ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভূমি রাজস্ব নীতি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভূমি রাজস্ব নীতি ঃ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা:

ইস্ট-ইন্ডিয়া-কোম্পানির-ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা-ইংরেজ-ইস্ট-ইন্ডিয়া-কোম্পানির-আমলে-ভূমি-রাজস্ব-নীতি

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা: ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য এবং প্রশাসনের ব্যয় নির্বাহের জন্য ও রাজ্য বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় আয়ের উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। কিন্তু ১৭৬৫ ১৭৭২ খ্রিঃ পর্যন্ত কোম্পানীর রাজস্ব সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করে ১৭৭৩ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংস সরাসরি প্রজার কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করার নীতি গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশে ‘বোর্ড অফ রেভিনিউ’ গঠিত হয়। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু ছিল।

 পাঁচসালা বন্দোবস্ত :

ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের জন্য জেলাগুলিতে ভ্রাম্যমান কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটি নীলামে জমির বন্দোবস্ত করত। সর্বোচ্চ নীলামদারদের পাঁচ বছরের জন্য জমির স্বত্ব দেওয়া হত। এই ব্যবস্থা পাঁচসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। আর এই রাজস্ব কালেক্টরের মাধ্যমে আদায় হত। তবে এই ব্যবস্থায় যথেষ্ট ত্রুটি ছিল। ইজারাদারগণ রাজস্ব থেকে পাঁচ বছরের সময়কালে যতটা সম্ভব বেশি অর্থ কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করতেন, ফলে রায়তরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্যদিকে অনভিজ্ঞ ইংরেজ সংগ্রহকারীগণ রাজস্বের সমস্ত অর্থ আদায় করতে পারতেন না। দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারীগণ আবার তার সম্পূর্ণ অংশ কোষাগারে জমা দিতেন না। ১৭৭৩ খ্রিঃ চার সদস্যের রেভিনিউ বোর্ড গঠিত হয়। ঐ ব্যবস্থা সফল না হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়। ১৭৭৬ খ্রিঃ রাজস্ব ব্যবস্থা অনুসন্ধানের জন্য আমিনি কমিশন গঠিত হয়। হোস্টিংসএর শাসনকালে এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলি বিলুপ্ত হয়।

> একসালা বন্দোবস্ত ঃ

পাঁচসালা বন্দোবস্তের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতির ফলে হেস্টিংস পাঁচসালার পরিবর্তে বাৎসরিক ইজারার ব্যবস্থা চালু করেন, যা একসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এতে হেস্টিংস কালেক্টরের পরিবর্তে ভারতীয় দেওয়ান নিযুক্ত করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কোম্পানি এই বার্ষিক বন্দোবস্তে লাভবান হতে পারেনি। জমিদাররা নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব জমা দিতে পারত না। ফলে কোম্পানি রাজস্ব আদায় সম্পর্কে সংকটের সম্মুখীন হয়। এই কারণে ইংলন্ডের পার্লামেন্ট ১৭৮৪ খ্রিঃ-এ কোম্পানিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত :ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রচলিত রাজস্ব নীতির অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করেন। তিনি প্রথমে জেলার কালেক্টরদের জমি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়

তথ্য ও জমি জরিপ করার নির্দেশ দেন। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে সেইসব তথ্যের ভিত্তিতে জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য রাজস্ব বন্দোবস্ত করেন। পরে ডিরেক্টরদের অনুমতি নিয়ে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২শে মার্চ থেকে স্থির হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিতে পারলে (বছরের শেষ দিনের সূর্যাস্তের মধ্যে) জমিদারগণ বংশ পরম্পরায় চিরকালের জন্য জমির মালিকানা ভোগ করতে পারবেন। এই ব্যবস্থাই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত। মূলতঃ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাতেই এই ব্যবস্থা চালু হয়। সুফল ঃ এই ব্যবস্থাতেও কিছু সুফল কুফল লক্ষ্য করা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্ধারিত হলে জমিদার জমির মালিক হন এবং জমিদারি বংশাণুক্রমিক হয়। অবশ্য জমিদার সময়মতো রাজস্ব সরকারি তহবিলে জমা না দিলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হবার ফলে (১) কোম্পানি বছরের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিল। এতে কোম্পানির বাজেট স্থির করার সুবিধা হল। (২) জমিদাররা তাদের খাজনার সঠিক ভাবে পরিমাণ জানতে পারায় তাদেরও সুবিধা হয়েছিল। বেশি ফসল ফলাতে পারলে তাদের লভ্যাংশ বাড়বে তাই তারা জমির উন্নতিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। (৩) নতুন ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত ব্যয় কমে গিয়েছিল (৪) জমিদার জমির মালিক স্বীকৃত হওয়ায় অনেকেই কোম্পানির শাসনের সমর্থক হয়ে উঠেছিল। লর্ড কর্ণওয়ালিশ

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল ঃইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

(১) এই ব্যবস্থায় জমিদারদের রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত হলেও কৃষকদের কাছ থেকে জমিদারদের প্রাপ্য খাজনা নির্দিষ্ট না হওয়ায় কৃষকগণ নির্যাতিত হতে থাকেন। (২) জমিদার সম্প্রদায় নায়েব, গোমস্তা, পেয়াদাদের হাতে খাজনা আদায়ের ভার দিয়ে অলস, পরিশ্রমহীন জীবন শুরু করেন। এই সব কর্মচারীদের অত্যাচারে প্রজাদের দুর্দশা চরমে ওঠে। এই ব্যবস্থাই মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে। যার ফলে সার্বিকভাবে আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়। (৩) রাজস্ব স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট হওয়ায় কোম্পানি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজস্ব বাড়াতে পারত না, ফলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

O রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত ঃ

ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে মহীশূর মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির বহু জায়গায় রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত চালু হয়। প্রজাদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাকে রায়তওয়ারী ব্যবস্থা বলা হয়। এই ব্যবস্থায় কৃষককে জমির মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কুড়ি বা ত্রিশ বছর অন্তর খাজনার পরিমাণ পরিবর্তন করা হত। এই ব্যবস্থায় কোম্পানি নিজেই জমিদার হয়ে দাঁড়ায়। সরকার খুশীমত রাজস্ব বাড়াতে পারত। বন্যা ও খরার সময় প্রজারা রাজস্ব থেকে রেহাই পেত না। এই ব্যবস্থাতে রাজস্বের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। তাছাড়া স্বল্প বেতনের রাজস্ব আদায়কারী সরকারী কর্মচারীরা অবৈধভাবে বেতনের ঘাটতি পুষিয়ে নিতেন। রায়তয়ারী ব্যবস্থায় রায়তের অস্থাবর সম্পত্তি বা ঘটিবাটি ক্রোক করতে পারত। অথবা রায়তকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হত। এর ফলে কৃষকের দুঃখ দুর্দশা বাড়ে।

● মহলওয়ারী বন্দোবস্ত :ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

গঙ্গা উপত্যকা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যভারতের কিছু অঞ্চল এবং পাঞ্জাব প্রদেশে আর এক ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থা মহলওয়ারী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। কতকগুলি গ্রাম নিয়ে একটি মহল ধরা হত। মহলগুলির উপর এক বা একাধিক ইজারাদার দেওয়া হত। তাদের উপর আলাদা আলাদাভাবে রাজস্ব ধার্য হয়। এই ব্যবস্থায় রাজস্বের পরিমাণ মাঝে মাঝে বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। পাঞ্জাবে মহলওয়ারী ব্যবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন করে ভাইয়াচারী প্রথা চালু করা হয়। এই প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেক চাষীর উপর কর ধার্য করা হয় এবং খাজনা আদায়ের দায়িত্ব গ্রামের প্রধান ব্যক্তিকে দেওয়া হয়। এই প্রথায়ও কয়েক বছর পর পর রাজস্বের হার বৃদ্ধি করা হত। মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বোম্বাই ও উত্তর প্রদেশে মৌজাওয়ার বা মালগুজারি নামে আর এক ধরনের খাজনার ব্যবস্থা চালু ছিল। এই ব্যবস্থায় মালগুজারগণ খাজনা আদায় করে সরকারের কাছে দাখিল করার বিনিময়ে দস্তুরী পেত। এই ব্যবস্থায় গ্রামের প্রধান বা মোড়লকে পূর্ণ হস্তান্তরযোগ্য জমির মালিকানা দেওয়া হত। পরিশেষে বলা যায় যে ব্রিটিশ সরকারের এই ভূমি ব্যবস্থা ভারতের গ্রামীণ সমাজকে হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী

ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এই সব ব্যবস্থায় মহাজনী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ভূমি নীতি ভারতীয় কৃষককুলের জীবনে চরম সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসে।

– কৃষি অর্থনীতিতে ভাঙন :

ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই ভূমি রাজস্ব নীতির ফলে ভারতীয় কৃষকদের জীবনে চরম অভিশাপ নেমে আসে। ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করাই ছিল কোম্পানির একমাত্র লক্ষ্য। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে ভাঙন দেখা যায়। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ও কুটির শিল্পের ভাঙনের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে।

ইংরেজ কোম্পানির শাসনে ভারতের কৃষি এবং কৃষকের জীবনে নেমে এসেছিল সবচেয়ে বড় আঘাত। কৃষি প্রধান ভারতের ভূমি রাজস্বই ছিল কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস। কোম্পানির শাসনকালে ‘দাদনী প্রথার’ মাধ্যমে কৃষকরা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ত। দেশীয় কৃষকরা কৃষিজ পণ্য কোম্পানীকে সস্তায় বিক্রি করতে এবং বেশি দামে ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য কিনতে বাধ্য হত। রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে শস্যের পরিবর্তে নগদে রাজস্ব দেওয়ার রীতি কোম্পানি চালু করে। এই নগদ অর্থ জোগাড় করার জন্য কৃষকরা তাদের কৃষি পণ্য কোম্পানির লোকেদের সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হত।
উপরন্তু ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেত। এই অবস্থায় কৃষকদের জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা ও দুর্দশা। ফলে ভেঙ্গে পড়ল কৃষি ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি। কোম্পানির শাসনব্যবস্থায় গ্রামগুলি ছিল অবহেলিত। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদাররা হয়ে উঠল কৃষক শোষণের যন্ত্র। কৃষক ও গ্রামীণ সমাজ জমিদারদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সরকার, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারে নাভিশ্বাস উঠল গ্রামীণ প্রজাদের।

আবার পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনের কলকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যে ভারতীয় বাজার ছেয়ে গেল। বিলাতি পণ্য গ্রামাঞ্চলকেও গ্রাস করে ফেলে। কৃষকের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসায় কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে মাঝে মাঝে মানুষকে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হত। ফলে কৃষি অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে চলে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *