দর্শন

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গুলি আলোচনা কর teacj sanjib

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গুলি আলোচনা কর teacj sanjib

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ:

 

জ্ঞানের-উৎস-সম্পর্কে-বিভিন্ন-মতবাদ-গুলি-আলোচনা-কর-teacj-sanjib

 

জ্ঞানের উৎস (Origin of Knowledge)

 

দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল জ্ঞান। এ সম্পর্কে দার্শনিকগণ একমত পোষণ করলেও, জ্ঞানের উৎস এবং প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে তাঁরা কিন্তু কখনোই একমত পোষণ করেন না। জ্ঞানের উৎস বলতে বোঝায়, জ্ঞান যা থেকে উৎপন্ন বুদ্ধি (reason) এবং বা নিঃসৃত হয়।

  জ্ঞানের মৌল উপাদান হল ধারণা (idea)। এই ধারণার মূল উৎস হল দুটি— বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা (experience)। সুতরাং ধারণার এই দুটি উৎসের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত দুটি মূল মতবাদ লক্ষ করা যায়। 

 এই দুটি মতবাদের একটি হল বুদ্ধিবাদ (rationalism) এবং অপরটি হল অভিজ্ঞতাবাদ (empericism)। এ ছাড়াও জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে আরও দুটি মতবাদ লক্ষ করা যায়। এর একটি হল ও স্বজ্ঞাবাদ (intuitionism) এবং অপরটি হল বিচারবাদ (critical theory)। বুদ্ধিবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, বুদ্ধিই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয় সংবেদনই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস। স্বজ্ঞাবাদ অনুসারে বলা হয় যে, স্বজ্ঞা (intuition) হল জ্ঞানের মৌল উৎস আর বিচারবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, জ্ঞান নিঃসৃত হয় বিচারমূলক পদ্ধতির (critical method) মাধ্যমে।

 

 

 পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞান সম্পর্কিত যে সমস্ত মতবাদ প্রচলিত আছে, সেগুলিকে নীচের ছকে দেখানো হল—

 

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বুদ্ধিবাদ (Rationalism) 

 

বুদ্ধিবাদের মৌল দাবি হল — বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল জ্ঞানের একমাত্র উৎস (Reason is the only source of knowledge)। বুদ্ধিবাদের এরূপ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায়—

 

● জ্ঞানের একমাত্র উৎস বুদ্ধি:

 বুদ্ধিকে যাঁরা জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে দাবি করেন—তাঁদেরই বলা হয় বুদ্ধিবাদী দার্শনিক। বুদ্ধিবাদীরা বুদ্ধিকে জ্ঞানের একমাত্র উৎসরূপে স্বীকার করেন। তাঁরা বুদ্ধি ছাড়া জ্ঞানের আর

 

অন্য কোনো উৎসকেই স্বীকার করেন না। বুদ্ধিবাদীরা বলেন, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা যা কিছু পাই না কেন, সেগুলি নিয়ত পরিবর্তনশীল। সে কারণেই সেগুলি কখনোই অভ্রান্তরূপে গণ্য হতে পারে না। তাঁরা তাই অভিজ্ঞতাকে কখনোই জ্ঞানের উৎসরূপে স্বীকার করেন না।

 

সার্বিক ও শাশ্বত জ্ঞান বুদ্ধির দ্বারা সম্ভব:

 

 বুদ্ধিপাদীদের মতে, প্রকৃত জ্ঞান বলতে বোঝায় সেই জ্ঞানকে, যা সার্বিক, শাশ্বত ও নিত্যরূপে গণ্য। বুদ্ধিবাদীরা দাবি করেন যে, সার্বিক ও শাশ্বত জ্ঞান লাভ করতে হলে কখনোই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করা সংগত নয়। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ হল নিয়ত পরিবর্তনশীল। আজকের অভিজ্ঞতায় আমরা যা পাই, কালকের অভিজ্ঞতায় তা পরিবর্তিত হতে পারে। সুতরাং এরূপ পরিবর্তনীয় উৎস থেকে কখনোই সার্বিক ও শাশ্বত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। সার্বিক ও শাশ্বত জ্ঞান লাভ করতে হলে তাই আমাদের বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ওপরই নির্ভর করা উচিত।

 

বিভিন্ন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক :

 

 প্রাচীন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় পারমিনাইডিস, সক্রেটিস এবং প্লেটোর নাম। আর আধুনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—দেকার্ত, স্পিনোজা এবং লাইবনিজ প্রমুখ দার্শনিক। প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ভলফ্ এবং কান্টের নামও এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা সকলেই স্বীকার করেন যে, বুদ্ধিই হল জ্ঞানের মৌল উৎস।

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে দেকার্তের মতবাদ :

প্রখ্যাত বুদ্ধিবাদী ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তকে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। বুদি বা প্রজ্ঞাকেই তিনি জ্ঞানের মৌল উৎস বলে দাবি করেছেন। তাঁর আগে পাশ্চাত্য দর্শনে যুক্তিবাদের কোনো ঠাঁই ছি না। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের নাগপাশে মধ্যযুগীয় দর্শনচিন্তা আবদ্ধ ছিল। দেকার্ত পাশ্চাত্য দর্শনকে এই মধ্যযুগীয় ভাবধারার অন্ধকার থেকে মুক্ত করেন। তিনিই প্রথম ঈশ্বর, মানবাত্মা ও জাগতিক সত্তা সম্পর্কে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর সময়েই আন্তরিকতার সাথে ও যুক্তিনিষ্ঠভাবে দর্শনতত্ত্বের ক্ষেত্রে স্বাধীন জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে দেকার্তের মতবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরূপে বিবেচিত। কারণ, তিনি জ্ঞানতত্ত্বকে অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতবাদের বিভিন্ন দিকগুলি হল—

 

 সন্দেহবাদের প্রয়োগ: দার্শনিক দেকার্ত তাঁর দর্শনতত্ত্বের শুরুটি এভাবেই করেছেন যে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যেই আমাদের জ্ঞানের বিষয়কে লাভ করা উচিত। আর এরূপ করতে গেলে আমাদের গোড়া থেকেই শু করা উচিত। গোড়া থেকে শুরু করার অর্থ হল—তৎকালীন যুগে যে সমস্ত জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ প্রচলিত ছিলতার সবগুলিকেই সন্দেহ করা। কারণ, তৎকালীন যুগে প্রচলিত জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদগুলি ছিল স্ববিরোধিতায় পূর্ণ সেগুলিকে তাই সন্দেহের কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই গ্রহণ অথবা বর্জন করা উচিত। আর এ কাজ শুধুমাত্র বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই করা সম্ভব, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নয়। তিনি আমাদের মধ্যে যে স্বতঃসিদ্ধ অন্তরধারণা আছে বলে মনে করেন, তারই সাহায্যে এগুলির বিচার করে এগুলিকে সন্দেহাতীত রূপে গণ্য করতে চেয়েছেন 

 

সহজাত ধারণার অস্তিত্বে বিশ্বাস:

 

 দেকার্ত বলেন যে, আমাদের মনের মধ্যে মোট তিন প্রকার ধারণা আছে এগুলি হল যথাক্রমে— অন্তরধারণা বা সহজাত ধারণী (innate ideas), ii কৃত্রিম ধারণা (fictitious ideas), এবং iii আগন্তুক ধারণী (adventitious ideas)। আগন্তুক ধারণাগুলি আমাদের মনের বাইরে থেকে আসে, যেমন টেবিল, বই, খাতা, গাছ, পাহাড় ইত্যাদির ধারণা। এগুলি অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণারূপেই গণ্য। কৃত্রিম ধারণাগুলি হল মানব মনের কল্পনাপ্রসূত। অর্থাৎ, আমাদের মন তার কল্পনাশক্তির মাধ্যমেই এগুলিকে তৈরি করে। যেমন—আকাশ-কুসুমের ধারণা, মৎস্যকন্যার ধারণা, সোনার পাথরবাটির ধারণা ইত্যাদি। দেকার্ত দাবি করেন যে, এই আগন্তুক ও কৃত্রিম ধারণার মাধ্যমে আমরা কখনোই স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারি না। কিন্তু সহজাত তথা অন্তরধারণাগুলির মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, তা স্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সার্বিক রূপে গণ্য। কারণ, এই সমস্ত সহজাত ধারণাগুলিকে আমরা জন্মসূত্রেই পেয়ে থাকি এবং বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার আলোয় সেগুলি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই অন্তরধারণাগুলি কখনোই ইন্দ্রিয়-সংবেদন তথা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লব্ধ নয়। এই সহজাত বা অন্তর ধারণার দ্বারা আমরা প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারি।

 

সহজাত ধারণার সপক্ষে’ যুক্তি : 

 

দেকার্ত সহজাত ধারণাবাদের ওপরই তাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে, বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে সহজাত ধারণার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সহজাত ধারণার সপক্ষে তিনি কয়েকটি যুক্তির উপস্থাপনা করেছেন। সেগুলি হল—

 

i ) বিরোধিহীন ধারণা রূপে সহজাত ধারণা: আমাদের মধ্যে এমন কতকগুলি ধারণা আছে যার বিরোধিতা সম্ভব নয়, আর সেগুলিই হল সহজাত ধারণা। দেকার্ত দাবি করেন যে, ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতায় আমরা যা পাই, তা অবশ্যই সন্দেহজনক। কারণ, আজকের অভিজ্ঞতা যে বিষয়টির কথা স্বীকার করে, ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতা তাকে অস্বীকারও করতে পারে। অথচ আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা এমন কিছু ধারণার সন্ধান পাই, যেগুলি সহজাত এবং যাদের বিরোধিতা করা যায় না।

 

ii)  অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা রূপে সহজাত ধারণা: অভিজ্ঞতার পূর্বে যদি কোনো সাধারণ বিষয়ের ধারণা আমাদের মনে থাকে তাহলে সেগুলিকেই সহজাত ধারণা বলা যায়। নিত্যতার ধারণা, কার্যকারণের ধারণা, অসীমের ধারণা প্রভৃতি আমাদের মনে অভিজ্ঞতা অর্জনের আগে থেকে আছে। সুতরাং এই সমস্ত ধারণাগুলি সহজাতরূপেই গণ্য। সুতরাং সহজাত ধারণার অস্তিত্ব আছে।

 

iii)  আবশ্যিক ধারণারূপে সহজাত ধারণা: আমাদের অভিজ্ঞতায় পাওয়া ধারণা কখনোই আবশ্যিক (Necessary)-রূপে গণ্য নয়। কারণ এই ধারণাগুলিকে গঠন করলেও চলে, আবার না করলেও চলে। অন্যদিকে আবার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার প্রয়োগও কিন্তু সবক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু এমন কতকগুলি ধারণা দেখা যায়, যেগুলিকে গঠন না করলেই নয় এবং যেগুলির প্রয়োগও সবক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন—দেশ, কাল, দ্রব্য প্রভৃতির ধারণা। এই জাতীয় ধারণাগুলিই হল আবশ্যিক ও সহজাত ধারণা।

 

iv ) প্রকৃত সত্তার জ্ঞানের উৎস রূপে সহজাত ধারণা: ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা বস্তুর বাহ্যরূপের জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু বস্তুর বাহ্যরূপের অন্তরালে যে প্রকৃতসত্তা আছে, তাকে আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না। বরং বলা যায় যে, বস্তুর এই প্রকৃত সত্তা বা অন্তরূপটিই হল আসল। বস্তুর এই অন্তরূপের জ্ঞান কখনোই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। তা পাওয়া যায় সহজাত ধারণার মাধ্যমে।

 

v ) ঐশ্বরিক বিশ্বাস বা অবিশ্বাস—উভয়ই সহজাত ধারণার অস্তিত্বসূচক: আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, একপ্রকার ঐশ্বরিক ধারণা আমাদের মনে রয়েই যায়। কারণ, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তিনি বলবেন যে, “আমার ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা আছে”, আর যিনি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, তিনি বলবেন যে “আমার কোনো ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাই নেই”। এরূপ সদর্থক ও নঞর্থক উভয় প্রকার স্বীকৃতিই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের ধারণাকেই সূচিত করে। আর ঈশ্বরের ধারণা যেহেতু সহজাতরূপে গণ্য হয়, সেহেতু সহজাত ধারণার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ:

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে স্পিনোজার মতবাদ (Spinoza’s Theory on Origin of Knowledge)

 

জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে দেকার্তের পর যাঁর অভিমতটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তিনি হলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বেনেডিক্ট স্পিনোজা। দেকার্তের মতোই স্পিনোজাও শুধুমাত্র বুদ্ধিকেই জ্ঞানের মৌল উৎসরূপে স্বীকার করেন। তিনি দেকার্তের সহজাত ধারণাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ঈশ্বরের ধারণাকে তিনি সহজাতরূপে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, আমরা জন্মসূত্রেই ঈশ্বরের ধারণাকে পেয়ে থাকি। ঈশ্বরের ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তিনি তাঁর দর্শনের সমস্ত বিষয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। কিন্তু পদ্ধতির প্রয়োগের দিক থেকে তিনি দেকার্ত থেকে স্বতন্ত্র।

 

জ্যামিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ:

  স্পিনোজা তাঁর দর্শনে যে পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন, তা হল জ্যামিতিক পদ্ধতি (geometrical method)। জ্যামিতিতে যেমন স্বতঃসিদ্ধ ধারণা থেকে অবরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে ‘ সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো হয়, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও স্পিনোজা তেমনই কিছু ঐশ্বরিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য থেকে অবরোহ পদ্ধতির সাহায্যে যথার্থ জ্ঞান লাভ করার কথা বলেন। এই জ্যামিতিক পদ্ধতির সাহায্যেই তিনি অন্তর ধারণাপ্রসূত ঈশ্বরের অস্তিত্ব থেকে জীবাত্মা এবং জড়জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন।

 

একমাত্র দ্রব্য হিসেবে ঈশ্বর: 

 স্পিনোজা দেকার্তের দ্রব্যতত্ত্বের সংশোধন করে বলেন যে, দ্রব্য কখনোই তিনটি নয়, দ্রব্য হল একটি এবং এই একমাত্র দ্রব্যই হল ঈশ্বর (God)। তিনিই হলেন চরম ও পরম দ্রব্য। এর বাইরে অন্য কোনো দ্রব্যের অস্ত্বিত্ব নেই।

 

 দ্রব্যরূপে দেহ ও মনের অস্বীকৃতি:

 দেকার্ত দেহ এবং মন- -এ দুটিকেও দ্রব্যরূপে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্পিনোজা এ দুটিকে দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করেননি। তিনি দেহ এবং মন-কে ঈশ্বরের দুটি সমান্তরাল গুণরূপে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, দেহের গুণ হল বিস্তৃতি (extention) এবং মনের গুণ হল চেতনা (consciousness)। এই বিস্তৃতি এবং চেতনা দিয়েই তিনি সমগ্র জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন।

 

  জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে লাইবনিজের মতবাদ (Leibnitz’s Theory on Origin of Knowledge)

 

প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ একজন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক। জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে দেকার্ত ও স্পিনোজার পর লাইবনিজের অভিমতটি বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। এর কারণ হল, লাইবনিজ তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদের বিষয়টিকে অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

সমস্ত ধারণাই সহজাত :

  দেকার্ত যেখানে আমাদের কোনো কোনো ধারণাকে সহজাতরূপে উল্লেখ করেছেন, সেখানে লাইবনিজ আমাদের সমস্ত প্রকার ধারণাকেই সহজাত বলে দাবি করেছেন। আমাদের মনের মধ্যেই সমস্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা সুপ্তভাবে নিহিত থাকে। মনের ক্রিয়ার মাধ্যমেই সেগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাঁর মতে, আমাদের এই জড়জগৎ মনের অন্তর ধারণা তথা সহজাত ধারণার মূর্ত প্রকাশ মাত্র।

 

আধ্যাত্মিক একক হিসেবে মনাড:

  লাইবনিজের ধারণায় মনাড হল দ্রব্য। এগুলি আধ্যাত্মিক এককরূপেই গণ্য। মনাডগুলি সংখ্যায় বহু। এই সমগ্র বিশ্বজগৎ মনাড দ্বারাই গঠিত। মনাডগুলির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হল— এগুলি এক-একটি আধ্যাত্মিক একক (spiritual unit) রূপে গণ্য হয়। লাইবনিজের মতে, দ্রব্য বলতে আমরা মনাড (monad)-কেই বুঝি। সুতরাং মন বা আত্মাও হল মনাড। মনাডগুলিকে গবাক্ষহীন (windowless) বলা হয়। এগুলি নিজে নিজেই ক্রিয়াশীল বা স্বয়ংক্রিয় (self-active)। কোনো মনাডই অন্য কোনো মনাডের ওপর নির্ভরশীল নয়। এরা সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করে। এদেরকে বুদ্ধি দ্বারাই জানা সম্ভব, অভিজ্ঞতা দ্বারা নয়। ও জাগতিক বিষয়-সংক্রান্ত সত্য এবং বুদ্ধিলব্ধ সত্য: লাইবনিজ তাঁর দর্শনে দু-প্রকার সত্যের উল্লেখ

 

 জাগতিক বিষয়-সংক্রান্ত সত্য (truths of fact) এবং বুদ্ধিলব্ধ সত্য (truths of reason)।

  তাঁর মতে, প্রথম ধরনের সত্য হল অভিজ্ঞতালব্ধ এবং সে কারণেই তা সার্বিক ও স্বতঃসিদ্ধ রূপে গণ্য নয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের সত্যটি অবশ্যই বুদ্ধিলব্ধ এবং সে কারণেই তা সার্বিক ও স্বতঃসিদ্ধ রূপে গণ্য। সুতরাং নিয়ত এবং শাশ্বত জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় শুধুমাত্র বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারাই। করেছেন

 

বুদ্ধির কাজ: লাইবনিজের মতে, জড় বা জড়জগৎ বলে কিছু নেই। জড়জগতের প্রত্যক্ষ হল ভ্রমাত্মক। জড়জগৎ হল তাদৃশ্য অজড় পরমাণুসদৃশ মনাডের সংকলনমাত্র।

 

 

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে লকের মতবাদ (Locke’s Theory on Origin of Knowledge)

 

প্রখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক (Locke)-ই প্রথম অভিজ্ঞতাবাদের একটি সুস্পষ্ট ও সুসংহত রূপদান করেছেন। তিনি তাঁর An Essay Concerning Human Understanding নামের বইতে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, আমাদের সমস্ত ধরনের জ্ঞানের মৌল উপাদান হল সরা ধারণা (simple idea)। এই সরল ধারণাগুলিকে আমরা ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই লাভ করি। অভিজ্ঞতার পূর্বে আমাদের মন থাকে অলিখিত সাদা কাগজের (tabula rasa) মতো, যেখানে অভিজ্ঞতার কালিতে মুদ্রিত হয় ধারণা (idea) এবং এই ধারণার মাধ্যমেই আমরা জ্ঞান লাভ করি। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আগে থেকেই যেসব ধারণা মনে থাকে বলে অনেকে মনে করেন, সেগুলিকে বুদ্ধিবাদী দার্শনিক দেকার্ত অন্তর ধারণা বা সহজাত ধারণা (innate idea) রূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো অন্তর ধারণার অস্তিত্ব লক মানতে রাজি নন। তিনি বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে দেকার্তের অন্তরধারণার বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, আমাদের সমস্ত প্রকার ধারণাই হল অভিজ্ঞতালব্ধ।

 

দু-ধরনের অভিজ্ঞতার পথ ধরে ধারণার আগমন: 

 লকের মতে, আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদন বা অভিজ্ঞতা আসে দুটি পথ ধরে — সংবেদন (sensation) এবং i ii অন্তরদর্শন (reflection) -এর মাধ্যমে।

 

সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বাহ্যবস্তু সম্পর্কে ধারণা লাভ করি এবং অন্তরদর্শনের মাধ্যমে আমরা লাভ করি আমাদের অন্তর ইন্দ্রিয়ের ধারণা। এই দু-ভাবে প্রাপ্ত ধারণা ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে আমরা ধারণা লাভ করতে পারি না। এই ধারণা লাভের ক্ষেত্রে আমাদের মন থাকে একেবারেই নিষ্ক্রিয় (passive)। আমাদের অভিজ্ঞতা ধারণাকে যেভাবে আমাদের মনে মুদ্রিত করে, আমরা ঠিক সেইভাবেই সেগুলিকে গ্রহণ করতে বা প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হই। আমাদের মনে অভিজ্ঞতাপূর্ব কোনো ধারণাই থাকে না । লক তাই বলেন যে, বুদ্ধিতে এমন কিছু নেই যা পূর্বে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না (There is nothing in the intellect which was not previously in the senses)।

 

ধারণাসমূহের মধ্যে মিল বা অমিল প্রত্যক্ষই জ্ঞান: 

 শুধুমাত্র ধারণা লাভ করলেই যে আমরা জ্ঞানলাভ করি, এমন নয়। ধারণা জ্ঞানের অপরিহার্য উৎস হলেও, নিছক ধারণাই জ্ঞান নয়। লকের মতে, একাধিক ধারণার মধ্যে মিল বা অমিল প্রত্যক্ষ করার নামই হল জ্ঞান (Knowledge is nothing but agreement or disagreement of ideas)। উদাহরণস্বরূপ, নিছক ‘সুরভির ধারণা’ বা ‘চন্দনের ধারণা’ জ্ঞান নয়। কিন্তু ‘চন্দনের’ ধারণার সঙ্গে যদি ‘সুরভি’ নামক ধারণার মিল পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে তা আমাদের জ্ঞানের বিষয়বস্তুরূপে পরিগণিত হয়। এক্ষেত্রে আমাদের কাছে সুরভি চন্দনের জ্ঞান হতে পারে। অনুরূপভাবে, দুটি ধারণার অমিলের মাধ্যমেও আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি এবং বলতে পারি, “চন্দন পদ্ম নয়।” সুতরাং, আগে আমাদের মনে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধারণার উদ্ভব হয় এবং সেই ধারণার মিল বা অমিল প্রত্যক্ষের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করি। এজন্যই লকের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদকে প্রতিনিধিত্বমূলক মতবাদ (representationalism) রূপে অভিহিত করা হয়।

 

 আরোহাত্মক পদ্ধতিতে জ্ঞানলাভ:

  দর্শনের ক্ষেত্রে জ্ঞানলাভের প্রসঙ্গে লক যে পদ্ধতির উল্লেখ করেন, তা হল আরোহাত্মক পদ্ধতি (inductive method)। দেকার্ত ও স্পিনোজা জ্ঞানের পদ্ধতি হিসেবে অবরোহ পদ্ধতিকেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু লক তাঁদের বিরোধিতা করে এই মত দেন যে, আমাদের জ্ঞানের পদ্ধতি কখনই অবরোহাত্মক হতে পারে না। কারণ আমরা অন্তর ধারণা বলে কোনো ধারণা থেকে জ্ঞান পেতে পারি না। আমাদের সমস্ত ধারণা এবং জ্ঞান নিষ্কাশিত হয় অভিজ্ঞতা থেকেই। এভাবেই আমরা বিশেষ বিশেষ ধারণা থেকে বিশেষ বিশেষ জ্ঞান লাভ করি এবং ওই সমস্ত বিশেষ জ্ঞানের মাধ্যমে সাধারণ জ্ঞান লাভ করতে পারি।

 

লকের জ্ঞানতত্ত্বের অসংগতি

 

জ্ঞানতত্ত্ব প্রসঙ্গে লক যে তিন প্রকার জ্ঞানকে স্বীকার করেছেন, তা হল যথাক্রমে— বোধিসত্তাক জ্ঞান, ) যৌক্তিক জ্ঞান এবং  সংবেদনলব্ধ জ্ঞান। এই তিনপ্রকার জ্ঞানের মধ্যে বোধিসত্তাক জ্ঞানকেই তিনি সর্বোচ্চ স্থানে রেখেছেন। সংবেদনলব্ধ জ্ঞানকে তিনি গুরুত্ব অনুযায়ী সবার নীচে রেখেছেন। কিন্তু একজন প্রকৃত অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে এটা আদৌ সংগত নয়। সে কারণেই পাশ্চাত্য দর্শনের পুস্তক রচয়িতা ফলকেনবার্গ (Falckenberg) লকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন যে, লকের অভিজ্ঞতাবাদী ভিত্তিপ্রস্তর তাঁর যুক্তিবাদী জ্ঞানসৌধের সঙ্গে বিরোধিতা করে। উপরন্তু, লক মন, ঈশ্বর এবং দ্রব্য—নামক তিনটি অভিজ্ঞতাপূর্ব বিষয়ের অস্তিত্বকে স্বীকার করে এই অসংগতিকে আরও জটিল করেছেন।

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ:

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বার্কলের মতবাদ (Berkeley’s Theory on Origin of Knowledge)

 

লকের পরেই অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসেবে যিনি প্রসিদ্ধ, তিনি হলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলে। অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি আর কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক উৎসকে স্বীকার করেন না। জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বার্কলের মতবাদকে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা যায়—

 

অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর: 

 অভিজ্ঞতাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব হল— অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর। অর্থাৎ, যাকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি না, তার অস্তিত্বকেও স্বীকার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যা কিছু প্রত্যক্ষযোগ্য, কেবল তারই অস্তিত্ব আছে।

 

বস্তু নয়, গুণাবলি প্রত্যক্ষ: 

 তাঁর মতে, আমরা প্রকৃতপক্ষে কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ করি না, প্রত্যক্ষ করি বস্তুটির গুণাবলিকে। বস্তুর গুণাবলিই আমাদের মনে ধারণার সৃষ্টি করে এবং আমরা শুধুমাত্র ধারণাকেই প্রত্যক্ষ করি।

 

উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, বাইরের কোনো সবুজ বস্তুকে প্রত্যক্ষ করলে আমাদের মনটিও সবুজ হয়ে যায় না, মনে যে সবুজের অস্তিত্ব দেখা যায়, তা হল সবুজের চেতনা বা ধারণা। অতএব এই দাবি করা সংগত যে একমাত্র ধারণাই হল সদ্বস্তু।

 

ও আত্মা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার: অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের একমাত্র উৎসরূপে স্বীকার করলেও, বার্কলে অভিজ্ঞতাপূর্ব মন বা আত্মা এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হিসেবে তিনি তাঁর দর্শন তত্ত্বের ক্ষেত্রে একপ্রকার স্ববিরোধিতার বিষয়কে সূচিত করেছেন।

 

 জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে হিউমের মতবাদ (Hume’s Theory on Origin of Knowledge)

 

দার্শনিক লক এবং বার্কলের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ চরম পরিণতি লাভ করে দার্শনিক হিউমের জ্ঞান সম্পর্কিত মতবাদে। দর্শনের ইতিহাসে হিউম একজন প্রকৃত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকরূপে স্বীকৃত। তাঁর মতে, সমস্ত প্রকার জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে অভিজ্ঞতা থেকেই। অভিজ্ঞতা বলতে তিনি ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে বুঝিয়েছেন। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ দু-ভাগে বিভক্ত—  ইন্দ্রিয়জ সংবেদন এবং ও ধারণা। ইন্দ্রিয়জ সংবেদন বলতে হিউম বাহ্য এবং আন্তর—উভয় প্রকার সংবেদনকেই বুঝিয়েছেন। আমরা যখন কোনো বস্তু দেখি, শুনি বা স্পর্শ করি, তখন তা ইন্দ্রিয়জ সংবেদন। অপরদিকে, এই ইন্দ্রিয়জ সংবেদনের ক্ষীণ প্রতিরূপকেই অভিহিত করা হয় ধারণারূপে। বাড়িতে আমার সামনে ডাকাতির যে ঘটনা ঘটে, তখন তা হল আমার ইন্দ্রিয়জ সংবেদনের। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আমি যখন পুলিশ অফিসারের কাছে ওই ঘটনার বিবরণ দিই, তখন তা হল আমার ধারণা। ইন্দ্রিয়জ সংবেদন যেখানে খুব বেশি স্পষ্ট, প্রাঞ্জল এবং স্বচ্ছ, ধারণা সেখানে অপেক্ষাকৃতভাবে কম স্পষ্ট, কম প্রাঞ্জল এবং কম স্বচ্ছ।

 

দ্রব্য, ঈশ্বর এবং আত্মার জ্ঞানলাভ অসম্ভব: 

 হিউম তাঁর দর্শনে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ঈশ্বর, মন এবং দ্রব্যের কোনো ইন্দ্রিয়জ সংবেদন অথবা ধারণা সম্ভব নয় বলে, এগুলি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানলাভ হতে পারে না। তাঁর মতে, ঈশ্বর অস্তিত্বহীন, কারণ তা ইন্দ্রিয় সংবেদনের অতীত। স্থায়ী মন বা আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই। দ্রব্যও অস্তিত্বহীন, কারণ দ্রব্য কতকগুলি গুণের সমষ্টি মাত্র। সুতরাং দ্রব্য, মন এবং ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞানলাভ হতে পারে না।

 

 সম্বন্ধযুক্ত ইন্দ্ৰিয়জ সংবেদন ও ধারণাই হল জ্ঞান:

  হিউমের মতে, ইন্দ্রিয়জ সংবেদন এবং ধারণাই হল জ্ঞানের মৌল উপাদান। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন বলে, শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়জ সংবেদন এবং ধারণার প্রাপ্তিই জ্ঞান নয়, এগুলির মধ্যে সম্বন্ধ থাকাও প্রয়োজন এবং সেরূপ হলে তবেই তা জ্ঞানের মর্যাদা পায়।

 

বিচ্ছিন্ন ধারণাগুলি অনুষঙ্গের নিয়মে জ্ঞান দান করে:

  হিউমের মতে, অনুষঙ্গের নিয়ম হল তিনটি— : সমতা বা সাদৃশ্যের নীতি, ii সান্নিধ্য বা সহচর নিয়ম এবং iii কার্যকারণ নিয়ম। এই তিনটি নিয়মের ভিত্তিতে আমরা পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয়জ সংবেদন অথবা ধারণাগুলির মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে নানান বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি।

 

চরম পরিণতিরূপে সংশয়বাদ: 

 ইন্দ্ৰিয়জ সংবেদন এবং ধারণার বাইরে কোনো কিছুকেই স্বীকার না করায়, হিউমের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের চরম পরিণতি হল সংশয়বাদ। যা কিছু সংবেদনলব্ধ নয়, তা আমাদের জ্ঞানের বিষয়বস্তুরূপে কখনোই পরিগণিত হতে পারে না। তিনি দাবি করেছেন যে, সার্বিক বা নিশ্চিত জ্ঞান বলে কোনো জ্ঞানই নেই। অতএব জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হিউমের সিদ্ধান্ত হল—সার্বিক এবং অনিবার্য জ্ঞান একেবারেই অসম্ভব, সমস্ত জ্ঞানই সম্ভাব্য (probable)। এই সংশয়বাদ ‘ তাঁর মতবাদের সবচাইতে বড়ো সীমাবদ্ধতা।

জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *