গণসাধারণতন্ত্রী চীনের নতুন সংবিধানের (১৯৮২) প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।

 গণসাধারণতন্ত্রী চীনের নতুন সংবিধানের (১৯৮২) প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর। [Describe the salient features of the new constitution of the People’s Republic of China (1982)]

গণসাধারণতন্ত্রী চীনের নতুন সংবিধানের

গণসাধারণতন্ত্রী-চীনের-নতুন-সংবিধানের-প্রধান-প্রধান-বৈশিষ্ট্যগুলি-আলোচনা-কর

 

চীনের ১৯৮২ সালের সংবিধান

] উত্তর। যে-কোন দেশের সংবিধান গড়ে ওঠে সেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৭৮ সালে গণসাধারণতন্ত্রী চীনের তৃতীয় সংবিধানটি গৃহীত হবার পর চীনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় এই পরিবর্তিত অবস্থার উপযোগী একটি নতুন সংবিধান রচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তদনুযায়ী ১৯৮২ সালে একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয়। ১৯৮২ সালের সংবিধানটিকে অনেকে পূর্ববর্তী সংবিধানগুলির বিকশিত রূপ বলে বর্ণনা করলেও, অনেক দিক থেকেই এই নতুন সংবিধানটি অভিনবত্ব দাবি করতে পারে। নিয়ে ১৯৮২ সালের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল :

 

গণসাধারণতন্ত্রী চীনের নতুন সংবিধানের বৈশিষ্ট্য (১) লিখিত সংবিধান : 

চীনের ১৯৮২ সালের সংবিধানটি লিখিত। এতে একটি দীর্ঘ প্রস্তাবনা ছাড়াও ১৩৮টি ধারা আছে। রাষ্ট্রের সাধারণ নীতি, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির গঠন, ক্ষমতা, কার্যাবলী, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নতুন সংবিধানটি ৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত : সাধারণ নীতিসমূহ (১-৩২ ধারা), নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য (৩৩-৫৬নং ধারা), রাষ্ট্রের কাঠামো (৫৭-১৩৫), জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক এবং রাজধানী (১৩৬-১৩৮নং ধারা)।

 

(২) দুষ্পরিবর্তনীয়:

 এই নতুন সংবিধানটি শুধু লিখিতই নয়, দুষ্পরিবর্তনীয়ও বটে। সংবিধানের ৬৪নং ধারা অনুযায়ী, জাতীয় গণ-কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি বা জাতীয় গণ-কংগ্রেসের এক-পঞ্চমাংশের বেশি ডেপুটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করার পর তা জাতীয় গণকংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক ডেপুটি কর্তৃক সমর্থিত হলে তবেই কেবলমাত্র সংশোধন করা যাবে।

 

(৩) সংবিধানের প্রাধান্য : 

প্রস্তাবনায় সংবিধানকে ‘রাষ্ট্রের মৌলিক আইন’ (fundamental law of the state) এবং ‘সর্বোচ্চ আইনগত ক্ষমতার অধিকারী’ (supreme legal authority) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া সংবিধানের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে যে, “কোন আইন বা প্রশাসনিক বা স্থানীয় নিয়মকানুন সংবিধানের বিরোধী হতে পারবে না”। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে, সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা, সামিরিক বাহিনী, রাজনৈতিক দলসমূহ, গণ-সংগঠন প্রভৃতিকে সংবিধান মেনে চলতে হবে। এছাড়া সংবিধানের ৫৩নং ধারায় প্রতিটি চীনা নাগরিককে সংবিধান মেনে চলা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

(৪) সংবিধানের তাত্ত্বিক ভিত্তি :

 নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনায় মাকর্সবাদ, লেনিনবাদ ও মাও জেদঙ্-এর চিন্তাধারাকে সংবিধানের তত্ত্বগত ভিত্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এবং মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাও জেদঙ্-এর চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত হয়ে সমগ্র চীনা জনগণ জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্বকে সুদৃঢ় করবে, সমাজতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করবে, শিল্প, কৃষি, জাতীয় প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার আধুনিকীকরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করবে। লক্ষনীয় বিষয় হল, ১৯৭৮ সালের সংবিধানের গণবিপ্লব, সংবিধানের বিবর্তন, প্রস্তাবনা, নীতি ও বৈশিষ্ট্য

 

২, ১৪ এবং ১৬নং ধারায় যেরূপ মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাও জেদঙ্-এর আদর্শকে অনুসরণের কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল, ১৯৮২ সালের সংবিধানের মূল অংশের কোথাও সেভাবে উপরোক্ত আদর্শগুলির উল্লেখ করা হয়নি।

 

(৫) এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র : 

সংবিধানের প্রস্তাবনায় চীনকে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ন্যায় চীনে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটেনি। সমগ্র চীনকে কতকগুলি প্রদেশ, স্বয়ংশাসিত ঞ্চল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন পৌরসভায় বিভক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও নিম্নস্তরের অসংখ্য সংস্থার কাজের মাধ্যমে ক্ষমতার বন্টন হয়েছে।

 

( গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা :

 গণসাধারণতন্ত্রী চীনের সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসরণ করে চলে। এর দ্বারা ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘কেন্দ্রিকতা’— এই দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। মাও জেদ বলেছেন, জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যেরূপ গুরুত্বপূর্ণ, শৃঙ্খলা ও কেন্দ্রিকতার গুরুত্বও তার থেকে কোন অংশে কম নয়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা অনুসারে— (ক) সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে নির্বাচিত হতে হয়, (খ) তাদের সকলকে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয় এবং (গ) অধস্তন সংস্থাগুলিকে ঊর্ধ্বতন সংস্থার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ মেনে চলতে হয়।

 

(৭) রাষ্ট্রের প্রকৃতি :(সংবিধানের ১নং ধারায় গণসাধারণতন্ত্রী চীনকে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত এবং শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্বের অধীন একটি সামজতান্ত্রিক রাষ্ট্র (a socialist state under the people’s democratic dictatorship) বলে ঘোষণা করা হয়েছে।) সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’কে প্রকৃতপক্ষে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ (dictatorship of the proletariat) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই জনগণতান্ত্রিক একনায়কত্বের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রকে বজায় রাখা হবে এবং জনগণের শত্রুর ওপর একনায়কত্ব কায়েম রাখা হবে। জিয়াং জেমিন (Jiang Zemin)-এর ভাষায় : “The people’s democratic dictatorship combines the exercise of democracy among the people with dictatorship over the enemies of the people.”

 

(৮) গণসার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠা :

 সংবিধানের ২নং ধারায় গণসার্বভৌমত্বের বাস্তব রূপায়ণের জন্য জনগণকেই সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করা হয়েছে (“All power in People’s Republic of China belongs to the people’- Art.2) । সংবিধানের ২৭নং ধারায় সকল রাষ্ট্রীয় সংগঠনকে জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে কাজ করার কথা বলা হয়েছে এবং ২৯নং ধারায় সামরিক বাহিনীকেও জনগণের সেবার জন্য কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

(৯) বহুজাতিক রাষ্ট্র : 

বর্তমান সংবিধানের প্রস্তাবনায় চীনকে একটি ‘বহুজাতিসম্পন্ন রাষ্ট্র’ (multi-national state) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে “All nationalities in the People’s Republic of China are equal”. রাষ্ট্রের কাজ হবে সকল জাতির মধ্যে সমতা, ঐক্য ও সহযোগিতার বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালানো। দেশের মধ্যে অবস্থিত সংখ্যালঘু জাতিগুলি যাতে তাদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করতে পারে রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে।

 

(১০) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : 

চীনের অর্থনীতি হল সমাজতান্ত্রিক। এখানে উৎপাদনের উপায়গুলির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সামাজিক মালিকানাকে আবার দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: (ক) সমগ্র জনগণের মালিকানা এবং (খ) শ্রমজীবী জনগণের যৌথ মালিকানা। অবশ্য সংবিধানে নাগরিকদের সীমিত পরিমাণে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। সংবিধানের ৮নং ধারায় বলা হয়েছে, গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমবায়গুলির সদস্যরা জমি ও পার্বত্যভূমি ব্যক্তিগতভাবে চাষ করতে পারে, পারিবারিক প্রয়োজনে সীমিতভাবে অন্যান্য উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে গবাদি পশু রাখতে পারে। রাষ্ট্র নাগরিকদের আইনসঙ্গতভাবে উপার্জিত আয়, সঞ্চয় ও অন্যান্য আইনানুগ সম্পত্তি অর্জনের অধিকার সুরক্ষিত করে। সংবিধানের ১১নং ধারায় নাগরিকদের উত্তরাধিকারসূত্রে সম্মতি অর্জনের অধিকার স্বীকার J করা হয়েছে।

 

সাম্প্রতিক কালে চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি বেসরকারী মালিকানাকে সহবস্থান করার এবং বিকশিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চতুদর্শ কংগ্রেসে চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এরূপ পুণর্বিন্যাসের মূলকথা হল ‘একটি সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ (a socialist market economy)-র প্রতিষ্ঠা। প্রস্তাবিত সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল : সমাজতান্ত্রিক মালিকানাকে মৌল মালিকানা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বীকার ও সমর্থন, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজারের সম্প্রসারণ, মালিকানা থেকে পরিচালন ব্যবস্থার পৃথকীকরণ এবং পরিচালন ব্যবস্থাকে সরকার থেকে স্বতন্ত্র করা, চীনের বাজারকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিকট উন্মুক্ত রাখা ইত্যাদি।

 

(১১) বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ :

 সংবিধানের ১৮নং ধারাতে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই ১৮নং ধারাটি ১৯৮২ সালের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এতে বলা হয়েছে, গণ-সাধারণতন্ত্রী চীনের আইন মেনে বিদেশী উদ্যোগগুলি, অন্যান্য বিদেশী অর্থনৈতিক সংগঠন এবং বিদেশীরা চীনে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবে। এছাড়া এই ধারায় বিদেশী উদ্যোগ, অর্থনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের সর্বপ্রকার আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার গ্যারান্টি প্রদান করা হয়েছে।

 

(১২) অর্থনৈতিক পরিকল্পনা :

 পূর্ববর্তী সংবিধানগুলির ন্যায় ১৯৮২ সালের সংবিধানেও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫নং ধারা অনুসারে “রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় মালিকানার ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে।” কোন সংগঠন বা ব্যক্তি যাতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে বিনষ্ট করতে না পারে সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। করতে

 

(১৩) শ্রমের গুরুত্ব : গণসাধরণতন্ত্রী চীনের বর্তমান সংবিধানে শ্রমের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সংবিধানের ৪২নং ধারায় বলা হয়েছে যে, “কাজ করা হল প্রত্যেক সক্ষম নাগরিকের গৌরবময় কর্তব্য”। সংবিধানের ২৭নং ধারায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সংস্থায় নিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কঠোর পরিশ্রম করাকে আবশ্যিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। চীনের প্রতিটি নাগরিকের কাজের অধিকার যেমন আছে, তেমনি কাজ করার কর্তব্যও আছে

 

20 গণবিপ্লব, সংবিধানের বিবর্তন, প্রস্তাবনা, নীতি ও বৈশিষ্ট্য

 

 

(১৪) পরিবার পরিকল্পনা : দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশকে সুনিশ্চিত করার জন্য এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে জনসংখ্যার সামঞ্জস্য বিধানের জন্য চীনের সংবিধানের ২৫নং ধারায় পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৪৯নং ধারায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীকে সাফল্যমণ্ডিত করা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য বলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

(১৫) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অস্বীকৃতি: গণসাধারণতন্ত্রী চীনে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখানে আইন সংক্রান্ত কাজ, শাসন সংক্রান্ত কাজ এবং বিচার সংক্রান্ত কাজ যথাক্রমে জাতীয় গণকংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় পরিষদ এবং সর্বোচ্চ গণ-আদালতের ওপর ন্যস্ত করা হলেও তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বর্তমান। সরকারের প্রতিটি বিভাগকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত হতে হয় এবং সেই কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্ক অতীব ঘনিষ্ঠ।

 

(১৬) নাগরিক অধিকার এবং কর্তব্যের উল্লেখ : 

সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৩৩ থেকে ৫৬নং ধারাগুলিতে চীনা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, বাক্-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিটিং, মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকার, নির্বাচনের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, কর্মের অধিকার, বিশ্রামের অধিকার ইত্যাদি হল নাগরিকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মৌলিক অধিকার। চীনের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে শুধু উল্লেখ করা হয়নি, সেইসঙ্গে নাগরিকরা যাতে এই অধিকারগুলি ভোগ করতে পারে তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত থাকে। সেই অনুযায়ী সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্যসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কর্তব্যগুলি হল—— দেশের সংবিধান ও আইন মান্য করা, সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া, মাতৃভূমির সম্মান রক্ষা করা, সরকারী সম্পত্তি রক্ষা করা, শিক্ষা লাভ করা ইত্যাদি।

 

(১৭) রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রবর্তন: ১৯৮২ সালের সংবিধানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি পদের পুনঃপ্রবর্তন। ১৯৫৪ সালের সংবিধানে এই দুটি পদের অস্তিত্ব থাকলেও ১৯৭৫ সালের সংবিধানে এই দুটি পদের বিলোপসাধন করা হয়। সংবিধানের ৭৯নং ধারা অনুযায়ী ভোটাধিকারপ্রাপ্ত এবং ৪৫ বছর বয়স্ক যে-কোন চীনা নাগরিক রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির পদে প্রার্থী হতে পারেন।

 

(১৮) কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা:

 ১৯৭৮ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে কমিউনিস্ট পার্টির যে ব্যাপক ভূমিকা স্বীকৃতি পেয়েছিল, ১৯৮২ সালের সংবিধানে সেরূপ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নতুন সংবিধানের মূল অংশে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা প্রসঙ্গে কোন উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র প্রস্তাবনায় এর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য তত্ত্বগতভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সংকুচিত হলেও বাস্তবে চীনের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে।

 

(১৯) কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন গঠন : চীনের ১৯৭৫ এবং ১৯৭৮ সালের সংবিধানে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গণসাধারণতন্ত্রী চীনের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু ১৯৮২ সালের সংবিধানের ৯৩নং ধারায় একটি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন হল সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক। কমিশনের সভাপতি জাতীয় গণ-কংগ্রেস কর্তৃক ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং কমিশনের সম্পাদিত কার্যবলীর জন্য তাঁকে জাতীয় গণ-কংগ্রেস ও তার স্থায়ী কমিটির নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়।

 

(২০) পরোক্ষ নির্বাচন ও অপসারণ ব্যবস্থা : 

গণসাধারণতন্ত্রী চীনের জাতীয় গণ-কংগ্রেস গঠনের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে জাতীয় গণ-কংগ্রেসের ডেপুটিগণ প্রদেশ, স্বয়ংশাসিত অঞ্চল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন পৌরসভাগুলির গণকংগ্রেস এবং সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। সংবিধানে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন স্তরের নির্বাচকমণ্ডলী সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নিজ নিজ প্রতিনিধিদের অপসারণ করতে পারে। এরূপ অভিনব নির্বাচন ও অপসারণের ব্যবস্থা বেশিরভাগ বুর্জোয়া রাষ্ট্রে নেই।

 

(২১) বিচার বিভাগের অভিনবত্ব : চীনে বিচার ব্যবস্থার মূল সংস্থা হল গণ-আদালতগুলি (People’s courts)। সর্বোচ্চ গণ-আদালত ও বিভিন্ন স্তরের গণ-আদলতের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালিত হয়। চীনের বিচার ব্যবস্থার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল গণ-প্রকিউরেটর দপ্তর। গণ-প্রকিউরেটর দপ্তরগুলির দায়িত্ব হল সর্বস্তরের সরকারী বিভাগগুলি আইন অনুসারে কাজ করছে কিনা তা লক্ষ্য রাখা, আদালত ঠিকঠিকভাবে বিচার করছে কিনা তা নজর রাখা এবং গণ-আদালতগুলির সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ সঠিকভাবে বলবৎ করা হচ্ছে কিনা তা তদারক করা প্রভৃতি। চীনের বিচার ব্যবস্থার অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল, দেশের সংবিধানের ব্যাখ্যা-কর্তা এবং অভিভাবক হিসাবে বিচার বিভাগের কোন ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়নি। সংবিধান ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা জাতীয় গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ওপর ন্যস্ত।

 

(২২) পররাষ্ট্রনীতি : 

গণসাধারণতন্ত্রী চীনের বর্তমান সংবিধানের মূল অংশে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা না থাকলেও প্রস্তাবনার মধ্যে চীনের পরারাষ্ট্রনীতির মূল নীতিগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা, উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বাধীনতা রক্ষা ও অর্থনৈতিক বিকাশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানানো, বিশ্বশান্তি সংরক্ষণ ও মানব জাতির অগ্রগতির জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালানো ইত্যাদি হল চীনের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য।

গণসাধারণতন্ত্রী চীনের নতুন সংবিধানের

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *