বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য, ভূমিকা, গঠন ও কাজ গুলি উল্লেখ কর | Mention the role, structure and functions of the World Bank
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য, ভূমিকা, গঠন ও কাজ গুলি উল্লেখ কর | Mention the role, structure and functions of the World Bank
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ও ভূমিকা
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য
বিশ্ব ব্যাংক
. বিশ্ব-ব্যাঙ্ক (World Bank)
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কেবল বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ধ্বংস ও জীবননাশ ঘটেনি, সেই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। এমতাবস্থায় ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেটন উড়সে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ সমবেত হয়ে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সমাধানের উপায় অন্বেষণের কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। অনেক আলাপ-আলােচনার পর পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ২২শে জুলাই চুক্তির শর্তাবলী’ (Articles of Agreement) চূড়ান্ত করা হয়। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক’ সাধারণভাবে বিশ্বব্যাঙ্ক (World Bank) নামে পরিচিত। ১৯৪৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সদস্য ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বব্যাঙ্কও প্রতিষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের চুক্তিপত্র বা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলির প্রত্যেকেই বিশ্বব্যাঙ্কের চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সঙ্গে বিশ্বব্যাঙ্কের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তা ১৯৪৭ সালের ১৫ই নভেম্বর সাধারণ সভা কর্তৃক অনুমােদিত হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাঙ্ক সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের একটি বিশেষ উদ্দেশ্যসাধক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরুতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ৩৮ হলেও বর্তমানে (নভেম্বর, ২০০০) তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮২-তে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশ বিশ্বব্যাঙ্কের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি।
উদ্দেশ্য গুলি কি কি
• উদ্দেশ্য (Purposes) ঃ চুক্তিপত্রের ১ নং ধারায় বিশ্বব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। এইসব উদ্দেশ্য হােল ।
[১] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনাসহ উৎপাদনশীল উদ্দেশে পুঁজি বিনিয়ােগের মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলির পুনর্গঠন ও উন্নয়নে সাহায্য প্রদান ;
[২] উৎপাদনের সুযােগ-সুবিধাগুলিকে শান্তির সময়কার অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে উৎপাদনের সুযােগ-সুবিধা ও সম্পদ বৃদ্ধিতে উৎসাহদান ;
[৩] বৈদেশিক ব্যক্তিগত পুঁজির বিনিয়ােগ বৃদ্ধিতে এবং অন্যান্য বেসরকারী বা ব্যক্তিগত বিনিয়ােগকারীদের উৎসাহ প্রদান ;
[৪] যুক্তিসঙ্গত শর্তে বেসরকারী পুজি পাওয়া না গেলে উৎপাদনের উদ্দেশে নিজ তহবিল ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রয়ােজনীয় অর্থ সরবরাহের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ;
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
[৫] সদস্য-রাষ্ট্রগুলির উৎপাদনশীল সম্পদের বিকাশ সাধনের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দীর্ঘমেয়াদী ভারসাম্যমূলক অগ্রগতির প্রসার ঘটানাে এবং তাদের উৎপাদনমূলক সম্পদের বিকাশ সাধনের জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ;
[৬] সদস্য রাষ্ট্রগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান ও শর্তাবলীর উন্নতিসাধন ;
[৭] ক্ষুদ্র-বৃহৎ নির্বিশেষে অত্যন্ত জরুরী প্রকল্পগুলির জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা গ্রহণ ;
[৮] সদস্য রাষ্ট্রগুলির ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আন্তর্জাতিক বিনিয়ােগের ফলাফল পর্যালােচনা ; এবং
[৯] যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি থেকে শান্তিকালীন অর্থনীতিতে রূপান্তরের কাজে সাহায্যদান।
বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সাধারণ নীতিসমূহ :
ঋণ প্রদানের বিষয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক কয়েকটি সাধারণ নীতি অনুসরণ করে। এই নীতিগুলি হােল ।
[i] ঋণের জন্য আবেদনকারী কোন রাষ্ট্র সঙ্গত শর্তে অন্য কোন উপায়ে ঋণ গ্রহণ করতে সমর্থ হলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ প্রদান করে না।
[ii] সাধারণভাবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য প্রদান করার জন্যই ব্যাঙ্ক প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ হিসেবে দেয়।
[iii] ঋণ গ্রহণকারী ও জামিনদার—উভয়ে ঋণ পরিশােধে সক্ষম বলে বিবেচিত হলেই ঋণ পাওয়া যায়।
[iv] ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি বিশদ পরিকল্পনা ব্যাঙ্কের নিকট পেশ করতে হয়। বিশ্বব্যাঙ্ক ঐ উদ্দেশ্যকে মহৎ বলে মনে করলেই কেবল ঋণদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
[v] দক্ষতার সঙ্গে ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থের সদ্ব্যবহার করার জ্ঞান, ক্ষমতা ইত্যাদি ঋণগ্রহীতার আছে কিনা, তা বিশ্বব্যাঙ্ক বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করে দেখে। প্রয়ােজন মনে করলে ব্যাঙ্ক বিশ্বের যে-কোন দেশের ব্যবসায়ীদের নিকট ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংকের গঠন:
• সাংগঠনিক কাঠামাে (Organizational Structure) :
বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের সাংগঠনিক কাঠামাে প্রায় একই ধরনের। [i] একটি গভর্নর-পর্ষদ (Board of Governors), [ii] কার্যনির্বাহী পরিচালকমণ্ডলী (Executive গভর-পর্ষদ Directors), [iii] একজন সভাপতি (President) এবং [iv] অন্যান্য কর্মচারী নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত একজন করে গভীর এবং একজন করে বিকল্প গভর্নর (an Alternative Governor)-কে নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের গভর্নর-পর্ষদ গঠিত হয়। সাধারণতঃ সদস্য-রাষ্ট্রগুলির অর্থমন্ত্রিগণ কিংবা সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিরা গভর্নরের পদে নিযুক্ত হন। তাদের কার্যকালের মেয়াদ হােল ৫ বছর। সাধারণভাবে বিকল্প গভর্নরদের ভােটাধিকার থাকে না। তবে কোনও সদস্য রাষ্ট্রের গভর্নর অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প গভর্নর ভােটদান করতে পারেন। গভর্নর-পর্ষদই হােল বিশ্বব্যাঙ্কের
সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। গভর্নর-পর্ষদের অধিবেশন প্রতি বছর একবার অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া, বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃক অনুমােদিত আন্তর্জাতিক অর্থ নিগম (International Finance CorporationIFC), আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার গর্ভনরের দায়িত্বও গভর্নর-পর্ষদ পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিক, আর্থিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাের মধ্যে এইসব সংস্থার ভূমিকা পর্যালােচনা করা গভর্নর-পর্যদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গভর্নর-পর্ষদের সব সদস্যের সমান ভােটাধিকার থাকে না। প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণের আনুপাতিক হারে সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভােটের সংখ্যা স্থিরীকৃত হয়। তবে সংস্থার ক্ষুদ্র সদস্যদেরও অন্যূন সংখ্যক ভােটদানের অধিকার রয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধিক পরিমাণ চাদা (৩০:০২৫ মিলিয়ন ডলার) প্রদান করে। তাই মােট ভােটের সিংহভাগ (১৭৬৬%) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। আবার, ব্রিটেন তুলনামূলকভাবে কম চাদা (৮৩৭২ মিলিয়ন ডলার) প্রদান করে বলে তার হাতে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ভােট (৪৯২%) প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
কার্যনির্বাহী পরিচালকমণ্ডলী:
বিশ্ব ব্যাঙ্কের দৈনন্দিন কার্যাবলী পরিচালনার জন্য ২২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত কার্যনির্বাহী পরিচালকমণ্ডলী রয়েছে। ব্যাঙ্কের তহবিলে অধিক অর্থ প্রদানকারী ৫টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেই ১ জন করে পরিচালক নিয়ােগ করে। এই ৫টি সদস্য রাষ্ট্র হােল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানী, জাপান ও ফ্রান্স। অবশিষ্ট ১৭ জন সদস্য বাকী সদস্য রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক নিযুক্ত হন। প্রত্যেক পরিচালকের ভােটের সংখ্যা তার দেশের প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। পরিচালকমণ্ডলীর কার্যকালের মেয়াদ ২ বছর। পরিচালকমণ্ডলীর সভা প্রতি মাসে একবার করে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতি ও কর্মদপ্তর:
বিশ্ব ব্যাঙ্কের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন সভাপতি। তিনি কার্যনির্বাহী পরিচালকদের দ্বারা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং কার্যনির্বাহী পরিচালকমণ্ডলীর সভায় সভাপতিত্ব করেন। সাধারণভাবে তার কোন ভােটাধিকার নেই। তবে কোন প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভােট পড়লে তিনি একটি নির্ণায়ক ভােট প্রদান করে অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে পারেন। সম্পাদিত কার্যাবলীর জন্য সভাপতিকে গভর্নরপর্ষদের নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়। তাকে সাহায্য করার জন্য কতকগুলি দফতর রয়েছে। প্রতিটি দফতরের একজন করে প্রধান থাকেন।
বিশ্ব ব্যাংকের কাজ:
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
বিশ্ব-ব্যাঙ্কের কার্যাবলী Functions) ঃ
বিশ্ব-ব্যাঙ্ক নানা ধরনের কার্য সম্পাদন করে। এইসব কাজের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হােল ?
[i] বিশ্ব ব্যাঙ্ক মূলতঃ একটি ঋণদানকারী সংস্থা। তাই ঋণদানই হােল তার প্রধান কাজ। অনুৎপাদনশীল খাতে বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ প্রদান করে না। মূলতঃ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশেই ব্যাঙ্ক সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে ঋণ প্রদান করে থাকে। যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলিতে পশ্চিম ইউরােপের পুনর্গঠনের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা বিশেষ জরুরী ছিল। তাই বিশ্বব্যাঙ্ক ঐসব দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশে প্রথমে ঋণ প্রদান করলেও পরবর্তী সময়ে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ঋণ প্রদান করতে শুরু করে। এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৬০ সালে বিশ্ব-ব্যাঙ্কের অনুমােদিত আর্থিক সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানতঃ রেলপথ নির্মাণ, রেল ইঞ্জিন ও
যাত্রীবাহী বিমান ক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতির মতাে গঠনমূলক কার্যাবলীর জন্য বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে থাকে।
[i] ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে পরিচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণদান করে থাকে। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক তার অনুমােদিত সংস্থা হিসেবে ১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক অর্থ নিগম (International Finance Corporation)-এর প্রতিষ্ঠা করেছে। এই নিগমের তহবিল বিশ্বব্যাঙ্কের তহবিলের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হলেও তা বিশ্বব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণাধীনেই পরিচালিত হয়।
> [ii] ঋণদান ছাড়াও সদস্য-রাষ্ট্রগুলির, বিশেষতঃ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়নের জন্য কারিগরি সাহায্যদান করা বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান কাজ। বলা বাহুল্য, কারিগরি ক্ষেত্রে সমস্যা ও নৈপুণ্যহীনতা দূরীকরণের উদ্দেশেই বিশ্বকারিগরি সাহায্য প্রদান ব্যাঙ্ক এরূপ কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। তবে কারিগরি ক্ষেত্রে সাহায্যদানের পূর্বে ব্যাঙ্ক সংশ্লিষ্ট দেশে সমীক্ষক দল প্রেরণ করতে পারে। এই দলের কাজ হােল সমস্যা পর্যালােচনার পর প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাবনা সম্পর্কে সুপারিশ করা।
[iv] আবার, সাহায্য-গ্রহণকারী যে-কোন দেশ তার কর্মসূচী গ্রহণ ও রূপায়ণে সাহায্য প্রার্থনা করলে বিশ্বব্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞ দল প্রেরণ করতে পারে। কর্মসূচী গ্রহণ ও রূপায়ণে বিশেষতঃ, উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্ক এরূপ করে থাকে। সাহায্যদান অনেক সময় ব্যাঙ্ক এরূপ সাহায্যপ্রার্থী দেশের সরকারের সঙ্গে একযােগে কাজ করার জন্য পরামর্শদাতা ও বিশেষজ্ঞদের প্রেরণ করে।
[v] বিশ্বব্যাঙ্ক স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা করে থাকে। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণদান (Economic Development Institute-EDI)-এর মাধ্যমে এই কার্য সম্পাদন করে।
বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা:
• ভূমিকা (Role) : আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক হােল যমজ ভাই। এই দু’টি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় ৫৫ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সুদীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাঙ্ক যে ভূমিকা পালন করেছে, তাকে দুটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে, যথা—ইতিবাচক ভূমিকা এবং নেতিবাচক ভূমিকা।
ইতিবাচক ভূমিকা (Positive Role) :
সংস্থার ইতিবাচক ভূমিকাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি দিক থেকে আলােচনা করা যেতে পারে :
[১] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মূলতঃ মার্শাল পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য ব্যাঙ্ক আন্তরিকভাবে যে-প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের তার প্রমাণ পাওয়া যায় পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলির ভেঙে যাওয়া অর্থনীতির পুনর্গঠনের মাধ্যমে। শিল্পোন্নত পশ্চিমী দেশগুলির পুনর্গঠনের কাজ মােটামুটি শেষ হওয়ার পর বিশ্বব্যাঙ্ক স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। মূলতঃ উৎপাদন খাতে বিশ্বব্যাঙ্ক স্বল্প সুদে ঐসব দেশকে ঋণ দেওয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। নিজের তহবিল ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগৃহীত
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
ঋণ ও বন্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের সাহায্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে ব্যাঙ্ক বিশেষভাবে আত্মনিয়ােগ করে। এই উদ্দেশে বিশ্বব্যাঙ্ক তার সহযােগী সংস্থা হিসেবে
> আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা’ (১৯৬০) গড়ে তােলে। রাস্তাঘাট, বাঁধ, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মতাে হার্ডওয়্যার’ প্রকল্প (‘hardware’ projects) নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম দিকে ঋণদান করলেও বর্তমানে বিশ্বব্যাঙ্ক শিক্ষা, জন্মনিয়ন্ত্রণ-পরিকল্পনা, নগরায়ন, জল সরবরাহ প্রভৃতির মতাে সফটওয়্যার প্রকল্প (‘software’ projects) রচনার জন্য ঋণ প্রদান করে। ইথিওপিয়ায় জাতীয় সড়ক নির্মাণ, রেঙ্গুনে নতুন বন্দর স্থাপন, মেক্সিকোতে জল সরবরাহ প্রকল্প গড়ে তােলা প্রভৃতিতে ব্যাঙ্ক বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে প্রদান করেছে। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ব-ব্যাঙ্ক উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়ন প্রকল্পগুলি রূপায়ণের জন্য মােট ২৪৯,৩৯৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করেছে। এই ঋণ প্রদান করা হয়েছে ৩,৬৬০ ক্ষেত্রে। কেবল ১৯৯৩-৯৪ আর্থিক বছরে বিভিন্ন খাতে বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণদানের পরিমাণ ছিল ১৪,২৪৩৯ মার্কিন মিলিয়ন ডলার। কৃষি, শিক্ষা, শক্তি, শিল্প, খনি, পরিবেশ, টেলিযােগাযোেগ, পর্যটন, পরিবহন, নগরােন্নয়ন, জল সরবরাহ ও নিকাশী ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ঐ ঋণ প্রদান করা হয়েছে। মােট ঋণের প্রায় ১৪% পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, প্রায় ৯% শক্তির বিকাশ এবং প্রায় ১৫% কৃষির উন্নতি খাতে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাঙ্কের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন’
থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রদত্ত অর্থের সাহায্যে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। ১৯৯২ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের পরিবেশ সংরক্ষণ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির
আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কাঠামাের পুনর্বিন্যাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের প্রতিবেদনে ‘গণমুখী নীতি’ (People Centred Policy) গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু ও নারীকল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের কথা বলা হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে বলিভিয়া, তানজানিয়া, সুদান, মােজাম্বিক, কেনিয়া, মাওরিতানিয়া, পাপুয়া নিউ গিনিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ঘানা, নেপাল, উগান্ডা, ভারত ও শ্রীলঙ্কা—এই ১৫টি ঋণ-গ্রহণকারী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশে যেসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেগুলিতে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
[২] অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপকভাবে ণদান করা ছাড়াও বিশ্বব্যাঙ্ক সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে নানা ধরনের কারিগরি সাহায্য প্রদান করে থাকে। এই উদ্দেশে ব্যাঙ্ক তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সমীক্ষক দল প্রেরণ করেছে। এই কারিগরি সাহায্য প্রদান দলের কাজ হােল উন্নয়নশীল সদস্য রাষ্ট্রগুলির জাতীয় সম্পদকে উন্নয়নের কাজে যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করা। তাছাড়া, নীতি নির্ধারণের ব্যাপারেও এই দল সদস্য রাষ্ট্রগুলির সরকারকে বিশেষভাবে সাহায্য ও সহযােগিতা করে। ১৯৯৩-৯৪ সালে ব্যাঙ্ক এই খাতে ১,১৫১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রকল্প রচনার ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বব্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সাহায্যদানের মাধ্যমে মূলতঃ এই দায়িত্ব পালন করে। প্রাক্-বিনিয়োেগ পর্যালােচনা (pre-investment studies)র জন্য ব্যাঙ্ক সর্বাধিক ২,০০,০০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে থাকে। তাছাড়া, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচী’ (The United Nations Development Programme-UNDP) কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থের সাহায্যে ব্যাঙ্ক ঐসব পর্যালােচনার রূপায়ণকারী এজেন্সী হিসেবে কার্য সম্পাদন করে। অনেক সময় ব্যাঙ্ক সদস্য রাষ্ট্রগুলির উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে পরামর্শদান করে এবং প্রয়ােজনবােধে ঐসব দেশের সরকারের সঙ্গে একযােগে কাজ করার জন্য পরামর্শদানকারী বিশেষজ্ঞদের প্রেরণ করে থাকে। এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার জন্য ব্যাঙ্ক যে-স্থায়ী সমীক্ষক দল গঠন করেছে, সেগুলি নাইরােবি, কেনিয়া, আবিদজান ও আইভরি কোস্টে কার্য সম্পাদন করে চলেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
[৩] ১৯৫৫ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের স্টাফ কলেজ হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান’(The Economic Development Institute-EDI) স্থাপিত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়ন কর্মসূচী ও প্রকল্পগুলিতে নিযুক্ত মাঝারি ও উচ্চ স্তরের সরকারী প্রশিক্ষণদান আধিকারিকদের প্রশিক্ষণদান করাই হােল এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটনে অবস্থিত ঐ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়ােজিত প্রশিক্ষণ কোর্সে উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে ১৫,০০০-এরও বেশি আধিকারিক অংশগ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে অন্ততঃ ১,৫৫০ জন ১৯৯৩-৯৪ আর্থিক বছরে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রেরিত হয়েছেন।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের অন্যতম কাজ
[৪] বিশ্ব ব্যাঙ্কের অন্যতম কাজ হােল–বৈদেশিক ব্যক্তিগত পুঁজির বিনিয়ােগ বৃদ্ধিতে এবং অন্যান্য বেসরকারী বা ব্যক্তিগত বিনিয়ােগকারীদের উৎসাহ প্রদান। তাই বিদেশী বিনিয়ােগকারীদের সঙ্গে সদস্য-রাষ্ট্রগুলির যাতে বিরােধ না বাধে তা বিরােধ নিষ্পত্তি ব্যাঙ্ক বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখে। তা সত্ত্বেও যদি এরূপ কোন বিরােধের ঘটনা ঘটে, তাহলে তার নিষ্পত্তির জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৬৫ সালের ২৯শে মার্চ একটি সংস্থা গঠন করেছে। এর নাম হােল রাষ্ট্রসমূহ এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বিরােধ নিষ্পত্তিকরণ সম্মেলন ১৯৬৬ সালের ১৪ই অক্টোবর থেকে এই সভা কার্য শুরু করে। এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিনিয়ােগ সংক্রান্ত বিরােধ নিষ্পত্তিকরণের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র’ স্বাক্ষরকারী দেশের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়ােগকারীদের বিরােধ দেখা দিলে তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা বা আপস-মীমাংসা করাই হােল এই সংস্থার প্রধান কাজ। ১৯৯৪ সালের মধ্যে ১১৩টি দেশ এই সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। ১৯৮৯-৯৪ সালের মধ্যে আই.সি.এস.আই.ডি. এই ধরনের ১৫টি বিরােধের নিষ্পত্তি করেছে এবং ৩টি বিরােধ অমীমাংসিত থেকে গেছে।
[৫] জটিল আন্তর্জাতিক বিরােধের নিষ্পত্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাঙ্ক আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। সুয়েজ খাল জাতীয়করণের প্রশ্নে ব্রিটেন এবং সম্মিলিত আরব প্রজাতন্ত্র (The United Arab Republic)-এর মধ্যে বিরােধ আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যে-বিরােধ বেধেছিল, তা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের ভূমিকা ছিল বিশেষ ইতিবাচক। অনুরূপভাবে, সিন্ধু নদীর জলবণ্টনকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে-আসা বিরােধের নিষ্পত্তি ঘটেছিল ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই বিরােধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্বব্যাঙ্ক সিন্ধু অববাহিকা উন্নয়ন তহবিল’ (The Indus Basin Development Fund) গঠন না করলে এই সমস্যার সমাধান করা আদৌ সম্ভব হােত কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
[৬] বিশ্ব ব্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান কাজ হােলনগরােন্নয়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পর্যটনের বিকাশ। ব্যাঙ্কের অর্থনৈতিক দপ্তর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি জনসংখ্যা প্রকল্প উন্নয়ন’(Population Projects Development) এবং একটি জনসংখ্যা পর্যালােচনা নগরােন্নয়ন, জনসংখ্যা বিভাগ (Population Studies Division) এই লক্ষ্যে কাজ করে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যটনের বিকাশ চলেছে। ১৯৭৬-৭৭ সালে ৬ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি জনসংখ্যা বিষয়ক মিশন’ জামাইকা পরিদর্শন করেছিল। ঐ মিশনের উদ্দেশ্য ছিল পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী রচনায় ঐ দেশের সরকারকে সাহায্য করা। আবার, পর্যটনের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্য করার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক পর্যটন প্রকল্প দপ্তর’ (Tourism Projects Department) গঠন করেছে। এই দপ্তর পর্যটন ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়ােগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অর্থ নিগম’ (International Finance Corporation)-কে কারিগরি সহযােগিতা করে থাকে।
ভারত হােল বিশ্বব্যাঙ্কের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ভারতের উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর মূল্যায়ন এবং বিভিন্ন প্রকল্প খতিয়ে দেখার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক বিভিন্ন সময় ভারতে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছে। এইভাবে ১৯৫৬ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ভারত ও বিশ্বব্যাঙ্ক মাধ্যমে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক কমিশন প্রেরণ করেছিল। তাছাড়া, নতুন লীর একজন বাসিন্দাকে ব্যাঙ্ক তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ করে। এই প্রতিনিধির কাজ হােল ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলি সম্পর্কে বিশ্বব্যাঙ্ককে অবহিত রাখা।
ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য বৈদেশিক সম্পদের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সমীক্ষা চালানাের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ভারতে এসেছিল। ঐ দলে ছিলেন স্যার অলিভ ফ্র্যাঙ্কস (Sir Olive Franks), অ্যালান প্রাওয়েল (Allan Proual) ও ডক্টর হারম্যান অ্যাক্স (Dr. Herman Abs)। তৃতীয় পরিকল্পনায় বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক প্রকল্প খাতে সম্ভাব্য সাহায্যের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ১৯৬১ সালের জানুয়ারী মাসে যােশেফ রুশিন্স্কি (Joseph Rucinsky)র নেতৃত্বে একটি মিশন প্রেরিত হয়েছিল। একইভাবে ১৯৬৭ ও ১৯৭০ সাল-সহ বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাঙ্ক তার প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত সর্বাপেক্ষা বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে।
১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট থেকে ১৯৯৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ব্যাঙ্কের কাছ থেকে গৃহীত ভারতের ঋণের পরিমাণ হােল ২১,৮৩৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ঋণের ৫০%-এরও বেশি পরিবহন খাতে, প্রায় ২০% বিদ্যুৎ শক্তির বিকাশে, প্রায় ২৮% শিল্পের উন্নয়নে এবং মাত্র ৮% কৃষির উন্নতির জন্য প্রদান করা হয়েছে। ব্যাঙ্কের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ভারতকে সাহায্যদানের জন্য ১২টি দেশের সংঘ’ (The 12-nation Aid India Consortium) গঠিত হয়েছিল। সাধারণভাবে এই সংঘ এইড ইন্ডিয়া ক্লাব’ (Aid India.Club) নামে পরিচিত। এই সংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি হােল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানী, জাপান, ফ্রান্স, কানাডা, ইতালী, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও হল্যান্ড। প্রধানতঃ বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য এই সংঘ ভারতকে ঋণ দিয়েছিল মােট ৫,৪৭২ মিলিয়ন ডলার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতের মতাে পাকিস্তানকেও সাহায্যদানের জন্য একটি হেলপ পাকিস্তান ক্লাব’ (Help Pakistan Club) গড়ে তুলেছে। ব্যাপকভাবে ঋণদান ছাড়াও ভারতে কয়লা, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের উদ্দেশে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতকে ৮,৬২,০০০ ডলার প্রদান করেছে।
এছাড়া, হুগলী নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাঙ্ক ৮৭,৫০০ ডলার প্রদান করেছিল। ঋণ দেওয়া ছাড়াও ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি’(The Indus Water Treaty) সম্পাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্কের ভূমিকার কথা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এই চুক্তি সম্পাদনের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জলবণ্টনকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা বিরােধের নিষ্পত্তি হয়। ভারতের কাছে বিশ্বব্যাঙ্ক কেবল একটি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানই নয়, সেই সঙ্গে আর্থিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠানও বটে। যে-কোন আর্থিক বা অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়লে ভারত সরকার বিশ্বব্যাঙ্কের পরামর্শ গ্রহণ করে। তাছাড়া, বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান’ (EDI)-এর বিভিন্ন শিক্ষামূলক কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য ভারত সরকার তার উধ্বর্তন আধিকারিকদের (senior officials) প্রেরণ করেছেন। উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনার ব্যাপারে ঐ কোর্সে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১,১০০র বেশি আধিকারিক এইভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
বিশ্ব ব্যাঙ্কের নেতিবাচক ভূমিকা (Negative Role) :
বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি ইতিবাচক দিক থাকলেও তার নেতিবাচক ভূমিকাটিকে আদৌ উপেক্ষা বা অস্বীকার করা যায় না। এই নেতিবাচক ভূমিকাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে ।
[i] বিশ্বব্যাঙ্কের কার্যপ্রণালী (modus operendi) নানা দিক থেকে সমালােচিত হয়েছে। সাধারণভাবে অভিযােগ করা হয় যে, বিশ্বব্যাঙ্ক অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণদান করে। এই ধরনের সুদ গ্রহণ শুধু অনৈতিকই নয়, অযৌক্তিকও বটে। কারণ, যে-দেশ ঋণ গ্রহণ করে, সেই দেশ। বিশ্ব ব্যাঙ্কেরই সদস্য। তাছাড়া, ঋণ-গ্রহণকারী দেশের সরকার ঋণ পরিশােধের যেহেতু নিশ্চয়তা। প্রদান করে, সেহেতু ঋণ প্রদানের জন্য ব্যাঙ্ককে কোনরকম ঝুকি গ্রহণ। করতে হয় না। আসলে ঋণের সুদ পরিশােধ করতে গিয়ে তৃতীয়। বিকে অর্থনৈতিক উন্নতির পথ কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঐসব দেশের অর্থনৈতিক। উন্নয়নের জন্যই নাকি ঋণ প্রদান করা হয়। বিশ্বব্যাঙ্ক যদি তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল । দেশগুলির প্রকৃত উন্নতি চাইত, তাহলে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার যথেষ্ট কম রাখত। ভারত। সর্বশেষ যে-ঋণ গ্রহণ করেছে, তার জন্য ৬% সুদ দিতে হয়। অবশ্য এর মধ্যে ১% প্রদান করতে। হয় কমিশন হিসেবে। এই কমিশন ব্যাঙ্কের বিশেষ সংরক্ষিত তহবিল (special reserve fund)-এ জমা পড়ে। কিন্তু ঋণদানের ওপর এই ধরনের কমিশনব্যবস্থা রাখা আদৌ সমীচীন। নয়। তবে ১৯৭৬ সালের ১লা জুলাই-এর পর থেকে সুদের হার নির্ধারণের ব্যাপারে ব্যাঙ্ক একটি নতুন ফর্মুলা গ্রহণ করেছে। এই ফর্মুলা হােলপ্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাঙ্ক তার ঋণের হার পুনবীক্ষণ করবে এবং বিগত এক বছরে ব্যাঙ্ক যে-হারে বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহ করেছে, তার থেকে ০.৫%-এর বেশি হারে সুদ প্রদান করা হবে। এর ফলে ব্যাঙ্কের সুদের হার স্থিতিশীল হওয়ার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক অর্থ ও পুঁজির বাজারের অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৪-৯৫ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক তার সুদের হার ৭৯% থেকে কমিয়ে ৭:৪৫% করেছিল।
[i] বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ প্রদানের পূর্বে ঋণের জন্য আবেদনকারী রাষ্ট্রের ঋণ পরিশােধ করার সামর্থ্য বিচার-বিবেচনা করে এবং এরূপ সামর্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল ব্যাঙ্ক সংশ্লিষ্ট সদস্য রাষ্ট্রকে ঋণ প্রদান করে। কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা কাম্য নয়। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী। কেবল অর্থের অভাবেই তারা ঐসব সম্পদের যথাযথ সদ্ব্যবহার করতে পারে না। তাই বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের প্রয়ােজনমতাে ঋণ প্রদান করলে সেই অর্থ দিয়ে তারা জাতীয় সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে গৃহীত ঋণ সুদ-সহ পরিশােধ করা আদৌ কষ্টসাধ্য নয়।
[i] বিশ্ব ব্যাঙ্ক হােল একটি অরাজনৈতিক ও অ-পক্ষপাতমূলক (non-partisan) প্রতিষ্ঠান। তাই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সদস্যদের প্রতি তার সমদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া উচিত। যেসব সদস্য রাষ্ট্রের ঋণের প্রয়ােজন সর্বাপেক্ষা বেশি, তাদের প্রথমেই ঋণ প্রদান করা সমীচীন। কিন্তু বাস্তবে ঋণ প্রদানের ব্যাপারে ব্যাঙ্ক বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। বিশ্বব্যাঙ্কের বৈষম্যমূলক ঋণ প্রদানের উদাহরণ হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববন্ধের দাবি হেল—ঐসব দেশের উন্নয়নের জন্য ঋণদানের পরিমাণ ২৩% থেকে বৃদ্ধি করে ৮৫% হয়েছে। কিন্তু ঋণদানের এই হার বৃদ্ধির পেছনে ব্যাঙ্কের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে সমালােচকরা মনে করেন। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি জনসংখ্যা, ভৌগােলিক অঞ্চল ও অব্যবহার্য সম্পদের অধিকারী হােল ঐ দুটি মহাদেশ। কিন্তু এত প্রাচুর্য সত্ত্বেও ঐ দু’টি মহাদেশের জনসাধারণকে চরম দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়। অপরদিকে, ইউরােপ ও পশ্চিম গােলাৱে স্বল্প জনসংখ্যা ও ভৌগােলিক অঞ্চলবিশিষ্ট তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত দেশগুলিকে বিশ্বব্যাঙ্ক অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ প্রদান করে। বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক বিবেচনা অপেক্ষা রাজনৈতিক বিবেচনাই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়।
[iv] আবার, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ক্রমবর্ধমান হারে ঋণ প্রদানের পেছনে বিশ্বব্যাঙ্কের একটি অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঐসব দেশকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তােলার জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক অসৎ উদ্দেশ্যে ঋণদান ঋণ প্রদান করে না। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি ঐসব দেশের কাঁচামাল আমদানি এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় ও পুজি রপ্তানির হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাঙ্ককে ব্যবহার করে। এই কাজে আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মাইকেল তানজের বলেছে যে, বিশ্বব্যাঙ্ক কাঁচামাল উৎপাদনকারী দেশগুলির সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে কোন একটি শিল্পোন্নত দেশকে এককভাবে সুবিধাজনক চুক্তি সম্পাদন করা থেকে বিরত রেখে নিজেই বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশে কাঁচামালের যােগান বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অন্যভাবে বলা যায়, কাঁচামালের জন্য বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের মধ্যে যাতে বৈরিতামূলক সম্পর্কের বিকাশ না ঘটে, সেজন্য বিশ্বব্যাঙ্ক তৎপর রয়েছে। এইভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দর কষাকষির ক্ষমতা হ্রাস করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাঙ্ক কার্যতঃ উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির সেবাদাসে পরিণত হয়েছে।
[v] উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় ও উদ্বৃত্ত পুজি রপ্তানির জন্য তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকেই বেছে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, তাদের এই কাজে সাহায্য ও সহযােগিতা করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাঙ্কের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ঐসব দেশে যাতে বিদেশী পুজি ও পণ্য অবাধে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য বিশ্বব্যাঙ্ক সাম্প্রতিক কালে বিশ্বায়নের স্লোগান তুলেছে। তাছাড়া, ঋণ প্রদানের অন্যতম শর্ত হিসেবে যাতে ঐসব দেশের সরকার বিশ্বায়নের নীতি কার্যকর করে, সেজন্য আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের মতাে বিশ্বব্যাঙ্কও ঐকান্তিকভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বায়নের অর্থ হােল—উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির পুঁজির বিশ্বায়ন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।
[vi] বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বিশ্বায়ন ও পুঁজির ফাটকাবাজারী যতই বেড়ে চলেছে, আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের মতাে বিশ্বব্যাঙ্কও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে আন্তর্জাতিক পুজির গােলামি করতে ততই বাধ্য করছে। এর ফলে দরিদ্র দেশগুলি ক্রমশই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাদের দারিদ্র্য এবং সাধন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে রকেট গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ঋণ গ্রহণের শর্ত হিসেবে ঐসব দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ অন্যান্য পরিষেবামূলক ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস বা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ক্রমশই ব্যাহত হচ্ছে এবং মাথাপিছু আয়ের হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আলােচনা করা যেতে পারে। আশির দশকে মেক্সিকো বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার ফলে মেক্সিকোর অর্থনীতি কার্যতঃ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। ঐ দেশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী পথে বসে, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়, নাগরিকদের প্রকৃত আয় ৭.৫% কমে যায় এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের বিক্রি মাত্র ১৫%-এ নেমে যায়।
[vii] ঋণের দায়ে জড়িয়ে-পড়া তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত বা উন্নতিকামী দেশগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতাও কার্যতঃ খর্ব হতে বসেছে। ঐসব দেশের সরকার উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির, বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশমতাে কাজ করতে অস্বীকার করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ঋণদানের পরিমাণ কমিয়ে দেয় কিংবা এমন সব শর্ত আরােপ করে, যার ফলে এসব রাষ্ট্রের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ
উপসংহার:
বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজার দখল ও সম্পদ লুণ্ঠনের যে-চক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি চালিয়ে যাচ্ছে, তার সহায়ক হিসেবে যে-তিনটি আন্তর্জাতিক উপসংহার সংস্থা ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছে, সেগুলির অন্যতম হােল বিশ্বব্যাঙ্ক। এইসব সংস্থা বিশ্বায়ন, উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের স্লোগান তুলে কার্যতঃ মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাঙ্কের এই ধরনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নানা দেশে বিভিন্ন প্রতিবাদী সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। ২০০০ সালের এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রমে ওয়াশিংটন ও প্রাগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডার ও বিশ্ব-ব্যাঙ্কের সম্মেলন চলাকালে মবিলাইজেশন ফর গ্লোবাল জাস্টিস’ নামক একটি সংস্থার নেতৃত্বে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ সমাবেশের আয়ােজন করা হয়।
বিশ্বায়ন-বিরােধী কর্মসূচীকে সামনে রেখে বিক্ষোভকারী সংগঠনগুলি এই অভিযােগ উত্থাপন করে যে, আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক ও বিশ্ব-বাণিজ্য সংস্থা উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি এবং ঐসব দেশের ধনকুবের বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির সেবায় আত্মনিয়ােগ করেছে। ওয়াশিংটন ও প্রাগে বিক্ষোভকারীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র দেশগুলির ঋণ মকুবের দাবি ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী সংগঠিত প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলির সংগঠন জি-৭-এর শীর্ষ বৈঠকে ভীষণভাবে ঋণগ্রস্ত দরিদ্র দেশ’ (HIPC) হিসেবে ইতােমধ্যে চিহ্নিত ৪০টি দেশের মােট ২৬ হাজার কোটি বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ২০ হাজার কোটি ডলার ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু অদ্যাবধি ঐ প্রতিশ্রুতি কার্যকর করা হয়নি। তাছাড়া, তা কার্যকর করা হলেও ঐসব দেশের ঋণের বােঝা যে আদৌ কমবে না, তা অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা থেকে জানা যায়।* এইভাবে আন্তর্জাতিক অর্থ-ভাণ্ডারের মতাে বিশ্বব্যাঙ্কও তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বার্থ রক্ষার জন্য বাহ্যত কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করলেও তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে মুষ্টিমেয় উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ রক্ষা করা, সেকথা আজ দিবালােকের মতােই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভূমিকা গঠন ও কাজ