গোপন কূটনীতি কী? এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলি উল্লেখ কর।

গোপন কূটনীতি কী? এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলি উল্লেখ কর।

এখানে গোপন কূটনীতির সুবিধা অসুবিধা গুলি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে।

গোপন কূটনীতি বলতে কি বুঝি

উত্তর। গোপন কূটনীতি বলতে কূটনীতির সেই পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে কূটনৈতিক আলোচনা ও কার্যাবলী গোপন রাখা হয়। গোপন কূটনীতির ক্ষেত্রে কূটনীতি পরিচালনায় জনগণের কোন ভূমিকা থাকে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত পৃথিবীতে গোপন কূটনীতির প্রচলন ছিল।
রাষ্ট্রনেতারা এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা গোপনে সলাপরামর্শ চালিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন এবং জনগণকে সেই সিদ্ধান্ত কেবল জানানো হত। আলোচনার কোন পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মনে করা হত কূটনীতির এই গোপন পদ্ধতি ক্ষমতার ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব রক্ষায় সহায়ক।

গোপন-কূটনীতি-কী-এর-সুবিধা-ও-অসুবিধাগুলি-উল্লেখ-কর

গোপন কূটনীতির সুবিধা :

গোপন কূটনীতির সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি খাড়া করা হয় : প্রথমত, গোপন কূটনীতির প্রবক্তাগণ মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সাফল্যের অন্যতম পূর্ব শর্ত হল গোপনীয়তা (Secrecy is the key to success in diplomacy.)। গোপন কূটনীতিতে দরকষাকষি বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সুবিধা আদায় করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, কূটনীতি গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হলে দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব হয়। জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভর করে যদি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে কূটনীতি পরিচালনায় অযথা বিলম্ব ঘটে এবং কূটনীতির আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে।

তৃতীয়ত, প্রকাশ্যে কূটনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হলে আলোচনারত কূটনৈতিক প্রতিনিধি সিদ্ধান্তের নমনীয়তা হারাতে পারেন। কারণ একবার জনগণের নিকট কোন কিছু প্রকাশ করা হলে তা থেকে সরে আসা সম্ভব হয় না।

চতুর্থত,

কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে যে দায়িত্বজ্ঞান থাকা প্রয়োজন জনসাধারণের কাছ থেকে তা আশা করা যায় না। একমাত্র পেশাদার কূটনীতিবিদরাই পারে দরকষাকষির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তকে নিজ দেশের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করতে।

পঞ্চমত, সাধারণ নাগরিক দেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে অনেকখানি সচেতন হলেও বৈদেশিক নীতি নিয়ে চিন্তা করতে খুব বেশি অভ্যস্ত নয়। পররাষ্ট্র ব্যাপারে তারা বিশেষ সংবাদ পায় না, তাই তারা ঐ ব্যাপারে অনেকটা অনাগ্রহী

ষষ্ঠত, গোপন কূটনীতির সমর্থনে আরও বলা হয় যে, কূটনীতির লক্ষ্য ও কার্যকলাপ প্রকাশিত হলে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্বার্থগোষ্ঠী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে কূটনৈতিক কার্যকলাপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গোপন কূটনীতির অসুবিধা :

গোপন কূটনীতির বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দেখানো হয় ঃ

প্রথমত, গোপন কূটনীতিকে অনেকে ষড়যন্ত্রমূলক পদ্ধতি বলে সমালোচনা করেন। কেউ কেউ বলেন গোপন কূটনীতি যে বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও সন্দেহের বীজ রোপণ করে তারই পরিণতি হল যুদ্ধ। ডি. সি. পুলে (D. C. Poole) গোপন কূটনীতির প্রকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, গোপন কূটনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে এমন সন্দেহ ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে যা অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক ধরনের গুজব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অনেকে বলেন গোপন কূটনীতি থেকে উদ্ভূত অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাবানল প্রজ্জলিত করেছিল।

দ্বিতীয়ত, সমালোচকদের মতে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির সাফল্যের চাবিকাঠি একমাত্র গোপনীয়তার মধ্যেই নিহিত নয়। তা যদি হত তাহলে অতীতের সকল কূটনৈতিক উদ্যোগই সফল হত।

তৃতীয়ত, সমালোচকেরা আরও বলেন, কোন দেশের কূটনৈতিক সাফল্য শুধুমাত্র গোপনীয়তার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে সেই দেশের কূটনীতিবিদদের দক্ষতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক সামর্থ্য প্রভৃতি বিষয়ের ওপর।

চতুর্থত, গোপন কূটনীতি অনেক সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হিসাবে কাজ করে। কারণ গোপন কূটনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে পারস্পরিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে।

পঞ্চমত, গণতন্ত্র ও গোপনীয়তা পরস্পরবিরোধী। জনসাধারণের অজ্ঞাতে সরকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে কেবলমাত্র স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতে। হিটলার, মুসোলিনি, চিয়াং কাই শেক প্রভৃতি স্বৈরাচারী শাসকগণের আমলে কূটনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয় চূড়ান্ত গোপনে এবং জনগণকে এসব ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়। এর জন্য দেশকে যথেষ্ট মূল্যও দিতে হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *