ওয়াহাবী আন্দোলন এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
ওয়াহাবী আন্দোলন এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিক্রিয়া
প্রশ্ন । ওয়াহাবী আন্দোলনের অভ্যুত্থান ও প্রসারের কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা কর অথবা,
ওয়াহাবী আন্দোলনের উদ্দেশ্য, সূত্রপাত ও প্রভাব উল্লেখ কর।
ওয়াহাবী আন্দোলন:
উত্তর।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ধর্মমত-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ফলে হিন্দুদের মত মুসলমান সমাজেও ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া উঠে। ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের ফলে হিন্দুদের অপেক্ষা মুসলমানেরাই আর্থিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়া বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাহারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হইতে বিচ্যুত হইয়া হীনবল হইয়া পড়ে এবং ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার ঘটিলে তাহারা নূতন শিক্ষাপদ্ধতিকে গ্রহণ করিতে অস্বীকার করায় হিন্দুদের অপেক্ষা অনগ্রসর হইয়া পড়ে।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিবার জন্য মুসলমান সমাজ শরিয়ৎ বা ইসলামী ধর্মশাস্ত্রের দ্বারা নিজেদের পরিচালিত করিতে সচেষ্ট হয়। ইতিমধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমে ইবন আবদুল ওয়াহাবী নামক এক ধর্মপ্রাণ আরববাসী কোরান, হদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের উপর ভিত্তি করিয়া যে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রবর্তন করেন, তাহাই ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। আবদুল ওয়াহাব ঈশ্বরের একত্ববাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া ধর্মকে আচার-অনুষ্ঠান ও গোঁড়ামির হাত হইতে মুক্ত করিতে চাহিয়াছিলেন।
আন্দোলনের প্রবর্তন
ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিল্লীর বিখ্যাত মুসলমান সম্ত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁহার পুত্র আজিজ ভারতে ইসলামের শুদ্ধি-আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। শীঘ্রই এই আন্দোলন ধর্মীয় রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহের মতবাদে প্রভাবিত হইয়া উত্তরপ্রদেশের শাহ্ সৈয়দ আহম্মদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ) ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। সৈয়দ আহম্মদকেই ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
ওয়াহাবী আন্দোলন মূলত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনরূপে আরম্ভ হইলেও ইহা ক্রমশ সৈয়দ আহম্মদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ইহার উদ্দেশ্য হইল ভারতবর্ষ হইতে ইংরাজ শাসনের অবসান ঘটাইয়া ভারতকে দার-উল-ইসলাম বা ইসলামের পবিত্র রাষ্ট্রে পরিণত করা।
সৈয়দ আহম্মদের মতে ইংরাজ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতে বিধর্মী শাসনের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে এবং ইংরাজ শাসনে বিদেশী বণিকেরা ভারত সম্পদ লুঠ করিতেছে। তাই বিদেশী শাসনের অবসান না হইলে দেশবাসীর নিস্তার নাই। কেয়ামউদ্দীন আহমেদ মনে করেন প্রথমদিকে সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন রূপে শুরু হইলেও পরবর্তী কালে তাহা এক ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলনের স্তরে উন্নীত হয়।
ওয়াহাবী আন্দোলন ১৮২০ হইতে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সৈয়দ আহম্মদের দুই অনুচর বিলায়েৎ আলি ও এনায়েৎ আলি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ওয়াহাবী কেন্দ্র গঠন করেন। বাংলা, বিহার, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও মাদ্রাজের মধ্যে এই আন্দোলন বেশী প্রসার লাভ করে। ওয়াহাবী সম্প্রদায় পাঞ্জাবের শিখশক্তির সঙ্গেও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এবং এই সংঘর্ষে ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে সৈয়দ আহম্মদ নিহত হইলেন।
অতঃপর ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরাজ সৈন্যবাহিনী গারভকের নেতৃত্বে লাল্লুর যুদ্ধে ওয়াহাবী শক্তিকে পরাস্ত করেন। ইহার পর ওয়াহাবী আন্দোলন স্তিমিত হইয়া পড়ে। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহে সক্রিয় অংশ না লইলেও ওয়াহাবী সম্প্রদায় বিদ্রোহের বিরোধিতা করে নাই। যাহা হউক, ব্রিটিশ সরকারের সুপরিকল্পিত দমননীতি ও অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে আন্দোলন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হইয়া যায়।
বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলন :
ওয়াহাবী আন্দোলন বাংলাদেশেও প্রসার লাভ করে এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা, নদীয়া ও যশোহর অঞ্চলে ইহা বিশেষ শক্তিশালী হইয়া উঠে। কলিকাতার নিকটবর্তী বারাসাতে সৈয়দ আহম্মদের শিষ্য মীর নিসার আলী বা তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খ্রীঃ) ওয়াহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। স্থানীয় মুসলমান কৃষক ও তাঁতী সম্প্রদায় এই আন্দোলনের অংশ গ্রহণ করে। তিতুমীরের নেতৃত্বে সংগঠিত কৃষকগণ অত্যাচারী হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের উপর হামলা চালায় এবং নীলকরদের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করে।
জমিদারদের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করিবার পর তিতুমীর ও তাহার সমর্থকগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। তাঁহার অনুগামীগণ ঘোষণা করে যে অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজ সৈন্যবাহিনী তিতুমীরের নেতৃত্বে গঠিত আন্দোলনকে দমন করিতে সমর্থ হয় এবং সংঘর্ষে তিতুমীর নিহত হইলেন।
ওয়াহাবী আন্দোলন এর গুরুত্ব :
ওয়াহাবী আন্দোলন ব্যর্থ হইলেও ভারতে মুসলমান সমাজের নবজাগরণ ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই আন্দোলন মুসলমান সমাজে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবের সঞ্চার করিয়াছিল। ভারতের মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ও ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সামিল হইয়াছিল। যদিও ইংরাজ ঐতিহাসিক হান্টার ওয়াহাবী আন্দোলনকে হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছেন, কিন্তু এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, হিন্দুরা ওয়াহাবী আন্দোলনের বিরোধিতা করেন নাই।
এমন কি অনেক হিন্দু ওয়াহাবী আন্দোলনের সমর্থক ছিল। সমসাময়িক কালের সরকারী বিবরণ হইতে জানা যায় বাংলাদেশে ওয়াহাবীদের সংখ্যা আশি হাজার। এই সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নাই এবং ইহাদের সকলে নিম্নশ্রেণীর মানুষ। হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের নিম্নশ্রেণীর জনগণ এই আন্দোলনে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এইভাবে ওয়াহাবীআন্দোলন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ সামন্ততন্ত্র-বিরোধী আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিত্তশালী ব্যক্তিরা সন্ত্রস্ত হইয়া পড়েন।
ক্যান্টোয়েল স্মিথের মতে অর্থনৈতিক দিক দিয়া বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় ওয়াহাবী বিদ্রোহ ছিল পূর্ণমাত্রায় শ্রেণী সংগ্রাম। হান্টারের বিবরণে জানা যায়—“১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ব্যাপক কৃষক অভ্যুত্থানে তাহারা (ওয়াহাবিরা) নিরপেক্ষতার সহিত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল জমিদারের আবাস স্থল লুন্ঠন করিয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান ধনীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অধিকতর শোচনীয় হইয়াছিল।
ওয়াহাবীআন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটান। এই লক্ষ্য সাধিত না হইলেও ওয়াহাবীআন্দোলন ভারতীয় মুসলমান সমাজে ব্রিটিশ-বিরোধী বিক্ষোভ সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু পরবর্তী কালে শিক্ষিত মুসলমান সমাজ ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব পরিত্যাগ করে এবং আলিগড় আন্দোলনের ফলে ওয়াহাবীআন্দোলন হইতে বিচ্যুত হইয়া ব্রিটিশ শাসনের সমর্থকে পরিণত হয়।