দর্শন

কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণগুলি কী কী

 কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণগুলি কী কী?

কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণ

কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণগুলি: কারণের গুণগত লক্ষণগুলি কী কী (What are the qualitative marks of cause ? )

কারণের-গুণগত-ও-পরিমাণগত-লক্ষণগুলি-কী-কী

 

উত্তর :

 

১) কারণ ও কার্য পরস্পর সাপেক্ষ পদ (Cause and effect are relative terms) :

  ‘কারণ’ ছাড়া ‘কার্য’ শব্দ অর্থহীন, আবার ‘কার্য’ ছাড়া ‘কারণ’ শব্দ অর্থহীন। কারণকে বুঝতে হলে তার কার্যকে উল্লেখ করতে হয়। আবার কার্যকে বুঝতে হলে, তার কারণ উল্লেখের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া কার্য ও কারণ শব্দ দুটি সাপেক্ষ। প্রকৃতিতে দুটি পৃথক শ্রেণির ঘটনা নেই, যে দুটির একটিকে কার্য, অন্যটিকে কারণ বলা যায়। যে-কোনে ঘটনা অতীত কোনো ঘটনার কার্য এবং ভবিষ্যত কোনো ঘটনার কারণ হতে পারে। যেমন— অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা হতে পারে, আবার বন্যার ফলে মানুষ গৃহহীন হতে পারে। সুতরাং, বন্যা এক অর্থে কার্য, অন্য অর্থে কারণ।

 

(2) কারণ সর্বদা কোনো কালিক ঘটনা হয় (The given phenomenon is always an event in time) :

  কারণ সর্বদা কোনো কালিক ঘটনা। প্রকৃতিতে কোনো অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তবেই আমরা তার কারণ অনুসন্ধান করি। চন্দ্রগ্রহণ বা ভূমিকম্প হলে, মহামারি বা বিপ্লব হলে তার কারণ অনুসন্ধান করি। কারণ কোনো অবস্থার পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, ওই পরিবর্তন প্রকৃতিতে কোনো কালে (time) ঘটে। প্রকৃতিতে কোনো বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে কারণের প্রসঙ্গ ওঠে না।

 

৩) কারণ কার্যের পূর্বগামী ঘটনা (The cause is an antecedent of the effect) : 

 কারণ ও কার্যের মধ্যে পূর্বগামী ও অনুগামী (antecedent-consequent) সম্বন্ধ আছে। কারণ কার্যের পূর্বগামী ঘটনা এবং কার্য কারণের অনুগামী ঘটনা। বিষপানে মৃত্যু হয়। বিষপান পূর্বগামী ঘটনা, মৃত্যু অনুগামী ঘটনা। পূর্বগামী ঘটনা কারণ। দুটি ঘটনার মধ্যে কার্য-কারণ সম্বন্ধ থাকলে পূর্বগামী ঘটনাটি কারণ হবে। বিষপানের পর মৃত্যু হলে, বিষপান পূর্বগামী ঘটনা হওয়ায় কারণ হবে। বিষপানের পূর্বেই যদি মৃত্যু হয় তবে বিষপানকে মৃত্যুর কারণ বলা যাবে না।

 

৪) কারণ কার্যের নিয়ত বা অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনা (Cause is the invariable antecedent of the effect) :

  কারণ কার্যের পূর্বগামী ঘটনা। কিন্তু, যে-কোনো পূর্বগামী ঘটনাকে কারণ বলা যায় না। যে-কোনো পূর্বগামী ঘটনাকে কারণ বললে যুক্তি দুষ্ট হতে পারে। এই দোষের নাম ‘কাকতালীয় দোষ’ (Post hoc ergo propter hoc)। তাল গাছের উপর দিয়ে একটি কাক উড়ে যাবার পরই একটি তাল মাটিতে পড়ল। এ দেখে যদি অনুমান করা হয় কাকের উড়ে যাওয়া তাল পড়ার কারণ, তাহলে অনুমানটি কাকতালীয় দোষে দুষ্ট হবে। রাজার মৃত্যুর ঠিক পূর্বে আকাশে ধূমকেতু দেখা গেল। এক্ষেত্রে ধূমকেতুর আবির্ভাবকে রাজার মৃত্যুর কারণ বললে কাকতালীয় দোষ হবে। কারণ, ধূমকেতুর আবির্ভাব কোনো রাজার মৃত্যুর পূর্বগামী ঘটনা হলেও অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনা নয়।

 

অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনাই কারণ। অর্থাৎ, যে ঘটনা অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ ব্যতিক্রমহীনভাবে সব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ঘটনার পূর্বগামী হয়, সেই পূর্বগামী ঘটনাই কারণ। প্রত্যেক ব্যক্তির ম্যালেরিয়া জ্বরের পূর্বে যদি মশক দংশন করে থাকে, তবে ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মশক দংশনের ব্যতিক্রমহীন বা অপরিবর্তনীয় সম্বন্ধ আছে বলা যায়। ধূমকেতুর আবির্ভাব যদি রাজার মৃত্যুর কারণ হত, তবে যখনই কোনো রাজার মৃত্যু হবে, তখনই তার পূর্বে ধূমকেতুর আবির্ভাব হবে। কিন্তু বাস্তবে এরকম ঘটনা ঘটে না। ধূমকেতুর আবির্ভাব ছাড়াই অনেক রাজার মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং, কারণ শুধু পূর্বগামী ঘটনা নয়, নিয়ত পূর্বগামী ঘটনা।

 

(৫) কারণ কার্যের শর্তান্তরহীন পূর্বগামী ঘটনা (The Cause is the unconditional antecedent) ঃ 

 কারণ কার্যের অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনা। কিন্তু যে-কোনো অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনাকে কারণ বলা যায় না। যে-কোনো অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী ঘটনাকে কারণ বললে “সহকার্যকে কারণ মনে করা” নামক দোষ ঘটবে। যেমন— দিন রাত্রির

 

অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী (invariable antecedent) অথবা রাত্রি দিনের নিয়ত পূর্বগামী।। কিন্তু একটি অন্যটির কারণ নয়। দিন ও রাত্রির পূর্বাপর সম্বন্ধ অন্য শর্তের উপর। নির্ভরশীল। ঘটনা দুটি অন্য ঘটনা সাপেক্ষ। উভয়ে একই ঘটনার যুগ্ম-কার্য (co-effect)। 4 উভয়ে পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফল। আবার, বিদ্যুৎ চমকানো ও বজ্রনিনাদ ঘটনা দুটির মধ্যে পূর্বাপর সম্বন্ধ থাকলেও একটি অন্যটির কারণ নয়। ঘটনা দুটি অন্য একটি ঘটনা এই ঘটনাটি হল মেঘে মেঘে ঘর্ষণ। সুতরাং, কারণ শুধু অপরিবর্তনীয় পূর্বগামী। ঘটনা নয়, শর্তান্তরহীন (unconditional) পূর্বগামী ঘটনা। সাপেক্ষ ;

কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণগুলি

(৬) কারণ কার্যের অব্যবহিত পূর্বগামী ঘটনা (The cause is the immediate antecedent) : 

 কারণ ও কার্যের মধ্যে মধ্যবর্তী কোনো ঘটনা থাকতে পারে না। একটি ঘটনা ঘটার ঠিক পরমুহূর্তে যদি অন্য আর-একটি ঘটনা ঘটে এবং ঘটনা দুটির মাঝখানে যদি অন্য কোনো ঘটনা না ঘটে, তবে প্রথম ঘটনাটিকে অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা বলা যায়। কারণ কার্যের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা। যদি কোনো ঘটনা কোনো কার্যের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা না হয়ে বহুপূর্ববর্তী (remote antecedent) ঘটনা হয়, তবে তাকে ওই কার্যের কারণ বলা যাবে না। অতিবৃষ্টিতে বন্যার ফলে বাড়ি ধসে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে অতিবৃষ্টিকে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ বলা যাবে না। এক্ষেত্রে অতিবৃষ্টি মৃত্যুর পূর্বগামী ঘটনা হলেও অব্যবহিত পূর্বগামী ঘটনা নয়। বাড়ি ধসে যাওয়া মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা, তাই একে কারণ বলতে হবে। সুতরাং, গুণগত দিক থেকে কারণ হল কার্যের নিয়ত বা অপরিবর্তনীয়, শর্তান্তরহীন, অব্যবহিত পূর্বগামী ঘটনা। }

 

 কারণের পরিমাণগত লক্ষণ বলতে কী বোঝায়?

 

(What is meant by the quantitative marks of cause ?)

 

* উত্তর ঃ কারণের পরিমাণগত লক্ষণ হল কারণ ও কার্য সমপরিমাণ। কার্য কারণের রূপান্তরিত অবস্থা। কারণের এই লক্ষণের ভিত্তি হল দুটি বৈজ্ঞানিক নিয়ম। যথা (ক) জড়ের সংরক্ষণ নীতি (The law of the conservation of matter) এবং (খ) শক্তির নিত্যতা নীতি। (The law of the conservation of energy) |

 

(ক) জড়ের সংরক্ষণ নীতি (Law of conservation of matter) : 

 এই নীতি অনুসারে বলা হয় যে, পৃথিবীতে জড়বস্তুর পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে। বস্তুর পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে না। বস্তুর যে পরিবর্তন হয়, তা হল বস্তুর বিশেষ রূপের পরিবর্তন। যেমন- মিশ্রিত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের ওজন যা হবে, ওই মিশ্রণ থেকে উৎপন্ন জলের ওজনও তাই হবে। আবার, জল পরিবর্তিত হয়ে বরফ হয়। কিন্তু জলের পরিমাণ ও বরফের পরিমাণ এক। এই নীতি অনুসারে বলা হয় যে, কারণ কার্যের রূপান্তরিত অবস্থা এবং কারণে যে পরিমাণ জড়সত্তা ও শক্তি থাকে, কার্যের মধ্যেও সেই পরিমাণ জড়সত্তা ও শক্তি থাকে। সুতরাং, জড়ের দিক থেকে কার্য কারণের সমান, কেবল তাদের রূপ ভিন্ন।

 

খ) শক্তির নিত্যতা নীতি (Law of the conservation of energy) :

  এই নীতি অনুসারে বলা হয় যে, এই জগতে শক্তির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে, শক্তির পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে না। যে পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি তা হল শক্তির বিশেষ রূপের পরিবর্তন। কয়লার দহনের ফলে তাপ সৃষ্টি হয়। আবার তাপ বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই নীতি অনুসারে বলা যায় যে, কারণ ও কার্য ভিন্ন নয়। একই শক্তির ভিন্ন রূপ মাত্র। কারণ শক্তিতে যা অব্যক্ত থাকে, কার্য শক্তিতে তা ব্যক্ত হয়। অর্থাৎ কারণের মধ্যে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, কার্যের মধ্যেও সেই পরিমাণ শক্তি থাকবে। সুতরাং, পরিমাণের দিক থেকে কারণ কার্যের সমান। কার্য হল কারণের রূপান্তরিত অবস্থা, কারণ কার্যে রূপান্তরিত হয়। এই বক্তব্যের ভিত্তি হল জড় (matter) এবং শক্তির (energy) অবিনশ্বরতা নীতি।

 

কারণের গুণগত ও পরিমাণগত লক্ষণগুলি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *