ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ব্যাখ্যা করো? ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য

 

ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ব্যাখ্যা করো? ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য

 

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করা হয়েছে

ভারতের পররাষ্ট্র নীতি(India’s Foreign Policy)

ভারতের-পররাষ্ট্র-নীতি-ব্যাখ্যা-করো-ভারতের-পররাষ্ট্র-নীতির-প্রধান-বৈশিষ্ট্য

 

■ ভূমিকা ( Introduction)

 

ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে আদর্শবাদ ও বাস্তববাদের সমন্বয় : 

 

 প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান লক্ষ্য হোল জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৪৭ সালে আত্মপ্রকাশ করার পর ভারত তার জাতীয় স্বার্থে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারত ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে থাকায় তার পক্ষে স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। তবে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রতি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁদের যে-মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে। 

 তাছাড়া, সম্রাট অশোক থেকে শুরু ক’রে মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত মহামনীষীরা শান্তি, সৌভ্রাত্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির যে-বাণী প্রচার করেছিলেন, ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে তার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতের পররাষ্ট্র নীতি আদর্শবাদ এবং বাস্তববাদ (idealism and realism)-এর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ পরিবেশ, রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং সামরিক সামর্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুতঃ, ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন বিশ্ব-রাজনীতির দ্বি-মেরুকরণ (bi-polarization) যেমন ঘটেছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোটের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ (Cold War) শুরু হয়ে গেছে। 

 তাছাড়া, ঐ সময় এশিয়া ও আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদ (racism) আসর জাঁকিয়ে বসেছিল। এমতাবস্থায় স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতের যে-পররাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করেন, তা ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ভারতের পররাষ্ট্র নীতির এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যা সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।

 

■ ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ (Main Features of Indian Foreign Policy)

 

ভারতের পররাষ্ট্র নীতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য পরের পাতায় আলোচনা করা হল।

 

[১] জোট-নিরপেক্ষতা (Non-alignment) ঃ 

 

জোট নিরপেক্ষতার অর্থ ও প্রকৃতি —

 

 

ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির প্রথম ও প্রধান

 বৈশিষ্ট্য হোল জোট-নিরপেক্ষতা। সাধারণভাবে জোট-নিরপেক্ষতা বলতে সামরিক জোট থেকে অনেক দূরে অবস্থান করার নীতিকে বোঝায়। বিশ্লেষণ করে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরস্পর-বিরোধী যে-দু’টি শক্তিজোট বা সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল, তার কোনটিতে যোগদান না করাই হোল জোট-নিরপেক্ষতা। তবে জোট-নিরপেক্ষতা বলতে পুঁজিবাদী শিবির কিংবা সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে সমদূরত্ব (equi-distance) বজায় রাখার নীতিকে বোঝায় না। 

 জোট-নিরপেক্ষতা বলতে জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী স্বাধীন নীতির অনুসরণকে বোঝায়। বস্তুতঃ, জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র দু’টি অতি-বৃহৎ শক্তি (super powers)-র বিরোধ থেকে নিজেকে যেমন শত-সহস্র যোজন দূরে সরিয়ে রাখে না, তেমনি সে ব্যাপারে মধ্যপন্থাও অবলম্বন করে না। বরং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করতে, এমনকি যে-কোন পক্ষকে সমর্থনও জানাতে পারে। সুতরাং জোট-নিরপেক্ষতা বলতে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার নীতিকে বোঝায় না। তাই জোট-নিরপেক্ষতাকে ‘গতিশীল নিরপেক্ষতা’ (dynamic neutrality) বলে চিহ্নিত করা হয় (এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ১৯৪৬ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেহরু মন্তব্য করেছিলেন যে, পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারত একটি স্বাধীন নীতি অনুসরণ করবে এবং গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক ক্ষমতার রাজনীতিগত বিরোধ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। সেই সঙ্গে তিনি একথাও বলেছিলেন যে, দেশের স্বাধীনতা ও ন্যায়-নীতি বিপর্যস্ত হলে ভারত নিরপেক্ষ থাকবে না, নিরপেক্ষ থাকতে পারে না।

  ১৯৫৬ সালের ১৭ই মার্চ তিনি লোকসভায় দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, আমরা কেবল নিরপেক্ষ বা নেতিবাচক নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী নয়। আমরা ইতিবাচক নীতি অনুসরণ করতে চাই। যে-দেশ ন্যায্য পথে চলবে, আমরা তাদের সাহায্য করব। কিন্তু যারা আমাদের পছন্দ-বিরোধী কাজ করবে, আমরা তাদের বিরোধিতা করতে দ্বিধা করব না। ভারত উপনিবেশগুলির জনগণের স্বাধীনতার সপক্ষে এবং বিশ্বের যে-কোন স্থানে সংঘটিত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধাচরণ করবে। সেই সঙ্গে সে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সদিচ্ছার বিস্তার সাধনের জন্য শান্তিপ্রিয় জাতিসমূহের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রয়াস চালাবে। নেহরু আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতি জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হবে।(এই নীতি ভারতকে একটি নতুন ও তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে।) সুতরাং বলা যায়, জোট-নিরপেক্ষতা বলতে দু’টি বৃহৎ শক্তিজোট থেকে সম-দূরত্ব বজায় রাখা কিংবা আন্তর্জাতিক সমস্যার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণ করাকে বোঝায় না। জোট-নিরপেক্ষতা হোল সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও জাতিবিদ্বেষবাদ-বিরোধী এমন একটি আন্দোলন, যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বিশ্বশান্তি ও জাতীয় নিরাপত্তার নীতিতে গভীরভাবে আস্থাশীল।

 

অনেক সময় জোট-নিরপেক্ষতাকে ‘নিরপেক্ষতা’ (neutrality) বা ‘নিরপেক্ষতাবাদ’ (neutralism)-এর সমার্থক বলে মনে করা হয়। কিন্তু নিরপেক্ষতা এবং জোট-নিরপেক্ষতা অভিন্ন নয়। এদের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলি হোল –[i] জোটনিরপেক্ষতা বলতে দু’টি শক্তিজোটের কোনটিতেই যোগদান না করাকে বোঝালেও

 

 

জোট নিরপেক্ষতার সঙ্গে নিরপেক্ষতার পার্থক্য :

 

 প্রকৃতিগতভাবে তা সাম্রাজ্যবাদ, , শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, শান্তি ও নিরাপত্তার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি আন্দোলন। তাই জোট-নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিরোধ সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করতে কিংবা ঐ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতা করতে পারে। আসলে জোট-নিরপেক্ষতা বলতে কার্যক্ষেত্রে সামরিক জোট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাকে বোঝায়। কিন্তু নিরপেক্ষতা বলতে যে-কোন আন্তর্জাতিক সমস্যার ব্যাপারে নিস্পৃহ মনোভাব বা ঔদাসীন্য প্রদর্শনকে বোঝায়। একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোন আন্তর্জাতিক বিরোধ বা সমস্যার ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করে না এবং পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে সম-দূরত্ব বজায় রাখার নীতি অনুসরণ ক’রে থাকে।

  [ii] আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরপেক্ষ বলে পরিচিত হওয়ার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি একান্তভাবেই অপরিহার্য। এর অর্থ—একটি দেশকে তখনই নিরপেক্ষ বলা হবে, যখন অন্যান্য দেশ তাকে নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি প্রদান করবে। কিন্তু জোট-নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের কিংবা জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হওয়ার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। বস্তুতঃ, আন্তর্জাতিক আইনে জোট-নিরপেক্ষতার কোন স্বীকৃত মানদণ্ড নেই।

  [iii] নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ওপর আন্তর্জাতিক আইন কতকগুলি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যুদ্ধরত কোন দেশকে আর্থিক বা সামরিক সাহায্য প্রদান করতে কিংবা নিজের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করতে দিতে পারে না। কিন্তু জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী এইসব বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয় না। 

 [iv] নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ভূ-খণ্ডগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব যুদ্ধ ও শান্তির সময় সমভাবেই অন্যান্য রাষ্ট্র স্বীকার করে নেয়। কিন্তু জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়।

  [v] যুদ্ধকালীন সঙ্কটের সময় কিংবা দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে যুদ্ধবন্দী বিনিময়, কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের স্থানান্তর, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংযোগসাধন প্রভৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্য নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক সম্পাদিত হতে পারে। কিন্তু জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি আইনগতভাবে এইসব দায়িত্ব পালন করার অধিকারী নয়। সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, লাওস প্রভৃতি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 

জোট-নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের কারণ:

  ভারতে পররাষ্ট্র নীতির প্রধান স্তম্ভ হোল জোট-নিরপেক্ষতা এবং জোট-নিরপেক্ষতার প্রধান রূপকার হলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। জোট-নিরপেক্ষতাকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান স্তম্ভে পরিণত করার পেছনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল বলে তাত্ত্বিকরা মনে করেন, সেগুলি হোল :

 

[i] প্রায় দু’শ বছর ধরে ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে থাকার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। ভারতের এই সময়কার ইতিহাস হোল সাম্রাজ্যবাদী  শাসন ও শোষণের ইতিহাস। স্বাধীনতা লাভের পর পণ্ডিত নেহরু তথা জাতীয় নেতৃবৃন্দ একথা যথার্থভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তখন ভারতের ছিল না। তাই ভারত সরকার বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য গ্রহণ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। এমতাবস্থায় ভারত যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট কিংব৷ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোটে যোগদান করত, তাহলে বিরোধী জোটভুক্ত দেশগুলি থেকে কোন ঋণ বা সাহায্য পেত না। তাই জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবেই পণ্ডিত নেহরু জোট-নিরপেক্ষতাকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সাহায্য ও ঋণ পেতে ভারতের কোন অসুবিধা হয়নি।

 

[ii] ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ভারত সরকারকে জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করতে কার্যতঃ বাধ্য করেছিল। এশিয়ার প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই উপমহাদেশটি সামরিক দিক থেকে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এর ওপর যার প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে সে  এডেন থেকে টোকিও পর্যন্ত বিস্তৃত এশীয় ভূখণ্ডে তার প্রভাবপ্রতিপত্তি বিস্তার করতে স হবে। ভারত যদি জোট-নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ না করত, তাহলে কার্যক্ষেত্রে তা বৃহৎ শক্তিগুলির লড়াই-এর ময়দানে পরিণত হোত। ফলে এই উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

 

[iii] ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের সময় পণ্ডিত নেহরু-সহ তদানীন্তন জাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। গীতার অনাশক্তি যোগ, বৈদান্তিক দর্শন, হিন্দু ধর্মের সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য প্রভৃতি পররাষ্ট্র নীতি  প্রণেতাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। হিন্দু ধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অহিংসা নীতি, শান্তিবাদ, অন্য মতবাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রভৃতিও তাঁদের চিন্তা ও চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এমনকি, ইসলাম ও খ্রীস্ট ধর্মের সুমহান আদর্শ জোট-নিরপেক্ষতার দার্শনিক ঐতিহ্যকে যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ করেছিল।

 

[iv] স্বাধীন ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন ও বীভৎস রূপের সঙ্গে তাদের জাতি-বিদ্বেষী মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আবার, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সাম্যবাদের শ্রেণী সংগ্রাম, সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রভৃতিকে আদৌ গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে পারেননি। এর অর্থ—স্বাধীন ভারতের স্রষ্টাদের কাছে পুঁজিবাদ কিংবা সাম্যবাদ কোনটিই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। তাই স্বাভাবিক কারণে তাঁরা জোট-নিরপেক্ষতাকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। 

 

[v] গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ প্রমুখ মহামনীষী পশ্চিমী গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদের মধ্যে কোনটিকেই শাশ্বত সত্য বলে মেনে নিতে পারেননি। তাই তাঁরা এই দুই বিপরীতধর্মী মতাদর্শ থেকে দূরে থাকার জন্য ভারতবাসীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। স্বাধীন মনীষীদের প্রভাব ভারতের রূপকারদের পক্ষে সেই পরামর্শ উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তাঁরা জাতীয় ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতিকে কার্যকর করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

 

[vi] ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি হিসেবে জোট-নিরপেক্ষতার নীতিটিকে গ্রহণ করার পেছনে একটি আভ্যন্তরীণ কারণও ছিল। পণ্ডিত নেহরু সম্ভবতঃ একথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত সরকার যদি বিশেষ কোন শক্তিজোটকে সমর্থন করে, তাহলে অন্য জোটের প্রতি অনুরক্ত ভারতীয়রা সরকারের চরম বিরোধিতার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে। তার ফলে দেশের অভ্যন্তরে যে-মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সূত্রপাত ঘটত, তা বৈদেশিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত ক’রে দিত। এরূপ অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি যাতে না হয়, সেজন্য নেহরু অত্যন্ত সঠিকভাবেই জোট-নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের কথা ঘোষণা করেছিলেন।

 

 [vii] ভারতের মতো একটি বৃহৎ দেশের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাদের পরিচালিত গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা যে মোটেই সম্মানজনক নয়—এ কথা তদানীন্তন জাতীয় নেতৃবৃন্দ যথাযথভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই বিশেষ কোন শক্তিজোটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তাঁরা একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী ছিলেন। এরই ফলশ্রুতি হোল ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতি। বলা বাহুল্য, ভারত জোট-নিরপেক্ষতাকে তার পররাষ্ট্র নীতির কেবল কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবেই গ্রহণ করেনি ; সেই সঙ্গে জোট-নিরপেক্ষতাকে একটি আন্দোলন হিসেবেও গড়ে তুলেছিল। একাজে পণ্ডিত নেহরু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাঁর এই উদ্যোগে সামিল হয়েছিলেন নাসের, সুকর্ণ, নক্রুমা, টিটো প্রমুখ। এঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশেষ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

 

 [২] পঞ্চশীল (Panchshila) : 

 

ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য  হোল পঞ্চশীল নীতির অনুসরণ। নবার্জিত স্বাধীনতার সংরক্ষণ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে তার উন্নতি সাধনের উদ্দেশে ভারত আন্তর্জাতিক আচরণের পাঁচটি নীতি অনুসরণের কথা ঘোষণা করেছিল। এই পাঁচটি নীতি ‘পঞ্চশীল’ নামে পরিচিত। এই পাঁচটি নীতি হোল—

 [i] প্রতিটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শন (mutual respect for territorial integrity and sovereignty),

 [ii] অনাক্রমণ (non-aggression),

 [iii] অন্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না-করা (non-interference in the internal affairs of other nations), [iv] সাম্য ও পারস্পরিক সাহায্য (equality and mutual assistance) এবং

 [v] শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (peaceful co-existence)।

  ইন্দোনেশিয়ার ‘পঞ্জৎ শিলা’ (Panjat Shila) র অনুকরণে ১৯৫৪ সালে নেহরু পঞ্চশীলের কথা সর্বপ্রথম ঘোষণা করেছিলেন। ঐ বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী ঝৌ-এন লাই কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তির প্রস্তাবনায় সর্বপ্রথম পঞ্চশীল নীতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই নীতির ভিত্তিতে ভারত ভিয়েতনাম, যুগোশ্লাভিয়া, মায়ানমার, নেপাল ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৫৬ সালের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই পঞ্চশীলের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। বান্দুং সম্মেলন, আফ্রো-এশীয় সম্মেলন, জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির সম্মেলন, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবেশন প্রভৃতিতে ভারতও পঞ্চশীলের প্রতি তার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করে। কে. এস. মূর্তি (K. S. Murty) পঞ্চশীলকে ‘জোট-নিরপেক্ষতার পরিণতি’ (consequence of non-alignment) বলে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের পঞ্চশীল নীতি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার মূল কারণ হোল এই যে, এইসব নীতির প্রতি বিভিন্ন রাষ্ট্র ঐকান্তিকভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে। তার ফলে তৃতীয় বিশ্বে যুদ্ধের সম্ভাবনা যথেষ্ট হ্রাস পাবে বলে পণ্ডিত নেহরু প্রমুখ মনে করতেন। বস্তুতঃ, পঞ্চশীলের অন্তর্ভুক্ত নীতিসমূহকে উপেক্ষা করার ফলেই বিভিন্ন সময়ে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়েছে এবং আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেছে।

 

[৩] সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধিতা (Anti-Imperialism and Anticolonialism) : 

 

 সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ হোল মানবতার চরম শত্রু। ভারত-সহ তৃতীয়  বিশ্বের দেশগুলি সুদীর্ঘকাল ধরে কোন-না-কোন সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রের শাসনাধীন ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একাধিপত্য স্থাপন ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভেদ-বৈষম্যের প্রতিষ্ঠাই হোল সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হোল সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করা। তাই সে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। 

 ভিয়েতনাম, কোরিয়া, নিকারাগুয়া, এল সালভাদোর, ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, পানামা প্রভৃতি দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সপক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসন এবং অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এমনকি, পি. এল. ও.-র নেতৃত্বে পরিচালিত প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে। বস্তুতঃ, ইন্দোচীন ও কোরিয়ায় মার্কিন নীতি, সুয়েজ খালের ব্যাপারে ইঙ্গ-ফরাসী মনোভাব, ভিয়েতনাম ও আলজিরিয়ায় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন হোল তার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী পররাষ্ট্র নীতির অপরিহার্য অঙ্গ। আবার, পর্তুগাল-অধিকৃত গোয়া, দমন ও দিউ থেকে ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটানোর উদ্দেশে পশ্চিমী দেশগুলির ভীতি প্রদর্শনকে উপেক্ষা ক’রে ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। তাছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকা-সরকার নামিবিয়া দখল ক’রে রাখলে সোয়াপো-নেতা নুজোমার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের প্রতি ভারত দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল। 

 

[৪] নয়া উপনিবেশবাদ-বিরোধিতা (Opposition to Neo-colonialism) :

 

 সাম্রাজ্যবাদের সর্বাধুনিক রূপ হোল নয়া উপনিবেশবাদ। নয়া উপনিবেশবাদ বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণদান, বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, বহুজাতিক সংস্থা, খাদ্য সরবরাহ,  সামরিক জোট গঠন, অস্ত্র বিক্রয়, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, পুতুল সরকার গঠন প্রভৃতি কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহকে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

 

 প্রধানতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহই নয়া উপনিবেশবাদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হোল এরূপ উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করা। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, বিভিন্ন শীর্ষ বৈঠক এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থায় ভারত নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। দক্ষিণের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির প্রতি উত্তরের নয়া উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলির বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেবল প্রতিবাদ জ্ঞাপন ক’রেই ভারত ক্ষান্ত হয়নি, সেই সঙ্গে সে উত্তর-দক্ষিণ রাষ্ট্রগুলির বৈঠকে উত্তরের রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক অনুসৃত বৈষম্যমূলক নীতিগুলির বিরুদ্ধাচরণ করেছে। উত্তর ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ভারত চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। কিন্তু তার সেই চেষ্টা বিশেষ ফলবতী না হওয়ায় দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা (South South Co-operation)-র ওপর ভারত বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ৭৭টি দেশের জোট (Group of 77), সার্ক (SAARC)-এর প্রতিষ্ঠা, আফ্রিকার জন্য অর্থ তহবিল গঠন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

 

• [৫] বর্ণবাদ-বিরোধিতা (Anti-Racism) :

 

 ব্রিটিশরা ভারত শাসনের জন্য যেসব অদ্ভুত যুক্তি প্রদর্শন করত, সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল ‘শ্বেতাঙ্গের বোঝা’ (White man’s  burden) তথা জাতি-কুলগত শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব। কেবল ব্রিটিশ শাসনই নয়, বিশ্বের বহু দেশের শাসকশ্রেণী কর্তৃক অনুসৃত নীতির অপরিহার্য অঙ্গ হোল বর্ণবৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষ। সুদীর্ঘকাল ধরে এই নীতি অনুসৃত হওয়ার ফলে শাসিতের মধ্যে এক ধরনের হতাশা, বঞ্চনাবোধ ও হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। এই ধরনের শাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা করার কথা ঘোষণা করেছে। 

 বর্ণবাদের বিরোধিতা ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অপরিহার্য অঙ্গ। দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ রোডেশিয়া প্রভৃতি দেশে বর্ণবিদ্বেষী সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কেবল সোচ্চার হয়েই ওঠেনি, সেই সঙ্গে ঐসব দেশে শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসানের জন্য জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করেছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বহিষ্কারের ক্ষেত্রে ভারত অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। বস্তুতঃ, ভারত-সহ জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ রোডেশিয়ায় বর্ণবৈষম্যমূলক শাসনের অবসান ঘটেছে। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ সম্মেলন ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মঞ্চ থেকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে ভারত যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। 

 

 [৬] বিশ্বশান্তি (World Peace) : 

 

 ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত। সুদূর অতীত থেকে ভারত শান্তির পূজারী। তাই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মধ্যেও তার প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির রূপকার পণ্ডিত নেহরু জোট-নিরপেক্ষতাকে বিশ্বশান্তি রক্ষার প্রকৃষ্ট উপায় বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কোন পক্ষ (camp) এবং সামরিক জোট (military alliance)-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আমরা কেবল একটি পক্ষেরই অন্তর্ভুক্ত এবং তা হোল শান্তির পক্ষ। 

 যত বেশি সংখ্যক দেশকে এই পক্ষের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, ততই মঙ্গল।” ভারত তার জাতীয় স্বার্থে বিশ্বে শান্তির উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যেমন নিরলসভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিটিকেও সর্বজনগ্রাহ্য ক’রে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। ভারত সব সময়ই শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে-কোন আন্তর্জাতিক বিরোধ ও সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এইভাবে ইন্দোচীন, কোরিয়া, আরবইস্রায়েল, ইরাক-ইরান প্রভৃতি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ভারতের প্রয়াস বিশেষ প্রশংসার যোগ্য। তবে ভারতের শান্তিবাদকে কাপুরুষতা বলে মনে করলে ভুল করা হবে। ভারত আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করাকে অন্যায় বলে মনে করে না। তাই আত্মরক্ষার জন্য যেসব দেশ আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, ভারত তাদের ঐকান্তিকভাবে সমর্থন জ্ঞাপন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনি। 

 এমনকি, শান্তিবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরে পাক-হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের আগ্রাসী মনোবৃত্তির জন্যই ভারতের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়েছিল। তবে একথা সত্য যে, ভারত সব সময়ই শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হোল কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৭১ সালে সিমলা-চুক্তি সম্পাদন। তাছাড়া, চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য ভারত সব সময়ই আলাপ-আলোচনার পথ বেছে নিয়েছে।

 

• [৭] নিরস্ত্রীকরণ (Disarmament) : 

ভারত যুদ্ধ-বিরোধী এবং শান্তিকামী রাষ্ট্র হওয়ার ফলে নিরস্ত্রীকরণ তার পররাষ্ট্র নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যে-কোন ধরনের আণবিক অস্ত্রের উৎপাদন এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য আণবিক শক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে ভারত তার অভিমত ব্যক্ত করেছে। ভারত সর্বদাই  শান্তির উদ্দেশে আণবিক শক্তি ব্যবহার করার পক্ষপাতী। তাই ১৯৬১ সালে ভারত-সহ বিশ্বের জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি সাধারণ সভায় পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। 

 এই প্রস্তাবে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারকে মানব জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিকট আবেদন করেছিলেন। বস্তুতঃ, মারাত্মক অস্ত্র উৎপাদন প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকা, নিরস্ত্রীকরণের জন্য ঐকান্তিক প্রয়াস চালানো, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ, আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা প্রভৃতি হোল ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির উল্লেখযোগ্য দিক। তাই পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্রে• সজ্জিত করার যে কর্মসূচী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছে, ভারত তার প্রতিবাদ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।

 

• [৮] প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন (Establishment of cordial relationship with the neighbouring States) :

 ( ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হোল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং তার সম্প্রসারণ। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ ক’রে থাকে। ভারত গণ-সাধারণতন্ত্রী চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও বিভিন্ন সময় নানা কারণে ঐসব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কাশ্মীরকে কেন্দ্র ক’রে পাকিস্তানের সঙ্গে, গঙ্গার জলবণ্টন ও সীমান্তে অনুপ্রবেশ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে, সীমান্তের প্রশ্নে চীনের সঙ্গে এবং তামিল ভাষাভাষীদের দাবির প্রশ্নে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের বারংবার বিরোধ ঘটেছে। 

 এতদ্‌সত্ত্বেও ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে তাসখন্দ ঘোষণা (১৯৬৬), সিমলা চুক্তি (১৯৭১), বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য আলাপ-আলোচনা চালানো, রাজীব গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর মধ্যে শীর্ষ বৈঠক (১৯৮৮), রাজীব গান্ধীর পাকিস্তান সফর (১৯৮৯) প্রভৃতির মাধ্যমে পাক-ভারত সম্পর্কের উন্নতির কথা উল্লেখ করা যায়। অনুরূপভাবে, তিব্বতের দলাই লামাকে আশ্রয়দান (১৯৫৯), ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষ (১৯৬২) প্রভৃতি সত্ত্বেও বিগত শতাব্দীর আশির দশকের পর থেকে চীনের সঙ্গে ভারতের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-চুক্তি সম্পাদন (১৯৮৭), প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর চীন সফর (১৯৮৮), সীমান্ত সমস্যার সমাধানের উদ্দেশে ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন’ (১৯৮৮), সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য নরসীমা রাওয়ের চীন সফর (১৯৯৩) প্রভৃতির ফলে ভারত-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। 

 আবার, শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন সময়ে ভারতের উদ্যোগ গ্রহণ ও একাধিক চুক্তি সম্পাদন, শ্রীলঙ্কায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে ভারতের শান্তিবাহিনী প্রেরণ (১৯৮৭) প্রভৃতির মাধ্যমে ভারত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়। তাছাড়া, গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা, অনুপ্রবেশ বন্ধের উদ্দেশে সীমান্তে প্রাচীর গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

 

[৯] মতাদর্শগত নিরপেক্ষতা (Ideological Neutrality) : 

 

ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হোল মতাদর্শগত নিরপেক্ষতা। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু-সহ ভারতের নেতৃবৃন্দের দাবি হোল — ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত নয়। তাই মতাদর্শের ভিত্তিতে ভারত কোন রাষ্ট্রকে শত্রু এবং অন্য রাষ্ট্রকে মিত্র বলে মনে করে না। এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে যে-পার্থক্য বিদ্যমান, তার থেকে অনেক বেশি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে। সমাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক—যাই হোক না কেন, উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমস্যা সাধারণভাবে একই ধরনের হয়ে থাকে। 

 

 • [১০] সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ওপর গুরুত্ব আরোপ (Emphasis upon the United Nations) ঃ 

 

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠা, মানুষের সমানাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্প্রসারণ প্রভৃতি উদ্দেশে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারত কেবল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যপদই গ্রহণ করেনি, সেই সঙ্গে তার লক্ষ্যগুলি যাতে বাস্তবায়িত হতে পারে, সেজন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তাতে ভারত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। 

 উদাহরণ হিসেবে কোরিয়া, প্যালেস্টাইন, কঙ্গো, সাইপ্রাস প্রভৃতি সমস্যায় ভারতের ইতিবাচক ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া, মারণাস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ, নিরস্ত্রীকরণ, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক বিকাশ, বর্ণবৈষম্যের অবসান প্রভৃতি বিষয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে ভারত দৃঢ়ভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। তবে ভারত কখনই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নীতি ও কর্মসূচীকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেনি। মার্কিন প্রভাবিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ যখনই তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ-বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য উদ্যোগী হয়েছে, তখনই ভারত বলিষ্ঠভাবে তার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বৈষম্যমূলক পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty, 1968), সার্বিক পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা রোধ চুক্তি (Comprehensive Test Ban Treaty, 1996)-তে ভারতের স্বাক্ষরদানে অসম্মতির কথা উল্লেখ করা যায়।

 

• [১১] কমনওয়েলথের সদস্যপদ (Membership of the Commonwealth) : 

 

 কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ভারত তার জাতীয় স্বার্থে কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। প্রধানতঃ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা লাভের উদ্দেশে ভারত কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া, কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে 

 

ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন। কিন্তু কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করার ফলে ভারতের সার্বভৌম ও সাধারণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। কিন্তু পণ্ডিত নেহরু প্রমুখ এই অভিযোগ মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। কারণ, ভারতীয় সংবিধানে ব্রিটিশ রাজশক্তির কথা উল্লেখ নেই। তাছাড়া, কমনওয়েলথ হোল স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির একটি স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান। ভারত যে-কোন সময় ইচ্ছা করলে কমনওয়েলথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পণ্ডিত নেহরু বলেছিলেন, ভারত স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে কমনওয়েলথে যোগদান করেছে এবং প্রয়োজন মনে করলে সে যে-কোন সময় এর সদস্যপদ ত্যাগ করতে পারে। 

 এমনকি, ১৯৪৯ সালের ২৭শে এপ্রিল কমনওয়েলথের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনেও সরকারী ঘোষণায় ব্রিটেনের রাজা বা রানীকে কমনওয়েলথভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির স্বাধীন সম্পর্কের ‘প্রতীক’ (symbol) বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে জওহরলাল বলেছিলেন, কমনওয়েলথের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এর কতকগুলি সুবিধা আমরা ভোগ করতে পারি। কিন্তু তার বিনিময়ে আমাদের ওপর কোন দায়-দায়িত্ব আরোপিত হয়নি। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণের ফলে ভারতকে যেসব বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হয়, কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ সত্ত্বেও ঐসব বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হয় না। সুতরাং কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করার ফলে ভারতের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে—একথা মেনে নেওয়া যায় না।

 

মূল্যায়ন (Evaluation) : ‘

 

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা পালন–

 

 

ঠাণ্ডা লড়াই’ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ‘দ্বি-মেরুকরণ’ প্রবণতার জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলি যখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত, ঠিক তখনই জোট-নিরপেক্ষতার হাত ধরে একটি তৃতীয় পথের দিশারী হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে ভারতের আবির্ভাব ঘটেছিল। ঐসব অনুন্নত ও উন্নতিকামী দেশগুলির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে ভারত বিশ্বের দরবারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতের নেতৃত্বে যে-জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ক্রমে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। 

 জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে-ওঠা ‘৭৭টি রাষ্ট্রের গোষ্ঠী’ (Group of 77)-র ইতিবাচক ভূমিকা পালন, ‘নয়া আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থা’ (New International Economic Order — NIEO) -র প্রতিষ্ঠা, নতুন আন্তর্জাতিক তথ্য ব্যবস্থার প্রবর্তন, আফ্রিকার জন্য তহবিল গঠন, বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির অকারণ হস্তক্ষেপ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে নিরস্ত্রীকরণের প্রয়াস, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মূলতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা পালন তার সফল পররাষ্ট্র নীতির অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন।

 

কিন্তু বাস্তব রূপায়ণের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নানা ধরনের বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এইসব সমালোচনাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ ক’রে আলোচনা করা যেতে পারে :

 

[i] পণ্ডিত নেহরু ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতিকে মতাদর্শগত দিক থেকে নিরপেক্ষ বলে চিহ্নিত করলেও ভারত বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা পূর্বতন সোভিয়েত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *