গণপরিষদের গঠন, প্রকৃতি ও কার্যাবলীর উল্লেখ কর
গণপরিষদের গঠন, প্রকৃতি ও কার্যাবলীর উল্লেখ কর
গণপরিষদের গঠন,
প্রশ্ন । গণপরিষদের গঠন, প্রকৃতি ও কার্যাবলীর উল্লেখ পূর্বক ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়টি আলোচনা কর।
গণপরিষদের গঠন:
উত্তর।
গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে একটি সংবিধান রচনার কাজ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতের সংবিধান ভারতীয়দের দ্বারা রচিত হবে—এ ধরনের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা উচ্চারিত হয়ে আসছিল।
ক্রমশ এই দাবি জোরাল হয়ে উঠলে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ইংরেজ সরকার চার্চিলের মন্ত্রিসভার সদস্য স্টাফোর্ড ক্রিসকে ( Stafford Cripps) ভারতে পাঠান। ক্রিস প্রস্তাব করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর সংবিধান রচনার জন্য একটি নির্বাচিত সংস্থা গঠন করা হবে।
যুদ্ধ শেষ ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইংরেজ সরকার পুনরায় ক্রিপসের নেতৃত্বে একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠায় ভারতবর্ষে। ১৬ই মে এই ক্যাবিনেট মিশন তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব করে যে, সীমিত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত প্রাদেশিক আইন সভার সদস্যগণই গণপরিষদের সদস্যগণকে নির্বাচিত করবেন।
এই ক্যাবিনেট মিশন আরও প্রস্তাব করে যে হিন্দু, মুসলমান ও শিখ এই তিনটি সম্প্রদায় নিজেদের সংখ্যা অনুযায়ী গণপরিষদে নিজেদের প্রাদেশিক প্রতিনিধি প্রেরণ করবে। এই প্রস্তাবে দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে মনোনয়নের ভিত্তিতে ৯৩ জন প্রতিনিধিকে গণপরিষদে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠনের দীর্ঘদিনের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবগুলির অধিকাংশই মেনে নিতে সম্মত হন। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে গণপরিষদের সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
গণপরিষদের মোট ৩৮৯ জন সদস্যের মধ্যে ২৯২ জন সদস্য নির্বাচিত হন বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভাগুলির সদস্যদের দ্বারা এবং ৪ জন চীফ কমিশনার শাসিত অঞ্চল থেকে। বাকি ৯৩ জন সদস্য মনোনয়নের ভিত্তিতে দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে প্রেরিত হন। ২৯৬টি নির্বাচিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস দল ২০৮টি আসন লাভ করে। অর্থাৎ গণপরিষদের কংগ্রেস দল ৬৯ শতাংশ আসন লাভ করে।
গণপরিষদে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টি আসন দখল করে মুসলিম লীগ প্রার্থীরা। বাকি ১৫টি আসনে (৭টি সংরক্ষিত এবং ৮টি অসংরক্ষিত) ইউনিয়নিস্টরা ১ জন, ইউনিয়নিস্ট মুসলিমরা ১ জন, ইউনিয়নিস্ট তফসিলী জাতিগুলির একজন, কৃষক প্রজা পার্টির একজন, তফসিলী জাতি ফেডারেশন ১ জন, অকংগ্রেসী শিখরা ১ জন, কমিউনিস্টরা ১ জন এবং নির্দলীয়রা ৮ জন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর মুসলিম লীগ প্রতিনিধিরা পৃথক গণপরিষদ গঠনের দাবিতে গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করলে গণপরিষদে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৮২ শতাংশে দাঁড়ায়। এইভাবে গণপরিষদ কার্যত কংগ্রেস-পরিষদে পরিণত হয়।
অধিবেশন:
গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ সালের ৯ই ডিসেম্বর সচ্চিদানন্দ সিং-এর সভাপতিত্বে। ২৩শে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলে। ১১ই ডিসেম্বর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে গণপরিষদের স্থায়ী চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ১৩ই ডিসেম্বর গণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতীয় সংবিধানের উদ্দেশ্য বিষয়ক প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এগুলির বেশিরভাগই সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৪৭ সালের ২০শে জানুয়ারি গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশন চলে ২৫শে জানুয়ারি পর্যন্ত। এই অধিবেশনে কতকগুলি কমিটি গঠিত হয়, যথা কার্যনির্বাহক কমিটি (Steering Committee), কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কিত কমিটি, মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত পরামর্শদাতা কমিটি, সংখ্যালঘু সম্পর্কিত উপদেষ্টা কমিটি ইত্যাদি।
১৯৪৭ সালের ২২শে এপ্রিল এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুলাই যথাক্রমে গণপরিষদের তৃতীয় ও চতুর্থ অধিবেশন বসে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে গণপরিষদ একটি সার্বভৌম পরিষদে পরিণত হয়।
গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। এই অধিবেশনের শুরুতেই মাউন্টব্যাটনকে স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত করা হয় এবং জওহরলাল নেহরুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।
পঞ্চম অধিবেশনে সংবিধান রচনাকারী গণপরিষদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্পর্কিত বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এখন থেকে গণপরিষদ সংবিধান রচনার সঙ্গে সঙ্গে আইনসভা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করবে। এই অধিবেশনে ২৯শে আগস্ট একটি খসড়া সংবিধান রচনার জন্য একটি খসড়া কমিটি (Drafting Committee) গঠন করা হয়।
ডঃ বি. আর. আম্বেদকার (Dr. B. R. Ambedkar)-কে এই কমিটির সভাপতি করা হয়। আম্বেদকার ছাড়া এই কমিটিতে ছিলেন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, এ. কে. আয়ার, কে. এম. মুন্সী, ডি. পি. খৈতান, বি. এল. মিত্র প্রমুখেরা।
খসড়া কমিটি সংবিধানের খসড়া রচনার কাজ শুরু করে ১৯৪৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর থেকে। ১৯৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবিধানের খসড়া গণপরিষদে পেশ করা হয় এবং একই সঙ্গে জনমত যাচাই করার জন্য খসড়াটিকে দেশের প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশ করা হয়।
প্রায় আট মাস যাবৎ দেশের জনগণকে এই খসড়া সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা করার এবং সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়। খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার সময় মোট ৭, ৩৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত ২,৪৭৩টি সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এবং বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধিত ও সংযোজিত হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে ৩৯৫টি ধারা ও ৮টি তফসিল অনুমোদিত হয়। অবশেষে ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের স্বাক্ষরক্রমে ভারতীয় সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়।
১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারি গণপরিষদের সবশেষ অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভারতের সংবিধান রচনার কাজটি খুব সহজে রাতারাতি সম্পন্ন হয়ে যায় নি। এটি দীর্ঘ সময় ও শ্রমের ফলশ্রুতি। এটি রচনা করতে সময় লেগেছে মোট ২ বছর ১১ মাস ১৭ দিন, অর্থাৎ প্রায় ৩ বছর। গণপরিষদের মোট ১১টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং অধিবেশনগুলি সাকুল্যে ১৬৫ দিন ধরে চলে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, গণপরিষদের প্রথম ৬টি অধিবেশনে সরাসরি সংবিধান রচনার কাজ হয়নি, সংবিধান রচনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সংবিধানের খসড়া রচনার পর থেকেই গণপরিষদ সংবিধান রচনার কাজে সরাসরি আত্মনিয়োগ করে।
মূল্যায়ন :
স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান রচনার কাজ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ এই কাজের মধ্য দিয়েই প্রমাণ হয়েছিল যে, ভারতীয় জনগণই ভারতের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের একমাত্র অধিকারী। কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে যে গণপরিষদ গঠিত হয় তার গঠন ও কাজের প্রকৃতি বিষয়ে নানা সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করা হয়।
প্রথমত, গণপরিষদের কোন গণভিত্তি ছিল না বলে অভিযোগ করা হয়, কারণ সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নয়, সমগ্র ভারতীয় জনসাধারণের মাত্র ১৪% লোকের দ্বারা যে প্রাদেশিক আইনসভাগুলি গঠিত হয়েছিল, সেগুলির মধ্য থেকে গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ বাছাই করা হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, তত্ত্বগতভাবে গণপরিষদ সংবিধান রচনার প্রধান কার্যক্ষেত্র হলেও প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিই ছিল এর মূল স্রষ্টা। এই প্রসঙ্গে Austin-এর একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৃতীয়ত, সমালোচকদের মতে, ‘আমরা ভারতের জনগণ’ সংবিধান রচনা করেছে বলে যে দাবি করা হয় তা অযৌক্তিক, কারণ মূলত সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল।
চতুর্থত, রাজন্যবর্গের প্রতিনিধিস্বরূপ ৯৩ জন সদস্যকে মনোনয়নের ভিত্তিতে গণপরিষদে স্থান দেওয়ার বিষয়টিকে অনেকেই অগণতান্ত্রিক এবং সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আপস করার প্রচেষ্টা বলে মনে করেন।
পঞ্চমত, গণপরিষদের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের দাবিকে মেনে নিয়ে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদে পা বাড়িয়েছিলেন বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।
ষষ্ঠত, কেউ কেউ আবার গণপরিষদে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির প্রাধান্য (Elite domination) ও বৌদ্ধিক স্বৈরাচারের (Intellectual autocracy) প্রভাব লক্ষ্য করেছিলেন।
সপ্তমত, পণ্ডিত নেহরু, ডঃ আম্বেদকার, এ. কে. আইয়ার প্রমুখেরা মুখে ভারতের নিঃস্ব, দরিদ্র জনগণের জন্য করুণা প্রকাশ করেও শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া-জমিদারদের অনুকূলে শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন।
গণপরিষদে এক জনৈক সদস্য (শেঠ দামোদর স্বরূপ) গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই সংবিধান পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ হলেও, এই সংবিধান আইনজ্ঞদের স্বর্গ, এমনকি ভারতের পুঁজিপতিদের পক্ষে মহাসনদ হলেও, ভারতের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র শ্রমজীবী, খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, মানুষের স্বার্থরক্ষার কোন ব্যবস্থা সংবিধানে নেই।”
তবে গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান রচনার বিষয়টিকে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, সমকালীন অবস্থা ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে উপরোক্ত সমালোচনাগুলিকে সমর্থন করা যায় না। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠন করতে গেলে অহেতুক সময় নষ্ট হত এবং বিপুল অর্থের অপচয় হত।
যেসব ব্যক্তি গণপরিষদে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সমকালীন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা ; সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটের ব্যবস্থা হলে তাঁরাই গণপরিষদে নির্বাচিত হতেন। তাছাড়া গণপরিষদে কংগ্রেস দলের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য থাকায় একদিকে যেমন সংবিধান রচনার কাজে খুব একটা বিঘ্ন বা বিলম্ব ঘটে নি, অন্যদিকে তেমনি দেশের সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিতে পারে নি।
পরিশেষে, সংবিধান প্রবর্তিত হবার পর ১৯৫২ সালের সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যে নতুন কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠিত হয়, সেই আইনসভা যখন সংবিধানটিকে অপরিবর্তিত অবস্থায় গ্রহণ করে, তখন থেকেই ভারতীয় সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা ও গণপরিষদের গণচরিত্র সম্পর্কে সমস্ত সন্দেহের অবসান ঘটে।