সাজাহান’ নাটকের প্রধান প্রধান নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

 সাজাহান’ নাটকের প্রধান প্রধান নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

সাজাহান’ নাটকের নারীচরিত্র

প্রশ্ন ।। ‘সাজাহান’ নাটকের প্রধান প্রধান নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর। অথবা,

সাজাহান'-নাটকের-প্রধান-প্রধান-নারীচরিত্রগুলির-বৈশিষ্ট্য-আলােচনা-কর

 

নাদিরা, পিয়ারা, মহামায়া ও জাহানারা এই চারটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে নারী ব্যক্তিত্বের যে চাররূপ প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও। 

 

উত্তর। সাজাহান’ নাটকে পুরুষ চরিত্রগুলির পাশাপাশি নারী চরিত্রগুলিরও স্বতন্ত্র মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়। নারীচরিত্রগুলির মধ্যে নাদিরা, পিয়ারা ও জাহানারা মােগল রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত ও মহামায়া চরিত্রটি রাজপুত রমণী।

নাদিরা চরিত্র

নাদিরা সাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারার পত্নী। চরিত্রটি কল্যাণশ্রীমণ্ডিত। চরিত্রটির প্রাথমিক পরিচয়ে বলা যায়—দারার উপযুক্ত সহধর্মিনী। স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ, সতীসাধ্বী, সেবাপরায়ণ কল্যাণী রূপেই চির ভাস্বর। নাদিরার আচরণে সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারার স্ত্রী হিসাবে কোন রাজকীয় দম্ভ, রাজ ঐশ্বর্যের বিলাসিতা বিন্দুমাত্র পরিলক্ষিত হয় না। পরভেজের কন্যা সাধারণ নারীর মতই আবেগে উচ্ছ্বসিত, সংস্কারের দ্বারা পরিচালিত। দারার কোনরূপ অমঙ্গল আশঙ্কায় সে ভীত, সন্ত্রস্ত। তাই সে স্বামীকে অনুরােধ করে বলে, আমি বলি তুমি এ যুদ্ধ থেকে বিরত হও। যুদ্ধের কথা শুনে আশঙ্কিত অন্তরে দুঃস্বপ্ন দেখে স্বামীর অমঙ্গল চিন্তায় ব্যাকুল হয়েছে।

 

সাজাহান নাটকের চরিত্র

 

সম্ভবতঃ চিরন্তন ভারতীয় নারীর আদর্শ অর্থাৎ সীতা-সাবিত্রী-দময়ন্তীর আদর্শই তার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। এই নারী যদিও মােগল হারেমের, তাহলেও দারার মহিষীরূপে নয়, একটি সংসারের জায়া ও জননীরূপেই তার যা কিছু সার্থকতা। তাই নাদিরা চরিত্র ধীর, গম্ভীর ও মৃদুভাষিণী।

 

নাদিরা চরিত্রকে অবলম্বন করে নাট্যকার করুণরসের অবতারণা করেছেন। নাদিরা দারার চিরসঙ্গিনী, চরম দুর্দিনেও সে স্বামীকে ত্যাগ করে নি। দারার দুঃসময়ে সে স্বামীর সমব্যথী, স্বামীর পরিচর্যায় সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। কারণ স্বামী-পুত্রই তার ধ্যান-জ্ঞান। তাই সে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, নাথ! তােমার দুঃখের সঙ্গিনী হওয়াই আমার পরম গৌরব। এই গৌরব বক্ষে ধারণ করেই নাদিরা তার নারীজন্ম সার্থক বলে মনে করে। তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে দারা-নাদিরার পারিবারিক জীবনের দুর্ভাগ্যের চিত্র অঙ্কন করে নাট্যকার এক মর্মান্তিক করুণ রস সৃষ্টি করেছেন।

 

আবার সন্তানদের প্রতি স্নেহেও নাদিরা মমতাময়ী জননীর প্রতীক। তাই রাজপুতানার মরুভূমিতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর দারা, পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হলে, নাদিরাই সেই ছুরিকার সামনে বুক পেতে দিয়েছে। আর অন্তিম মুহূর্তে তার অন্তরাত্মা পুত্রকে স্মরণ করে কেঁদে উঠে বলে, ‘পুত্র সােলেমানের সঙ্গে আর দেখা হলাে না—ঈশ্বর।’ নাদিরা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ মহিমা নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

 

সাজাহান নাটকের প্রশ্ন উত্তর

পিয়ারা চরিত্র

পিয়ারা সুজার স্ত্রী। একই মােগল রাজপরিবারের পুত্রবধু হয়েও চরিত্রের দিক থেকে সে নাদিরার বিপরীত প্রকৃতির। অবশ্য পতিপ্রেমে, সতীত্বের মহিমায়, একনিষ্ঠা ও সততায় সে নাদিরার সগােত্রা। এ যেন একই উৎসজাত একই নদীর দুইরূপ। পিয়ারার নারীপ্রেম খরস্রোতা নদীর ন্যায় যেখানে নাদিরা নদীর নিম্নগতির ন্যায় মন্থরগামী সেখানে পিয়ারা জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাকে উজ্জ্বল হাস্য-পরিহাসে কৌতুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, বাইরে সে-বেদনার কোন প্রকাশ ঘটে নি। পিয়ারা চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে জনৈক। সমালােচক যথাথই বলেছেন, “পিয়ারাকে আপাতদৃষ্টিতে লঘুচিত্ত বলে মনে হয়। কিন্তু শেষদিকে বিপর্যয়ের চরম ক্ষণে তার মধ্যে যে দৃঢ়তা, তেজস্বিতা লক্ষ্য করা যায়, তাতে ধুত্রে আবরণ ছিন্ন করে, শাশ্বত নারী তার শক্তিময়ী রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।”

 

পিয়ারা যথার্থ প্রেমময়ী। যুদ্ধোন্মাদ ও আত্মাভিমানে স্ফীত সুজাকে সে যুদ্ধের নেশায় মত্ত থাকা থেকে নিবৃত্ত করেছে। সুজা সেটা বােঝেন, তাই তিনি বলেন—এই রকম করে সে আমাকে যুদ্ধের চিন্তা থেকে ভুলিয়ে রাখে। পিয়ারাও তার এই প্রবণতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই হাস্য-পরিহাসে, কৌতুকে উচ্ছলতায়, গানে গানে সে নিজের চারপাশকে ভরিয়ে রাখতে চায়। তার কথাবার্তায় তাই অর্থহীন প্রগলভতা প্রকাশ পেয়েছে। এ যেন নিজের জীবনের কঠোর বাস্তবতাকে জোর করে ভুলে থাকা। মােগল হারেমে এই প্রেমময়ী নারী যেন বেমানান। ছলনা নেই, মিথ্যাচারিতা নেই, উচ্চাকাঙ্খর সৌধ রচনার বাসনা নেই। তাই পিয়ারা যুদ্ধোন্মাদ স্বামী সুজাকে বলে, “কি হবে সাম্রাজ্যে নাথ? আমাদের কিসের অভাব? চেয়ে দেখ এই শস্যশ্যামলা, পুষ্পভূষিতা অমরাবতী, এই বঙ্গভূমি। কিসের সাম্রাজ্য। আর আমার হৃদয় সিংহাসনে তােমায় বসিয়ে রেখেছি, তার কাছে কিসের সেই ময়ূর সিংহাসন?

 

পিয়ারাকে সুজার মনে হয়েছে—’এক হাস্যের ফোয়ারা একটা অর্থশূন্য বাক্যের নদী।’ কিন্তু পিয়ারার এতে কোন ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই। প্রেমের অফুরন্ত শক্তিতে পিয়ারা সমস্ত তুচ্ছতার উর্ধ্বে বিরাজিতা। তাই সুজাকে পিয়ারা প্রেমের অফুরান প্রবাহে অবগাহন। করিয়ে সিদ্ধ করতে চেয়েছে—সমস্ত বিপর্যয়কে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে।

 

কিন্তু তার বাক্যধারা যত চটুলই হােক না কেন, চরিত্রটিকে কোনভাবেই লঘু বলা চলে না। তার প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আরাকান রাজ্যে আশ্রয় নেওয়ার সময়ে। মর্যাদাবােধ ও সতীত্বের তেজ পিয়ারাকে সাধারণ প্রেমময়ী নারী থেকে মহীয়সী নারীতে রূপান্তরিত করেছে। আরাকানরাজের হীন প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ পিয়ারা বলতে পেরেছে—এই চল্লিশজন অশ্বারোহী নিয়েই এই রাজ্য আক্রমণ কর; করে বীরের মত মর, আমি তােমার পাশে দাঁড়িয়ে করবাে! আর পুত্র কন্যারা তারা নিজের মর্যাদা নিজে রক্ষা করবে আশা করি। এই দৃঢ়তা তর চরিত্রে অন্তঃসলিলা ফরুধারার মতাে প্রবাহিতা।

 

সেজন্যে পিয়ারা চরিত্রের পরিকল্পনায় দেখা যায় যদিও নাটকের কাহিনীতে সে বিশেষ ছায়াপাত করে নি ; কাহিনী নিয়ন্ত্রণেও তার কোন ভূমিকাই নেই, তা ছাড়া সুজা ছাড়া অন্য চরিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্কও ঘটে নি, তবুও নাট্যকার এক বিশেষ নাটকীয় উদ্দেশ্যে তাকে সঠিকরেছেন। কাহিনীর সংঘাতময় নাট্যপরিস্থিতিতে সে একটি মুক্ত জানালার বাতায়ন পথ সৃষ্টি করেছে। হাস্যে, কৌতুকে, নৃত্যে, সঙ্গীতে দম বন্ধকরা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সৃষ্টি রেছে দিক বিরতি, আর তারই মধ্যে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতাে বয়ে গেছে শাশ্বত হামপ্রেম; অথচ এই পতিপ্রেমে আছে সদাজাগ্রত এক কল্যাণময়ী দৃষ্টি। 

 

সাজাহান

মহামায়ার চরিত্র

নারীচরিত্রগুলির মধ্যে আর একটি উল্লেখযােগ্য চরিত্র হিসাবে যোধপুর অধিপতি যশোবন্ত সিংহের পত্নী মহামায়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মােগল অন্তঃপুরচারিণীদের বাে? এর প্রতি স্বতন্ত্র। রাজপুত রমণী মহামায়ার মধ্যে রাজপুত চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত। ইতিহাসে যদিও মহামায়া নামে কোন চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় নি, তবে মহামায়া যশােবন্ত সিংহের পত্নীর প্রসঙ্গ ইতিহাসে বিধৃত আছে। আমাদের মনে হয়, সেই সূত্র ধরেই নাটকে মহামায়া চরিত্রটি পরিকল্পিত।

 

তৎকালীন স্বদেশচেতনার প্রবাহে দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে যে দেশাত্মবােধের ফুরণ হয়েছিল তারই বহিপ্রকাশ ঘটেছে এই মহামায়া চরিত্রটির মধ্যে। এখানে মহামায়াকে কেন্দ্র করে যে প্রধান ঘটনার উল্লেখ দেখা যায় তাহল, এই বীর রমণী মহামায়া যুদ্ধে পরাজিত স্বামী যশােবন্ত সিংহের প্রত্যাবর্তন মেনে নিতে পারেন নি। তাই মহারাণার দুর্গে প্রবেশে বাধা দিয়েছিলেন ; দুর্গদ্বার বন্ধ করার আদেশ দিয়ে তিনি তার মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। এ সম্পর্কে মহামায়ার উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে তিনি বলছেন, ‘যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, হতে পারে। তা হয়ে থাকে ত আমার স্বামী যুদ্ধক্ষেত্রে মরে পড়ে আছে।…যে এসেছে সে মহারাজ যশােবন্ত সিংহ নয়,…তাকে প্রবেশ কর্তে দিও না, দুর্গার রুদ্ধ কর’।

 

বীরাঙ্গনা রমণীর কাছে কাপুরুষতা অত্যন্ত ঘৃণ্য ব্যাপার। তাই স্বামীর যুদ্ধে পরাজয়কে কাপুরুষতার লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করে যুদ্ধ প্রত্যাগত স্বামীকে অভ্যর্থনা জানাতে কুষ্ঠিত। কিন্তু এখানে চরিত্রটির স্বাভাবিকতা রক্ষিত হয় নি বলেই মনে হয়। কারণ যশােবন্ত সিংহ, ভীরু বা কাপুরুষ, এ অপবাদ তার অতি বড় শত্রুর মুখেও উচ্চারিত হয় না। আর যুদ্ধে জয় পরাজয় তাে আছেই। তবুও মহামায়ার চরিত্রে রাজপুত চরিত্রের জাত্যাভিমান প্রকাশিত হয়েছে তা নাট্যকারের দেশাত্মবােধের স্বরূপই প্রতিবিম্বিত হয়েছে বলা যায়।

 

সাজাহান নাটক

 

তবে তৃতীয় অঙ্কের ষষ্ঠ দৃশ্যে আমরা মহামায়াকে পাই অনেক স্বাভাবিক হিসাবে। এখানে তাঁর আচরণ যুক্তিগ্রাহ্য ও যথাযথ হয়ে উঠেছে। জয়সিংহ ও যশােবন্ত সিংহের সংলাপের মধ্যে ঔরংজীবের প্রতি আনুগত্যের কথা শুনে তিনি রােষে দীপ্ত হয়ে বলে উঠেছে, ‘ঔরংজীবের পক্ষ হয়ে তার শিবির লুঠ করে পালানাের নাম প্রতিশােধ ? এর চেয়ে যে পরাজয় ছিল ভালাে, এ যে পরাজয়ের উপর পাপের ভার। রাজপুত জাতি যে বিশ্বাসঘাতক হতে পারে, তা তুমিই এই প্রথম দেখালে! এখানে মহামায়াকে নাট্যকার আদর্শ স্ত্রীরূপে চিত্রিত করেছেন। স্বামীকে মহামায়া আবেগময় উক্তিতে আরও বলেছেন, তােমার গৌরব কোলে করে আমি মরতে পারি—তার জন্য আমার এত চিন্তা, এত আগ্রহ যে, সে গৌরব ম্লান হয়ে গেছে দেখবার আগে আমার ইচ্ছা হয় যেন আমি অন্ধ হয়ে যাই।’ মহামায়ার এই উক্তিতে দেশপ্রেম, বীরাঙ্গনা নারী এবং আদর্শ পত্নীর রূপই ধরা পড়েছে। এ ছাড়া চতুর্থ অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে মহামায়া স্বামী যশােবন্ত সিংহকে যে ধিক্কার দিয়েছে, তা ব্যক্তি চরিত্রের সততারই পরিচায়ক। তবে এই সব দৃশ্যে মহামায়ার আবেগময় দীর্ঘসংলাপ দেশপ্রেমের জ্বলন্ত রূপকে প্রকাশ করলেও নাটকীয় চরিত্র হিসাবে তার গতিময়তা হারিয়েছে।

সাজাহান’ নাটকের প্রধান প্রধান নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য

এই চরিত্রটি সম্পর্কে আরও একটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করতেই হয়। সাজাহান’ নাটকে নাট্যকার এই চরিত্রটিকে নাট্যকাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন নি। সাজাহানের ট্র্যাজেডির সঙ্গে মহামায়া চরিত্রটি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কোনভাবেই যুক্ত নয়! ফলে নাট্য প্রয়ােজনীয়তার দিক থেকে এই চরিত্রটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এবং রাজপুত রমণীর স্বাজাত্যভিমানকে তুলে ধরে এর মধ্যে আদর্শ প্রচারের কথাটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

(জাহানারা চরিত্রটি আগের পোস্টে আলােচিত হয়েছে একটুকু দেখে নাও)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *