নকসী কাঁথার মাঠ প্রশ্ন উত্তর Teacj Sanjib

নকসী কাঁথার মাঠ প্রশ্ন উত্তর Teacj Sanjib

নকসী কাঁথার মাঠ
জসীমউদ্দীন

নকসী-কাঁথার-মাঠ-প্রশ্ন-উত্তর-Teacj-Sanjib

নকসী কাঁথার মাঠ রচনার উৎস –

→ আমাদের পাঠ্য ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতাটি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। কবির এই কাব্যগ্রন্থটি বহু সম্মানিত এবং পুরস্কৃত; ইংরাজিতে অনূদিত হয়ে কাব্যটি বিদেশি কাব্যরসিকজনেরও সানন্দ ভালোবাসা লাভ করেছিল। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ একটি প্রেমমূলক কাহিনি কাব্য। রূপাই ও সাজুর বিরহ-মিলনের কাহিনি এই কাব্যের মুখ্য কথাবস্তু । কাব্যের নামেই তাই এই পাঠ্য কবিতাটির নাম। এ-কাব্যের কাহিনির একটি অংশকে পাঠ্যাংশ প্রকাশ করেছে, সম্পূর্ণ কাহিনি এতে নেই। এই কবিতাটিকে বোঝার জন্য পূর্ববর্তী কাহিনি একটু জানার প্রয়োজন ছিল। তাই বন্ধনীর মধ্যে সেই সংকেতসূত্র ধরিয়ে দেওয়া হল।

→ [সাজুর স্বামী রূপাই একদিন ফেরার হল। সাজু স্বামীর প্রত্যাবর্তনের আশায় দিন গণনা করে চলে আর একটি নক্সী কাঁথা সেলাই করে, কিন্তু স্বামী ফেরে না। সাজুর মৃত্যু হল; মৃত্যুর পূর্বে সে বলে গেল, নক্সী কাঁথাখানি যেন তার কবরের ওপরে বিছিয়ে দেওয়া হয়। বহুদিন পরে গ্রামের লোক একদিন অবাক হয়ে দেখে, সাজুর কবরের পাশে সেই নক্সী কাঁথাখানি গায়ে জড়িয়ে একটি লোক মরে পড়ে আছে। সেই থেকে ওই কাঁথার নামে সামনের মাঠটির নাম হল ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। আলোচ্য কাব্যটি ওই মাঠ এবং মাঠের মানুষের কাব্য।]

নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের বিষয়বস্তু

• কবিতার সংক্ষিপ্তসার

→ মুখোমুখি দুটি গ্রাম যেন পরস্পরের কানে কানে কী যেন এক গভীর বেদনার কথা বলতে চায়, এবং তাদের কথা যেন আর শেষ হয় না। মাঝখানে দিগন্তবিস্তৃত একটি শূন্য মাঠ রৌদ্রদগ্ধ, ফুটি-ফাটা হয়ে পড়ে আছে; তারও বুকে যেন এক অব্যক্ত বেদনা! নিষ্ঠুর চাষি তার বুক থেকে ধান্যরূপ বসনখানি অপহরণ করেছে; বাতাসের পায়ে আগে যে ঝঝম্ করে মল বাজতো, অর্থাৎ পাকা ধানের মঞ্জরীগুলি বাতাসের দোলায় মলের মত যে বেজে উঠতো, তাদের সমস্ত মানঅভিমান আজ যেন মাঠের ধূলোয় লীন হয়ে গেছে।
রাবণের সীতাহরণের মত চাষি কেটে নিয়ে গেছে সোনার ফসল, পথের ধূলোয় মুঠো মুঠো ধান যেন সীতার নিক্ষিপ্ত গহনার মত তাঁর স্মরণচিহ্ন হয়ে পড়ে আছে। মাঠের কলমিলতা এবং মটরফুলও উদ্বেগে অধীর,—জাতি গৌরব এবং কুলমর্যাদা রক্ষা করা কী তাদের পক্ষে সম্ভব হবে? লাঙ্গলও আজ পাগল হয়ে গেছে, মাটির বুক চিরে শক্ত ঢেলার মাথা ভাঙা ছাড়া তার আর যেন কোনো গত্যন্তর নেই।

→ তবু একটি গ্রাম অন্য গ্রামটির পানে চেয়ে আছে, হয়তো থাকবে অনন্তকাল ধরে। মধ্যে বিস্তৃত দিগন্তজোড়া নক্সী কাঁথার মাঠ, তার বুকের মুদ্রিত বেদনার বিরহ লিপি নীরবে পাঠ করে চলেছে। · নামকরণের তাৎপর্য

→ জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের নামের পশ্চাৎভূমিতে রয়েছে এক কিংবদন্তীমূলক করুণ কাহিনি। গ্রামের মেয়ে ‘সাজু’ আর গ্রামের ছেলে ‘রূপা’ই ভালোবেসেছিল দু’জনা দু’জনকে। বিবাহের পর একদিন রূপাই হল ফেরার; পলাতক স্বামীর বিরহে সাজুর দিন কাটে, আর সে একটি কাঁথার বুকে সূচীমুখে নকসা ফুটিয়ে তুলতে থাকে তাদের ভালোবাসার স্মৃতিচিত্র হিসাবে।
এমনি করে সাজু একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে; মৃত্যুর পর তার ইচ্ছা অনুসারে নক্সী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয় তার কবরের ওপর। অবশেষে বহুদিন পরে, একদিন গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখে, একটি লোক সেই কবরের পাশে এসে মরে পড়ে আছে, আর সেই নক্সী কাঁথাখানা জড়ানো আছে তার গায়ে। সেই মৃত লোকটিই হল সাজুর স্বামী, রূপাই। সেই থেকে গ্রামের মানুষ সামনের মাঠখানির নাম দিয়েছে নক্সী কাঁথার মাঠ।

→ রূপাই-সাজুর প্রথম দেখা, তাদের বিবাহ, মিলন, বিরহ, মৃত্যু এবং মৃত্যুর মাঝে পুনর্মিলন সবই মূলকাব্যে বর্ণিত রয়েছে। নক্সী কাঁথার মাঠের পটভূমিতে যে গ্রামজীবন, সেই গ্রামের দুটি ছেলেমেয়ের করুণ-মধুর প্রেম,—এই সবকিছুরই স্মারক হয়ে আছে এই মাঠ। তাই মাঠের নামে কাব্যের নামকরণটি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে।

→ আমাদের পাঠ্য কবিতাংশটিতেও মাঠই প্রাধান্য পেয়েছে; রূপাই যেমন সাজুর ভালোবাসার কাঁথাখানি গায়ে জড়িয়ে মৃত্যুর মাঝেও মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেমের জয়গান গেয়ে গেছে, তেমনি সমস্ত প্রান্তর-প্রকৃতিও যেন অনন্তকাল ধরে রূপাই-সাজুর প্রেমের স্মৃতিবাহী হয়ে একটি করুণ চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে। তার হৃদয়েও লেগে রয়েছে বেদনার করুণ লিপি।
যুগান্তরের পালাবদলে মানুষ হয়তো মানুষের কথা ভুলে যায়, কিন্তু প্রকৃতি ঋতুতে ঋতুতে সেই গ্রামীন প্রেমকাহিনিকে নবীন করে তোলে গ্রামের মানুষের কাছে; হৃত শস্যপ্রান্তরের রিক্ততায়, কলমি ও মটরফুলের গভীর উৎকণ্ঠায় এবং লাঙলের মুখে কঠিন মাটির বক্ষবিদারণে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এক চিরন্তন বিরহ গাথা।
এখানে প্রেমিক নেই, প্রেমিকা নেই, আছে তাদের প্রেমের স্মৃতি; সেই স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে মাঠ যেন নিজেই এক বিরহী। এই কবিতাংশটিতে আদ্যন্ত ভরে রয়েছে ওই স্মৃতিবাহী মাঠের কথা। তাই ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’—এই অভিধাটি কবিতার পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত ও সার্থক হয়েছে বলেই মনে করা যায়।

রচনাধর্মী, আলোচনামূলক, ব্যাখ্যামূলক ও সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন : ১। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নামটি কিভাবে প্রচলিত হল? অথবা, ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নামটির পটভূমিটি ব্যক্ত করো। জসীমউদ্দীনের কবিতায় এই মাঠের যে রূপটি ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় বর্ণনা কর। ‘সারা বুক ভরি কি ব্যথা সে লিখি নীরবে করিছে পাঠ!’—কবি একথা কেন বলেছেন বুঝিয়ে দাও।

অথবা, ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ নামকরণের কারণ কি? কবি মাঠের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো।

উত্তর : জসীমউদ্দীনের ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ কবিতাটির নামকরণের নেপথ্যে আছে এক কিংবদন্তীমূলক ব্যথাহত প্রেমের করুণ কাহিনি। মাঠের দুধারে মুখোমুখি দুটি গ্রামের একটির ছেলে ‘রূপা’ই আর অন্যটির যুবতী মেয়ে ‘সাজু’ ভালোবেসেছিল পরস্পরকে। তাদের সেই ভালোবাসা একদিন মধুর বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়েছিল। কিন্তু তাদের দাম্পত্যজীবনের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হ’ল না। একদিন রূপাই ফেরার হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। ফেরারি স্বামীর প্রতীক্ষায় সাজুর দিন কাটে, কিন্তু রূপাই আর ফেরে না।
সাজু তার বিরহের করুণ কাহিনি বুনে তোলে একটি নক্সী কাঁথার বুকে। তারপর একদিন স্বামী-বিরহ-কাতরা সাজু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার শেষ ইচ্ছানুসারে তার নক্সী কাঁথাখানি বিছিয়ে দেওয়া হয় তার কবরের ওপরে। বহুদিন পরে হঠাৎ একদিন গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখে সাজুর কবরের পাশে পড়ে আছে একটি বিদেশি লোকের মৃতদেহ; তার গায়ে জড়ানো রয়েছে সাজুর সেই সেলাই করা কাঁথাখানা।
বলা বাহুল্য, এ লোকটি সাজুর ফেরারি স্বামী রূপাই। সাজু-রূপাইয়ের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম এবং একই সঙ্গে বেদনাদায়ক। গ্রামের মরমী মানুষ তা উপলব্ধি করেছিল বলেই তাদের গ্রামের ওই দুটি প্রিয় ছেলেমেয়ের প্রেমের স্মারক ওই কাঁথাখানির নামে সামনের মাঠখানির নাম রাখল, ‘নকসী কাঁথার মাঠ’।

→ গ্রামের মেয়ে সাজু আর গ্রামের ছেলে রূপাইয়ের ব্যথাদীর্ণ প্রেমের স্মৃতি বুকে নিয়ে নক্সী কাঁথার মাঠ নিজেও হয়ে উঠেছে বেদনাবিধুর। সাজু-রূপাইয়ের স্মৃতি পাশাপাশি দু’টি গ্রামকেও করেছে ভারাক্রান্ত। সেই মুখোমুখি গ্রাম দু’টির মাঝে দিগন্তজোড়া নক্সী কাঁথার মাঠ আজো বিস্তৃত। সে আজ শুধু স্মৃতিভারে পীড়িতই নয়, সে রিক্ত, তার তাপদগ্ধ বুক শত ফাটলে বিদীর্ণ। তারও বুকে জমে উঠেছে অব্যক্ত বেদনা। নিষ্ঠুর চাষি তার বুক থেকে ধান্যরূপ বসনখানি অপহরণ করে নিয়ে গেছে ; এ যেন নিষ্ঠুর দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।
বাতাসের তালে তালে পাকা ধানের মঞ্জরিগুলি যে পল্লীবালিকার পায়ের ছন্দে মলের মত ঝমঝম্ করে বাজত, আজ তার সমস্ত নৃত্যগৌরব আহত হয়ে ধূলোর সঙ্গে লীন হয়ে গেছে। রাবণের সীতাহরণের মত চাষি মাঠ থেকে কেটে নিয়ে গেছে সোনার ফসল; পথের ধুলোয় মুঠো মুঠো ধান সীতার নিক্ষিপ্ত গহনার মত তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হয়ে পড়ে আছে। মাঠের কলমিলতা এবং মটরফুল উদ্বেগে আকুল,—এই নিষ্ঠুর লোভী মানুষের হাত থেকে বোধহয় তাদের কুল-মান-মর্যাদা রক্ষা পাবে না। লাঙ্গলও আজ বেদনায় অধীর হয়ে উঠেছে এবং কঠিন মাটির শক্ত ঢেলা ভেঙে চলেছে একান্ত বাধ্য হয়ে।

→ রিক্ত শূন্য নক্সী কাঁথার মাঠের নীরস বুকের নীরব বেদনার সঙ্গে রূপাই-সাজুর বিরহবেদনা মিশে একাকার। মাঠ তার বুকে কোন্ সুদূর অতীতে গ্রামের ঐ দুটি প্রিয় ছেলেমেয়ের প্রেমের

কাহিনি মুদ্রিত করে রেখেছিল, আজ সে তাই বিদীর্ণ ফাটলে ফাটলে তারই লিপি পাঠ করে চলেছে। কবি তাই বলছেন—“কি ব্যথা সে লিখি নীরবে করিছে পাঠ’। মাঠ নীরব, কারণ সে মূক; বেদনার গভীরতা এবং তীব্রতা তাকে আরো নীরব করেছে। তাছাড়া বর্তমানের নাগরিক সভ্যতার কাছে এই গ্রামীণ প্রেমকাহিনি অপাঙ্ক্তেয় বা অনভিজাত মনে হতে পারে। কবি তাই প্রকৃতির নির্জনতায় তাকে দিয়েছেন নিঃশব্দ অনুধ্যান। নীরবতার মাঝেও এই স্মৃতিবাহী প্রেম মহীয়ান হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি প্রেমকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে কবি তাকে বিশ্বজনীন বিরহ গাথায় সমৃদ্ধ করেছেন।

নকসী কাঁথার মাঠ কবিতা

প্রশ্ন :। “সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, ….. বুঝি ঝরে!”—সোনার সীতা বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? রাবণ বলা হয়েছে কাকে? ছত্রগুলির অর্থ বিশ্লেষণ কর।

● উত্তর : এখানে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর সোনালি রঙের পাকা ধানকে সোনার সীতা বলে কল্পনা করা হয়েছে।

রাবণ বলা হয়েছে মাঠের পাকা ফসলের কর্তনকারী চাষিকে।

● → লঙ্কার রাক্ষসরাজ রাবণ যখন পঞ্চবটী বন থেকে সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যান, সীতা তখন নিজের চিহ্নস্বরূপ তাঁর অঙ্গের অলংকারগুলি পথে নিক্ষেপ করতে করতে গিয়েছিলেন। এখানে চাষিও যখন পাকা ধান কেটে বোঝা বেঁধে তার গৃহে নিয়ে গেছে, তখন সারা পথের ওপর ঝরে পড়েছে মুঠো মুঠো পাকা ধান।
সীতার অভাবে রামচন্দ্রের কুটির এবং জীবন যেমন শূন্য ও রিক্ত হয়ে গিয়েছিল, মাঠও তার পাকা ফসলগুলিকে হারিয়ে হৃতসর্বস্ব এবং হতশ্রী হয়ে গেছে। সীতাহারা রামের বেদনার সঙ্গে ফসলহীন মাঠের মর্মবেদনা এখানে মিশে একাকার; আবার এরই সঙ্গে কবি একাত্ম করে দিয়েছেন সাজু-হারা রূপাইয়ের বিরহব্যাকুলতা। সব মিলিয়ে ইমেজ এবং তৎসহ উপমাটি সুন্দর।

এই উপমাটি রামায়ণের সঙ্গে আরও একটু নিগূঢ় সম্বন্ধে যুক্ত। আমরা জানি, রাজর্ষি জনকের লাঙ্গলের ফালের রেখায় সীতার জন্ম হয়েছিল। সোনার ফসলও তেমনি জন্ম নেয় চাষির হলকর্ষণে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের কথামত রামায়ণকে যদি রূপক কাব্য ধরি, তবে রাম, সীতা এবং রাবণকে যথাক্রমে কৃষিসভ্যতা এবং কৃষিসভ্যতার বহনকারী শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরতে হয়; রাবণ সীতাহরণ করেছিলেন,–এর রূপকার্থ হল রাবণ কৃষিকে বিনষ্ট করেছিলেন। এই বিচারে উপমাটি বড়োই ব্যঞ্জনামধুর।

তবে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলা যায় যে, যে-চাষি তার সম্বৎসরের জীবিকাস্বরূপ মাঠের সোনার ধানকে লক্ষ্মীরূপে গৃহে নিয়ে যায়, সে রাবণের মত নিষ্ঠুর বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। কিন্তু কবি এখানে মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় প্রকৃতির প্রাণসম্পদকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে চেয়েছেন এবং রূপাই-সাজুর বিরহবেদনাকে গভীরভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাই চাষির নিষ্ঠুরতায় শূন্য মাঠের রিক্ততার চিত্র বেশি করে মর্মস্পর্শী করে তুলেছেন।

নকসী কাঁথার মাঠ বিষয়মুখী প্রশ্নোত্তর

• সংক্ষিপ্ত

প্রশ্ন :। “আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,/নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।”—‘গাঁও’ এবং ‘অঝোরে’ কথার অর্থ লেখ। তারা কোন্ কথা কানে কানে বলেছে বলে তুমি মনে কর?

উত্তর : জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় ‘গাঁও’ বলতে ‘গ্রাম’-কে, এবং ‘অঝোরে’ শব্দের অর্থ হল সজল চোখের ‘অশ্রুবর্ষণ’।

→ দু’টি গ্রাম পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে নীরব ভাষায় যে-কথা বলাবলি করছে, তা হল বেদনাদায়ক এক করুণ কাহিনি; ‘অঝোরে চাহিয়া’ কথাটির মধ্যে সেই দুঃখের ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে। কবিতাটি পড়ে আমরা বুঝতে পারি—গ্রাম দুটির আলোচ্য বিষয় হল রূপাই ও সাজুর মিলন-বিরহের করুণ কাহিনি। এই প্রেমের করুণ গাথা শুধু মানুষকে অভিভূত করে না, প্রকৃতির কাছেও ওই স্মৃতি রীতিমত দুঃখ বিধুর।

প্রশ্ন: । “মধ্যে অথই শূনো ….. কি মূক মাটি!”—অথই’ ও ‘শূনো’ শব্দের অর্থ লেখ। উদ্ধৃতিটির ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় ‘অথই’ ও ‘শূনো’ শব্দের অর্থ হল যথাক্রমে ‘সীমাহীন ’ ও ‘ফাঁকা-রিক্ততা’।

→ চাষিরা মাঠ থেকে পাকা ফসল কেটে নিয়ে গেছে; তাই রিক্ত শূন্য দিগন্তহীন মাঠ ফাগুনের রৌদ্রে তাপদগ্ধ হয়ে শতশত ফাটলে দীৰ্ণ-বিদীর্ণ হয়ে গেছে। ভাষাহীন বোবা মাঠ যেন তার বুকে নীরবে ওই অব্যক্ত বেদনাকে বহন করে নিয়ে চলেছে। শস্যহীন শোভাহীন নক্সী কাঁথার মাঠের রিক্ততার সঙ্গে মিশে গেছে রূপাই সাজুর করুণ-মধুর প্রেমের স্মৃতি। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে মাঠও যেন এক বিরহী প্রেমিকে রূপান্তরিত। নির্জীব মাঠের বুকে সজীব প্রাণ সত্তার আরোপ করে কবি এই প্রাকৃতিক বেদনাকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন।

প্রশ্ন :। “নীরবে করিছে পাঠ”—কে পাঠ করছে? সে কী পাঠ করছেনীরবতার কারণ কি?

অথবা, এ নীরবতার কারণ কী বুঝিয়ে দাও।

• উত্তর : পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় এখানে ওই মাঠের স্মৃতিলিপি পাঠ করার কথা বলা হয়েছে।

→ গ্রামের মেয়ে সাজু এবং গ্রামের ছেলে রূপাইয়ের যে প্রেম-বিরহের করুণ কাহিনির স্মৃতি মাঠ তার নিজের বুকে ধরে রেখেছিল, সেই স্মৃতিলিপিই মাঠ নীরবে এখন পাঠ করছে।

→ নক্সী কাঁথার মাঠটি যে অচেতন এবং তার যে ধ্বনিময় ভাষা নেই, সেটাই তার নীরবতার প্রকৃত কারণ। কিন্তু কবি মাঠটির ওপর মানুষের প্রাণধর্ম আরোপ করেছেন। তাই কাব্যিক ব্যাখ্যা করে বলা যেতে পারে, রূপাই-সাজুর দুঃখে প্রান্তর তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এই প্রেমকাহিনির অনির্বচনীয় কারুণ্য, তার গভীরতা এবং ব্যাপকতা মাঠকে নীরব স্মৃতিচারণায় নিরত করেছে।
শোক লঘুভার হলে তার প্রকাশ স্বভাবত বাহ্যিক হয়, কিন্তু গভীর শোক অনেক সময় মানুষকে পাথরের মত স্তব্ধ করে দেয়। তাছাড়া সময়ের ব্যবধানেও উচ্ছ্বসিত শোক স্তব্ধ স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়। এক্ষেত্রে দুটি কারণই বিদ্যমান। এ ছাড়া আধুনিক নাগরিক সভ্যতার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ থেকে আড়াল করে নক্সী কাঁথার মাঠ যেন গ্রামীণ প্রেমের স্মৃতিকে নীরবে নিজের মধ্যে লালন করে চলেছে। —এটাও একটি বাড়তি কারণ।

প্রশ্ন । ‘সোনার সীতারে হরেছে রাবণ’–‘সোনার সীতা কে? কোন্ রাবণ তাকে করেছে? কীভাবে হরণ করেছে?

• উত্তর : জসীমউদ্দীন রচিত ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ শীর্ষক কবিতা থেকে উদ্ধৃত পংক্তিটিতে নক্সী কাঁথার মাঠের সোনালী রঙের পাকা ধানকে ‘সোনার সীতা’ বলে কল্পনা করা হয়েছে। রাবণ বলা হয়েছে সেই পাকা ফসলের কর্তনকারী চাষিকে।

লঙ্কাধিপতি, রাক্ষসরাজ রাবণ যখন পঞ্চবটী বন থেকে সীতাকে অপরহণ করে আকাশ পথে নিয়ে যান লঙ্কায়, সীতা তখন নিজের পরিচয় চিহ্ন হিসাবে তাঁর অঙ্গের অলংকারগুলিকে পথে ফেলতে ফেলতে গিয়েছিলেন। রামচন্দ্র পরবর্তীকালে ওই অলংকারগুলি দেখইে বুঝতে পেরেছিলেন ‘সোনার সীতারে হরেছে রাবণ’। অনেকটা ঠিক সেই রকমই ভাবে চাষিও যখন ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর পাকা ধান কেটে বোঝা বেঁধে তার ঘরে নিয়ে যায়, তখন সারা পথের ওপর ঝরে পড়ে মুঠো মুঠো পাকা ধান। অর্থাৎ পথের ওপর ছড়ানো-ছিটোনো সোনালী রঙের পাকা ধান দেখলেই বোঝা যায় যে, ‘সোনার সীতারে হরেছে রাবণ’।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *