কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু Class XI Teacj Sanjib

কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু Class XI Teacj Sanjib

কর্তার ভূত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১

কর্তার ভূত গল্পের উৎস

‘কর্তার ভূত’ রচনাটি ১৩২৬ বঙ্গাব্দে (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রবাসী পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গল্পটি রবীন্দ্রনাথের লিপিকা (আগস্ট, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

কর্তার-ভূত-গল্পের-বিষয়বস্তু-Class-XI-Teacj-Sanjib

কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু:

বুড়োকর্তা মারা যাওয়ার সময় দেশের সমস্ত লোক তাঁকে জানাল যে, তিনি চলে যাওয়ার পর তাদের অবস্থা করুণ হয়ে পড়বে। এ কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ দুঃখ পেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর দেশসুদ্ধ লোক কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকবে—সেই বিষয়টি তাঁকে চিন্তিত করে তুলল।

ভগবান তাই দয়ালু হয়ে জানালেন যে, চিন্তার কিছু নেই | কর্তাই আবার ভূত হয়ে দেশসুদ্ধ লোকের ঘাড়ে চেপে থাকবেন। কারণ, মানুষের মৃত্যু থাকলেও ভূতের মৃত্যু নেই |

এ কথা শুনে দেশের লোক খুব নিশ্চিন্ত হল| কারণ, ভবিষ্যৎকে অর্থাৎ আগামীকে মানার ক্ষেত্রেই ভাবনাচিন্তার প্রশ্ন আসে, ভূতকে অর্থাৎ অতীতকে মানার ক্ষেত্রে তেমন কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। সেক্ষেত্রে সমস্ত ভাবনাচিন্তা ভূতের প্রেতের ওপর দিয়ে দেওয়া যায় | আবার, ভূতের যেহেতু মাথা নেই, তাই কারও জন্য মাথাব্যথা অর্থাৎ দুশ্চিন্তাও নেই তার।

আর, স্বভাবতই যারা নিজের মতো করে কিছু চিন্তাভাবনা করে, তাদের ভূতের কানমলা খেতে হয় | কিন্তু সেই ‘বিনা অপরাধে শাস্তি’-র জন্য কোথাও অভিযোগও করতে পারে না ওই চিন্তাশীল ব্যক্তিরা। কেননা, ভূতের বিরুদ্ধে বিচার করার কোনো ব্যবস্থাই যে নেই।

কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু

দেশসুদ্ধ লোক তাই ভূতে-পাওয়া দশায় চোখ বুজে জীবন কাটাতে থাকে। দেশের তত্বজ্ঞানী মানুষেরা বলেন যে, চোখ বুজে চলাই হল পৃথিবীর অতি প্রাচীন চলা। এই চলাকেই বলে নিয়তির নিয়মে চলা । বিশ্বসৃষ্টির প্রথম যুগে অন্ধ এককোশী প্রাণীরা তেমনভাবেই চলত। ঘাস থেকে শুরু করে সমস্ত প্রকারের উন্নত গাছের মধ্যে তেমনই চলার ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায়।

তত্ত্বজ্ঞানীদের এই তত্ত্বকথা শুনে ভূতে-পাওয়া দেশবাসী তাদের সুপ্রাচীন আভিজাত্যকে উপলব্ধি করে। নিজেদের ঐতিহ্যের এই বিস্তারে তারা আনন্দিত হয়।

ভূতের প্রতিনিধি ভূত-শাসিত কারাগারের দারোগা। সেই কারাগারের প্রাচীর অবশ্য চোখে দেখা যায় না। একারণে সেখানে যেসব মানুষ বন্দি থাকে, তারা বুঝে উঠতে পারে না যে, কীভাবে সে-প্রাচীরে ছিদ্র করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। ভূত-নিয়ন্ত্রিত কারাগারেও অপরাধীদের ঘানি ঘোরাতে হয় |
তবে অবিরাম ঘুরিয়েও সেখানকার ঘানি থেকে এক ছটাক তেলও বের হয় না, যে তেল হাটে বিক্রি হবে। সেই ঘানি ঘোরালে বের হয় কেবল ঘানি চালকের তেজ ও শক্তি | সেই শক্তি শরীর থেকে বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠান্ডা হয়ে যায় | ফলে, ভূতের রাজত্বের এই ব্যবস্থায় মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান হয়তো হয় না, কিন্তু সমাজে শান্তি বিরাজ করে।

অন্য দেশগুলিতে যেখানে ভূতের উপদ্রব দেখলে মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ওঝার খোঁজ করে, এ দেশের মানুষের সে বালাই-ও নেই। কেননা, এদেশের ওঝাদের অর্থাৎ, যাঁদের ভূত তাড়ানোর কথা, তাঁদের আগেভাগেই যে ভূতে পেয়ে বসেছে।

বিষয়বস্তু

এভাবেই এদেশের মানুষের দিন কাটছিল| ভূতের দেশ শাসন প্রণালী নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় ছিল না। দেশবাসী সবসময় এই আত্মশ্লাঘা বা গৌরব অনুভব করত যে, পালিত ভেড়ার মতোই তাদের ভবিষ্যৎ চিরদিনের জন্য ভূতের খোঁটায় বাঁধা| খোঁটায় বাঁধা পোষা ভেড়া যেমন ভ্যা বা ম্যা না করে মাটিতেই পড়ে থাকে, এদের ভবিষ্যৎও তেমনই,— ‘যেন একেবারে চিরকালের মতো মাটি’ | কেবল খুব সাধারণ একটা ভাবনার কারণে একটা অসুবিধার সৃষ্টি হল |
অসুবিধাটা হল এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষদের তো ভূতে পায়নি। তাই অন্য দেশগুলিতে জেলে বা জেলের বাইরের ঘানি থেকে যে তেল বের হয়, তা ওই দেশের রথের চাকাকেই সচল করে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় | সংগত কারণেই বিদেশিরা একেবারে শীতল হয়ে যায়নি। তারা অত্যন্ত সজাগ রয়েছে। কিন্তু এদেশের ঘানি থেকে তো তেল বের হয় না, ঘানি-পেষণকারীর রক্তই কেবল |

কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু

মনোরম, ঠান্ডা আবহাওয়ার ভূতের রাজ্যে তাই প্রায়শই শোনা যায় ‘খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো’—এই ছেলেভুলানো ছড়া। এমন ছড়া খোকার পক্ষে সুখের, খোকার অভিভাবকের পক্ষেও বটে। কিন্তু ছড়াটির পরবর্তী অংশে আছে—‘বর্গি এল দেশে’ | ছড়াকার ছন্দ মেলানোর জন্যও বটে, আবার ইতিহাসের ক্রমকে যথাযথ রাখতে এই অংশটির উল্লেখ না করে পারেননি। দেশবাসী শিরোমণি, চূড়ামণি প্রভৃতি উপাধিপ্রাপ্ত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের এমনটা ঘটার কারণ জিজ্ঞাসা করে| পণ্ডিতের দল তার উত্তরে ঢিকি নেড়ে জানান

কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু

যে, সেটি ভূতের বা ভূতশাসিত দেশের দোষ নয়, সে দোষ বর্গিদেরই। বর্গিদেরই দেশে আসা অন্যায় হয়েছে। পণ্ডিতদের এই উত্তরে দেশবাসী নিশ্চিন্ত হয়, আশ্বস্তও বোধ করে।

দোষ থাক আর নাই থাক, বাড়ির খিড়কির গলিঘুঁজিতে যেমন থাকে ভূতের পেয়াদা, ঠিক তেমনই বাইরের রাস্তাঘাটে অভূতের অর্থাৎ বাস্তব জগতের পেয়াদা ঘুরে বেড়ায়। তাই ভূতের দেশের গৃহস্থ ঘরেও সুস্থ থাকতে পারে না, বাইরেও বেরোতে পারে না। কেন না, উভয়েই যে তাকে বারংবার বলতে থাকে, ‘খাজনা দাও’ | তাই, অন্তরে এবং বাইরে, সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে।

কিন্তু ছড়াতে রয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে।

উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম—চারদিক থেকেই আসা বুলবুলি পাখি যে এতদিন ধরে সমস্ত ধান খেয়ে গেল, সে ব্যাপারে কারও চৈতন্য ছিল না। এদিকে, সতর্ক. ও সচেতন দেশবাসী যারা, তাদের সঙ্গে সাধারণ দেশবাসী ঘনিষ্ঠ হতে চায় না। কেন-না সেক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতে পারে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তারাই সচেতন মানুষের কাছাকাছি আসে অথচ প্রায়শ্চিত্ত করতেও অস্বীকার করে | শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা শাস্ত্র খুলে বলেন যে, অচেতন যাঁরা, তাঁরাই পবিত্র ও শুদ্ধ। সচেতন ও সতর্ক যাঁরা, তাঁরাই অপবিত্র ও অশুচি। তাই সচেতনদের প্রতি আসক্তিহীন থাকা প্রয়োজন | চেতনাপ্রাপ্ত ব্যক্তিমাত্রেই ঘুমন্ত |

তবুও অনিবার্যভাবে এ কথা উঠেই আসে—‘খাজনা দেব কিসে’ |

শবস্থান থেকে, বধ্যভূমি থেকে আসা ঝোড়ো হাওয়া হা হা শব্দ করে উত্তর দেয়—ইজ্জত দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে এবং বুকের রক্ত দিয়ে খাজনা দিতে হবে।

এ প্রশ্ন শুনে ‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি’রা এবং তাদের অনুচরের দল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা এই প্রশ্ন করাকে সর্বনাশ বলে মনে করে। জানায় যে, সাতজন্মেও তারা এমন অলক্ষুনে প্রশ্ন শোনেনি | তা ছাড়া, ভূতের শাসন না থাকলে আদিম এবং চিরন্তন ঘুমের কী হবে, ঐতিহ্য কীভাবে টিকে থাকবে—এ প্রশ্নও তারা তোলে ।

তাদের এ কথা শুনে প্রশ্নকারী বলে যে, সাম্প্রতিককালের বুলবুলির শ্রেণি এবং বর্গির দলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার তো তাহলে কোনো উপায়ই নেই। উত্তরে মাসিপিসিরা জানায় যে, বুলবুলির ঝাঁক এবং বর্গির দলকে কৃষ্ণনাম শোনাতে হবে | নবীন সম্প্রদায় দুর্বিনীত হয়ে বলে ওঠে যে, তারা যেমন করে হোক ভূত তাড়াবে। শুনে ভূতের প্রতিনিধি সবাইকে চুপ করতে বলে। |

কিন্তু আসল কথাটা হল এই যে, বৃদ্ধ কর্তামশাই জীবিতও নন, মৃতও নন, কেবল প্রেত হয়ে আছেন। দেশটাকে অদৃশ্য বাঁধনে বেধে রেখেছেন তিনি, যদিও দেশের ভালোমন্দ নিয়ে তাঁর কোনো হেলদোল নেই |

দেশের দু-চারজন মানুষ দিনের বেলায় ভূতের ভয়ে মুখে রা না কাড়লেও গভীর রাত্রে জোড়হাতে বুড়োকর্তার প্রেতকে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করে যে, তাদের মুক্তি দেবার সময় কি তাঁর তখনও হয়নি | উত্তরে বুড়োকর্তা তাদের বলেন যে, তিনি দেশবাসীকে ধরেও রাখেননি, ছেড়েও দেননি। তারা তাঁকে ছাড়লে তবেই তিনি ছেড়ে যাবেন। সেকথা শুনে সেই লোকেরা জানায় যে, তেমনটা করতে তারা যে ভয় পায়। বুড়োকর্তা তখন বলেন যে, সেই ভয়ের মধ্যেই তো ভূত বাস করে।

কর্তার ভূত গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর:

| নামকরণ

সাধারণত বিষয়বস্তু, স্থান-কাল, চরিত্র এবং ব্যঞ্জনার দিকে লক্ষ রেখেই সাহিত্যে নামকরণ করা হয়। কোনো রচনার নাম শুধু রচনাটিকে চিহ্নিত করার উপায়মাত্র নয়। এটি পাঠকের কাছে রচনাটিতে প্রবেশের একমাত্র চাবিকাঠি, তাই সাহিত্যরচনায় নামকরণের গুরুত্ব অপরিসীম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘লিপিকা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘কর্তার ভূত’ আসলে একটি রূপকধর্মী ছোটোগল্প | এই গল্পে রূপকের আড়ালে প্রাচীন সভ্যতার অন্ধকুসংস্কারের কারাগারে বন্দি থাকা ভারতবাসীর মৃতপ্রায় অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে |
বুড়োকর্তার মৃত্যুকালে ভারতবাসী অভিভাবকহীন হয়ে পড়ার ভয় অনুভব করলে দেবতার দয়ায় বুড়োকর্তা প্রেত হয়ে তাদের ছত্রছায়া হয়ে রইলেন। ফলে তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুরাহা না হলেও, তারা শান্তিতে রইল | দু-একজন মানুষ মৌলিক চিন্তায় ভাবিত হলে তাদের কপালে জুটল ‘ভূতের কানমলা’ অর্থাৎ শাস্তি |
কিন্তু অন্ধের মতো কর্তার ভূতকে অনুসরণ করে চলা সাধারণ দেশবাসী এই ঘটনায় গর্ব অনুভব করল। ভূতুড়ে জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না বলে, সেই কারাগার থেকে বেরোনোর উপায়ও কারোর জানা নেই। আর এই জেলখানার ঘানি ঘোরালে শুধু মানুষের তেজ বের হয়। তাই ভূতুড়ে জেলখানার কয়েদিরা ঠান্ডা থাকে, শান্তিতে থাকে।
মৌলিক চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অন্য কথা বললে কর্তার ভূতের সহযোগী শিরোমণি-চূড়ামণির দল দেশবাসীকে জানায় যে, “বেহুঁশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি।” দেশবাসী এতে আশ্বস্ত হলেও নবীনের দল যখন প্রশ্ন তোলে, “ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে”, তখন ভূতের নায়েব রেগে গিয়ে ভয় দেখিয়ে বলে, “চুপ |
এখনো ঘানি অচল হয় নি।” দেশের কয়েকজন বুড়োকর্তার ভূতের কাছে মুক্তির আবেদন করলে তিনি জানান যে, “…তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।” এ কথা শুনে তারা জানায় যে, ভূতুড়ে বুড়োকর্তার নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে তারা ভয় পায় | বুড়োকর্তার ভূত তখন বলেন, “সেইখানেই তো ভূত।” এই হল গল্পটির বিষয়বস্তু |

এইভাবে ‘কর্তার ভূত’ রচনাটিতে লেখক ‘কর্তা’ তথা প্রাচীন সভ্যতার ‘ভূত’ তথা অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্নতার কথা আলোচনা করেছেন। এ গল্পে ‘দেশবাসী’ অর্থাৎ ভারতবাসীর মানসিক অবস্থার বর্ণনাও আমরা পাই।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভূতগ্রস্ত দেশবাসী প্রচলিত শাসনতন্ত্রের স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারে না কোনোভাবেই | যাই হোক, ‘কর্তার ভূত’. ছোটোগল্পে বুড়োকর্তাকে কেন্দ্র করেই সমগ্র গল্পটি আবর্তিত হয়েছে এবং তিনিই সমগ্ৰ গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

অতএব এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, ‘কর্তার ভূত’—এই রূপকধমী ছোটোগল্পের নামকরণটি অবশ্যই শিল্পসম্মত এবং সার্থক হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *