ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান উল্লেখ করো
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান উল্লেখ করো
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান:
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
উত্তর। ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের শেষপর্যায়ে স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না— ভারতের বাহিরে তাহা প্রাণবন্ত হইয়া উঠে। ভারতের অভ্যন্তরে ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন উত্তাল হইয়া উঠিতেছিল, সেই সময় স্বাধীনতা-আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ভারতের বাহিরে এক অভাবনীয় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
ত্রিপুরী কংগ্রেস, সুভাষরসুর পদত্যাগ:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব হইতেই সুভাষচন্দ্র গান্ধীজী পরিচালিত কংগ্রেসের আপোস-নীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য চরমপত্র পাঠাইবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু কংগ্রেস এই প্রস্তাব সমর্থন করে নাই। এদিকে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর বিরোধীতা সত্বেও কংগ্রেস সভাপতি পদে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় তাঁহার সঙ্গে গান্ধী-গোষ্ঠীর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হইল, ত্রিপুরীতে ইহার পর অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে (মার্চ, ১৯৩৯ খ্রীঃ) গান্ধীজীর অনুগামীরা তাঁহাকে কোণঠাসা করিতে সমর্থ হয়। ইহার পরিণতি রূপে ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে গান্ধীজীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইলে সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করিলেন যে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করিবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর দ্রুত পরিবর্তন ঘটিতে লাগিল। প্রাচ্যে জাপান ও ইওরোপে জার্মানীর আক্রমণে ব্রিটিশশক্তি কোণঠাসা হইয়া পড়িল। কিন্তু কংগ্রেস অবিলম্বে জাতীয় সংগ্রাম শুরু করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই সুভাষচন্দ্র তাঁহার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক ও অন্যান্য সম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের লইয়া ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে রামগড়ে আপোস-বিরোধী সম্মেলন ডাকিলেন। ইহার পর সুভাষচন্দ্র একক প্রচেষ্টায় জাতীয় সংগ্রাম শুরু করার কথা ঘোষণা করেন। দুঃখের বিষয় সরকারী দমননীতির ফলে এই প্রচেষ্টা তেমন ফলপ্রসু হইল না। সুভাষচন্দ্র দেখিলেন কংগ্রেসের বিরোধীতার জন্য দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় সংগ্রাম সফল হইবে না। এই পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র বিদেশে গিয়া ব্রিটিশ-বিরোধী শক্তি শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হইয়া স্বাধীনতা আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করিবার সঙ্কল্প গ্রহণ করিলেন।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দেশত্যাগ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হইবার পর সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ-বিরোধী আপোসহীন সংগ্রামের জন্য ভারতের ভারতে জনমত গঠনে উদ্যোগী হইলেন। ইহার পর ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে হলওয়েল স্মৃতি সৌধ অপসারণ-সংক্রান্ত আন্দোলনের প্রাক্কালে সুভাষচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করা হইল। কিছুদিন পর শারীরিক অসুস্থতার জন্য মুক্তি দেওয়া হইলেও তাঁহাকে স্বগৃহে অন্তরীণ রাখা হয়। অন্তরীণ অবস্থায় তিনি ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করেন এবং অনেক বাধা অতিক্রম করিয়া তিনি অবশেষে বার্লিনে উপস্থিত হইলেন (মার্চ, ১৯৪১ খ্রীঃ)। কিন্তু জার্মানী হইতে মুক্তি-সংগ্রাম পরিচালনার অসুবিধা অনুধাবন করিয়া সুভাষচন্দ্র রণকৌশল পরিবর্তন করিলেন এবং পূর্বসীমান্তে জাপানের সহযোগিতায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এই ব্যাপারে ইতিপূর্বেই রাসবিহারী বসু কিছুটা পটভূমি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। ইতিমধ্যে জাপান সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় এবং ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে সিঙ্গাপুরের পতন ঘটায়। ক্রমে ক্রমে সমস্ত ব্রহ্মদেশ এবং সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও প্রভৃতি দ্বীপমালা জাপানের অধিকারে আসিল।/সিঙ্গাপুরের পতনের পর জাপানের হস্তে বন্দী ভারতের সৈন্যদের লইয়া আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা লওয়া হয় এবং জুন মাসে ব্যাঙ্কক শহরে এক অধিবেশনে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে “ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘ” স্থাপিত হয়। উহার সভাপতি হইলেন রাসবিহারী বসু এবং ক্যাপ্টেন মোহন সিং-এর নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল গঠনের প্রস্তাব পাস হইল। কিন্তু ভারত সম্পর্কে জাপান সুস্পষ্টভাবে কোন নীতি ঘোষণা না করায় রাসবিহারী বসুর প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয় নাই। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে রাসবিহারী বসু বার্লিন হইতে সুভাষচন্দ্রকে জাপানে আনার ব্যবস্থা করেন। অতঃপর ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হইলে রাসবিহারী বসু তাঁহার উপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করিলেন।
নেতাজী কর্তৃক আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন:
অবশেষে ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে জাপানী সরকারের অনুমোদনে ও সহায়তায় আজাদ হিন্দ সরকার স্থাপন করেন এবং নূতন রূপে আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন করিলেন। সুভাষচন্দ্র হইলেন এই আজাদ হিন্দ সরকারের কর্ণধার— তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব, সমরসচিব এবং সৈন্যাধ্যক্ষ। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবরে আজাদ-হিন্দ সরকার ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান:
যুদ্ধপরিচালনা ও সংগঠনকার্যের জন্য কোটি কোটি টাকা সংগৃহীত হইল। এইভাবে সুভাষচন্দ্র অসাধারণ কর্মপ্রতিভা ও সংগঠন শক্তি দ্বারা ভারতের বাহিরে সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করিলেন। তিনি “নেতাজী” বলিয়া অভিনন্দিত হইলেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ তাঁহার প্রদত্ত “জয়হিন্দ” ধ্বনিতে মুখর হইয়া উঠিল।
অতঃপর সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত আক্রমণের কর্মসূচী গ্রহণ করিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হইল। জাপানী সৈন্যবাহিনী ব্রহ্মদেশ অধিকার করিলে আজাদ হিন্দ বাহিনীও আসাম সীমান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল (মার্চ, ১৯৪৪ খ্রীঃ)। ইহার পর, নেতাজী ভারতে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করিবার উদ্দেশ্যে আরাকান সীমান্ত ও মণিপুরের পথে অগ্রসর হইলেন। ১৫ই এপ্রিল (১৯৪৪ খ্রীঃ) আজাদ হিন্দ বাহিনী অসীম বীরত্বে সংগ্রাম করিয়া কোহিমা শহর অধিকার করিলেন এবং এখানে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উড্ডীন হইল।
কিন্তু অল্পকালের মধ্যে মার্কিন, ব্রিটিশ যুক্ত সৈন্যবাহিনীর অমানুষিক প্রচেষ্টায় ব্রহ্মদেশ পুনরায় অধিকৃত হইল এবং জাপানের অভিযান প্রতিহত হইল। ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল। জাপানের সামরিক বিপর্যয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত-উদ্ধারের প্রয়াস ব্যর্থ হইল। একদিকে ব্রিটিশ ও আমেরিকার অপরিমেয় রণসম্ভার অন্যদিকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর খাদ্য ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, তাই নেতাজীর পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাধ্য হইয়াই নেতাজী আজাদ হিন্দ আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয় সরকারের কর্মকেন্দ্র রেঙ্গুন হইতে ব্যাঙ্কক শহরে স্থানান্তরিত করেন। অবশেষে আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয় এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ সৈন্যদের হস্তে বন্দী হইয়া বিচারের জন্য ভারতে প্রেরিত হইল।
নেতাজী জাপান যাইবার সময় এক বিমান দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হইলেন। এইভাবে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে বহিরাগত শক্তির সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম বিফল হইল। গুরুত্ব—আজাদ-হিন্দ ফৌজের সাহায্যে বাহির হইতে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা সফল না হইলেও নেতাজীর আজাদ হিন্দ-আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা লাভ ত্বরান্বিত করিয়াছিল এই বিষয়ে কোন মতভেদ নাই। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নেতাজী সুভাষ যে মত ও পথ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা অনেকের মনঃপুত না হইলেও আজাদ হিন্দ বাহিনীর গৌরবজনক কীর্তি ও বীরত্বের কথা দেশবাসী জানিতে পারিলে সমস্ত ভারতবর্ষে ব্যাপক উত্তেজনার সঞ্চার হয় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপতিদের মুক্তির দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়।
আজাদ হিন্দ ফৌজ
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান:
অপরদিকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর কর্মকান্ড ব্রিটিশের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে আনুগত্যের অভাব প্রমাণিত করে। ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট বুঝিলেন যে আর সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করা সম্ভব হইবে না। পরিশেষে এই কথা বলা যায় যে আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের মাধ্যমে নেতাজী সুভাষ ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিতে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন, তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব হইয়া উঠিল।