো বজায় রেখেছিলেন। তবে প্রশাসনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি স্বাধীনভাবে করতেন। ফলে হায়দরাবাদে স্বাধীন আঞ্চলিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন 6 হয় ? স্বশাসিত আঞ্চলিক শক্তিরূপে অযোধ্যার উত্থান কীভাবে হয় ?
আঠারো শতকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে অযোধ্যার উত্থান ঘটে।
সাদাত খানের নেতৃত্ব: মুঘল প্রশাসকরূপে সাদাত খান অযোধ্যার স্থানীয় রাজা ও গোষ্ঠীর নেতাদের বিদ্রোহ মোকাবিলা করেন। পাশাপাশি তিনি অযোধ্যার দেওয়ানের দপ্তরকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেন। সাদাত খান জায়গিরদারি ব্যবস্থার সংস্কার এবং নিজের সমর্থক এক শাসকগোষ্ঠী তৈরি করে অযোধ্যার উত্থানের পথ তৈরি করেন।
সুজা-উদদৌলা: সফদর জং মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে সুজা-উদ্ দৌলা অযোধ্যার শাসক হন। এই সময় থেকে বক্সারের যুদ্ধের আগে পর্যন্ত অযোধ্যায় সুজার কর্তৃত্ব ছিল চূড়ান্ত।
প্রশ্ন 7 স্বশাসিত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে অযোধ্যা রাজ্যটির বিবরণ দাও?
সাদাত খানের নেতৃত্বে অযোধ্যা এবং স্বশাসিত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
প্রথম পর্যায়: মুঘল প্রশাসক হিসেবে সাদাত খান—
[1] অযোধ্যার স্থানীয় রাজা ও গোষ্ঠীর নেতাদের বিদ্রোহ মোকাবিলা করেন।
[2] তিনি নিজের জামাই সফদর জং-কে অযোধ্যার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
[3] অযোধ্যার দেওয়ানের দপ্তরকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করেন।
[4] মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি তার এই সমস্ত কাজের মধ্যে দিয়ে অযোধ্যাকে প্রায় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন ।
পরবর্তী পর্যায়: সাদাত খানের মৃত্যুর পর প্রথমে তাঁর জামাই সফদর জং এবং পরে সফদর জং-এর ছেলে সুজা-উদ্ দৌলা অযোধ্যার শাসক হন। বক্সারের যুদ্ধের আগে প্রায় ১০ বছর অযোধ্যা রাজ্যটি সুজা-উদদৌলার কর্তৃত্বে ছিল।
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান অনুশীলনী :
প্রশ্ন 8. টীকা লেখো: ফারুকশিয়রের ফরমান।
O ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়র এক ফরমান বা আদেশ জারি করেন।
ফরমানের বিভিন্ন দিক : ফারুকশিয়রের ফরমান অনুযায়ী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় কিছু বিশেষ বাণিজ্যিক অধিকার দেওয়া হয়। ফরমানে বলা হয়—
[1] ব্রিটিশ কোম্পানি বছরে মাত্র ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বাণিজ্য করতে পারবে। কিন্তু এই বাণিজ্যের জন্য কোম্পানিকে কোনো শুল্ক দিতে হবে না;
[2] বাংলার নবাবের মুরশিদাবাদ টাকশাল প্রয়োজনে কোম্পানি ব্যবহারের অধিকার পায়;
[3] কোম্পানির জাহাজের সঙ্গে অনুমতিপত্র থাকলে সেই জাহাজ অবাধে বাণিজ্য করতে পারবে;
[4] কোম্পানির পণ্য কেউ চুরি করলে বাংলার নবাব তাকে শাস্তি দেবেন এবং কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণও দেবেন।
প্রশ্ন 9. *ফারুকশিয়রের ফরমানের গুরুত্ব কী ছিল ?
আলিবর্দি খানের সঙ্গে সম্পর্ক : আলিবর্দি খান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে প্রায়ই অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতেন। তিনি কখনোই বাংলার রাজনীতিতে ইংরেজদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেননি।
> বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়রের ফরমানের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ফারুকশিয়র প্রদত্ত ফরমানের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দস্তকলাভ বাংলার বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে, যেমন—
ইংরেজ ও নবাব সম্পর্কের অবনতি: (ফারুকশিয়রের ফরমানকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তক প্রথার অপব্যবহার শুরু করে। ফলে নবাব মুরশিদকুলি খান ও তাঁর পরবর্তী বাংলার নবাবদের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
বাণিজ্যিক অধিকারে আইনগত স্বীকৃতি:-ফারুকশিয়রের ফরমান লাভের |
পরে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে।
কোম্পানির সুবিধা লাভ: দস্তকের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় অন্যান্য ইউরোপীয় ও ভারতীয় বর্ণিক কোম্পানিগুলির তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা পায় এবং ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করে। তাই ড. সুকুমার ভট্টাচার্য ফারুকশিয়রের ফরমানকে বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের ‘মহাসনদ’ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রশ্ন 10 বাংলার প্রথম তিন নবাবদের সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক কেমন ছিল তা লেখো।
বাংলার প্রথম তিন নবাব মুরশিদকুলি খান, সুজাউদ্দিন ও আলিবর্দি খান—এদের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না।
মুরশিদকুলি খানের সঙ্গে সম্পর্ক : মুরশিদকুলি খান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার (দস্তক) নিষিদ্ধ করেন এবং ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের মতো তাদেরও সমান হারে শুল্ক দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন।
সুজাউদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্ক: সুজাউদ্দিন কঠোর হাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দত্তকের অপব্যবহার বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন। এ ছাড়াও তিনি কোম্পানির বাণিজ্যিক পণ্যরে লবণ আটক করে প্রয়োজনীয় শুল্ক আদায় করেন।
প্রশ্ন 11 *ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাতের জন্য সিরাজ-উদদৌলা কতখানি দায়ী ছিলেন?
বেশ কিছু ঐতিহাসিক তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাতের জন্য সিরাজ-উদদৌলাও অনেকাংশে দায়ী ছিলেন।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা : সিরাজ ছিলেন অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি আলিবর্দির আমলের অভিজাতদের ক্ষমতা ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার দরুন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়, যার চরম পরিণতি ছিল নবাবইংরেজ সংঘাত।
বলপূর্বক অর্থ আদায়: তিনি ইংরেজসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির থেকে বলপূর্বক অর্থ আদায় করতেন। ইংরেজদের কাছ থেকে তিনি সর্বোচ্চ অর্থ দাবি করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ইংরেজদের বাণিজ্যিক অধিকার ধ্বংসেও উদ্যোগী হন। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন 12 অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থের ‘কলিকাতা অবরোধ’ অংশ থেকে সিরাজের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের কারণ খোঁজো।
সিরাজ-উদদৌলা আর্মেনীয় বণিক খোজা ওয়াজিদকে (১৭৫৬ খ্রি., ১ জুন) লেখা এক চিঠিতে ব্রিটিশদের সম্পর্কে নিজের মনোভাব জানান। চিঠিটিতে তিনি ইংরেজদের তাড়াবার ৩টি যুক্তি দেখান, যথা—
[1] ইংরেজরা দুর্গ তৈরি ও সুবিশাল পরিখা খনন করছে যা বাদশাহি সাম্রাজ্যের আইন বিরোধী,
[2] কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার জন্য দস্তকের অপব্যবহার করছে ও বাংলার রাজকোশের ক্ষতিসাধন করছে,
[3] বাদশাহের ক্ষতিকারী কর্মচারীদের আশ্রয় দিয়ে ন্যায়বিচারে বাধা দিচ্ছে। এই চিঠিতে সিরাজ আরও লেখেন, যদি ইংরেজরা এই সকল অন্যায় আচরণ না করে এবং নিয়ম মেনে বাণিজ্য করে তাহলে তাদের ক্ষমা করা হবে, না হলে তাড়ানো হবে।
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান: প্রশ্ন 13. টীকা লেখো: নবাব মিরজাফর।
পলাশির যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভ মিরজাফরকে বাংলার নবাব পদে বসান। নবাব পদ দেওয়ার বিনিময়ে মিরজাফরের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানি কিছু চুক্তি করে।
মিরজাফরের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তি: চুক্তি অনুযায়ী—
[1] ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলায় অবাধ বাণিজ্য চালু করে,
[2] কোম্পানি টাকা তৈরির অধিকার লাভ করে,
[3] ২৪ পরগনা জেলার জমিদারি ও সেখান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দিয়ে সামরিক খরচ মেটানোর অধিকার পায় কোম্পানি,
[4] মুরশিদাবাদে নবাবের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়,
[5] কলকাতার ওপর নবাবের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়াও নবাব মিরজাফরের আমলে বাংলার রাজকোশ থেকে কোম্পানি প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে।