ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা আলোচনা কর Teacj Sanjib

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা আলোচনা কর Teacj Sanjib

ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকদের ভূমিকা

প্রশ্ন । খ্রীষ্টাব্দের ফরাসী বিপ্লবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা,

ফরাসী বিপ্লবের আগমনে দার্শনিকদের প্রভাব কতদূর ছিল?

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা: উত্তর। রেনেসাঁসের সময় হইতে ইওরোপে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জ্ঞানদীপ্তির যুগে এই মানবতাবাদী ধারা আরও পরিপুষ্ট হইয়াছিল। ফ্রান্সের সাহিত্যিক ও দার্শনিকগণ অষ্টাদশ শতাব্দীর চিন্তাজগতে প্রধান ভূমিকা লইয়াছিলেন।

এই সকল সাহিত্যিক ফ্রান্সের সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের অসাম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করিয়া যে বৈপ্লবিক ভাবতরঙ্গের সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহাতে সমগ্র জাতির প্রাণশক্তি জাগরিত হইয়া উঠে। দীর্ঘকাল ধরিয়া অসাম্য ও অনাচারপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে শোষিত, নিপীড়িত ফরাসী জনগণের মনে যে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হইয়াছিল, ফরাসী সাহিত্যিকগণের রচনার মাধ্যমে তাঁহাদের ভাবাদর্শের সংস্পর্শে আসিয়া তাহা বিপ্লবের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করিল।)

ফরাসি-বিপ্লবে-দার্শনিকদের-ভূমিকা-আলোচনা-কর-Teacj-Sanjib

সমাজ জীবনের নানাবিধ বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করিয়া তাঁহারা ফরাসী জাতির মধ্যে তাহাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিয়াছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম-জীবনের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত অনাচার ও অবিচারের তীব্র সমালোচনা করিয়া তাহারা প্রচলিত ব্যবস্থার ভিত্তি শিথীল করিয়া দেন।

বিপ্লবী সাহিত্যিকগণের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন মন্টেস্কু (Montesquieu), ভল্টেয়ার (Voltaire); রুশো (Rousseau) ও দিদেরো (Diderot)।

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা: মন্টেস্কু

মন্টেস্কু ছিলেন ইংল্যাণ্ডের নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সমর্থক। তিনি তাঁহার বিখ্যাত ‘Spirit of Law’ নামক গ্রন্থে রাজার ভগবান-প্রদত্ত ক্ষমতার (Divine right of king) তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে শাসনতন্ত্রে আইন, শাসন ও বিচারবিভাগকে পৃথক রাখার পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। তাঁহার রচনা পাঠ করিয়া শিক্ষিত ফরাসী জনসাধারণ নিয়মতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রয়োজন উপলব্ধি করিলেন।

ভলটেয়ার:

ভলটেয়ার ছিলেন প্রগতিবাদী ও যুক্তিবাদী। শুধু সমালোচক হিসাবেই নয়, নাট্যকার ও ঐতিহাসিক হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। শ্লেষাত্মক রচনায়ও তিনি কুশলী ছিলেন। যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি ছাড়া কোন কিছুকেই গ্রহণ করা তাঁহার স্বভাব-বিরুদ্ধ ছিল।

তিনি তাহার লেখনী চালনা করিয়া স্বচ্ছ, তীব্র ও ক্ষুরধার ভাষায় রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে সকল অসাম্য ও অনাচার প্রবেশ করিয়াছিল, তাহার বিরুদ্ধে ফরাসী জনসাধারণের বিদ্বেষ সঞ্চারিত করেন। ভলটেয়ার

ভল্টেয়ার ইংল্যাণ্ডের নিয়মতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র সমর্থন করিলেও রাজনৈতিক মতবাদের দিক দিয়া প্রজাহিতৈষী রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, ভল্টেয়ার তাঁহার লেখনীর সাহায্যে প্রচলিত সংস্কার ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ফরাসী জনগণের বিদ্বেষ সঞ্চার করিয়া বিপ্লবের প্রেরণা যোগাইয়াছিলেন।

রুশো:

রুশো ফরাসী বিপ্লবের প্রেরণা ও আবেগ সৃষ্টিকারী মনীষীগণের মধ্যে রুশোর অবদান উল্লেখযোগ্য। রুশোর মতে সভ্যতার কৃত্রিম বিধিব্যবস্থা ত্যাগ করিয়া প্রকৃতির ক্রোড়ে সর্বপ্রকার বন্ধনমুক্ত সহজ, সরল জীবনযাপন করাই মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম বা আদর্শ।

তিনি তাঁহার ‘Discourse of Arts and Science’ নামক গ্রন্থে এই মতবাদই ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। আদিম যুগে মানুষের জীবন ছিল সহজ, সরল, শান্তিপূর্ণ ও সামাজিক বৈষম্যহীন। রুশোর মতে রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট সভ্যতার কৃত্রিম বিধিব্যবস্থাই মানুষের জীবনে দুঃখ ও অশান্তির কারণ।

সাম্যের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রই ছিল রুশোর আদর্শ। তাঁহার বিখ্যাত ‘Social Contract’ নামক গ্রন্থে তিনি এই মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি লিখিয়াছিলেন যে, সভ্যতার আদিম যুগে মানুষের স্বেচ্ছাকৃত চুক্তি অনুযায়ী একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের উপর রাজ্যশাসনের ভার অর্পিত হইত।

এই চুক্তির ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ থাকায় জনসাধারণ ছিল সুখী ও স্বাধীন। রুশোর মতে প্রজাবর্গের সম্মতির উপরই শাসকশ্রেণীর ক্ষমতা পরিচালনা নির্ভর করে। যেখানে এই পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যাহত হয়, জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত হয়, সেখানেই রাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

শাসকগোষ্ঠীর গণতন্ত্র-বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করিয়া রুশো আক্ষেপ করিয়া লিখিয়াছিলেন, “Man is born free, but everywhere man is in chains.” (মানুষ স্বাধীন হইয়া জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু মানুষ সর্বত্রই শৃঙ্খলাবদ্ধ)।
তাঁহার এই আবেগময়ী কথা ফরাসী জনগণকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। ভল্টেয়ার ছিলেন যুক্তিবাদী। রুশোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হৃদয়াবেগের উপর প্রতিষ্ঠিত।

দিদেরো

এ যুগে ফরাসী সাহিত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম মনীষী ছিলেন দিদেরো (Diderot)। তিনি সমসাময়িক পণ্ডিতগণের সহযোগিতায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ (Encyclopaedia) বা বিশ্বকোষ সঙ্কলন করিয়া মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করেন।

এই গ্রন্থে ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি বিশদভাবে আলোচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থ পাঠ করিয়া জনসাধারণের মনে প্রচলিত সমাজ দিদেরো রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছিল।

ফিজিওক্রাট:

এই যুগে “ফিজিওক্রাট (Physicrats) নামে একদল অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সমালোচনা করেন। তাহারা ‘Laissez Farire অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন।
তাঁহারা বাণিজ্য রক্ষার (Protection) বিরোধী ও অবাধ বাণিজ্যের (FreeTrade) সমর্থক ছিলেন। তাঁহাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে ফ্রান্সের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব সঞ্চারিত হইয়াছিল।

বিপ্লবের আগমনে দার্শনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায়। টেইন,
সেতোত্রিয়া প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ দার্শনিকদের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়াছেন। মাদেলার অভিমত হইল দার্শনিকগণ প্রচলিত ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করিয়া ফাটল সৃষ্টি করিয়াছিলেন।

ঐতিহাসিক রুদে (Rude) মনে করেন যে ফ্রান্সে ঐ সময় কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। এর পরিবর্তে দার্শনিকরা বিপ্লবী জনমত সংগঠিত করিয়াছিলেন। অন্যদিকে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে দার্শনিকগণ ফরাসী বিপ্লবের স্রষ্টা ছিলেন না। মনিয়র (Monier) মনে করেন সাধারণ মানুষ ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখের রচনা পড়িতেন না, তাই তাহারা এঁদের দ্বারা প্রভাবিত হন নাই।

মর্স স্টিফেনস্ মনে করেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে ফরাসী বিপ্লব ঘটিয়াছিল এবং ফরাসী বিপ্লবের উদ্ভবে ও গতিধারার উপর দার্শনিকদের প্রভাব ছিল নগণ্য। ডেভিড টমসনেরও বক্তব্য একই ধরনের।(তাঁহার অভিমত হইল, ফরাসী বিপ্লব সমকালীন বৈপ্লবিক পরিস্থিতির ফলশ্রুতি এবং এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না।

কিন্তু এই বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, তাঁহারা প্রচলিত ব্যবস্থার দোষ-ত্রুটিগুলি জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন এবং জনমত গঠনে সহায়তা করিয়াছিলেন।) ঐতিহাসিক উইলার্ট (Williart) মন্তব্য করেছেন যে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ফলে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুচ্চারিত, অবক্ত হইয়া মনের মধ্যে গুমরে উঠেছিল।
দার্শনিকেরা স্বাধীন চিন্তার পথে বাধা অতিক্রম করে অস্পষ্ট ধারণাগুলিকে ভাষা দান করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *