ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ Reasons for the Violence against Women in India

 ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ | Reasons for the Violence against Women in India

ভারতে-নারীদের-বিরুদ্ধে-হিংস্রতার-কারণ-Reasons-for-the-Violence-against-Women-in-India

 

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ (Reasons for the Violence against Women in India)

 

Table of Contents

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ:ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে-

 সেগুলিকে প্রধানত পাঁচ ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে, যথা—[১] ভুক্তভােগিনীদের প্ররোচনাদান (the victims’ provocation), [২] মাদকাসক্তি (intoxication), [৩] নারীদের প্রতি বিদ্বেষ (hostility towards women), [8] sfarsfosto Trocal al achtball (situational urge) এবং [৫] ব্যক্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য (personality traits)।

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ ভুক্তভােগিনীদের প্ররােচনাদান:

 

[১] প্রায়শই দেখা যায় যেসব নারী হিংস্রতার শিকার হয়েছে, তারা অবচেতনভাবে অপরাধীদের হিংস্র আচরণে প্ররােচিত করেছে। তাদের আচার-আচরণের ফলে নিপীড়ক বা প্রতারক বা অপহরণকারীর মনে হয়েছে যে, এরূপ আচরণ করলে  সংশ্লিষ্ট মহিলাটি কোনরূপ আপত্তি করবে না বা বাধা দেবে না।  অপরাধীদের মধ্যে নিজ কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা নেহাতই কম। স্ত্রী-প্রহারকারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে কথা চালাচালি করা, তাদের অপছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্তা বলা, তাদের পিতামাতা, ভাই-বােন প্রমুখের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, পারিবারিক দায়দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করা, পর-পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা, তাদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করা কিংবা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযােগ আনে।

  অনুরূপভাবে, ধর্ষণের মতাে ফৌজদারী নিগ্রহের ক্ষেত্রে নিগ্রহকারীদের অভিযােগ হােল—ধর্ষিতারাতাদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাদের প্ররােচিত করেছে। তবে ধর্ষিতারা সত্যিই তাদের প্ররােচিত করেছিল কিনা এবং করে থাকলে কতখানি করেছে, তা পরিমাপ করা যথেষ্ট কঠিন। অভিযুক্তদের বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের মতাে অভিযােগকারিণীরাও সমভাবে দোষী। বলা বাহুল্য, এইসব ক্ষেত্রে কে প্রকৃত অপরাধী, তা নির্ধারণ করা যথেষ্ট কঠিন হলেও একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কেউ প্ররােচিত করেছে বলেই যে সে এরূপ করেছে, তা মেনে নেওয়া আদৌ সমীচীন নয়। একই কথা বলা যায় হত্যার ক্ষেত্রে। হত্যাকারীরা নিজেদের সপক্ষে যে-যুক্তি খাড়া করে, তা হােল—প্রথমে সামান্য কথা কাটাকাটির ফলে নিহত মহিলারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে, উত্তেজনার বশে তাদের খুন করা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। 

 এরূপ ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যেহেতু মহিলাটি আর জীবিত নেই, সেহেতু প্রকৃত ঘটনা জানারও আর কোন সুযােগ থাকে না। তবে নারীহত্যার মতাে ঘটনা ঘটাতে যারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না, তারা নিশ্চিতভাবে অপরাধী। চরম শাস্তিই তাদের প্রাপ্য। তবে হরণের ক্ষেত্রে অনেক সময় অপরাধীদের সঙ্গে মহিলারা স্বেচ্ছায় স্বগৃহ থেকে চলে গেছে এবং তাদের বিবাহও করেছে, এমন নজির অনেক রয়েছে। কিন্তু মহিলার পিতামাতার অভিযােগক্রমে পুলিশ যখন তাদের উভয়কেই গ্রেপ্তার করেছে, তখন সংশ্লিষ্ট মহিলা সব দোষ পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়। অপহরণের ৩৯% ক্ষেত্রে মহিলারা স্বেচ্ছায় অপরাধীদের সঙ্গে চলে গেছে এবং ২৪% ক্ষেত্রে তাদের বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে হরণ করা হয়েছে।

 ১৭% ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে যেতে মহিলাটি যেমন আপত্তিও করেনি, তেমনি আবার স্বেচ্ছায়ও যায়নি। আবার, ২০% ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, মহিলাটি স্বেচ্ছায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে স্বগৃহ থেকে চলে যাওয়ার পর যখন ধর্ষিতা হয়েছে কিংবা তার সব অলঙ্কার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে অথবা তাকে কোন হােটেলে একা ফেলে রেখে অভিযুক্ত ব্যক্তি চলে গেছে, তখন তার অনুশােচনা হয়েছে। সুতরাং ভুক্তভােগিনীদের প্ররােচনাদানকে ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

 

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ মাদকাসক্তি:

 

[২] হিংস্রতার এমন অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে যে-ক্ষেত্রে আক্রমণকারী মাদকাসক্ত অবস্থায় কিংবা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণায় অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে আবেগতাড়িত হয়ে দুষ্কর্মে  লিপ্ত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু কিছু ধর্ষণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় মদ্যপানের ফলে ধর্ষণকারীর পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভদ্রজনােচিত আচরণ করলেও মদ্যপানের ফলে তার স্বাভাবিক বােধশক্তি লােপ পায়। রাম আহুজা তার গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, মাদকাসক্তির সঙ্গে হিংস্রতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষতঃ, স্ত্রী-প্রহারের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটতে দেখা যায়। এরূপ ঘটনার ৩১.৭% ক্ষেত্রে মদ্যপানকারী স্বামীরা স্ত্রীদের নির্মমভাবে প্রহার করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মদ্যপানের সঙ্গে স্ত্রী প্রহারের কোন সম্পর্ক থাকে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, রক্তের সঙ্গে মদের দ্রবীভবন খুব বেশি ঘটলে অপরকে আঘাত করার মতাে কোন ক্ষমতা মদ্যপানকারীর থাকে না। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, যারা স্ত্রীদের অতিমাত্রায় প্রহার করে, তারা কখনই অধিক পরিমাণে মদ্যপান করে না। অবশ্য এই ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে যে, যারা হিংস্র আচরণ করে, তাদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট কার্যে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে মদ্যপান করে। আবার, এও ঘটতে দেখা গেছে যে, অনেকে অস্বাভাবিক মদ্যপান করেও হিংস্র আচরণ করে না। সুতরাং মদ্যপানকে হিংস্রতার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়।

 

নারী-বিদ্বেষ:

 

[৩] নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব অনেকের স্বভাবজাত। এরূপ মনােভাবের জন্য তারা নারীদের নানাভাবে নির্যাতন করে। নারী বিদ্বেষী মনােভাবের সঙ্গে শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। অপরাধীদের অনেকেই পুরুষদের সঙ্গে আচার-আচরণের সময়  স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও নারীদের সঙ্গে আচার-আচরণের সময় তাদের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। মূলতঃ নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতাই এরূপ আচরণ করার জন্য তাদের উৎসাহিত করে। গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, সাধারণভাবে যুক্তিবাদী হলেও এরূপ অপরাধীদের একটি বড় অংশই নারীদের সঙ্গে আচরণের সময় যুক্তি অপেক্ষা আবেগ ও উত্তেজনার দ্বারা বেশি পরিচালিত হয়।

ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ

পরিস্থিতিগত উত্তেজনা:

 

[৪] নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে যে, পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত কারণে অপরাধীদের একটি বড় অংশ ধর্ষণ, স্ত্রী-প্রহার, অপহরণ বা হরণের মতাে দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে মহিলাদের প্ররােচনা কিংবা মাদকাশক্তি  অথবা নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাবের জন্য নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের এরূপ অপরাধমূলক আচরণের সুযােগ করে দিয়েছে। হরণ হিসেবে বলা যায়, স্ত্রী-প্রহারের ক্ষেত্রে আর্থিক কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি পুত্রবধূর দুর্ব্যবহারকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটি শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত স্ত্রী-প্রহারের রূপ পরিগ্রহ করে। এক্ষেত্রে যদি স্ত্রীরা উত্তেজক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকে, তাহলে হয়তাে প্রহারের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম থাকে। আবার, ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি হঠাৎ তার পরিচিত কোন মহিলা বা বান্ধবীকে কোন নির্জন স্থানে দেখতে পেয়ে তারা উভয়েই নানাধরনের কথাবার্তা বা গল্পগুজবে মেতে ওঠে। এরূপ পরিস্থিতিতে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ফলে পুরুষটির মধ্যে ঐ মহিলাটিকে পাওয়ার আকাঙক্ষা জাগে। অনেক সময় কোন অফিসের আধিকারিক বা কোন সংস্থার মালিক যথাক্রমে তার অধঃস্তন বা নিযুক্ত মহিলা কর্মীকে নির্দিষ্ট কাজের সময়ের পর অফিস বা কারখানায় একাকী পাওয়ার ফলে তার আদিম বাসনা জেগে উঠতে পারে। একইভাবে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের অনুপস্থিতিতে গৃহকর্তা পরিচারিকাকে একা পেয়ে তাকে ধর্ষণ করতে পারে। এরূপ ধর্ষণের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত নয়। পরিস্থিতিগত কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এসব ক্ষেত্রে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতামূলক আচরণকারীরা আবেগ বা উত্তেজনার বশে অসামাজিক কার্যে লিপ্ত হলেও তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনরূপ সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায় না।

 

 

ব্যক্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য:

 

[৫] মানুষের কিছু কিছু ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নারীদের প্রতি হিংস্রতামূলক আচারআচরণের কারণ বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে সন্দেহপরায়ণতা, আবেগসর্বতা, কর্তৃত্বকারী মনােভাব, যুক্তিহীনতা, ঈর্ষাপরায়ণতা প্রভৃতির কথা উল্লেখ  করা যায়। নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতামূলক আচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশের মধ্যে এই ধরনের ব্যক্তিত্বগত বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। সাধারণতঃ শৈশব বা কৈশােরাবস্থায় নিজের পরিবারের মধ্যে হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করার ফলে সংশ্লিষ্ট শিশু বা কিশােরের হিংস্র মনােভাব গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি শিশু বা কিশাের যখন তার পিতা কর্তৃক মাতার লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ করে কিংবা কারণে-অকারণে পিতা কর্তৃক নিজে প্রহৃত হয়, তখন তার মনের ওপর সেই ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে দেখা যায়। অনুরূপভাবে, কোন শিশু বা কিশাের যদি প্রায়শই তার পিতাকে মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে চিৎকার-চেঁচামেচি ও জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে দেখে, তাহলে সেই শিশুটির চারিত্রিক বিকাশ কখনই যথাযথভাবে ঘটতে পারে না। 

 বস্তুতঃ, যেসব পরিবার অসুখী এবং যেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সামাজিক বিচ্যুতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরাও সাধারণতঃ ভবিষ্যৎ জীবনে নানাধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের যথাযথ সামাজিকীকরণ না ঘটার ফলে সামাজিক নীতিবােধ, মূল্যবােধ প্রভৃতি তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা নারীদের সঙ্গে হিংস্রতাপূর্ণ আচরণের পথে পা বাড়ায়। বস্তুতঃ, গৃহের অশান্ত পরিবেশ শিশু বা কিশােরকে ভবিষ্যৎ জীবনে অশান্ত করে তােলে। তাই তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যে লিপ্ত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

 

| প্রতিকারের ব্যবস্থা (Remedial Measures)

 

নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতােই ভারতের সমাজ-জীবনে একটি কঠিন সামাজিক ব্যাধি বলে বিবেচিত হয়। সমাজের বুক থেকে এটিকে নির্মূল করা প্রয়ােজন। অন্যথায় তা পচনশীল ঘায়ের মতাে সমগ্র সমাজ-জীবনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার ফলে সভ্য সমাজ-জীবন বন্য বা বর্বর জীবনের রূপ পরিগ্রহ করে সমগ্র সমাজকেই ধ্বংসের পথে দ্রুত ঠেলে দিতে সক্ষম। নিম্নলিখিত কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতামূলক আচরণ বন্ধ করা সম্ভব ।

 

ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করা:

 

[১] মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজকে কেবল কাগজে কলমে অর্থাৎ সংবিধান, আইন প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য ধারাবাহিকভাবে  সংগ্রাম পরিচালনা করা প্রয়ােজন। কিন্তু এই আন্দোলন বা সংগ্রামে পরিচালনা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে সামিল করতে না পারলে তা কখনই সাফল্যলাভ করতে পারবে না। সেজন্য মানবাধিকার ‘সেল’ (cell) গঠন করা প্রয়ােজন। এর কাজ হবে মানবাধিকার ভঙ্গের ঘটনাগুলিকে লিপিবদ্ধ করা এবং সেগুলির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে গড়ে তােলা।

 

উপযুক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন প্রশাসনিক সংস্থা গঠন:

 

[2] মানবাধিকার কার্যকর করার জন্য প্রশাসনিক সংস্থা গঠনের প্রয়ােজন। এই সংস্থার হাতে মানবাধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে যথােচিত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাকে রূপায়ণ করার ক্ষমতা  প্রদান করতে হবে। প্রয়ােজনে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা প্রতিরােধের  উদ্দেশে একটি পৃথক প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে হবে এবং তাকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযােগ ও ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়ােজন। এরূপ কর্তৃপক্ষ যাতে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, সেজন্য সংস্থার পদাধিকারীদের নিয়ােগ, বেতন, ভাতা ইত্যাদি প্রদান, চাকুরির নিরাপত্তা রক্ষা প্রভৃতির জন্য প্রয়ােজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা কীভাবে প্রতিরােধ করা যায়, সে বিষয়ে আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে তারা নিরপেক্ষ ও আন্তরিকভাবে নারীদের মানবাধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে ঠিক সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

 

শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বৃদ্ধি

 

[৩] স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের মানবাধিকার, বিশেষতঃ নারীদের মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন করে ভােলার উদ্দেশে মানবাধিকার গােষ্ঠী ও কমিটি (Human Rights Groups and Committees) গঠন করা অত্যন্ত জরুরী।  তাছাড়া, মানবাধিকারকে যেমন পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তেমনি মানবাধিকার রক্ষা কিংবা মানবাধিকার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের ওপর পরীক্ষায় একটি আবশ্যিক পত্র (Compulsory Paper) থাকা বাঞ্ছনীয়। 

 

গণ-সচেতনতা বৃদ্ধি:

 

[৪] বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতিতে নিয়মিতভাবে আলােচনাসভা অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযােগিতা ও বিতর্কসভা আয়ােজন প্রভৃতির মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করে গড়ে তােলার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া, প্রতি বছর মানবাধিকার দিবস’  (Human Rights Day) উদযাপনের ব্যবস্থা করা এবং ঐ দিনটিতে মানবাধিকার রক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে আলােচনাসভা, পদযাত্রা, নাটকাভিনয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। এসবের মাধ্যমে মানবাধিকার সম্পর্কে গণ-সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং নারীর মানবাধিকার-সহ যে-কোন মানবাধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে জনসাধারণ রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।

 

কু-প্রথা, আইন বা নিয়মের বাতিলকরণ:

 

[৫] মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যে-কোন সামাজিক প্রথা, আইন বা নিয়ম অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। দেবদাসী প্রথা ও সতী প্রথার মতাে যেসব সামাজিক প্রথা এখনও বর্তমান রয়েছে, সেগুলিকে বে-আইনী বলে ঘােষণা করা  ছাড়াও এসব প্রথা-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বা তার সপক্ষে প্রচারকার্যে

 

 

লিপ্ত কোন ব্যক্তি, গােষ্ঠী বা সংগঠনের বিরুদ্ধে আইন মােতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনরূপ রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে চলবে না। ধর্মের নামে অসামাজিক কাজকর্ম বন্ধের জন্য কেবল আইন প্রণয়ন করাই যথেষ্ট নয়, একাজে সচেতন জনগণকে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

 

বিভিন্ন সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা পালন:

 

[৬] সরকারী ও বেসরকারী মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলিকে মানবাধিকার রক্ষায়, বিশেষতঃ নারীদের অধিকার রক্ষায় অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে সম্প্রতি অনেকগুলি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের  বিরুদ্ধে অভিযোেগ উঠেছে যে, তারা মানবাধিকার রক্ষার নামে যেসব প্রকল্প চালু করেছে, সেগুলি কার্যতঃ বিদেশী সরকারের এজেন্ট হিসেবে নানাপ্রকার দুরভিসন্ধিমূলক কার্যে লিপ্ত রয়েছে। তাই এই ধরনের প্রতিটি সংগঠনের ভূমিকা সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হওয়ার পর সরকারের উচিত তাদের কাজ করতে দেওয়া।

 

চরম শাস্তিদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা:

 

[৭] নারী ধর্ষণের মতােই নারীর অপহরণ বা হরণ, বধূ-হত্যা প্রভৃতির জন্য অপরাধীকে চরম শাস্তিদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা উচিত। তাছাড়া, গৃহতল্লাশির সময় আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ কর্মচারীরা ধর্ষণসহ নারীদের অন্যান্য  ঘটনা ঘটালে তাদের বিরুদ্ধেও চরম দণ্ডের ব্যবস্থা করা আইন প্রণয়ন প্রয়ােজন। জেলের মধ্যে মহিলা-অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশ যাতে দুর্ব্যবহার করতে না পারে, তা লক্ষ্য রাখার জন্য সৎ ও দায়িত্বশীল অফিসারদের নিয়ােগ করা প্রয়ােজন।

 

প্রাণ-পরীক্ষা বন্ধের জন্য আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ

 

[৮] ভ্রূণ-পরীক্ষাকে কেবল দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘােষণা করাই যথেষ্ট নয়, এরূপ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ডাক্তার এবং পরিবারের লােকজনদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। যেসব পরীক্ষাগারে এই ধরনের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের কাছে এই মর্মে  সরকারী নির্দেশ প্রেরণ করা প্রয়ােজন যে, ভ্রুণ-পরীক্ষার কার্যে  সহযােগিতা করলে তাদের পরীক্ষাগার কেবল বন্ধ করেই দেওয়া হবে , সেই সঙ্গে তাদের ফৌজদারী অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে।

 

[a] বিশেষ নারী মানবাধিকার ফোরাম (Special Women Human Rights Forum) গঠন করা প্রয়ােজন। নারীদের মানবাধিকার রক্ষা এবং সে সম্পর্কে ‘ফোরাম’ গঠন জনমত গঠনের দায়িত্ব এই ফোরামের হাতে প্রদান করা উচিত।

 

বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ

 

[১০] প্রত্যন্ত গ্রাম, উপজাতি অঞ্চল এবং তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য কিছু কিছু ‘ বিশেষ কর্মসূচী’ (Special Programmes) গ্রহণ করতে হবে। এই কর্মসূচী অনুযায়ী ঐসব পরিবারের বালিকাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা বাধ্যতামূলক কার্য  বলে বিবেচিত হবে। তবে কোন পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হলে মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলিকে সরকার আর্থিক সাহায্যদান কিংবা সংশ্লিষ্ট মেয়েদের ছাত্রবৃত্তি (scholarship) প্রদান করবে। এতদসত্ত্বেও কোন পিতামাতা তাদের মেয়েদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করতে রাজী না হলে তাদের কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা সরকারকে চালু করতে হবে।

 

বিবাহ বিচ্ছেদের পর মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ:

 

[১১] সাধারণভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরােধ ও ভুল বােঝাবুঝির ফলে স্ত্রীপ্রহারের ঘটনা ঘটে। এরূপ ভুল বােঝাবুঝি বা মতবিরােধের অবসান ঘটানাের জন্য প্রথমে প্রতিবেশীদের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়ােজন। প্রতিবেশীরা তা করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় বিচ্ছেদকরণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়ােজন। নারীরা যাতে

সহজে বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে পারে এবং সে কাজে তারা যাতে সহজে ও বিনা খরচে আইনের সাহায্য নিতে পারে, তা দেখা সরকারের কর্তব্য। আবার, বিবাহ বিচ্ছেদের পর কোন নারী যাতে আর্থিক অসুবিধার মধ্যে না পড়ে, সেজন্য তার ভরণ-পােষণের জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ স্বামী যাতে প্রদান করতে বাধ্য হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়ােজন হলে সরকারকেও তাদের দিকে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

 

নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ :

 

[১২] ভারতে মহিলাদের সংখ্যা মােট জনসংখ্যার প্রায় ৫০%। সুতরাং পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থিত পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলিতে নারীদের জন্য ৫০% আসন সংরক্ষণ করা প্রয়ােজন। এরূপ করা হলে নারীদের ওপর পুরুষের একাধিপত্য নারীদের জন্য আসন বিস্তারের প্রয়াস প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া, মন্ত্রিসভা কিংবা সংরক্ষণ স্থানীয় প্রশাসনে পুরুষদের মতােই নারীদের সমান অধিকার থাকা একান্তভাবে প্রয়ােজন।

 

মূল্যবোধ পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ:

 

[১৩] পরিবারের মধ্যে স্ত্রীলােকেরা যাতে পুরুষদের মতােই সমান মর্যাদার অধিকারী হতে পারে, সেজন্য মূল্যবােধ পরিবর্তনের উদ্দেশে যথােচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়ােজন। এই উদ্দেশ্যকে সফল করে তুলতে হলে নারীদের মানসিক উৎকর্ষবিধান  দরকার। পতি পরম গুরু’, ‘স্ত্রী স্বামীর দাসী’ প্রভৃতি মনােভাব জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ পরিবর্তনের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে স্বামীর পাদোদক পানের মতাে নারী-মর্যাদার অবনমনকারী কুপ্রথা ও আচার-আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

মানসিকতার পরিবর্তন:

 

[১৪] পণপ্রথা-বিরােধী আইন প্রণীত হলেও পণ বা যৌতুকের জন্য ভারতের বিভিন্ন অংশে বধূ-নির্যাতন ও বধূহত্যার যেসব ঘটনা দৈনন্দিন ঘটে চলেছে, সেগুলি প্রতিরােধ করতে হলে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।  সেজন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে।

 

আইনগত ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ

 

[১৫] বিধবাদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা প্রতিরােধের জন্য আইন প্রণয়ন এবং প্রণীত আইনের যথাযথ রূপায়ণ যেমন প্রয়ােজন, তেমনি স্বামীর সম্পত্তি বিধবারা যাতে লাভ করতে পারে তা নিশ্চিত করা সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য। আবার, বৃদ্ধ ও অক্ষম  পিতামাতার প্রতিপালনের দায়িত্ব সন্তান যাতে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়,  সেজন্য সংবিধান সংশােধনের প্রয়ােজন। সংবিধানে পিতামাতার প্রতিপালনকে সন্তানের মৌলিক কর্তব্য বলে ঘােষণা করতে হবে।

 

কুরুচিপূর্ণ সঙ্গীত, চলচ্চিত্র বন্ধের ব্যবস্থা:

 

[১৬] নারীদের উত্যক্ত করাকে উপেক্ষা করা আদৌ সমীচীন নয়। তাই এ ধরনের যে-কোন আচরণকে আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘােষণা করা  প্রয়ােজন। তাছাড়া, যেসব সঙ্গীত, চলচ্চিত্র প্রভৃতিতে নারীদের প্রতি  অবমাননাকর কিংবা কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা রয়েছে, সেগুলির প্রচার বন্ধ করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

উপসংহার:

  কিন্তু কেবল সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যবস্থাবলী নারীদের বিরুদ্ধে কখনই হিংস্রতার প্রতিরোধ করতে পারে না, সেজন্য প্রয়োজন প্রচলিত মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন। যতদিন পর্যন্ত আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন সাধিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত নারীদের অধিকার যথার্থভাবে কখনই রক্ষিত হতে পারবে না। বলা বাহুল্য, সেজন্য একদিকে যেমন নারীশিক্ষার বিস্তার প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি নারীদের অধিকার রক্ষার সপক্ষে জনমত গঠন করা বিশেষ জরুরী। তবে একথা সত্য যে, প্রতিটি দেশের বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী মুখে নারী-মুক্তি, নারী-আন্দোলন, নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতির কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তারা বিপরীত আচরণই করে থাকে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এরূপ সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটিয়ে নারীদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা প্রতিরোধের প্রয়াস কখনই সফল হতে পারে না।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *