Political science

ফরাসী নাগরিকদের অধিকারসমূহ বর্ণনা কর।Describe the rights of the citizens of France

  ফরাসী নাগরিকদের অধিকারসমূহ বর্ণনা কর।Describe the rights of the citizens of France

ফরাসী নাগরিকদের অধিকারসমূহ

ফরাসী নাগরিকদের অধিকার:

উত্তর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতবর্ষ, গণসাধারণতন্ত্রী চীন প্রভৃতি দেশের মত ফ্রান্সের সংবিধানও লিখিত। কিন্তু প্রথমোক্ত তিনটি দেশের সংবিধানে যেমন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ফ্রান্সের সংবিধানে সেরূপ করা হয়নি। ফ্রান্সে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং কয়েকটি ধারায় বিক্ষিপ্তভাবে নাগরিক অধিকার সমূহের উল্লেখ আছে।

 পঞ্চম সাধাণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, “১৭৮৯ সালের ঘোষণা এবং ১৯৪৬ সালে গৃহীত চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনার বর্ণিত মানবাধিকারের প্রতি ফরাসী জনগণ গভীরভাবে আস্থাশীল।” যাইহোক, ‘১৭৮৯ সালের ঘোষণা’, ১৯৪৬ সালে গৃহীত চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের প্রস্তাবনা, পঞ্চম সাধাণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং কয়েকটি ধারা থেকে সংগৃহীত নাগরিক অধিকারগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করা হল।

ফরাসী-নাগরিকদের-অধিকারসমূহ-বর্ণনা-কর-Describe-the-rights-of-the-citizens-of-France

 

(১) সাম্যের অধিকার : পঞ্চম সাধাণতন্ত্রের সংবিধানের ২নং ধারায় স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব’ (Liberty Equality and Fraternity)-কে ফরাসী সাধারণতন্ত্রের তিনটি প্রধান নীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে ফরাসী নাগরিকরা প্রত্যেকেই আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার ভোগ করে। ফ্রান্সে আইন সকলকে সমানভাবে রক্ষা করে। আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হওয়ায় নাগরিকগণ তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারী সম্মান, চাকুরি ইত্যাদি সমানভাবে লাভ করবে।

 

(২) চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার :

 ১৭৮৯ সালের ঘোষণায় চিন্তা ও মতামত প্রকাশের অধিকারকে ‘মানুষের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান অধিকার’ (the most precious of the rights of man) বলে বর্ণনা করা হয়। ফরাসী নাগরিকরা সভা-সমিতি, আলোচনাচক্র, সংবাদপত্র, পুস্তক পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে এই অধিকারটি বাস্তবায়িত করে।

 

(৩)  ভোটদানের অধিকার :

১৯৪৬ সালের সংবিধানের ৪নং ধারায় বলা হয়েছিল যে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল ফরাসী নাগরিক ভোটদানের অধিকারী। বর্তমানে ফ্রান্সে স্ত্রী-পুরুষ ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স্ক প্রত্যেক নাগরিক ভোটদানের অধিকার ভোগ করে। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের ৩নং ধারায় ভোটাধিকারকে ‘সার্বিক, সমান এবং গোপন’ (Universal, equal and secret) বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

 প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, ফ্রান্সের নাগরিকরা ভোটদানের অধিকারতো ভোগ করেই, উপরন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণ-ভোটের অধিকার ভোগ করে। এই গণ-ভোটের মাধ্যমে ফ্রান্সে গণ-সার্বভৌমিকতা অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে।

 

(৪) রাজনৈতিক দল ও সংঘ গঠনের অধিকার : 

পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের ৪নং ধারায় নাগরিকদের রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলি যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তার কথাও বলা হয়েছে। এই অধিকারটি অবাধ নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে জাতীয় সার্বভৌমিকতা ও গণতান্ত্রিক নীতি সমূহের (the principles of national sovereignty and democracy) প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। ১৯৪৬ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় নাগরিকদের সংঘ গঠনের এবং পছন্দমত সংঘে যোগদানের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে।

 

(৫) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার :

 ফ্রান্সে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে। পঞ্চম ফরাসী প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ২নং ধারায় ফ্রান্সকে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এর অর্থ রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। সংবিধানের ২ এবং ৭৭নং ধারায় সকল ধর্মের মানুষকে সমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৪৬ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্ম নিরপেক্ষ জনশিক্ষা’ (secular public education) প্রবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

 

(৬) ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার:

 ১৭৮৯ সালের ঘোষণায় ‘মানুষের স্বাভাবিক এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারসমূহ’ সংরক্ষণকে যে কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে ঘোষণা করা হয়। ঐ ঘোষণা অনুসারে পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানেও নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলা হয়, কোন ব্যক্তিকে খেয়ালখুশিমত (arbitrarily) আটক করা যাবে না (৬৬ নং ধারা)। সংবিধানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের ওপর। বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অভিভাবক’ (guardian of individual liberty ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে (৬৬ নং ধারা)।

 

(৭) ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার : ১৭৮৯ সালের ঘোষণায় সম্পত্তির অধিকারকে ‘একটি পবিত্র ও অলঙ্খনীয় অধিকার’ (a sacred and inviolable right) বলে বর্ণনা করা হয়। ঐ ঘোষণায় আরও বলা হয় ‘আইন সিদ্ধ জনসাধারণের প্রয়োজন’ ছাড়া কাউকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিনিময়েই কেবলমাত্র কোন ফ্রান্সের শাসনব্যবস্থা

 

ব্যক্তিকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। তবে ৩৪নং ধারায় সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পার্লামেন্টের ওপর।

 

(৭) রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের অধিকার : ফ্রান্সে বিদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের অধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অধিকারটি অন্য কোন দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায় না। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, স্বাধীনতার জন্য নির্যাতিত এবং নিবেদিতপ্রাণ কোন ব্যক্তি ফ্রান্সে আশ্রয় চাইলে তাঁকে ফ্রান্সের যে-কোন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে।

 

(৮) কর্মের অধিকার : 

ফ্রান্স একটি ধনতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে নাগরিকদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অধিকারকে সংবিধানে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল কর্মের অধিকার। ১৯৪৬ সালের চতুর্থ ফরাসী সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ফ্রান্সের প্রতিটি নাগরিক যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি (employment) পাওয়ার অধিকারী। প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, জন্ম, মতামত, বিশ্বাস এসবের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তিকে তার কাজ বা চাকরি (his work or his employment) থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

 

(৯) যৌথভাবে দরকষাকষির অধিকার : চতুর্থ সাধরণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় কাজের শর্তাবলী ও ব্যবসা পরিচালন সংক্রান্ত বিষয়ে শ্রমিকদের যৌথভাবে দরকষাকষির অধিকার (Collective bargaining) স্বীকৃতিলাভ করেছে। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও এই অধিকারটিকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

 

(১০) ধর্মঘটের অধিকার : ধর্মের অধিকার হল নাগরিকদের অর্থনৈতিক অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতম। ফ্রান্সের নাগরিকদের এই অধিকারটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, আইন নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে থেকে নাগরিকরা ধর্মঘটের অধিকার ভোগ করতে পারে।

 

(১১) বিশ্রাম ও অবকাশ যাপনের অধিকার : 

চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় নাগরিকদের বিশ্রাম ও অবসর যাপনের অধিকারটি স্বীকৃতি লাভ করে। জীবনকে সুখী ও সুন্দর করে তুলতে যেমন এই অধিকারটি প্রয়োজন, তেমনি চিন্তা ও মননের উৎকর্ষ বিধানের জন্যও এই অধিকারটি অপরিহার্য। অন্য কোন ধনতান্ত্রিক দেশে এই অধিকারটি সাংবিধানিক স্বীকৃতিলাভ করে নি।

 

উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় ফ্রান্সে নাগরিকদের শুধু কতকগুলি পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করা হয়নি, বেশ কিছু অর্থনৈতিক অধিকারও প্রদান করা হয়েছে। এই অর্থনৈতিক অধিকারগুলি প্রদানের জন্য ফ্রান্সের নাগরিকদের অন্যান্য অধিকারগুলি অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।

 তবে এটাও লক্ষ্য করতে হবে, ফ্রান্সে নাগরিক অধিকারগুলির অধিকাংশই সংবিধানের কার্যকরী অংশের পরিবর্তে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ঐসব অধিকারের আইনগত মূল্য কমে গেছে বলে অনেকের ধারণা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *