ফরাসি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর Teacj Sanjib | Discuss the powers, functions and position of the French President
ফরাসি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর Teacj Sanjib | Discuss the powers, functions and position of the French President
ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা
প্রশ্ন । ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদা আলোচনা কর।
ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কার্যাবলী ও পদমর্যাদা:
ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা উত্তর। ১৯৫৮ সালের পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি পদটিকে দুর্বল করে গড়ে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট দেখা দিয়েছিল তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান প্রণেতাগণ রাষ্ট্রপতির পদটিকে শক্তিশালী করে ক্যাবিনেট তথা পার্লামেন্টকে অধস্তন অবস্থায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। রোডী, এ্যাণ্ডারসন ও খ্রীস্টল (Rodee, Anderson and Christol) বলেছেন : “The Constitution of 1958 gave first place to the office of the President and placed both Cabinet and Parliament in inferior positions.” বস্তুত পূর্বেকার নিয়মতান্ত্রিক শাসকের জায়গায় নতুন সংবিধানে (১৯৫৮) রাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক হিসাবে গড়ে তোলা হয়।
ফরাসী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হোল :
- আরো পড়ুন ফরাসি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো
ফরাসী রাষ্ট্রপতির শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(১) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি হলেন একই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান এবং সরকারের প্রধান। তিনিই হলেন দেশের শাসনব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
রাষ্ট্রপতির অন্যান্য শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি হল নিম্নরূপ :
(ক) নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ ও পদচ্যুত করতে পারেন। এ ছাড়া অসামরিক সরকারী পদস্থ কর্মচারী, বহির্দেশীয় অঞ্চলের সরকারী প্রতিনিধি, অ্যাকাডেমীর রেক্টর, সরকারী বিভাগের পরিচালক প্রভৃতিকে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি।
(খ) প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি হলেন ‘সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক’ (the commander of the armed forces — Article 15)। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদগুলিতে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ভোগ করেন। এছাড়া তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষার উচ্চতর পরিষদ ও কমিটিগুলির সভায় সভাপতিত্ব করেন।
(গ) পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি বিদেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন এবং বিদেশের রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ করে থাকেন (১৪নং ধারা)। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধির শর্তাদি আলোচনা করার এবং চুক্তি সম্পাদন করার ক্ষমতা তাঁর আছে। আন্তর্জাতিক কোন সন্ধি বা চুক্তি তাঁর মনোমত না হলে তিনি সেটিকে গণভোটে দিতে পারেন।
ফরাসি রাষ্ট্রপতি আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(২) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতাও যথেষ্ট ব্যাপক।
(ক) বাণী প্রেরণ: সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বাণী প্রেরণ করতে পারেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। এই বাণী প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।
(খ) স্থগিতকারী ভেটো প্ৰদান : মার্কিন রাষ্ট্রপতির ন্যায় ফরাসী রাষ্ট্রপতির ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা নেই। এমনকি পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরদানের কোন প্রয়োজন হয় না। তবে তিনি যে-কোন বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টের কাছে নির্দেশ পাঠাতে পারেন। সংবিধান অনুসারে পার্লামেন্ট এই নির্দেশ অমান্য করতে পারে না।
(গ) গণভোট সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি যে-কোন বিলকে জনগণের সম্মতির জন্য গণভোটে পেশ করতে পারেন। এটি পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ব্যাপার ; এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বা অন্য কারও অনুমতি নিতে হয় না।
(ক) নিম্নকক্ষ ভেঙে দেবার ক্ষমতা : প্রধানমন্ত্রী এবং পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সভাপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় সভা ভেঙে দিতে পারেন (১২নং ধারা)। পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও পরামর্শমত কাজ করা বাধ্যতামূলক নয়। অবশ্য বছরে একবারের বেশি জাতীয় সভা ভেঙে দেওয়া যায় না।
(ঙ) আইনের বৈধতা বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির অন্যতম স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা হল এই যে, তিনি মনে করলে যে-কোন সাধারণ আইনের বৈধতা বিচারের জন্য সেটিকে সাংবিধানিক পরিষদের নিকট প্রেরণ করতে পারেন।
ফরাসি রাষ্ট্রপতি বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(৩) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন, এমনকি মৃতুদণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড নাকচ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি বিচারবিভাগীয় উচ্চতর পরিষদের (Higher Council of the Judiciary) অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তিনি এই পরিষদে ৯ জন সদস্যকে নিয়োগ করেন।
(8) সালিশী ক্ষমতা:
সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে মধ্যস্থতা করার বা সালিশী ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সরকারী সংস্থাগুলি যাতে নিয়মিতভাবে কাজ করে এবং যাতে রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তার জন্য রাষ্ট্রপতি সালিশের ভূমিকা পালন করে থাকেন।
(৫) সংবিধান সংক্রান্ত ক্ষমতা:
সংবিধানের ৫নং ধারায় রাষ্ট্রপতিকে ‘সংবিধানের অভিভাবক’ (the guardian of the constitution) হিসাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সবাই যাতে সংবিধান মেনে কাজ করে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। এছাড়া সংবিধানের ৮৯নং ধারা বলে রাষ্ট্রপতি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।
ফরাসি রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা:
(৬) জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা: সংবিধানের ১৬নং ধারায় রাষ্ট্রপতির হাতে জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশে যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যার ফলে জাতির স্বাধীনতা, সংহতি বিনষ্ট হতে পারে বা সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ ও সরকারী কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ভীষণভাবে বিপন্ন হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের সভাপতি এবং শাসনতান্ত্রিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় যে-কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন। ১৯৬১ সালে আলজিরিয়ার সংকটের সময়ে রাষ্ট্রপতি দ্য গল (De Gaulle) এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন এই ক্ষমতার দ্বারা রাষ্ট্রপতি একটি আইনসঙ্গত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন (a legal dictatorship could be established — J. Blondel)।
ফরাসি রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা:
পদমর্যাদা : ফরাসী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ও পদমর্যাদা বিষয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। কেউ কেউ বলেন ফ্রান্সে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতি হলেন একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের রূপকার মাইকেল দেৱে (Debre)-র মতে, সংসদীয় ব্যবস্থাই হল ফ্রান্সের পক্ষে একমাত্র উপযুক্ত ব্যবস্থা”। ব্লন্ডেল ও গডফ্রে (Blondel and Godfrey)-র মতে, ফ্রান্সে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নানাভাবে সীমিত। তিনি একজন রাষ্ট্রপ্রধানের বেশি কিছু নন (The President is not much more than a head of State)। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় সভার নিকট যৌথভাবে দায়িত্বশীল মন্ত্রিপরিষদই হোল প্রকৃত শাসনক্ষমতার অধিকারী। কারণ মন্ত্রিপরিষদের হাতেই সরকারের নীতি নির্ধারণ ও শাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
কিন্তু অপর একদল বিশেষজ্ঞের মতে, ফরাসী রাষ্ট্রপতি শুধু রাষ্ট্রের প্রধান নন, সরকারেরও প্রধান। তিনিই হলেন ফরাসী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু। দ্য গল (De Gaulle) স্বয়ং দাবি করতেন যে, রাষ্ট্রপতি হলেন ফরাসী শাসনব্যবস্থার প্রধান ভিত্তিপ্রস্তর) (The keystone of our regime)। বস্তুত পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে এক বিশাল ক্ষমতার অধিকারী করে গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমান সংবিধান অনুসারে তিনি চিরাচরিত ক্ষমতা ছাড়াও স্বেচ্ছাধীন ও সালিশী সংক্রান্ত বিপুল ক্ষমতা ভোগ করেন।)সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন, গণভোটের ব্যবস্থা করা, জাতীয় সভা বাতিল করা, বাণী প্রেরণ, জরুরী অবস্থা ঘোষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করেন। সালিশী সংক্রান্ত ক্ষমতার বলে রাষ্ট্রপতি যুদ্ধ, বৈদেশিক নীতি, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়মিত কার্যকারিতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় সভার কাছে মন্ত্রিপরিষদকে দায়িত্বশীল থাকতে হয়, রাষ্ট্রপতিকে নয়। অর্থাৎ নিম্নকক্ষে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের পতন ঘটানো যায় ; রাষ্ট্রপতির পতন ঘটে না। এছাড়া সংবিধান রাষ্ট্রপতির হাতে যে জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে, রাষ্ট্রপতি তার সুযোগ নিয়ে একটি আইনসঙ্গত একনায়কে পরিণত হতে পারেন।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তত্ত্বগতভাবে ফ্রান্সে শাসনবিভাগের শীর্ষে ‘দ্বৈত-শাসন’ (dyarchy)-এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রপতিই সর্বেসর্বা। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ফাইনার (Finer) বলেছেন, ফ্রান্সে দ্য গলের আমলে দুই-প্রধান বিশিষ্ট শাসনবিভাগ কার্যক্ষেত্রে এক-প্রধান বিশিষ্ট শাসনবিভাগে পরিণত হয়েছিল (In practice,
the two-headed executive became a single-headed one)। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছিল দ্য গলের ন্যায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কৃতিত্বে। পরবর্তীকালের রাষ্ট্রপতিগণ সেই ঐতিহ্য বজায় রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। ফলতঃ রাষ্ট্রপতির পদটি এখনও যথেষ্ট ক্ষমতা ও মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে রয়েছে।