ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা পর্যালোচনা কর teacj sanjib
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা পর্যালোচনা কর teacj sanjib
প্রশ্ন (রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা পর্যালোচনা কর। [Critically examine the emergency powers of the President of India].
রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি:
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতারা শুধুমাত্র স্বাভাবিক অবস্থাতে নয়, অস্বাভাবিক অবস্থাতে কী ধরনের সমস্যা আসতে পারে এবং কিভাবে তার মোকাবিলা করা যাবে সে সম্পর্কেও যে চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তার প্রমাণ পাই সংবিধানের অষ্টাদশ অংশে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তৃত বিবরণ থেকে। দেশের মধ্যে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সংবিধান কর্তৃক রাষ্ট্রপতির হস্তে তিন ধরনের জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে (ক) জাতীয় জরুরী অবস্থা, (২) রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থাজনিত জরুরী অবস্থা, এবং (গ) আর্থিক জরুরী অবস্থা।
(ক) জাতীয় জরুরী অবস্থা :
বর্তমানের ব্যবস্থাটি এইরূপ : “রাষ্ট্রপতি যদি সন্তুষ্ট হন যে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ অথবা আভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে ভারতের অথবা তার কোন অংশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে বা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে তিনি সমগ্র ভারতে অথবা এর যে-কোন অংশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন” (৩৫২ নং ধারা)। ৪৪তম সংবিধান সংশোধনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের লিখিত পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি এরূপ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন না।)
ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় জরুরী অবস্থার ঘোষণাকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নিকট এক মাসের মধ্যে উপস্থিত করতে হবে। পার্লামেন্টের প্রতিটি কক্ষে এই ঘোষণাকে মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ কর্তৃক সমর্থিত হতে হয়। উভয় কক্ষে অনুমোদিত হলে জরুরী অবস্থা ৬ মাস বলবৎ থাকবে। তবে এই ৬ মাস অতিক্রম করার পর প্রয়োজনে পার্লামেন্ট প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবারে ৬ মাস করে এর সময়সীমা বৃদ্ধি করতে পারে।
এ পর্যন্ত তিনবার জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে—প্রথমটি ১৯৬২ সালে চীনভারত সীমান্ত বিরোধের সময়; দ্বিতীয়টি ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এবং তৃতীয়টি ১৯৭৫ সালে আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার অজুহাতে।
জাতীর জরুরী অবস্থার ফলাফল :
জাতীর জরুরী অবস্থার ফলাফলগুলি হল নিম্নরূপ : প্রথমত, শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে এবং রাজ্যসরকারগুলি এই সমস্ত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে বাধ্য [৩৫৩(ক) ধারা]।
দ্বিতীয়ত, পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে অথবা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারে [৩৫৩ (খ) নং ধারা]।
তৃতীয়ত, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টন সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি রাষ্ট্রপতি বিশেষ নির্দেশ বলে পরিবর্তন করতে পারেন [৩৫৪ নং ধারা]।
চতুর্থত, পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে লোকসভার মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করা যায়।
পঞ্চমত, সংবিধানের ১৯ নং ধারায় বর্ণিত স্বাধীনতার অধিকারগুলিকে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্থগিত রাখা যায় অথবা ক্ষুণ্ন করা যায়।
— ষষ্ঠত, রাষ্ট্রপতি বিশেষ আদেশ জারি করে মৌলিক অধিকারগুলিকে কার্যকর করার জন্য ৩২ এবং ২২৬ নং ধারা বলে আদালতের যে ক্ষমতা রয়েছে, তা বাতিল করে দিতে পারেন। তবে সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনে বলা হয়েছে যে, ২১নং ধারায় বর্ণিত জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে কোনভাবে ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।
(খ) রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা :
(সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা অনুসারে কোন রাজ্যের রাজ্যপালের রিপোর্ট থেকে অথবা অন্য কোনভাবে রাষ্ট্রপতি যদি সন্তুষ্ট হন যে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না বা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে তিনি ঐ রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৫ সালের ৩৮-তম সংবিধান সংশোধনী আইনে বলা হয় যে কোন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ‘সন্তুষ্টি’ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং তা নিয়ে আদালতে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু ১৯৭৮ সালে ৪৪-৩ম সংবিধান সংশোধনী আইনে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বলা হয়, কোন রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন বলবৎ করণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ‘সন্তুষ্টি’ই শেষ কথা নয়, শেষ কথা বলার অধিকারী হলেন বিচার বিভাগ। এইভাবে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হলে, ১৯১৩ সালের ২রা এপ্রিল হাইকোর্ট তা খারিজ করে দেয়। অনুরূপভাবে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট এক রায়ে নির্বাচনোত্তর উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তকে খারিজ করে সংসদে এই শাসন অনুমোদিত হওয়াকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেন।
রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ঘোষণাকে দু’মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হয় এবং অনুমোদিত হলে এই জরুরী অবস্থা প্রথমে ৬ মাস এবং সংসদ পুনরায় অনুমোদন করলে আরও ৬ মাস বলবৎ করা যায়। তবে নির্বাচন কমিশনের অনুমতিক্রমে জরুরী অবস্থার মেয়াদকে আরও দু’বছর বৃদ্ধি করে সর্বমোট ৩ বছর চালু রাখা যায়।
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ফলাফল:
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণার ফলাফলগুলি হল নিম্নরূপ:
প্রথমতঃ, রাজ্য আইনসভা ছাড়া রাজ্য সরকারের, রাজ্যপালের অথবা অন্য যেকোন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় অথবা যে-কোন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি স্বহস্তে গ্রহণ করতে পারেন [৩৫৬(ক) ধারা]।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে পারেন যে, রাজ্য আইনসভার ক্ষমতাবলী পার্লামেন্টের কর্তৃত্বাধীনে প্রযুক্ত হবে [৩৫৬(খ) নং ধারা]। অর্থাৎ এই সময়ে রাজ্য আইনসভাকে ভেঙে দেওয়া যায় অথবা বরখাস্ত করা যায়।
তৃতীয়ত, এই ঘোষণাটিকে কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের যে-কোন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাতিল করে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনমত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে হাইকোর্টের কোন ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো যায় না।
চতুর্থত, রাজ্য আইনসভার আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা পার্লামেন্টের হস্তগত হয়। পার্লামেন্ট আবার আইন করে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করতে পারে।
পঞ্চমত, এই সময় সংশ্লিষ্ট রাজ্য আইনসভার এক্তিয়ার ভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা
(গ) আর্থিক জরুরী অবস্থা:
সংবিধানের ৩৬০ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি যদি সন্তুষ্ট হন যে, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যার দ্বারা সমগ্র ভারতের বা তার কোন অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম বিপন্ন হচ্ছে, তাহলে তিনি আর্থিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এরূপ ঘোষণাকে দু’মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সম্মতি লাভ করতে হয়, নইলে ২ মাস পর তা বাতিল হয়ে যায়। একবার অনুমোদিত হলে এরূপ ঘোষণার মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে।
আর্থিক জরুরী অবস্থার ফলাফলগুলি হল নিম্নরূপ:
প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে আর্থিক ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য আইনসভা কর্তৃক গৃহীত অর্থবিলসহ যে কোন বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দিতে পারে।
তৃতীয়ত, সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা হ্রাস করার নির্দেশ দিতে পারেন রাষ্ট্রপতি।
চতুর্থত, রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধে সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা হ্রাস করার নির্দেশ দিতে পারেন।
মূল্যায়ন :
অনেকের মতে ভারতের ন্যায় গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গণপরিষদে জরুরী অবস্থাকে কেন্দ্র করে তীব্র বাদানুবাদ হয়। শ্রী কামাথ, কে. টি. সাহ্, সাকসেনা প্রমুখ সদস্যগণ মন্তব্য করেছিলেন যে, এই জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা রাজ্যগুলির স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করবে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করবে। বাস্তবিকই এই জরুরী অবস্থার সময় কেন্দ্র এত বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে দেশ তখন যে-কোন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করে। তাছাড়া এসময়ে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে যেভাবে অকার্যকর করে দেওয়া হয় তা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘোষণার বিষয়টিকে সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক বলে অনেকে মন্তব্য করেন, কারণ গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন। কোন রাজ্যের সরকার যদি কোন ভুল করে ব৷ জনকল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার প্রতিকাররের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জনগণেরই থাকা উচিত।) সুশাসন প্রতিষ্ঠার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের নাক গলানো উচিত নয়। বস্তুত সুশাসন কখনই স্বশাসনের বিকল্প হতে পারে না। তাছাড়া, অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের এই ৩৫৬নং ধারাটিকে বহুবার তার সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে।
‘সমালোচকেরা আরও বলেন, জরুরী অবস্থার সময়, বিশেকেরে ৩৬০ নং ধারা বলে আর্থিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে আর্থিক দিক থেকে পঙ্গু করে দিতে পারে।
(উপরোক্ত সমালোচনার উত্তরে বলা যায় যে, দেশে যেহেতু দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, সেহেতু কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগ সাময়িকভাবে হলেও দীর্ঘকাল যাবৎ স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখতে সমর্থ হবে না। তাছাড়া, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি অশুভ শক্তিগুলি যাতে দেশের অখণ্ডতা, ঐক্য এবং নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে না পারে, সেজন্য বিশেষ বিশেষ অবস্থায় কেন্দ্রের হাতকে শক্তিশালী করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সুতরাং বলা যেতে পারে, ভারতের মত একটি বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্ম সমন্বিত দেশে জরুরী অবস্থার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধান প্রণেতাগণ দূরদর্শিতার পরিচয়ই দিয়েছেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থাদি সংক্রান্ত ক্ষমতা