কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন এর ভূমিকা আলোচনা কর teacj sanjib
কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন এর ভূমিকা আলোচনা কর teacj sanjib
ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন আলোচনা কর।
কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন: প্রশ্ন । ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা আলোচনা কর।
কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন: উত্তর। বিংশ শতাব্দীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক হইতে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে এবং জাতীয় আন্দোলনের বৃহত্তর স্রোতধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হইয়া উঠিল।
শ্রমিক-আন্দোলনের সূচনা
উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতে শ্রমিক-আন্দোলনের সূচনা হইলেও তাহার গতি ছিল শ্লথ ও বিক্ষিপ্ত, বিংশ শতকের সূচনায় শ্রমিক-আন্দোলন প্রথম জঙ্গী আকার ধারণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বাইর শ্রমিক-আন্দোলন।
এই প্রথম জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক-আন্দোলনের সংযোগ দেখা যায়। লোকমান্য তিলকের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বোম্বাই-এ ২৩শে জুলাই ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ সমস্ত কলকারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক ধর্মঘটে নামেন। তাঁহারা পুলিশের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হইলেন। ইহার ফলে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন। লেনিন এই শ্রমিক আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন।
কৃষক-আন্দোলনের প্রসার :
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক হইতে বলিষ্ঠ কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করে। মহাত্মা গান্ধী কৃষক-আন্দোলনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বিহারের চম্পারণ জেলার নীলকরদের বিরুদ্ধে নিরীহ কৃষকদের সত্যাগ্রহ পরিচালনা করিয়া জয়যুক্ত হন। গুজরাটেও তিনি কৃষক-আন্দোলন সংগঠিত করিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় গুজরাটের বারদৌলিতে বল্লভভাই প্যাটেল এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করিয়া তোলেন এবং কৃষকগণ খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে খাজনা দেওয়া বন্ধ করিল। অবশেষে এই আন্দোলন সাফল্য লাভ করে এবং বল্লভভাই ‘সর্দার’ নামে পরিচিত হইলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার মেদিনীপুর জেলায় বীরেন্দ্র নাথ শাসমলের নেতৃত্বে গ্রামের কৃষকগণ ইউনিয়ন বোর্ডগুলির ধার্যকর দিতে অস্বীকার করে। অবশেষে এই কর বন্ধ আন্দোলন সাফল্য লাভ করে।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়, রায়বেরিলী, ফৈজাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষকেরা বিদ্রোহী হইয়া দোকানপাট লুঠ করিতে শুরু করে এবং পুলিশের সহিত সংঘর্ষে বহু কৃষক নিহত হয়।
১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে আইন-অমান্য আন্দোলন শুরু হইলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গী কৃষক-আন্দোলন দানা বাঁধে। আইন অমান্য আন্দোলনের অংশ হিসাবে যুক্তপ্রদেশে কৃষকদের খাজনা বন্ধ আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কংগ্রেসের সমাজবাদী নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। যুক্তপ্রদেশের কৃষক-আন্দোলনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশেও কৃষক-আন্দোলন দেখা যায়। দক্ষিণ-ভারতের অন্ধ্র ও মালাবার অঞ্চলে কৃষক-আন্দোলন বেশ প্রসার লাভ করে। মালাবারে কৃষক-আন্দোলন পরিচালনায় পি. কৃষ্ণ পিল্লাই ও এ. কে. গোপালন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এদিকে ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী নেতাগণ যেমন—নরেন্দ্র দেব, জয়প্রকাশ নারায়ণ কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ( Congress Socialist Party) গঠন করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ভারতের শ্রমিক-আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে দেশের সর্বত্র যে অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখা দেয় তাহার চাপে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তাহা শ্রমিকশ্রেণীকেও প্রভাবিত করে।
১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে বি. পি. ওয়াদিয়া প্রতিষ্ঠিত ‘মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন’ ভারতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ইহার পর ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্ন ভাবে যে শ্রমিক আন্দোলন সূচিত হয় তাহা এক সর্বভারতীয় সাংগঠনিক চরিত্র গ্রহণ করিল। নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায়। তাঁহার মতে ভারতীয় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রসারিত করাই ছিল এই সংগঠনের লক্ষ্য।
এদিকে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও সমাজতন্ত্রী আদর্শ প্রসার লাভ করে এবং জওহরলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসু জঙ্গী শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখের নেতৃত্বে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি (Congress Socialist party) গঠিত হয়। ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জওহরলাল নেহরু ও ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হইলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে নেহরু কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে সমাজতন্ত্রবাদী আদর্শের কথা ঘোষণা করেন।
ইতিমধ্যে কমিউনিস্টদের কৃষক-আন্দোলনে সাম্যবাদী প্রভাব বেশ প্রসার লাভ করে। ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ওয়ার্কার্স অ্যাণ্ড পেজেন্টস পার্টি (Workers and Peasants Party) প্রতিষ্ঠা করে এবং সক্রিয়ভাবে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ত্রিশের দশকের গোড়াতে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ হ্রাস পায়। এই পরিস্থিতিতে কৃষকেরা জমিদারী-প্রথার বিলোপ, খাজনা ও অন্যান্য করের মাত্রা হ্রাস ও মহাজনদের অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানাইতে থাকে।
কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যুক্তপ্রদেশ, বিহার, মাদ্রাজ, অন্ধ্র, কেরালা ও পাঞ্জাবে কিষাণসভা প্রতিষ্ঠিত হয়! ইহার পর সর্বভারতীয় ভিত্তিতে কৃষকসভা গঠনের প্রয়াস শুরু হয়। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ-ভারতীয় কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক যুগ্ম-সংস্থা (South Indian Federation of Peasants and Agricultural labour) গঠিত হয়। এন. জি. রঙ্গ এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। অবশেষে ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে নিখিল ভারত কৃষকসভা গঠিত হইবার ফলে সমাজের মধ্যে নূতন রাজনৈতিক জাগরণ দেখা যায়। কৃষকগণ জমিদারী-প্রথা ও সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকসভার নেতৃত্বে সংগ্রামে অবতীর্ণ হইল।
স্বাধীনতা-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ভারত-ছাড় আন্দোলনে কৃষকগণ সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। মেদিনীপুর, মহারাষ্ট্রের সাতারা প্রভৃতি স্থানে বিদেশী শাসনের অবসান কল্পে কৃষকগণ তৎপর হইয়া উঠে। মেদিনীপুরে বৃদ্ধা কৃষক রমণী মাতঙ্গিনী হাজরা, রামচন্দ্র বেরা প্রমুখের অবদান চিরস্মরণীয়। ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে (১৯৪৬-৪৭খ্রীষ্টাব্দ) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষত দিনাজপুর, মেদিনীপুর ও যশোহরে ঐতিহাসিক ‘তেভাগা আন্দোলন’ সংগঠিত হয়।
এই আন্দোলনে দিনাজপুরের আদিবাসী সম্প্রদায় অগ্রণী ভূমিকা লয়। এই আন্দোলনে হাজার হাজার কৃষক গ্রেপ্তার হলেন এবং ৫০ জন কৃষক প্ৰাণ বিসর্জন দেন। এইভাবে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউ সুদূর গ্রামাঞ্চলেও প্রসার লাভ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম নবরূপ ধারণ করে। একই সময়কালে দক্ষিণ-ভারতের দেশীয় রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর কোচিনের পুন্নাপ্রা বয়ালার অঞ্চলে কৃষকেরা সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। ইহার ফলে ৮০০ কৃষক নিহত হন।
শ্রমিক-আন্দোলনের ব্যাপ্তি ঃ
১৯২০-র দশকেই ভারতে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শ প্রসার লাভ করে। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে দেশে কমিউনিস্ট কার্যকলাপের সূত্রপাত হয়। বিপ্লবী মানবেন্দ্র রায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন এবং ভারতের অভ্যন্তরে মুজাফ্ফর আহম্মদ, এস. এ. ডাঙ্গে, শওকত ওসমানী প্রমুখ নেতা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা করেন।
১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে কানপুরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার পর কমিউনিস্টগণ শ্রমিক-আন্দোলনে বিশেষ প্রভাবশালী হইয়া উঠে। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে কমিউনিস্টরা ‘ওয়ার্কার্স অ্যাণ্ড পেজেন্টস পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করে এবং সক্রিয়ভাবে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে যোগদান করিতে থাকে। জাতীয় কংগ্রেসের বামপন্থী অংশও শ্রমিক-আন্দোলনে যোগদান করিতে লাগিল।
১৯২৮-২৯ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বব্যাপী মন্দার অজুহাতে মিল মালিকগণ শ্রমিকদের সংগঠন ধ্বংস করিতে উদ্যোগী হয়। ফলে দেশব্যাপী দেখা দিল শ্রমিক বিক্ষোভ ও ধর্মঘট। ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দুই শতের বেশী শিল্পে ধর্মঘট হইয়াছিল। বোম্বাইয়ের কাপড় কলের শ্রমিকেরাই এই সকল শিল্পে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেয়। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পরিচালিত গিরণী কামগার ইউনিয়ন বোম্বাইয়ের এই ঐতিহাসিক ধর্মঘটে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এই ধর্মঘটে প্রায় দেড়লক্ষ শ্রমিক দীর্ঘ ছয়মাস যাবৎ অংশ গ্রহণ করিয়াছিল। বাংলাদেশের চটকলগুলিতে সাধারণ ধর্মঘট ঘোষিত হইল।
জামসেদপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় ও রেলওয়ে কারখানাগুলিতেও ধর্মঘট দেখা দেয়। শ্রমিকদের বিপ্লবী মনোভাব ধ্বংস করিবার জন্য সরকারের আদেশে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে ৩৩ জন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতাকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দী করা হয় (মার্চ, ১৯২৯ খ্রীঃ)। ইহাদের অধিকাংশ ছিল কমিউনিস্ট এবং তাঁহারা কুখ্যাত মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত হইলেন।
মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে মুজফ্ফর আহম্মদ, ডাঃ জি. অধিকারী, পি.সি যোশী, এস.এ. ডাঙ্গে, এস.এস. মিরাজকর, শওকত ওসমানী, ধরণী গোস্বামী, ফিলিপ স্প্রাট্, বি. এফ. ব্রাডলে প্রমুখ দেশী-বিদেশী শীর্ষস্থানীয় কমিউনিস্ট নেতারা ছিলেন। বিচারে ২৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া নানারূপ দণ্ডে দণ্ডিত করা হইল (জানুয়ারী, ১৯৩৩ খ্রীঃ)। যাহা হউক অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভারতীয় জনমতের সমর্থন লাভ করে।
জওহরলাল এই বিচারকে “শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের আক্রমণ” বলিয়া অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কমিউনিস্টগণ “রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস” নামে পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
অপরদিকে পি.সি. যোশী, ডঃ জি. অধিকারী প্রমুখের নেতৃত্বে বে-আইনী অবস্থায় কমিউনিস্ট আন্দোলন সুসংহত হইতে থাকে এবং কারাগারে বন্দী বিপ্লবীরা সাম্যবাদী ও গণ-আন্দোলনের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া উঠিল। কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা-বিস্তারে এই সকল দল অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে নিখিল ভারত কিষাণসভা গঠিত হইলে কৃষক-আন্দোলনের জন্য একটি সর্বভারতীয় সঙ্ঘ স্থাপিত হয়।
১৯৩৭-৩৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভারতে শ্রমিক-আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সংহতি ও শক্তি বৃদ্ধি পাইতে থাকে। কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট শ্রমিক সংগঠনগুলি যৌথভাবে শ্রমিক-আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করিতে লাগিল। ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে নথিভুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৫৬৮ এবং শ্রমিক সদস্যসংখ্যা ছিল ৩,৯৯,১৫৯, ১৯৪৫-৪৬ খ্রীষ্টাব্দে নথিভুক্ত ইউনিয়নের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়া দাঁড়াইল ১,০৮৭ এবং সদস্যসংখ্যা হইল ৮,৬৪,০৩১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হইবার পর ভারতের শ্রমিকশ্রেণী ব্যাপক আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়।
১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে ১,৬২৯ টি শ্রমিক ধর্মঘট হয় এবং ১,২৭,১৭,৭৬২ শ্রমিক এই সকল ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে। দুঃখের বিষয় এই সময় শ্রমিক-আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করিলেও শ্রমিক-আন্দোলনের সংহতি বিনষ্ট হইয়া গেল। নিখিল ভারত ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেস হইতে জাতীয় কংগ্রেস বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত লয় এবং নিখিল ভারত জাতীয় ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেস নামক স্বতন্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় (মে, ১৯৪৭ খ্রীঃ)।
এইভাবে দেখা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক হইতে ভারতে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন প্রসার লাভ করে, পাশাপাশি কমিউনিস্ট ও সমাজবাদী আন্দোলনও সক্রিয় হইয়া উঠে। এইসব আন্দোলনের ফলে ভারতীয় মুক্তি-সংগ্রাম ক্রমশ শক্তিশালী হইয়া উঠিল এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চশ্রেণী ও মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রহিল না। তাহা ছড়াইয়া পড়িল গ্রামে, গঞ্জে, মাঠে ও কারখানায়।