গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ Teacj Sanjib
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ Teacj Sanjib
প্রশ্ন ৷ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি নির্দেশ কর।
অথবা,
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি কি কি ছিল ?
অথবা,
অন্যান্য সীমা অক্ষুণ্ণ ; পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণ
গুপ্তরাজদের পতনের কাহিনী বিবৃত কর ?
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ: উত্তর । পরবর্তী গুপ্তরাজগণ—কুমারগুপ্ত-মহেন্দ্রাদিত্য : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর বেশ কিছুকাল গুপ্তসাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ও প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। তাহার পর প্রথম কুমারগুপ্ত-মহেন্দ্রাদিত্য সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি ৪১৫-৪৫৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং পিতার রাজ্যসীমাও অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন।
অবশ্য তাঁহার রাজত্বকালের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না; তবে নর্মদা উপত্যকার পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণে সাম্রাজ্যের প্রাধান্য এই সময়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল ।
স্কন্দগুপ্ত : কুমারগুপ্তের পুত্র স্কন্দগুপ্ত পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনিই ছিলেন গুপ্তবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা। সম্ভবত ৪৫৫-৪৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করিয়াছিলেন । তাঁহার সর্বপ্রধান উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল পুষ্যমিত্র জাতির আক্রমণকে প্রতিরোধ করিয়া সাম্রাজ্যের প্রাধান্য পুনরুদ্ধার করা ।
হূন আক্রমণের আঘাত হইতে তিনি সাম্রাজ্য রক্ষা করিয়াছিলেন । এই সমস্ত সামরিক স্থূন-আক্রমণ প্রতিরোধ সাফল্যের ফলে তাঁহার শেষ জীবন পর্যন্ত গুপ্তসাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ থাকিতে পারিয়াছিল ।
স্কন্দগুপ্তের সময় গুপ্ত শাসনব্যবস্থার দক্ষতা ততটা হ্রাস পায় নাই। তিনি পর্ণদত্ত প্রমুখ সুদক্ষ শাসকের সাহায্যে দেশ শাসন করিতেন । তাঁহারই আমলে পর্ণদত্তের পুত্র চক্রপালিত সুদর্শন হ্রদের পার্শ্ববর্তী বাঁধ পুনঃ নির্মাণ করাইয়াছিলেন । তিনি ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী এবং তাঁহার পূর্বপুরুষদিগের মত পরধর্মসহিষ্ণু ।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ কে. পি. জয়সোয়ালের মতে স্কন্দগুপ্ত ছিলেন “শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও ধর্মপরায়ণ” রাজা। এশিয়া ও ইওরোপের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র সাফল্যের সহিত বর্বর হূন জাতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর হইতেই গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন অপ্রতিরোধ্য হইয়া উঠে।
পরবর্তী রাজগণ :
স্কন্দগুপ্তের পরে পুরুগুপ্ত, নরসিংহগুপ্ত, বালাদিত্য, দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত প্রভৃতি রাজগণ রাজত্ব করিয়াছিলেন। ইহাদের রাজত্বকালে ক্রমে গুপ্তসাম্রাজ্য একটি ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হইয়া যায়।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সমূহ :
সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সামরিক নৈপুণ্য ও সুদক্ষ নেতৃত্বের ফলে যে বিশাল গুপ্তসাম্রাজ্য গড়িয়া উঠিয়াছিল, খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ হইতে তাহার পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্তসাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় ।
প্রসঙ্গত বলা যায়, পৃথিবীর সকলযুগে সকল দেশের ইতিহাসে কোন রাজ্য বা সাম্রাজ্য পতন হইতে অব্যাহতি পায় নাই । আরব ঐতিহাসিক ইবন ঘালদুনের মতে প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে উত্থানের ন্যায় পতনও অনিবার্য। জৈবিক কারণ ভিন্ন অন্যান্য কয়েকটি বিশেষ কারণের ফলে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগ হইতে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্রমশ হীনবল হইয়া পড়িতে লাগিল ।
পৃথিবীর সমস্ত সাম্রাজ্যগুলির পতনের মত গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের মূলেও কোন একটি মাত্র বিশেষ কারণ ছিল না, বহুবিধ কারণের সমন্বয়ের ফলেই পতনের পথ প্রশস্ত হয়। গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের মূলে নিম্নলিখিত কারণগুলি উল্লেখ করা যায়—
(১) পুষ্যমিত্র জাতি :
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্য ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়িতেছিল । পুষ্যমিত্র জাতির বিদ্রোহ এই বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুমারগুপ্তের রাজত্বকালেই তাহারা বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছিলেন।
স্কন্দগুপ্ত তাহাদিগকে সাময়িকভাবে দমন করিলেও তাহাদের শক্তি খর্ব হয় নাই ; আঘাতের পর আঘাত হানিয়া তাহারা গুপ্তসাম্রাজ্যকে দুর্বল করিয়া তুলেন । বাকাটকদের আক্রমণ তাহাতে আরও সাহায্য করিয়াছিল ।
(২) বৈদেশিক আক্রমণ, হূনজাতি :
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্য যখন ক্ষতবিক্ষত, তখন আসিল বহির্দেশ হইতে হূনজাতির আক্রমণ । মালব ও পাঞ্জাব সাম্রাজ্যচ্যুত হইয়া গেল । স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী দুর্বল সম্রাটগণ আর হূন-আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে পারিল না, তাহারা মধ্য-ভারতের এরাণ জেলা পর্যন্ত বিনা বাধায় অগ্রসর হইল ।
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হূণজাতির আক্রমণ ছিল গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের প্রধানতম বা মূল কারণ, কিন্তু ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার হূন আক্রমণকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ বলিয়া মনে করেন না । তাঁহার মতে গুপ্তরাজারা হূন-আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
কিন্তু হূন-আক্রমণ গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ বলিয়া স্বীকৃত না হইলেও বৈদেশিক আক্রমণের ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের সংহতি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল । মালব ও পাঞ্জাব দমন মধ্য-ভারত পর্যন্ত অগ্রসর
(৩) প্রাদেশিক শাসক ও বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতা :
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখে গুপ্তসম্রাটগণের অকর্মণ্যতা যখন সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল তখন সুযোগ বুঝিয়া সামরিক ও বে-সামরিক কর্মচারীগণ এবং প্রাদেশিক শাসকগণ নিজ স্বার্থ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হইয়া উঠিল । সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের অনেক শাসক স্বাধীন হইয়া পড়িল ।
সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্বভাবতঃই দুর্বল হইয়া গেল । বলভী রাজ্য ও মৈত্রকজাতি স্বাধীন হইল ; মধ্য-ভারতের মৌখরীগণ গুপ্তসাম্রাজ্যের আনুগত্য অস্বীকার করিল। বুধগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্তসাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে যশোধর্মণ নামে এক ব্যক্তি মালবে একটি শক্তিশালী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ।
হূনরাজ মিহিরকুলকে পরাজিত করিয়া তিনি নিজস্ব সামরিক শক্তির পরিচয় দেন । এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়িয়া তাঁহার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে পরাক্রমশালী রাজাদের উত্থানে গুপ্তসাম্রাজ্য যেন ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইতে লাগিল।
(৪) গুপ্তরাজগণের মধ্যে স্বার্থপরতা ও দ্বন্দ্ব :
গুপ্ত যুবরাজগণের পারস্পরিক ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যের পতন আরও সুনিশ্চিত করিয়া তোলে। তাঁহারা পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যের এক-একটি অংশ আত্মসাৎ করিবার জন্য নানারূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা গুপ্তরাজগণের অন্তর্দ্বন্দ প্রাদেশিক শাসকদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ করিতে লাগিলেন।
ইহাতে সাম্রাজ্যের শক্তিই শুধুমাত্র খর্ব হইল না, তাহার মর্যাদারও যথেষ্ট হানি হইল । স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজগণ ছিলেন প্রায় সকলেই অযোগ্য ও তাঁহারা পারস্পরিক কলহে লিপ্ত ছিলেন। নেতৃত্বের দুর্বলতা যে কোন স্বৈরাচারী শাসনের স্থায়িত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কারণ, স্বৈরতন্ত্র মূলত নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল ।
(৫) অর্থনৈতিক দুর্বলতা :
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের মূলে অর্থনৈতিক কারণ পরিলক্ষিত হয় । বিভিন্ন জাতির বিরুদ্ধে আক্রমণের চাপে সাম্রাজ্যের আর্থিক সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হয় । গুপ্তযুগের শেষ দিকে মুদ্রার অপ্রাচুর্য হইতে প্রমাণিত হয় যে, গুপ্তসাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হইয়া পড়িতেছিল ।
(৬) বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সম্রাটগণের নামরিক অকর্মণ্যতা :
পরবর্তী গুপ্তসম্রাটগণের মধ্যে বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত প্রমুখ কয়েকজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হইয়া পড়িয়াছিলেন ; তাঁহাদের সামরিক দক্ষতা বজায় রাখিবার না ছিল ক্ষমতা, না ছিল ইচ্ছা । গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের জন্য অনেকে ইহাও একটি কারণ বলিয়া মনে করেন।
উপরি-উক্ত কারণগুলির ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিল । ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্ত সাম্রাজ্য একটি ক্ষুদ্র স্থানীয় রাজ্যে পরিণত হইল ; অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাহাও নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় ।
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ আলোচনা করিয়া দেখা যায় যে, ভারতের ইতিহাসে মৌর্যসাম্রাজ্য হইতে মুঘল সাম্রাজ্য পর্যন্ত দীর্ঘসময়ে সবকটি সাম্রাজ্যের পতনের মূলে কারণগুলি ছিল একই ধরনের, – নেতৃত্বের দুর্বলতা, বৈদেশিক আক্রমণ, প্রাদেশিক রাজ্যগুলির বিদ্রোহ, অভিজাতশ্রেণীর ক্ষমতা লিপ্সা ইত্যাদি ।