মহম্মদ বিন্ তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার বিচার কর Teacj Sanjib

 মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার বিচার কর Teacj Sanjib

মহম্মদ বিন্ তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতা

 

প্রশ্ন । মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার বিচার কর। 

মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের-কৃতিত্ব-ও-ব্যর্থতার-বিচার-কর-Teacj-Sanjib

 

অথবা,

মহম্মদ বিন্ তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতা

“মহম্মদ-বিন্-তুঘলক ছিলেন প্রতিভা ও অসামঞ্জস্যের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ” মন্তব্যটি ব্যাখ্যা কর।

 

অথবা,

 

মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের চরিত্র ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে সাম্প্রতিক গবেষণায় কি নূতন মূল্যায়ন দেখা যায়?

 

অথবা, মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার সমালোচনামূলক আলোচনা কর।

মহম্মদ বিন্ তুঘলকের কৃতিত্ব

 উত্তর।

 মহম্মদ তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব :

 ভারতের মধ্যযুগীয় বিখ্যাত সুলতানগণের মধ্যে মহম্মদ-বিন্-তুঘলক ছিলেন অন্যতম। কিন্তু তাঁহার চরিত্র সম্পর্কে  ঐতিহাসিকগণের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রহিয়াছে; এল্‌ফিনস্টোন, স্মিথ, হ্যাভেল, এড্‌ওয়ার্ড,  টমাস প্রমুখ ইংরাজ ঐতিহাসিকগণ তাঁহাকে অনেকক্ষেত্রে উন্মাদ ও পিপাসু বিকৃত-মস্তিষ্ক বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। 

 

  তাহারা অনেকেই সুলতানকে ‘রক্ত-পিপাসু’ বলিয়াও প্রতিপন্ন করিয়াছেন। পক্ষান্তরে গার্ডনার ব্রাউন, ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মহম্মদের বিরুদ্ধে রক্তলোলুপতা ও বিকৃত মস্তিষ্কের অভিযোগ অযৌক্তিক বলিয়া মনে করিয়াছেন। এমনকি তাঁহারা মহম্মদ-বিন্-তুঘলককে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। 

 

কেবলমাত্র এ যুগের ঐতিহাসিকগণ নয়, সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণের মধ্যেও যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। জিয়াউদ্দিন বারণি তাঁহাকে প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন এবং রক্তপিপাসু ও নিষ্ঠুর বলিয়া অভিযুক্ত করিয়াছেন। আফ্রিকা হইতে আগত পর্যটক ইবন্ বতুতা কয়েক বৎসর সুলতানের রাজ্যে অবস্থান করিয়াছিলেন। তিনি সুলতানের ব্যক্তিগত চরিত্র বর্ণনা 

করিতে যাইয়া বলিয়াছেন যে তিনি একাধারে ‘দয়ার সাগর ও রক্তপিপাসু’ ছিলেন। 

 

সঙ্গে সঙ্গে ইবন্ বতুতা সুলতানকে বিনয়ী, সত্যনিষ্ঠ ও উদার প্রকৃতির নরপতি বর্ণনা করিয়াছেন। ঐতিহাসিকগণের মধ্যে এত অনৈক্যের মূল কারণ হইতেছে যে, সুলতানের চরিত্রে কতকগুলি পরস্পর-বিরোধী গুণের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছিল ।

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের বহুমুখী প্রতিভা:

 

বিদ্যা, মানসিক উৎকর্ষতা ও প্রতিভার দিক দিয়া বিচার করিলে মহম্মদকে মধ্যযুগীয় সুলতানগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। (ক) তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, কবি ও গণিতশাস্ত্রবিদ। ধর্মশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, মানসিক উৎকর্ষতা ও জ্যোতির্বিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার বহুমুখী প্রতিভার বহুমুখী প্রতিভা পরিচয় পাওয়া যায়। জিয়াউদ্দিন বারণির ন্যায় যাঁহারা সুলতানের তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন তাহারাও তাঁহার বহুমুখী পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করিয়াছেন।

 (খ) দান-দক্ষিণায়ও তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। বারণি ও ইবন্ বতুতা উভয়েই তাঁহার দানশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন।

 (গ) ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে ছিলেন দান-দক্ষিণায় মুক্তহস্ত; নিষ্ঠাবান মুসলমান। কিন্তু অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধে তিনি ছিলেন উদার। ধর্মে নিষ্ঠাবান ও উদার বিশেষ করিয়া রাষ্ট্রশাসন ব্যাপারে তিনি কোন একটি ধর্মের একাধিপত্য এই কারণেই তাঁহাকে গোঁড়া উলেমা ও কাজীদের বিরাগভাজন হইতে হইয়াছিল।

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের আদর্শবাদীতা:

 

তিনি ছিলেন আদর্শবাদী। তাঁহার পরিকল্পনাগুলির মধ্য দিয়া তাঁহার মৌলিকত্ব ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই দিক দিয়াও তিনি ছিলেন পৃথিবীর বহু রাজার ঊর্ধ্বে। কিন্তু বহুগুণের আধার হওয়া সত্ত্বেও তাঁহার চরিত্রের কয়েকটি দুর্বলতা ও ও ত্রুটি তাঁহার জীবনে ব্যর্থতা টানিয়া আনিয়াছিল। 

 (ক) বাস্তব জগৎ সম্পর্কে তিনি ছিলেন অনভিজ্ঞ এবং তাঁহার আদর্শবাদ অনেকক্ষেত্রেই  ছিল বাস্তব অবস্থার সহিত সম্পর্কহীন। দেবগিরিতে রাজধানী পরিবর্তনের প্রচেষ্টার মধ্যে তাঁহার অনভিজ্ঞতা ধরা পড়ে। যেখানে কেবলমাত্র সরকারী দপ্তর স্থানান্তর করিলেই চলিত, সেক্ষেত্রে তিনি দিল্লীর সমগ্র অধিবাসীকে স্থানান্তরের আদেশ দিলেন। ফলে একদিকে যেমন মোঙ্গল আক্রমণের পথ পরিষ্কার করা হইল। অপরদিকে অর্থ অপব্যয়ের ও জনসাধারণের দুঃখ-কষ্টের সীমা রহিল না। 

 (খ) তামার নোট প্রচলনের প্রচেষ্টা অর্থনীতিসম্মত ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু এইরূপ নোট প্রচলন করিতে হইলে বাস্তৰক্ষেত্রে যে সমস্ত ব্যবস্থাদি  গ্রহণ করা প্রয়োজন তাহা তিনি করেন নাই; ফলে জালনোটে দেশ ভরিয়া যায়। পরে স্বর্ণমুদ্রা দিয়া ঐ তামার নোট উঠাইয়া লইতে রাজকোষ প্রায় শূন্য হইয়া গেল। সেইজন্য অনেকে মনে করেন যে, ইহা একটি দুঃসাহসিক পরিকল্পনা ছিল এবং মোটেই যুগোপযোগী ছিল না। এই সমস্তর মধ্য দিয়া তাঁহার অস্থিরচিত্ততা প্রকাশ হইয়া পড়ে।

  (গ) কোন ক্ষেত্রেই সুপরিকল্পিতভাবে এবং ধৈর্যসহকারে তিনি জনসাধারণের সমর্থন আদায়ের সেইজন্যই তাঁহার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থাগুলি, যেমন ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে বিচারব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা, ধর্মনিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা, সকল ধর্মের প্রতি সমভাবে উদারতা প্রদর্শন করা—এ সমস্তই অনেকের মধ্যে  ভ্রান্তধারণার সৃষ্টি করিতে পারিয়াছিল। অসন্তুষ্ট উলেমারা তাহারই সুযোগ গ্রহণ করিয়াছিল মাত্র।

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের অদূরদর্শিতা

 

 (ঘ) তাঁহার দিগ্বিজয় পরিকল্পনাগুলি কার্যকর করিতে যাইয়াও তিনি অবাস্তবতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সমাধান  না করিয়া, বৈদেশিক শক্তির সাহায্যের উপর ভরসা করিয়া খোরাসান জয়ের প্রস্তুতি আরম্ভ করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হয় নাই। পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধ করিতে অনভ্যস্ত এক বিরাট বাহিনীকে কুর্মাচলে প্রেরণ করা মোটেই সমীচীন হয় নাই। মোঙ্গল আক্রমণের মুখে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে সুরক্ষিত না রাখার  ফলেই মোঙ্গল নেতা তরমাশিরীণ উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশগুলিকে বিধ্বস্ত করিতে পারিয়াছিল; এ ক্ষেত্রেও তিনি রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছেন। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ফলে সুলতানের মর্যাদা হ্রাস পাইয়াছিল, রাজকোষ শূন্য প্রায় হইয়াছিল এবং শাসনদক্ষতাও বিনষ্ট হইয়াছিল। ফলে প্রভাবশালী আমীর, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও শাসনকর্তাগণ বিদ্রোহী হইতে সাহসী হইয়াছিল এবং সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন দ্রুত করিয়া তুলিয়াছিল।

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের বহুমুখী প্রতিভা কিন্তু শাসক হিসেবে ব্যর্থতা

 

সুতরাং প্রজাবর্গের প্রকৃত হিতসাধন, দেশে একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন অথবা সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারেই মহম্মদ তুলকের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছিল। তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি, উচ্চ আদর্শ ও বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন হইয়াও সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কারণস্বরূপ হইয়াছিলেন; তাঁহার বাস্তব জ্ঞানের অভাব, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, যুগধর্মের অগ্রবর্তী আদর্শবাদিতা, শাসনব্যাপারে অনভিজ্ঞতা, অস্থিরচিত্ততা ও ধৈর্যের অভাব এই সমস্তই তাঁহার ব্যর্থতার কারণ। 

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের ব্যর্থতার কারণ

 

অল্পতেই ক্রোধান্ধ কঠোর শাস্তিবিধান: 

 

 অনেক ইংরাজ ঐতিহাসিক এবং গোঁড়া মুসলমান ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারণি তাঁহাকে ‘রক্তপিপার্সু’ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এ কথা সত্য যে, কোন ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হইলে বা ব্যর্থ হইলে তিনি ক্রোধান্ধ হইয়া উঠিতেন; সে সময়ে তিনি অপরাধের তারতম্য করিতে পারিতেন না, সামান্য অপরাধে কঠোর শাস্তিবিধান করিতেন। কিন্তু ইহা তাঁহার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা যায় না। 

 

মহম্মদ বিন তুঘলকের খামখেয়ালী’ চরিত্রের ত্রুটি:

 

তাঁহার বিরুদ্ধে আর একটি গুরুতর অভিযোগ হইল যে তিনি কিছুটা খামখেয়ালী ছিলেন। নূতন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করিবার জন্য তিনি সবসময় আগ্রহশীল হইয়া উঠিতেন। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে তাঁহার পরিকল্পনাগুলির মধ্য দিয়া তাঁহার প্রতিভা ও মৌলিকত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। বাস্তব জ্ঞানের ও ধৈর্যের অভাব সেগুলি ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী। অনেক ক্ষেত্রেই অস্থিরচিত্ততা, অদূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাব সেগুলিকে নিষ্ফল করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু এ সমস্ত সত্ত্বেও তিনি ভারত-ইতিহাসে একজন প্রগতির পথপ্রদর্শক ছিলেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *