ত্রি শক্তি সংগ্রাম: পাল, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহারদের মধ্যে ত্রি শক্তি সংগ্রামের বিবরণ

পাল, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহারদের মধ্যে ত্রি শক্তি সংগ্রাম এর বিবরণ

প্রশ্ন । কনৌজের উপর আধিপত্য স্থাপনের জন্য প্রতিহার, পাল ও রাষ্ট্রকূটদের ত্রি শক্তি সংগ্রাম এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখ ।

অথবা,

পাল, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহারদের মধ্যে ত্রি শক্তি সংগ্রাম এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

অথবা,

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে ধর্মপাল ও দেবপালের সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

পাল-রাষ্ট্রকূট-ও-প্রতিহারদের-মধ্যে-ত্রি-শক্তি-সংগ্রাম-এর-বিবরণ

ত্রি শক্তি সংগ্রাম এর বিবরণ

উত্তর ।

কনৌজ ও উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা :

ত্রি শক্তি সংগ্রাম: হর্ষবর্ধন কনৌজে তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিবার পর হইতে কনৌজ সমগ্র উত্তর ভারতের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হইয়া উত্তর-ভারতের প্রাণকেন্দ্র উঠিল । হর্ষবর্ধনের পরবর্তী যুগেও কনৌজ ভারতের মধ্যমণিরূপে সকল দিগ্বিজয়ীগণকে আকর্ষণ করিত। এই ‘মহোদয়শ্রী’ বা কনৌজের অধিকার লাভ না করিলে সমগ্র উত্তর-ভারতে সাম্রাজ্য ও আধিপত্যবিস্তার সম্পূর্ণ হয় না ।
তাই অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগ হইতেই গুর্জর-প্রতিহারবংশ, রাষ্ট্রকূটবংশ এবং পালবংশের রাজগণের মধ্যে কনৌজ তথা উত্তর-ভারতের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এক ত্রি-শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত হইল । মুসলিম আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন পরিসমাপ্তি হয় নাই ।

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর কনৌজের গৌরব কিছুটা ম্লান হইয়া পড়ে । অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে অবশ্য যশোবর্মন উহার পূর্ব গৌরব কিছুটা ফিরাইয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছিলেন । কিন্তু তাহার পর উহা আবার দুর্বল হইয়া পড়ে । অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে কনৌজে রাজত্ব করিতেন ইন্দ্রায়ুধ নামে একজন রাজা । এই একই সময়ে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটগণ, রাজপুতানার গুর্জর-প্রতিহারগণ এবং বাংলার পালরাজগণ সমগ্র উত্তর-ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বপ্ন দেখিতেছিলেন ।

ভাগে -ভারতে পালরাজগণের আধিপত্য :

বাংলার পালবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপাল উত্তর-ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে পশ্চিম অভিমুখে অগ্রসর হইলে গুর্জর-প্রতিহার বংশের বৎসরাজের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বৎসরাজ স্বয়ং রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবের হস্তে দারুণভাবে পরাজিত হন । বৎসরাজের এই দুর্বলতার সুযোগে ধর্মপাল উত্তর-ভারতে তাঁহার আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন । তিনি কনৌজের রাজা ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া তাহার মনোনীত চক্রায়ুধকে কনৌজের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কথিত আছে চক্রায়ুধের অভিষেকের সময় ভোজ, বৎস, মদ্র, কুরু, অবন্তি, গান্ধার প্রভৃতি রাজ্যের রাজন্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন । এ কথা নিঃসন্দেহ যে, উক্ত রাজন্যবর্গ ধর্মপালের প্রাধান্য স্বীকার করিয়াছিলেন । অর্থাৎ এই সময় উত্তর-ভারত ধর্মপালের প্রভাবাধীন হইয়া পড়িয়াছিল ।

কিন্তু নবম শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রতিহার-রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট শক্তিশালী হইয়া উঠেন এবং ধর্মপাল ও তাঁহার আশ্রিত রাজা চক্রায়ুধকে পরাজিত করিয়া পুনরায় কনৌজের সিংহাসনে ইন্দ্রায়ুধকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ঠিক এই সময় রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয়, গোবিন্দ উত্তর-ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা দিলেন এবং তিনি সসৈন্যে উত্তর-ভারতে অগ্রসর হইয়া দ্বিতীয় নাগভট্টকে দারুণভাবে পরাজিত করেন, অভ্যন্তরীণ কারণে তাঁহাকেও নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করিতে হয়।
সুতরাং ধর্মপাল পুনরায় উত্তর-ভারতে তাঁহার আধিপত্য পুনরুদ্ধার করিতে সক্ষম হন । তাঁহার পুত্র দেবপালও প্রতিহার-রাজ প্রথম ভোজকে পরাজিত করিয়া উত্তর-ভারতে পালবংশের এই আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখিয়াছিলেন ।

গুর্জর-প্রতিহারগণের প্রভাব :

বাংলার পাল-রাজা দেবপালের মৃত্যুর পর হইতে উত্তর-ভারতে প্রতিহার-রাজগণের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। প্রতিহার-রাজ প্রথম ভোজ কনৌজ অধিকার করেন এবং উত্তর-ভারতে আধিপত্য বিস্তার করিয়া কনৌজে তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সমসাময়িক পালরাজাকে পরাজিত করিয়া তিনি মগধ পর্যন্ত তাঁহার সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন ।
প্রথম ভোজের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র মহেন্দ্র পাল ৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে কনৌজের সিংহাসনে আরোহণ করেন । তাঁহার সময় সমগ্র উত্তর-ভারতে গুর্জর-প্রতিহার রাজগণের প্রভাব অপ্রতিহত হইয়া উঠে। তিনি বাংলার নারায়ণ পালকে পরাজিত করিয়া উত্তর-বঙ্গ পর্যন্ত তাঁহার সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত করেন। তাঁহার সময়েই প্রতিহার সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল । সাম্রাজ্য

রাষ্ট্রকূটদের প্রাধান্য :

৯১২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিহার-রাজ মহীপাল কনৌজের সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি কিছুকাল পর্যন্ত গুর্জর-প্রতিহার বংশের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন । কিন্তু এই সময় রাষ্ট্রকূটবংশ আবার শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্ৰ মহীপালকে পরাজিত করিয়া কনৌজ অধিকার করেন । তৃতীয় ইন্দ্রের পুত্র তৃতীয় কৃষ্ণও একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন এবং রাষ্ট্রকূটবংশের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার পর হইতে রাষ্ট্রকূটবংশেরও পতন আরম্ভ হয়।

ইহার পর প্রতিহাররাজগণ কনৌজ পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন সত্য কিন্তু তাঁহারা কনৌজের পূর্ব গৌরব আর ফিরাইয়া আনিতে সক্ষম হন নাই। ১০১৯ খ্রীষ্টাব্দে গজনীর সুলতান মামুদ কর্তৃক শেষ প্রতিহার-রাজ জয়পাল কনৌজের সংগ্রামে পরাজিত হইয়া বিতাড়িত হন।

কনৌজের তথা উত্তর-ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেহই স্থায়ীভাবে সার্বভৌম শক্তি প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিলেন না বলিয়া ভারতে বিদেশী আক্রমণের পথ সুগম হইয়াছিল ।

প্রশ্ন) কোন্ কোন্ রাজবংশ তথাকথিত ত্রি শক্তি সংগ্রাম এ লিপ্ত হইয়াছিল ?

উত্তর । উত্তর-ভারতের গুর্জর প্রতিহার বংশ, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ ও পূর্ব-ভারতের পালবংশ কনৌজে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ত্রি-শক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন । এই সংগ্রামে রাষ্ট্রকূটবংশ তুলনামূলকভাবে বেশী সাফল্যের পরিচয় দেয়।

(২) তৃতীয় গোবিন্দ কি ভাবে পাল ও প্রতিহারদের ক্ষমতা খর্ব করিয়াছিলেন ?

উত্তর । রাষ্ট্রকূট বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন তৃতীয় গোবিন্দ (৭৯৩-৮১৪ খ্রীঃ)। তিনি প্রথমে প্রতিহার-রাজ দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেন। পাল-সম্রাট ধর্মপালও বিনা যুদ্ধেই রাষ্ট্রকূট-রাজের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন । তৃতীয় গোবিন্দ এইভাবে সমগ্র উত্তর-ভারতে তাঁহার মর্যাদা ও প্রতিপত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *