কূটনীতির সংজ্ঞা ও কার্যাবলী বর্ণনা দাও।diplomacy
কূটনীতির সংজ্ঞা ও কার্যাবলী বর্ণনা দাও।diplomacy
এই আর্টিকেলটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর কূটনীতির সংজ্ঞা ও কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
কূটনীতির সংজ্ঞা
উত্তর।
পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে জাতীয় স্বার্থের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে কূটনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি বা মাধ্যম। কূটনীতি একটি অতি প্রাচীন পন্থা। গ্রীক শব্দ ‘diploun’ থেকে diplomacy কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতির প্রচলন ছিল ঐতিহাসিক থাসিডাইড্স (Thucydides)-এর লেখায় কূটনীতির পরিচয় পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কূটনীতির বিবরণ পাওয়া যায়। তবে আধুনিক যুগে কূটনীতি প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন স্থায়ী কূটনীতিবিদ নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে,
প্রাচীনকালে ঠিক তেমনভাবে স্থায়ী কূটনীতিবিদ নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষ কারণে প্রয়োজন হলেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে দূত বিনিময় করা হত।
ব্যাপক অর্থে কূটনীতি হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার পদ্ধতি। The Oxford English Dictionary-তে বলা হয়েছে, কূটনীতি হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার ব্যবস্থা। আর্নেস্ট স্যাটাউ (E. Satow)-এর ভাষায়, “কূটনীতি হল বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে সরকারি সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও কৌশলের প্রয়োগ।”
চার্লস (Charles O Lerche) বলেছেন, কূটনীতি হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম যার সাহায্যে বিভিন্ন সরকারের মধ্যে সরকারি সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তাদের মধ্যে মত বিনিময় করা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের আদান-প্রদান করা হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মতের মিল আবিষ্কার করা হয়। অনুরূপভাবে জর্জ কেন্নান (Kennan) কূটনীতিকে বিভিন্ন সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধনের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
হ্যারল্ড উইলসন্ বলেছেন, কূটনীতি শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। কখনও কূটনীতি বলতে পররাষ্ট্রনীতিকে বোঝায়, কখনও কূটনীতিকে আলাপআলোচনার সমার্থক বিষয়রূপে গণ্য করা হয়, কখনও আলাপ-আলোচনার পদ্ধতিকে বোঝানো হয়, আবার কখনও আলাপ-আলোচনা পরিচালনার দক্ষতাকে বোঝানো হয়।
পামার্ ও পারকিনস কূটনীতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার এক সাধারণ পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন । তাঁর মতে, কূটনীতির ব্যবহার ও মূল্য কূটনীতিবিদদের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। ফ্রাঙ্কেল্ বলেছেন, কূটনীতিকে কখনও কখনও ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করা হয়। এই ব্যাপক অর্থ অনুযায়ী কূটনীতি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত।
অর্গানস্কি কূটনীতিকে পররাষ্ট্রনীতির সমার্থক বিষয়রূপে গণ্য করার বিরোধী। তাঁর মতে, কূটনীতি হল পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রক্রিয়ার একটি অংশবিশেষ।) কূটনীতির মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সরকারি প্রতিনিধিদের আলাপ-আলোচনা পরিচালিত হয়।
মরগেনথাউ কূটনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির রূপায়ণ ও প্রয়োগই হল কূটনীতি। কূটনীতি শুধু পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে না, পররাষ্ট্রনীতির ব্যাখ্যাও করে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কূটনীতির কোন সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। সংক্ষেপে বলা যায়, কূটনীতি হল এমন একটি প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধনের ব্যবস্থা কার্যকর করা হয় এবং পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবায়িত করা হয়। কূটনীতি আর পররাষ্ট্রনীতি এক জিনিস নয়। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে দেশের মুখ্য শাসক ও পররাষ্ট্র দপ্তর। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন
ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার জোরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁদের কখনই পররাষ্ট্রনীতির মুখ্য রূপকার বলা যায় না।
কূটনীতির কার্যাবলী বর্ণনা কর।
অথবা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে কূটনীতির ভূমিকা পর্যালোচনা কর।
উত্তর। অধ্যাপক মরগেনথাউ কূটনীতির চারটি প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা—
(১) নিজ দেশের বাস্তব ও সম্ভাব্য ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতি জাতীয় লক্ষ্য স্থির করবে এবং সেই লক্ষ্যে পৌছাবার চেষ্টা করবে ;
(২) কূটনীতি অন্যান্য দেশের লক্ষ্য অনুধাবন করবে এবং ঐ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের বাস্তব ও সম্ভাব্য ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করবে;
(৩) ঐসব লক্ষ্য পরস্পরের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ কূটনীতি তা নির্ধারণ করবে ; এবং
(৪) নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কূটনীতি উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
এইসব দায়িত্ব ঠিক ঠিক ভাবে পালনের ওপর একটা দেশের কূটনীতির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্যাপারটি খুব সহজ নয়। কোথাও কোন ভুল হলে বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়। মর্গেন্থাউ বলেছেন, যদি কোন দেশ নিজ দেশের ক্ষমতা পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয় অথবা অন্য দেশের ক্ষমতার ভুল পরিমাপ করে তাহলে উভয়ক্ষেত্রেই যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে যায়।
বাস্তবিকই নিজ দেশের ক্ষমতা অতিরঞ্জিত করে ভেবে এবং অন্য দেশের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার জন্যই নাৎসী জার্মানি ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং নিজের পতন ডেকে এনেছিল।
জোসেফ গ্রেউ বলেছেন, কূটনীতিবিদেরা প্রধানত দু’ধরনের কাজ করে থাকেন। প্রথমত, যে দেশে নিযুক্ত আছেন সেই দেশের অবস্থা, মানসিকতা, কার্যাবলী এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভালভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেন এবং ঐসব বিষয় নিজ দেশের সরকারকে জানান।
দ্বিতীয়ত, তিনি যে দেশে নিযুক্ত আছেন সেই দেশের সরকারকে নিজ দেশের সরকারের উদ্দেশ্য এবং আশা-আকাঙ্খা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেন। কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের দুটি দেশের ক্ষমতা ও আদর্শের পারস্পরিক সামঞ্জস্যবিধানের মাধ্যমরূপে গণ্য করা হয়।
অধ্যাপক মরগেনথাউ কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের তিন ধরনের কাজের উল্লেখ করেছেন :
(ক) প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব
(খ) আইনগত প্রতিনিধিত্ব ; এবং
(গ) রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব।
প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব :
কূটনীতিবিদেরা তাঁদের নিজ নিজ দেশের প্রতীকী প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। প্রতীকী প্রতিনিধি হিসাবে কূটনৈতিক মিশনগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোজসভার আয়োজন করেন এবং অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করেন। যে দেশে তিনি নিযুক্ত আছেন, সেই দেশের সরকারি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হলে কূটনৈতিক প্রতিনিধি সেইসব অনুষ্ঠানে নিজ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করেন। কোন বিশেষ কারণে নিজ রাষ্ট্র যখন কোন বিদেশী রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানায় বা শোকবার্তা প্রেরণ করে বা কোন প্রতিবেদন প্রেরণ করে, তখন সেই দেশে নিযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমেই তা পাঠাতে হয়।
আইনগত প্রতিনিধিত্ব ঃ
বিদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণ নিজের দেশের আইনগত প্রতিনিধি হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। আইনগত প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্রদূতকে বিদেশী রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা চালাতে হয় এবং প্রয়োজন হলে বিভিন্ন চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে হয়। অনেক সময় রাষ্ট্রদূত তাঁর সরকারের নির্দেশে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে থাকেন। রাষ্ট্রদূতেরা বিদেশে নিজের দেশের নাগরিকদের অধিকার ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। অনেক সময় তাঁরা দেশের আইনগত প্রতিনিধি হয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ঃ
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক কাজই হল কূটনীতিবিদদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যে দেশে তাঁরা নিযুক্ত থাকেন সেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য সম্পৰ্কীয় নীতি, সামরিক প্রস্তুতি, জনমত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁদের বিস্তারিত সংবাদ আহরণ করতে হয়। তাঁদের নিজের দেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি ও আদর্শ বিদেশে প্রচার করা এবং সেই সব নীতি ও আদর্শের সমর্থনে জনমত গঠন করা রাষ্ট্রদূতদের একটি বিশেষ দায়িত্ব। কূটনীতিবিদেরা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা নিজের দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বিবাদের মীমাংসা করেন এবং পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তি ও হৃদ্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করেন। বস্তুত একজন সুদক্ষ কূটনীতিবিদ বিদেশে তাঁর নিজ দেশের সুনাম, সম্মান ও প্রভাব রক্ষার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকেন।
উপরোক্ত কাজগুলি ছাড়াও কূটনীতিবিদদের অন্যান্য বহু কাজ সম্পাদন করতে হয়। যেমন—
তথ্য সংগ্রহ :
কূটনীতিবিদেরা যে দেশে নিযুক্ত সেই দেশ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা তাদের অন্যতম প্রধান কাজ। এব্যাপারে অনেক সময় তাঁরা গোয়েন্দাদের সাহায্য গ্রহণ করেন। সংবাদ সংগ্রহের কাজে কূটনীতিবিদগণ অনেক সময় কিছু অভিজ্ঞ কর্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করে থাকেন। সংগৃহীত তথ্য তাঁদের নিজ দেশের সরকারের নিকট প্রেরণ করতে হয়।
পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সাহায্যদান :
কূটনীতিবিদদের প্রেরিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে কোন একটি দেশ তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে। বলা বাহুল্য কোন দেশের বিদেশ নীতির সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকখানি নির্ভর করে কূটনীতিবিদ কর্তৃক প্রেরিত সংবাদ ও তার বিশ্লেষণের ওপর। পামার ও পারকিস এই জাতীয় সংবাদ বা প্রতিবেদনকে বৈদেশিক নীতির কাঁচামাল হিসাবে
গণ্য করেছেন। বস্তুতপক্ষে, কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চোখ, কান ইত্যাদি হিসাবে কাজ করেন।
আলাপ-আলোচনা ঃ যে দেশে নিযুক্ত আছেন সেই দেশের সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করা হল কূটনীতিবিদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির খসড়া রচনা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিময় নিয়ন্ত্রণ, ভ্রমণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় এই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
অন্যান্য : এছাড়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কূটনীতিবিদ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কূটনীতির কার্যাবলী ও দায়িত্বের পরিধি বহুদূর বিস্তৃত। বস্তুত বর্তমানে আন্তঃরাষ্ট্রীয় নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতিবিদদের কাজের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।