প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠাশক্তির বিস্তার বর্ণনা কর-Teacj Sanjib
প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠাশক্তির বিস্তার বর্ণনা কর-Teacj Sanjib
প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠাশক্তির বিস্তার
প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তার পর্যালোচনা কর।
অথবা, পেশোয়া বাজীরাত্তের নেতৃত্বে মারাঠাশক্তির অগ্রগতি পর্যালোচনা কর। অথবা,
“পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কারণ সমূহ এবং গুরুত্ব আলোচনা কর।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ।
প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তার পর্যালোচনা কর।:
উত্তর। শিবাজী আপন শৌর্য, কর্মক্ষমতা ও প্রতিভার দ্বারা মারাঠাজাতির মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং মারাঠারাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পর নানা কারণে সেই রাজ্যে দুর্বলতা দেখা দিতে লাগিল। তাঁহার পুত্র শম্ভুজী মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু যথেষ্ট রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় না দিতে পারায় তিনি ১৬৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের হস্তে পরাজিত ও নিহত হন। তাঁহার পুত্র শাহু মোগলদের হস্তে বন্দী হয়। কিন্তু মারাঠাশক্তিকে একেবারে পর্যুদস্ত করা ঔরঙ্গজেবের পক্ষে সম্ভব হইল না। শম্ভুজীর অব্যাহত ভ্রাতা রাজারাম এবং ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যুর পর তদীয় পত্নী তারাবাঈ আপন শিশুপুত্র তৃতীয় শিবাজীর পক্ষ হইয়া মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া গেলেন। এই সময় মারাঠাজাতির মধ্যে আবার জাগরণ দেখা যায়।
ঔরঙ্গজেবের ব্যর্থতা
ঔরঙ্গজেব তাঁহার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াও মারাঠাশক্তি দমনে ব্যর্থ হইলেন। মারাঠাবাহিনী নূতন নূতন অঞ্চলে তাহাদের আক্রমণ চালাইয়া গেল ; দাক্ষিণাত্যে, উত্তর-ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে নূতন করিয়া তাহাদের প্রভুত্ব স্থাপিত হইল, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাঠাগণ প্রবল শক্তিরূপে দেখা দিল।
মারাঠাগণের আত্মকলহ
অতঃপর ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মারাঠাশক্তির মধ্যে বিভেদসৃষ্টির জন্য দিল্লী হইতে শম্ভুজীর পুত্র শাহুকে মুক্তি দেওয়া হইল। শাহু মহারাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করিলে মারাঠাশক্তি তারাবাঈ ও শাহুর মধ্যে বিভক্ত হইয়া গেল। মারাঠাশক্তি আত্মকলহে দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল। এই সময়ে শাহু কোঙ্কণের বালাজী বিশ্বনাথ নামে এক দূরদর্শী ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণের হস্তে শাসনক্ষমতা অর্পণ করিলে মারাঠাজাতি আবার সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হইয়া উঠিল।
পেশোয়াগণের নেতৃত্ব ঃ
বালাজী বিশ্বনাথ ছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণবংশের সন্তান। কিন্তু আপন কৃতিত্ব ও প্রতিভার পরিচয় দিয়া তিনি শাহু কর্তৃক রাজ্যের পেশোয়াপদে নিযুক্ত হন। ক্রমে কর্তব্যনিষ্ঠা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ক্ষমতার জোরে তিনিই রাজ্যের সর্বময় কর্তা হইয়া উঠিলেন। শাহু কেবলমাত্র নামে রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত রহিলেন। এইসময় হইতেই মারাঠারাজ্যে ‘পেশোয়াতন্ত্রের’ সূচনা হইল।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বালাজী বিশ্বনাথ বিদ্রোহী সর্দারদের দমন করিয়া কূটনীতির সাহায্যে তারাবাঈ-এর পরিকল্পনা ব্যর্থ করিয়া মারাঠাজাতির সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত সন্ধি করিলেন। রাজস্ববিভাগেও বিভিন্ন সংস্কার প্রবর্তন করিয়া তিনি মারাঠাজাতিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুলিলেন। বৈদেশিক ক্ষেত্রেও তাঁহার সাফল্য কম নহে। তিনি ধ্বংসোন্মুখ মোগল-সাম্রাজ্যের উপর আঘাতের পর আঘাত হানিতে লাগিলেন এবং বিভিন্ন অঞ্চল হইতে ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ আদায় করিতে আরম্ভ করিলেন। অবশেষে ১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দে বালাজীর সৈয়দ-ভ্রাতৃদ্বয়ের সহিত সহিত সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের হুসেন আলীর সন্ধি হইল। মারাঠা-রাজ শাহু দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ, বেরার, ঔরঙ্গবাদ, বিদর, হায়দ্রাবাদ ও বিজাপুর ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ আদায়ের অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। ইহার বিনিময়ে তিনি মোগল সম্রাটকে বাৎসরিক কর প্রদান ও অশ্বারোহী সৈন্য দিয়া সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। এই সন্ধির ফলে শাহু মোগল সম্রাটের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া লইলেন, মোগলদের সহিত শান্তি স্থাপিত হইল ; সঙ্গে সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের রাজনৈতিক প্রভুত্বও স্থাপিত হইল। ইহার পর সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের দাক্ষিণাত্যে ও বিরোধী দলকে দমন ও সম্রাট ফারুখশিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করিবার উত্তর-ভারতে মারাঠাদের জন্য বালাজী হুসেন আলীর সহিত সসৈন্যে দিল্লী প্রবেশ করিলেন। এই সময় হইতে মারাঠাগণ দিল্লীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিতে আরম্ভ করিল।
বালাজী বিশ্বনাথের আমলে মারাঠাগণের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাইল, তেমনি তাহারা এক দুর্ধর্ষ শক্তিতে পরিণত হইল। সেইজন্য তাঁহাকে মারাঠা সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
প্রথম বাজীরাও (১৭২০-১৭৪০ খ্রীঃ) :
১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে বালাজী বিশ্বনাথের মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র প্রথম বাজীরাও পেশোয়া হইলেন। সামরিক প্রতিভা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও সুচতুর কূটনীতিবিদ্ হিসাবে তিনি পেশোয়াগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। মহারাষ্ট্রকে কেন্দ্র করিয়া সর্বভারতীয় এক অখণ্ড হিন্দুরাজ্য স্থাপন করাই তাঁহার রাজনৈতিক আদর্শ ছিল। তিনি তাঁহার এই অখণ্ড হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনের বা ‘হিন্দুপাদ পাদশাহীর’ পরিকল্পনা সমস্ত হিন্দু দলপতি ও রাজাদের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করার পথে অন্তরায় ছিল মোগল সাম্রাজ্য। সুতরাং কিছুদিনের মধ্যেই মোগলশক্তির সহিত তাঁহার সংঘর্ষ অনিবার্য হইয়া উঠিল।
তাহার আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করিবার জন্য তিনি প্রথম হইতেই সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হইলেন। তিনি মালব, গুজরাট ও বুন্দেলখণ্ডের কিয়দংশ জয় করেন এবং কর্ণাট পর্যন্ত অভিযান প্রেরণ করেন। জয়পুরের দ্বিতীয় জয়সিংহ এবং বুন্দেল-রাজ ছত্রশালের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিয়া তিনি দিল্লীর উপকণ্ঠ পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ্ ভীত হইয়া নিকট সাহায্যের জন্য আবেদন করিলে ১৭৩৮ খ্রীষ্টাব্দে নিজাম ও বাজীরাও-এর মধ্যে ভূপালের নিকট এক যুদ্ধ হয়। নিজাম পরাজিত হইয়া তাঁহার রাজ্যের কিয়দংশ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হন ; অবশ্য দিল্লী সাময়িকভাবে রক্ষা পাইয়া গেল! অপরদিকে মারাঠাবাহিনী পর্তুগীজদের পরাজিত করিয়া সলসেট ও বেসিন দখল করে। অতঃপর নাদির শাহের বিরুদ্ধে যখন তিনি হিন্দু ও মুসলমান রাজগণের সম্মিলিত শক্তি গড়িয়া তুলিতেছেন তখন অকস্মাৎ ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।
মারাঠাশক্তির বিবর্তনের ইতিহাসে বাজীরাও-এর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাঁহার নীতি ও কার্যকলাপের ফলে মারাঠা-রাজ্য সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হইয়াছিল এবং দক্ষিণ-ভারত ও উত্তর-ভারতের রাজনীতিতে অগ্রগণ্য শক্তিতে পরিণত হইয়াছিল। এইজন্য কে. এম. পানিক্কর মনে করেন “If Shivaji was the founder of the Maratha state, Baji Rao would claim that he transformed what was a national state into an empire.” কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়া সাফল্য লাভ করিলেও বাজীরাও প্রশাসক ও সংগঠকরূপে সাফল্যের পরিচয় দেন নাই। ডঃ দীঘে মনে করেন যে বাজীরাও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর কোন সংস্কার বা পরিবর্তন সাধন করেন নাই। সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সংযত করিয়া কেন্দ্রীয় শক্তিকে সুদৃঢ় না করার ফলে পরবর্তীকালে মারাঠা রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট হইয়া পড়ে।
প্রথম তিনজন পেশোয়ার নেতৃত্বে মারাঠাশক্তির বিস্তার
বালাজী বাজীরাও (১৭৪০-১৭৬১ খ্রীঃ) :
প্রথম বাজীরাও-এর ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু হইলে তাঁহার পুত্র বালাজী বাজীরাও পেশোয়া-পদ লাভ করেন ও রাষ্ট্রের সর্বাত্মক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ফলে তাঁহার বিরুদ্ধে তারাবাঈ ও বরোদার গাইকোয়াড় বিদ্রোহ করিলে তিনি তাহাদিগকে দমন করিতে সক্ষম হন। রাজারামের সময় হইতেই মারাঠাসাম্রাজের ভিত্তিতে ফাটল সৃষ্টি করা হইয়াছিল, জায়গির-প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করিয়া মারাঠাশক্তির সাম্রাজ্যবিস্তারের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সাফল্য দেখা যাইতেছিল, অপরদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উহার সংহতি ক্রমেই বিনষ্ট হইয়া যাইতেছিল! ধীরে ধীরে কয়েকটি অঞ্চলে শাসক-পরিবারের উদ্ভব হইল। যেমন—বেরারের ভোঁসলে, বরোদার গাইকোয়াড়, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া, ইন্দোরের হোলকার এবং মালবের অন্তর্গত ধার নামক অঞ্চলের পাবার। ইহারা পেশোয়ার অধীন ছিল বটে, কিন্তু ক্রমেই স্বাধীন কার্যকলাপ ও পরস্পরের মধ্যে স্বার্থদ্বন্দ্বে লিপ্ত হইয়া পড়িতেছিল। সময়ে সময়ে তাহারা পেশোয়ার ক্ষমতাকে উপেক্ষা করিত। এই সকল ঘটনার ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যের সংহতি দ্রুত বিনষ্ট হইতে লাগিল।
বালাজী রাও তাঁহার পিতার ন্যায় সাম্রাজ্যবিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন সত্য, কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে তিনি তাঁহার অনুসৃত নীতি হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িলেন। প্রথমত, ‘হিন্দুপাদ-পাদশাহী’ আদর্শের উপরেও তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেন না। তাঁহার সৈন্যবাহিনী হিন্দুদের রাজ্যও নির্বিচারে লুণ্ঠন করিয়া চলিল। ফলে সমস্ত হিন্দু দলপতি রাজগণকে এক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। তিনি রাজপুত ও জাঠদের সহানুভূতি হইতেও বঞ্চিত হইলেন; এইজন্যই পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে রাজপুতগণ নিরপেক্ষ রহিয়া গেল। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁহার সৈন্যবাহিনীতে মুসলমান ও বিদেশী সৈন্য ও সেনাপতি নিয়োগ করিলেন ; ইহাতে মারাঠা সৈনিকদের জাতীয়তাবোধ হ্রাস পাইতে লাগিল, তাহাদের ঐক্য ও সংহতিও বিনষ্ট হইয়া গেল।
কিন্তু এ সমস্ত সত্ত্বেও মারাঠা সাম্রাজ্য ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগে চারিদিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল। নিজাম ও মহীশূর রাজ পরাজিত হইয়া তাঁহাদের রাজ্যের কিয়দংশ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইলেন। বেরারের ভোঁসলে বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর নিকট চৌথ আদায় করিলেন এবং উড়িষ্যা জয় করিলেন। পেশোয়ার ভ্রাতা রঘুনাথ রাও উত্তর-ভারতে সামরিক অভিযান চালাইয়া পাঞ্জাব পর্যন্ত অঞ্চল দখল করিলেন। দিল্লীর সম্রাট শাহ্ আলম বালাজী রাও-এর হাতের পুতুলে পরিণত হইলেন। মারাঠা শক্তি ও মর্যাদা চরমে পৌছিল।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ :
কিন্তু মারাঠাগণ কর্তৃক পাঞ্জাব দখল হইলে আহম্মদ শাহ্
আবদালীর সহিত তাহাদের সংঘর্ষ অনিবার্য হইয়া উঠিল। কারণ ইহার পূর্বেই মোগল সম্রাট আহম্মদ শাহের নিকট হইতে আফগান বীর আহম্মদ শাহ্ আবদালী পাঞ্জাবের কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং পাঞ্জাব পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি ১৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় ভারত আক্রমণ করিলেন। তাঁহাকে প্রতিরোধ করিবার জন্য সদাশিব রাওয়ের নেতৃত্বে এক বিরাট মারাঠাবাহিনীও উত্তর-ভারতে প্রেরিত হইল। মারাঠা অভ্যুত্থানে সন্ত্রস্ত অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা, রোহিলখণ্ডের নাজির খাঁ প্রভৃতি আফগানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করিলেন। অপরপক্ষে মারাঠাবাহিনী তাহাদের অদূরদর্শী নীতির ফলে রাজপুত ও জাঠদের সাহায্য হইতে বঞ্চিত হইল। শিখদের দলে টানিবার মত সুবিবেচনার পরিচয়ও তাহারা দিতে পারিল না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে হোলকার বাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্র মারাঠাবাহিনীর পরাজয় হইতে দূরে রহিল। ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে পানিপথের বিখ্যাত প্রান্তরে মারাঠাবাহিনী পরাজিত ও বিধ্বস্ত হইল ; বিশ্বাস রাও ও সদাশিব রাও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এই দুঃসংবাদে অসুখ ও দুর্বল বালাজী বাজীরাও ভগ্নহৃদয় হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন।
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ভারত-ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। যদিও সরদেশাই, রাজওয়াদে প্রমুখ মারাঠা ঐতিহাসিকগণ এই যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয়কে সার্বিক বিপর্যয় বলিয়া মনে করেন না। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার মনে করেন মারাঠা ঐতিহাসিকগণ ইচ্ছাকৃত ভাবে মারাঠাদের পরাজয়ের গভীরতা লঘু করিয়া দেখিয়াছেন। তাঁহার মতে মারাঠাদের পরাজয় ছিল “এক জাতীয় বিপর্যয়।” (“There was not a home in 66 Maharashtra that had not to mourn the loss of a member and several of their heads, and entire generation of leaders was cut off at one stroke. It was, in short, a national disaster like Flooden Field.”)। ইহার ফল হইয়াছিল সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মারাঠাগণ কর্তৃক ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিলুপ্ত হইয়া গেল। এই ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে মারাঠা-সাম্রাজ্যবাদের অবসান হইল। দ্বিতীয়ত, এই পরাজয়ের ফলে পেশোয়ার মর্যাদাও বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হইল।
মারাঠা শক্তি-সংঘের পতন
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠীগুলি অধিকতর স্বাধীনতাকামী হইয়া উঠিল, মারাঠা শক্তি-সংঘের সংহতি অনেকখানি বিনষ্ট হইয়া গেল। তৃতীয়ত, ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আরও প্রকট হইয়া উঠিল। মারাঠাশক্তি দুর্বল হওয়ার ফলে পাঞ্জাবে শিখদের অভ্যুত্থান সহজ হইল। দাক্ষিণাত্যে মহীশূরের আধিপত্য বিস্তৃত হইল এবং সর্বোপরি ইংরাজদের সাম্রাজ্যবিস্তারের পথ উন্মুক্ত হইয়া গেল।