ভারতের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো-Teacj Sanjib
ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো-Teacj Sanjib
ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য
সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও প্রস্তাবনা
প্রশ্ন । ভারতীয় সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর। (Discuss the salient features of the constitution of India.)
ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য:
উত্তর : পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই একটি করে সংবিধান থাকতে দেখা যায়। এই সংবিধান হল সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন। নিয়ে ভারতীয় সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করা হল।
ভারতীয় সংবিধান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংবিধান:
(১) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংবিধান : ভারতের সংবিধান পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান। আদি সংবিধানে ৩৯৫টি ধারা, নানা উপধারা এবং ৮টি তালিকা ছিল। পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধান বহুবার সংশোধিত হওয়ার ফলে কয়েকটি নতুন ধারা ও তালিকা সংযোজিত হয়েছে। বর্তমানে এই সংবিধানে ৪০৫টি ধারা, বহু উপধারা এবং ১২টি তালিকা আছে। সংবিধানটি এত বড় হওয়ার কারণ এই যে, এতে একদিকে উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র ও গান্ধীবাদ প্রভৃতি বিভিন্ন মতাদর্শের সহাবস্থান ঘটান হয়েছে; অপরদিকে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সাংবিধানিক অভিজ্ঞতা থেকে নানা বিধি-বিধান সংগ্রহ করে সংবিধানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতা বন্টন, সরকারি ও আঞ্চলিক ভাষা সংক্রান্ত আলোচনা, বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি বিষয়গুলি সংবিধানে স্থান পাওয়ার জন্য এর আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
- আরো পড়ুন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা কর।
- ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদা আলোচনা কর
ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য:ভারতের সংবিধান লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের সংমিশ্রণ:
(২) লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের সংমিশ্রণ : ভারতীয় সংবিধান মূলত লিখিত হলেও এর মধ্যে অলিখিত সংবিধানের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথা, শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রভৃতি ভারতীয় সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উদাহরণস্বরূপ লোকসভায় কোন সরকারি বিলের ওপর ভোট গ্রহণের সময় সরকার পক্ষের পরাজয় ঘটলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে—সংসদীয় গণতন্ত্রের এই প্রথাটি ভারতীয় সংবিধানে লিখিত অবস্থায় নেই।
সংবিধানের প্রস্তাবনা:
(৩) প্রস্তাবনা : মার্কিন যুক্তেরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানে একটি প্রস্তবনা সংযোজিত হয়েছে। এই প্রস্তাবনাতে সংবিধানের উৎস, নৈতিক আদর্শ ও মূল লক্ষ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া আছে। প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতা, প্রত্যেক ব্যক্তির সমমর্যাদা এবং সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথাও প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।
নমনীয় ও অনমনীয় সংবিধানের সংমিশ্রণ
(8) নমনীয় ও অনমনীয় সংবিধানের সংমিশ্রণ : ভারতীয় সংবিধান অংশত নমনীয় এবং অংশত অনমনীয়। নতুন রাজ্যের সৃষ্টি, পুরাতন রাজ্যের সীমানা বা নাম পরিবর্তন, বিধান পরিষদের সৃষ্টি অথবা বিলোপ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের।
সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতা বন্টন, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়গুলিকে সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন ছাড়াও রাজ্যগুলির অন্তত অর্ধেকের সমর্থন প্রয়োজন।
(৫) যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার সমন্বয় :
লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতা বন্টন, নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের অবস্থিতি প্রভৃতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতে বিদ্যমান। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিকতার দিকে প্রবল ঝোঁক লক্ষ্য করে কোন কোন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ভারতকে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ বলে অভিহিত করেছেন।
(৬) সংসদ শাসিত শাসনব্যবস্থা : ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতবর্ষে মন্ত্রিপরিষদ চালিত শাসনব্যস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের যাবতীয় শাসনসংক্রান্ত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করা হলেও রাষ্ট্রপতি হলেন একজন নাম সর্বস্ব শাসন-প্রধান। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা তাঁর হাতে নেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রিপরিষদ।
(৭) মৌলিক অধিকার :
ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে ৬ প্রকার মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অধিকারগুলি হল— (ক) সাম্যের অধিকার, (খ) স্বাধীনতার অধিকার, (গ) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (ঘ) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, (ঙ) সংস্কৃতি ও শিক্ষা সম্পর্কিত অধিকার এবং (চ) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। বলা বাহুল্য, এই অধিকারগুলি অবাধ নয়। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে অধিকারগুলির ওপর যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অধিকারগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, কর্মের অধিকার বা অন্য কোন অর্থনৈতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকারের অধ্যায়ে স্থান দেওয়া হয়নি।
(৮) মৌলিক কর্তব্য : ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের দশটি মৌলিক কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। যদিও এই কর্তব্যসমূহ আদালতের দ্বারা বলবৎ করা যায় না, কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য ও স্বদেশপ্রীতির মনোভাব জাগ্রত করার জন্য এগুলির একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি সমূহ:
(৯) নির্দেশমূলক নীতি : আয়ারল্যাণ্ডের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে ৩৬ থেকে ৫১নং অনুচ্ছেদে কতকগুলি রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্দেশমূলক নীতির উল্লেখ করা হয়েছে। এই অধিকারগুলি মৌলিক অধিকারের ন্যায় আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য না হলেও, নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং জনকল্যাণকর সমাজ গঠনের পক্ষে এগুলি অপরিহার্য।
(১০) বিচারালয়ের প্রাধান্য এবং পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের মধ্যে সমন্বয় : ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারবিভাগের প্রাধান্য –এই দুই ব্যবস্থার
মধ্যে ভারতীয় সংবিধানে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। সংবিধানের অভিভাবক ও মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসাবে সুপ্রীম কোর্টের ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়েছে, আবার একই সঙ্গে সংবিধান নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয়েছে।
(১১) ধর্ম নিরপেক্ষতা : ভারতীয় সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না।
বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা:
(১২) বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা: ভারতীয় সংবিধানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনুন্নত শ্রেণীর উন্নতিবিধানের জন্য কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৩০ থেকে ৩৪০ নম্বর ধারায় তফশিলভুক্ত জাতি, উপজাতি ও ইঙ্গ-ভারতীয়দের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য কথা বলা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে আইনসভায় আসন সংরক্ষণ, সরকারী চাকুরিতে পদ সংরক্ষণ, শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ আর্থিক আনুকূল্য প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
(১৩) এক নাগরিকত্ব: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় ভারতবর্ষে দ্বি-নাগরিকত্ব স্বীকার করা হয় নি। ভারতের জনগণ সকলেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অধীন। কোন অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্ব এখানে স্বীকার করা হয়নি।
জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ব্যবস্থা:
(১৪) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ব্যবস্থা: ‘সংকটকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ভারতীয় সংবিধানের জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিশেষ ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৫২, ৩৫৬ এবং ৩৬০ নং ধারা অনুসারে যথাক্রমে জাতীয় জরুরি অবস্থা, রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা এবং আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এই জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে অনেকে অযুক্তরাষ্ট্রীয় বলে সমালোচনা করেন।
ভারতের সংবিধানের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য:
(১৫) অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : সমাজতন্ত্রবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি, দলত্যাগ বিরোধী আইন, শান্তির আদর্শ, সার্বিক প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি, ভাষা সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ব্যবস্থা ইত্যাদি হল ভারতীয় সংবিধানের অপরাপর বৈশিষ্ট্য।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাগণ যতখানি ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রমুখ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, ততখানি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা গণ সাধারণতন্ত্রী চীনের ন্যায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি।