সার্ক এর সাফল্য ও ব্যর্থতা টীকা লেখ। SAARC

সার্ক এর সাফল্য ও ব্যর্থতা টীকা লেখ। SAARC

অথবা,

সার্ক-এর সমস্যাগুলি কী?

এই আর্কিকেলটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর সার্ক-এর সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে

সার্ক-এর-সাফল্য-ও-ব্যর্থতা-টীকা-লেখ-SAARC

সার্ক এর সাফল্য: সার্ক-SAARC

উত্তর। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ—এই সাতটি দক্ষিণ এশীয় দেশকে নিয়ে ১৯৮৩ সালে সার্ক (SAARC) নামক আঞ্চলিক সংস্থাটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে যেসব আঞ্চলিক সংগঠনগুলি রয়েছে, সার্ক হল তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। এর কার্যকাল মাত্র ১৫-১৬ বছরের। এত অল্প সময়ের মধ্যে এর সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে হিসেবনিকেশ করতে বসলে অনেক কিছুই গরমিল হয়ে যায়। তাছাড়া এর প্রেক্ষিত এবং তাগিদও অন্যসব সংগঠন থেকে লক্ষণীয়ভাবেই পৃথক। অতীতের বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য এবং অবিশ্বাসের আবহ কাটিয়ে উঠে সহযোগিতার নতুন লক্ষ্যে যাত্রা করা সহজ কাজ নয়। যাইহোক, প্রথমে আমরা দেখব সার্ক-এর সমস্যাগুলি কী বা কোথায় এর দুর্বলতা।

সার্কের সমস্যা বা দুর্বলতা :

প্রথমত, পারস্পরিক সহযোগিতার সার্বিক বিকাশ যদি কোন আঞ্চলিক সংগঠনের সাফল্যের চাবিকাঠি হয়, তবে সেই মানদণ্ডে সার্কের ব্যর্থতাই বেশি করে নজরে আসে। পারস্পরিক সম্প্রীতির অভাব, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, জাতি-বিদ্বেষ, হিংসা এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে সার্কের জন্ম। সার্ক-এর জন্মের ১৫-১৬ বছর পর সেই অবস্থার কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন না।
ভারত ও পাকিস্তান—দুটি সার্কভুক্ত দেশ। কিন্তু এ দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে চরম শত্রুতার সম্পর্ক। বলাবাহুল্য এই তিক্ত সম্পর্কের অশুভ প্রভাব থেকে সার্ক রেহাই পায় নি। ১৯৯৫ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সার্ক-এর অষ্টম শীর্ষ সম্মেলনে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এছাড়া ১৯৯৮-এর মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিযোগিতামূলক পরমাণু বিস্ফোরণের পরে পরেই জুলাই মাসে দশম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলম্বোয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই পরমাণু বিস্ফোরণের আগুন সার্ক সম্মেলনের গায়েও লাগে। তদানীন্তন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন : “সার্কের সদস্যদের মধ্যে যে মতপার্থক্য ও উত্তেজনা রয়েছে সার্ক তা থেকে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না ।
অবশ্য অন্য দেশগুলির হস্তক্ষেপে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের বিষয়টি সার্ক সম্মেলনে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। শুধু পাকিস্তান নয় শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের মনোমালিন্য হয়েছে এবং তার প্রভাবে সার্ক-এর আন্দোলন দুর্বল হয়েছে।
১৯৮৪ সালে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে যে সার্ক-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে শ্রীলঙ্কা অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউল রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর হস্তক্ষেপে শ্রীলঙ্কার মনোভাব নরম হয়।

দ্বিতীয় যে বিষয়টিতে সার্ক-এর ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটা হল এর দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির কথা সার্ক-এর জন্মের প্রথম দিন থেকে বলা হয়েছিল। অথচ আজও এই অঞ্চলের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য দিল্লী সম্মেলনে (১৯৯৫) জোর দেওয়া হয়েছিল। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে. পি. ভট্টরাই-এর নেতৃত্বে একটি কমিশনও গঠন করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। তাই সার্ক এখনও ‘গরীবদের ক্লাব’ (Poormen’s Club) হয়েই রয়ে গেছে।

সার্ক-এর-সাফল্য-ও-ব্যর্থতা-টীকা-লেখ-SAARC

শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ করে শিশু শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতিকল্পে সার্ক চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখিয়েছে। ১৯৯০ সালকে সার্ক দেশগুলি ‘শিশুকন্যা বর্ষ’ রূপে পালন করে। ১৯৮৮–এর ইসলামাবাদ সম্মেলনে বেনজির ভুট্টোর প্রস্তাবমত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এই সাতটি দেশেই শিশু কন্যারা আজ অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। শ্রমিক হিসাবেই এদের অনেকের জীবন শুরু হয়। শিশু কন্যাদের বেশ্যাবৃত্তির কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও দক্ষিণ এশীয় সংস্থাটি কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি।
পাকিস্তানের মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের (Human Development Centre) প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব-উল-হক (Mahbub-UlHaq) দেখিয়েছেন, বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৩৪ মিলিয়ন। এদের মধ্যে আবার অনেককেই দিনে ১৫ ঘন্টার বেশি পরিশ্রম করতে হয়।

অশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই চিত্র ফুটে ওঠে। জাতিপুঞ্জের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিরক্ষর মানুষের বাস দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশে। এখানেও সার্ক ব্যর্থ। এছাড়াও সমালোচকেরা আরও অনেক সমস্যা বা দুর্বলতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন।
সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে মতৈক্যের থেকে মতবিরোধের জায়গাটাই বেশি, অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের আচরণ ‘বড় দাদা’ সুলভ, এদের মধ্যে সাধারণ কোন শত্রুর বিরুদ্ধে এক-কাট্টা হওয়ার তাগিদ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এরা পরস্পরের সহযোগী নয়, প্রতিযোগী, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে বৈদেশিক নীতির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রচনায় এদের অনীহা প্রভৃতি নানান নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়।

সার্ক এর সাফল্য :

উপরোক্ত দুর্বলতা বা সমস্যাগুলি সত্ত্বেও সার্ক এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রভূত প্রত্যয় নিয়েই তার চলার পথ সে প্রশস্ত করে চলেছে। সার্কভুক্ত দেশগুলির বিভিন্ন মন্ত্রক পর্যায়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, নানাক্ষেত্রে এর সম্প্রসারণশীল কার্যক্রম এবং রাষ্ট্রবহির্ভূত স্তরেও নিয়মিত আদান-প্রদান একে প্রাণবন্ত রেখেছে। অতীতের বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য এবং অবিশ্বাসের আবহ কাটিয়ে উঠে সহযোগিতার নতুন লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটু সময় তো লাগবেই।
নিজেদের মধ্যে বিরোধ বা মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও যে বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা গড়ে উঠতে পারে তার একটি বড় মাপের উদাহরণ হল সার্কভুক্ত দেশগুলি কর্তৃক ‘সাপটা’ (SAPTA – South Asian Preferential Trade Agreement ) চুক্তি স্বাক্ষর। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে এই চুক্তি সাক্ষরিত হয় ১৯৯৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর নতুন দিল্লীতে। দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রসারে এটি

একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সার্কের সাতটি দেশই ঘোষণা করেছে তারা ধাপে ধাপে রপ্তানিবাণিজ্যে শুল্ক তুলে নেবে। প্রতিটি সদস্য দেশই অন্য সদস্য দেশগুলির কাছে এমন কিছু পণ্যের তালিকা দেবে, যেগুলির ওপর শুল্ক হ্রাস করা হবে। সাপটার লক্ষ্য হল ২০০৬ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় অবাধ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করা। এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে সার্কের সাতটি দেশের মধ্যে অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে এবং সাতটি দেশই আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হবে।

এছাড়াও সার্ক তার সাফল্যের নজির রেখেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৩ সালে সার্ক ও ইউনিসেফ (UNICEF)-এর মধ্যে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি শিশুদের কল্যাণ সাধন করার বিষয়ে সার্কের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে সার্ক ও ইউ. এন. ডি. পি. (UNDP)-এর মধ্যে একটি সমঝোতা পত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল দারিদ্র্য দূরীকরণ, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ, প্রাকৃতিক সম্পদের সংস্কার সাধন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মহিলাদের উন্নয়ন ইত্যাদি।
১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে সার্ক ও UNDCP-এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার লক্ষ্য হল মাদকের অপব্যবহার ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ করা। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে সার্ক ও এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিট (APT)-র মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এইসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও সার্ক কলম্বো প্ল্যান, ITU, EU প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাছাড়া ECO, ASEAN প্রভৃতি আঞ্চলিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রচেষ্টা চলছে।

সার্কভুক্ত দেশগুলি নিজেদের মধ্যেও বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উপমহাদেশীয় জলসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি হল নেপালের সঙ্গে ভারতের মহাকালী নদী উপত্যকা পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপদান ; অন্যটি গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে ঢাকা-নয়াদিল্লী চুক্তি।
দুটি পদক্ষেপই ভারত-নেপাল এবং ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল হয়েছে। এই চুক্তির ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির দীর্ঘকালীন বিরোধের অবসান ঘটেছে এবং উন্নয়নের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ এবং ভারত-পাকিস্তান সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর ভারত-বাংলাদেশ রেল যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে।

এ সবই হল সার্কের সাফল্যের দ্যোতক। বস্তুত সার্কের হাত ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বিভেদের প্রাচীর অনেকখানি ভেঙে গিয়েছে। যেটুকু বাকি আছে তা অদূর ভবিষ্যতেই ঠিক হয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সার্ক সত্যিসত্যিই একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম হয়ে ডালপালা মেলতে শুরু করুক, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মনে-প্রাণে এটাই প্রার্থনা করে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *