ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ Teacj Sanjib

ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ Teacj Sanjib

ডাকাতের মা গল্পের উৎস

‘ডাকাতের মা’ ছোটোগল্পটি ১৩৬১ বঙ্গাব্দের শারদীয় যুগান্তর পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। লেখক সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প-সংকলন গ্রন্থ চকাচকী (প্রথম প্রকাশ ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ) থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠ্য হিসেবে এই গল্পটি সংগ্রহ করা হয়েছে।

ডাকাতের-মা-গল্পের-বিষয়বস্তু-ও-নামকরণ-Teacj-Sanjib

ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু:

সৌখীর মা আগে পরিচিত ছিল ‘ডাকাতের বউ’ হিসেবে। সৌখীর বাবা মারা যাওয়ার পর সৌখীও বাবার মতোই পেশা হিসেবে ডাকাতির পথ বেছে নেয়। তখন থেকেই তার মায়ের পরিচয় হয় ‘ডাকাতের মা’। ডাকাতের মা যারা হয়, তাদের ঘুম হালকা না হলে চলে না। কেননা, রাতবিরেতে কখন যে তার দরজায় টোকা মারার শব্দ শোনা যাবে, তার কোনো ঠিক নেই |
সৌখীর মা জানে যে, দুটো টোকা দেওয়ার টক টক শব্দ থেমে থেমে তিনবার হলে তা সৌখীর ডাকাত দলের লোকের টাকা দিতে আসার সংকেত।ওইরকমই শব্দ যদি থেমে থেমে চারবার হয়, তবে তার অর্থ হল, সৌখী বাড়ি ফিরেছে | শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা না খোলার ব্যাপারে সৌখী তার মাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। দশবার শ্বাস ফেলতে যতক্ষণ সময় লাগে, ততক্ষণ অপেক্ষা করার পরই যেন সৌখীর মা দরজা খোলে।
এখন সময়টা আর আগের মতো নেই | একসময় সৌখীর বাবার আমলের এক ডাকাত আহত হয়ে ধরা পড়লে নিজের হাতেই নিজের জিব কেটে ফেলেছিল, যাতে পুলিশ তার কাছ থেকে তাদের দলের গোপন কথা জানতে না পারে। কিন্তু সৌখীর তেমন অনুচরভাগ্য নেই | তাই, পাঁচ বছর আগে সৌখী জেলে যাওয়ার পর তার অনুচররা প্রথম দু-বছর ধরে প্রতি মাসে তার মাকে টাকা দিয়ে গেলেও তারপর থেকে আর টাকা দেয় না। সৌখীর দ্বিতীয় বউটার শরীর স্বাস্থ্য ভালো নয় |
ছেলে হওয়ার পর একেবারে ভেঙে গেছে তার শরীর | যখন সৌখীর বউ গর্ভবতী ছিল, তখনই শেষবার ধরা পড়েছিল সৌখী। সেকারণেই সৌখীর চার-পাঁচ বছরের ছেলেটি কখনোই বাবাকে দেখতে পায়নি। রুগ্ণ শরীরের জন্য সৌখীর দ্বিতীয় স্ত্রী তার ছেলের মুখে অন্ন জোগাতে পরিশ্রম করতে পারে না। তাই বৃদ্ধা ঠাকুমাই খই ও মুড়ি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে আসে | কিন্তু এ ব্যবস্থায় একজনের পেট চালানোই মুশকিল |
ঝিয়ের কাজ করতে চাইলেও ডাকাতের মাকে বিশ্বাস করে কাজ দিতে কেউ রাজিও হত না। গোয়ালা বেয়াইয়ের দুটো মোষ আছে বলে তার দুধ নিশ্চয়ই তার নাতি ও বউমা খেতে পাবে—এই আশাতেই সৌখীর মা তার নাতি ও বউমাকে বেয়াইয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সৌখীর মায়ের স্থির বিশ্বাস, বছরখানেক পরে তার ছেলে ছাড়া পেলে সে তার বউকে নিয়ে এসে তাকে রুপোর গয়নায় ভরিয়ে দেবে। তখন পাড়ার লোকেরা বুঝতে পারবে, তার নাতি পথের ভিখিরি নয়। শুধু তাই নয়, সৌখী এলে তার দলের খারাপ লোকগুলোকেও ঠান্ডা করতে হবে।

ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু

বেশ কিছুদিন ধরেই সৌখীর মায়ের রাত্রিবেলায় ঘুম আসতে চায় না। বেশ কিছুদিন আগে এক শীতের মাঝরাতে সৌখীর মা আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল| সেসময় সৌখী এসে দরজায় নিয়মমতো টোকা দেয়| কিন্তু তার মায়ের কানে সে শব্দ পৌঁছোয়নি |
অনেক ডাকাডাকির পর তার মা জেগে ওঠে এবং দরজা খুলে দেয়। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সৌখী তখন মাকে খুব মারে। বিগত পাঁচ বছর ধরে সেই সৌখী জেলে থাকায় তাকে বকাঝকা করার মতো একটা মানুষও এ বাড়িতে নেই | এটা সৌখীর মায়ের কাছে বড়ো কষ্টের| তবুও সেই ছেলের কথা মনে করেই সৌখীর মা সেই পাঁচ বছরে একদিনও নাক-মুখ কম্বলে ঢেকে ঘুমোয়নি।

বাইরে নোনা-আতা গাছতলায় শুকনো পাতায় একটা খড়খড় শব্দ শুনতে পেল সৌখীর মা। বয়স বেড়েছে বলে সৌখীর মায়ের শীতও বেড়েছে। আগে শীতকালটা একটা কম্বলে খুব ভালোভাবেই চলে যেত তার | এখন আর তাতে হয় না। তা ছাড়া তার গায়ের কম্বলটাও অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। এর আগেরবার জেলফেরত সৌখীর আনা কম্বলটার বয়স কত হবে, সেই চিন্তাই | করতে থাকে সে। হঠাৎই একটা টক টক শব্দে তার চিন্তা বাধা পায় | প্রথমে সৌখীর যা তাকে টিকটিকির ডাক বলে মনে করে।

বিষয়বস্তু

কিন্তু দরজায় আবার দুটো টোকা পড়তেই সে বুঝতে পারে, আগেরটাও টিকটিকির আওয়াজ ছিল না। কেননা, টিনের পাল্লায় টোকা মারলে যেরকম খনখনে শব্দ হয়, তেমনই শব্দ সেটা | বৃদ্ধা উঠে বসল | মাটিতে আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য ধোঁয়ায় ঘরটা ঘন অন্ধকার হয়ে রয়েছে। আবার দুটো টোকা পড়ল দরজায়। আর তার কোনো সংশয় রইল না যে, সেটি নিশ্চয় সাংকেতিক শব্দ |
আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে বন্ধ দরজার সামনে উপস্থিত হল। দরজার কপাটের ফাঁক দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল। ও প্রান্তের লোকটাও ওই ফাঁক দিয়েই ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল বলেই হয়তো সৌখীর মা বাইরে কিচ্ছুটি দেখতে পেল না | আবার দুটো টোকা পড়ল দরজায় | এই চারবারের জোড়া টোকায় অবাক হয়ে গেল সৌখীর মা।
বুঝতে পারল যে, দলের লোক যদি টাকা দিতে বা অন্য কারণে আসে, তাহলে তো তিনবার টোকা মারবে। তবে তো তারা কেউ আসেনি | তবে কি পুলিশের লোক এল? কিন্তু, তাদের আসার তো কোনো কারণ নেই | সৌখী তো জেলে। তার ছাড়া পাওয়ার অনেক দেরি। সৌখীর মায়ের হঠাৎ মনে পড়ল, প্রতিবার খিল খোলবার আগে সৌখী তাকে দশবার শ্বাস ফেলতে বলেছিল। কোনোরকমে তাড়াতাড়ি দশবার শ্বাস ফেলে ছেলের নির্দেশ পালন করে নিল সে |
দরজা খুলে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বড়োসড়ো চেহারার মানুষ | এরপর ছেলের গলা শুনে ধড়ে প্রাণ এল তার। সৌখী মাকে জানায় যে, লাটসাহেব জেলখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সৌখীর কাজকর্ম দেখেশুনে খুশি হয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন তিনি। আসলে তাঁর খুশির কারণটা হল, প্রধান জমাদারকে সৌখী ঘুস দিয়েছিল। তাই তিনি জেলারসাহেবের কাছে সৌখীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন।
এই কথাগুলো সৌখী খুব জোরেই বলে, যাতে তার কথা ঘরের অন্যরাও শুনতে পায়। তার মা যখন কেরোসিনের কুপিটা খুঁজছিল, তখন সে দেশলাই জ্বেলে তুলে ধরে মাকে সাহায্য করত। সেই আলোতে বৃদ্ধা তার ছেলের মুখ দেখতে পায় | সৌখীর মাথার চুল অনেকখানি পেকে যাওয়ায় তার মুখে তার বাবার আদল দেখতে পায় সৌখীর মা | সৌখী কিন্তু ঘরের চারদিকে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজতে থাকে। বুড়ি বুঝতে পারে সে কাদের খুঁজছে |
সৌখী মাকে উলটে জিজ্ঞাসা করে যে, তার ছেলে-বউ কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে না কেন। এতক্ষণ ধরে এই অপ্রিয় প্রশ্নের ভয়ই করছিল তার মা। সে ছেলেকে জানায় যে, বউ ছেলেকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি গেছে | ছেলে-বউ নেই শুনে খুবই হতাশ হয় সৌখী। বাড়ি ফিরে আসার আনন্দ অর্ধেক হয়ে যায় তার। ছেলে তার কেমন দেখতে হয়েছে—তা নিয়ে সে জেলে বসে কল্পনার জাল বুনেছিল অনেক।
সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে, পরদিনই সে শ্বশুরবাড়ি যাবে বউছেলেকে নিয়ে আসার জন্য। সৌখী এরপর তার মায়ের ব্যাবসার পুঁজি খইমুড়িগুলো খেয়ে মায়ের ছেঁড়া কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে, মাকে নিজের নতুন কম্বলটা দিয়ে শুয়ে পড়ে।

ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু

পরদিন সকালে সে ছেলেকে কী খেতে দেবে — সেই চিন্তা সৌখীর মাকে উদ্‌বেল করে তোলে। আলুচ্চড়ি খেতে তার ছেলে খুবই ভালোবাসে | পরদিনই তাই তাকে চাল, আলু, সরষের তেল—এসব কিছুই কিনতে হবে। এতসব কেনার পয়সা তার কাছে নেই | ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়ে যে, পাড়ার পেশকারসাহেবের বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ হচ্ছে | বুড়ি পা টিপে টিপে বের হয় ঘর থেকে |
মাতাদিন পেশকারের বাড়ি গিয়ে বুড়ি দেখে যে, দু-আড়াই হাত পর্যন্ত পাঁচিল গাঁথা হয়েছে। সেই অর্ধসমাপ্ত পাঁচিলের পাশে মাটি আর ভাঙা ইট বিছানো থাকায় বুড়ি সহজেই সেই পাঁচিল টপকে পেশকারসাহেবের বাড়ি ঢোকে| জলভরা লোটাটি হাতের কাছে পেয়ে সে নিঃশব্দে সেটি তুলে নেয় এবং পাঁচিল টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে।

সারাংশ

পেশকারসাহেব তাঁর লোটার প্রতি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাই ভোরে উঠে। সেটি না দেখতে পেয়ে বাড়িতে হই-হট্টগোল বাঁধিয়ে দিলেন তিনি। তার স্ত্রী নাকি-কান্না কেঁদে তাঁকে জানালেন যে, বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনার জন্য তখনই আর-একটা লোটা কিনে আনা অবশ্যই দরকার | তিনি স্ত্রীকে বললেন । যে, চুরি হওয়ার খবর পুলিশকে না জানালে সে দোষে জেল পর্যন্ত হতে পারে, সে খবর তারা রাখে না।
আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ মাতাদিন এইরকম আর অনেক কটুকথা তাঁর স্ত্রীকে শোনাতে শোনাতে বাড়ি থেকে বের হলেন। প্রথমে তিনি থানায় গেলেন চুরির খবর জানাতে। ফেরার পথে তিনি গেলেন। বাসনের দোকানে। দোকানদার পেশকারসাহেবকে নানারকমের ঘটি দেখাল| কিন্তু কোনোটাই তাঁর পছন্দ হল না। তিনি চাইছিলেন বড়ো-মুখযুক্ত, বড়ো আকারের লোটা। বাসনওয়ালা হতাশ হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে যে, পুরোনো হলে তাঁর চলবে কি না।
সে জানায় যে, কম দামে, মাত্র আড়াই টাকায় পেশকারসাহেব সেটি পেয়ে যাবেন। দোকানটিতে পুরোনো বাসন । বিক্রি হয় শুনে প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। তারপর সেটি দেখতে চান। লোটাটি দেখেই সন্দেহ হল তাঁর | পকেট থেকে চশমা বের করে পরে ভালো করে দেখলেন| দেখলেন যে, এটিও তাঁর লোটার মতোই চার-পায়াওয়ালা এবং এরও পায়ার নীচে তারা আঁকা রয়েছে। তিনি নিশ্চিত হলেন যে, সেটি তারই লোটা।
রাগে উত্তেজিত হয়ে দোকানদারের গলা টিপে ধরে পেশকারসাহেব তার কাছে জানতে চাইলেন যে, সে ঘটিটি কোথা থেকে পেয়েছে | ভীতসন্ত্রস্ত দোকানদার মাতাদিনকে জানাল যে, কিছুক্ষণ আগেই সে সৌখীর মায়ের কাছ থেকে নগদ চোদ্দো আনা পয়সায় লোটাটি কিনেছে। এরপর পেশকারসাহেব একটি ছেলেকে থানায় পাঠালেন দারোগাসাহেবকে ডেকে আনার জন্য।

ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু

দারোগাসাহেব সেই মুহূর্তে সাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলেন। সেখানে সব কথা শোনার পর তিনি দলবলসহ সৌখীর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন | সৌখীর মা তখন সবেমাত্র আলুর তরকারি উনানে চাপিয়েছে। সৌখী তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে | উঠোনে লোকজন-সমেত পুলিশকে দেখতে পেয়ে বুক কেঁপে ওঠে সৌখীর মায়ের।
আসলে, সৌখীর মায়ের অনুমান ছিল যে, বাসনওয়ালারা পুরোনো বাসন রং করে নতুন করে নিয়েই তারপর তা বিক্রি করে। পাঁচ-সাত বছর আগে একবার ভোররাতে তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ, আগ্নেয়াস্ত্রের খোঁজে। তখন কিন্তু বুড়ির সম্মানে ঘা লাগেনি। কেননা, সে মনে করে যে, ডাকাতি তার স্বামী-পুত্রের ন্যায অধিকারের জীবিকা | ডাকাতি তো সমর্থ পুরুষের কাজ, অহংকারের কাজ জেলে যাওয়া সেক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যের ব্যাপারই মাত্র, আর কিছু নয়।
কিন্তু শেষকালে সে ডাকাত পরিবারের বউ এবং মা হয়ে ছিঁচকে চুরির দায়ে ধরা পড়ল! তাই লজ্জায় সৌখীর মা তার বিরুদ্ধে ওঠা নালিশ অস্বীকার করতে পর্যন্ত ভুলে গেল। দারোগাসাহেব যখন তাকে লোটাটি বাসনের দোকানে চোদ্দো আনায় বিক্রি করার কথা জিজ্ঞাসা করেন, তখন কোনো কথা বেরোয় না তার মুখ থেকে |
একবার মাত্র সৌখীর দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নেয় সে | হই-হট্টগোলে ইতিমধ্যেই ঘুম থেকে জেগে ওঠা সৌখীর কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
জেলে এতদিন জেলখানার গুদামঘরে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে সর্বমোট নব্বই টাকা সে আয় করেছে। সৌখী ভাবে, বাড়ি-ঘর-দুয়োরের দিকে তাকিয়ে তারই মার অবস্থাটা বোঝা উচিত ছিল| যাই হোক, শেষে মায়ের সম্মান রক্ষার তাগিদে সে নিজেই লোটা চুরির দায় মাথা পেতে নেয়।

সৌখীর মা এবার ভেঙে পড়ে। দারোগাবাবুর পায়ে মাথা ঠুকে সে জানায় যে, তার ছেলে চুরি করেনি, সেই করেছে | দারোগাবাবু যেন তার ছেলেকে ছেড়ে দেন। জেল থেকে ফিরে এসে ছেলে বউয়ের সঙ্গে যে সৌখীর একবার দেখাও হয়নি! থানায় যাওয়ার আগে সৌখী তার কোমরের বটুয়াটা বার করে খাটিয়ার ওপর রেখে যায় | তার বুড়ি মা তখনও মেঝেতে লুটিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর তার উনুনে বসানো তরকারির পোড়া গন্ধ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

ডাকাতের মা গল্পের নামকরণের সার্থকতা

নামকরণ

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ ছোটোগল্পটি পড়লে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই যে, এই নামকরণ চরিত্রকেন্দ্রিক। কেননা, নামচরিত্রটিই আলোচ্য গল্পের প্রধান চরিত্র।

‘ডাকাতের মা’ ছোটোগল্পে মৃত ডাকাতসর্দারের বউ হল বর্তমান ডাকাতসর্দার সৌখীর মা | পাঁচ বছর আগে ছেলে সৌখী জেলে গেলে এবং তার দু-বছর পর সৌখীর অনুচররা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলে অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে এই বৃদ্ধা। নিতান্ত বাধ্য হয়েই সে শিশু নাতি এবং বউমাকে বেয়াই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় | সুদিনের আশা বুকে নিয়ে খই-মুড়ি |
বেচে কোনোক্রমে দিন কাটাতে থাকে সৌখীর মা। ছেলে সৌখীর আপত্তির জন্য নাক-মুখ কম্বলে ঢেকে না শুতে পারার জন্য রাতে তার ঘুমও ভালো হয় না| তা সত্ত্বেও ছেলের বারণ মনে করে পাঁচ বছরে একদিনও সে নাক-মুখ ঢেকে ঘুমোয়নি | জেল থেকে আগেভাগে ছাড়া পেয়ে হঠাৎই এক রাতে বাড়ি ফেরে সৌখী | ঘরে কিছু না থাকায় মা বিক্রির জন্য রাখা খই-মুড়িই খেতে দেয় ছেলেকে।

রাতে শুয়ে শুয়ে পরদিন সকালে ছেলেকে কী খাওয়াবে—সেই চিন্তায় সৌখীর মার ঘুম হয় না। ছেলেকে তার প্রিয় আলুচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাওয়াতে হলে যে তেল-চাল-আলুর দরকার, তা কেনার মতো পয়সাও তার নেই | তাই বাধ্য হয়ে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার মাতাদিন পেশকারের বাড়ি ঢুকে তাদের লোটাটা সে চুরি করে। সকালে বাসনওয়ালার দোকানে সেটা চোদ্দো আনায় বিক্রি করে সেই পয়সায় প্রয়োজনীয় জিনিস কেনে এবং উনুনে আলুচচ্চড়ি চাপায়|
কিন্তু পরদিন সকালেই সে পুলিশের কাছে ধরা পরিবারের একজন সদস্যা হয়েও সামান্য ছিঁচকে চুরির অপরাধে ধরা পড়ে যাওয়ায় লোকলজ্জাজনিত কারণে তার অহংবোধে ঘা লাগে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সৌখীর মা পুলিশের কাছে তার চুরির ঘটনা অস্বীকার করতে পর্যন্ত ভুলে যায়। এদিকে হই-হট্টগোলে সৌখীর ঘুম ভেঙে যায়।
সে বুঝতে পারে যে, ডাকাত বংশের বউ হয়েও তার মা সামান্য চোদ্দো আনার জন্য ছিঁচকে চুরি করেছে। বৃদ্ধা মাকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাই সে চুরির দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। বুড়ির কাতর স্বীকারোক্তিতে দারোগাবাবু কর্ণপাত পর্যন্ত করেন না। শোকে-দুঃখে বৃদ্ধা তখন মেঝেতে লুটিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, আর তার উনুনের তরকারির পোড়া গন্ধ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

সুতরাং ‘ডাকাতের মা’ ছোটোগল্পটি নামহীন চরিত্র সৌখী-ডাকাতের মায়েরই গল্প। তার চিন্তাভাবনা, দুঃখকষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সহানুভূতিকে কেন্দ্ৰ করেই আবর্তিত হয়েছে গল্পটি| শেষপর্যন্ত তারই ভুল পদক্ষেপে কোনো অপরাধ না করা সত্ত্বেও তার ছেলেকে পুনরায় জেলে যেতে হয়। যেহেতু ডাকাতের মা চরিত্রকে কেন্দ্র করেই গল্পটি আবর্তিত হয়েছে এবং তারই ভুলের কারণেই গল্পটি এক বিষাদময় পরিণতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে । তাই গল্পটির ‘ডাকাতের মা’ নামকরণকে আমরা সর্বাঙ্গসুন্দর বলতেই পারি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *