দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো
দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কে আলোচনা করো
প্রশ্ন ।। দিল্লীর সুলতানি রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।
কোন্ ঘটনাপরম্পরায় দিল্লীর সুলতানি শাসনের পতন ঘটিয়াছিল?
অথবা,
কি কি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণে দিল্লীর সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন হইয়াছিল?
দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন
উত্তর। ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে কুতুব-উদ্দিন আইবক কর্তৃক দিল্লীতে যে সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাহার অবসান হইয়া যায়। দীর্ঘ তিন শতাব্দীরও অধিককাল দিল্লীর সুলতানি টিকিয়া ছিল বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের রাজত্বের শেষভাগ হইতে ইহার পতনের সূত্রপাত হইয়াছিল; পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহ্ এবং তাঁহার তুঘলকবংশীয় বংশধরগণ সেই পতনকে তো রোধ করিতে পারেন নাই, বরং তাহাদের কার্যকলাপ সে পতনকে আরও দ্রুত করিয়া দিয়াছিল। সৈয়দ ও লোদীবংশীয় সুলতানগণের পক্ষে সেই পতন প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না, তাঁহাদের সে ক্ষমতাও ছিল না।
সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
এত দীর্ঘস্থায়ী এত বড় একটি সাম্রাজ্যের পতন কোন একটি কারণে সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। দিল্লীর তুর্কী-আফগান সাম্রাজ্যের পতনের পশ্চাতেও বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করিয়াছিল। এছাড়া, সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। তুলক বংশের সময় হইতে পতনের প্রক্রিয়া সূচিত হয় এবং দীর্ঘ দেড়শত বৎসর ধরিয়া সুলতানি সাম্রাজ্য উত্তরোত্তর দুর্বল হইতে থাকে। অবশেষে ইব্রাহিম লোদীর রাজত্বকালে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন সম্পূর্ণ হয়।
নেতৃত্বের দুর্বলতা:
সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ হইল নেতৃত্বের দুর্বলতা। স্বৈরাচারী মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল সম্রাটের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা। কিন্তু মহম্মদ-বিন্-তুলকের সময় হইতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুর্বলতা দেখা যায়। পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহ্ তুলক পতনের প্রবণতা প্রতিহত না করিয়া সুলতানি সাম্রাজ্যে শিথিলতা আনিতে সহায়তা করেন। ফিরোজের উত্তরাধিকারীগণ সকলেই ছিলেন দুর্বল ও রাজ্যশাসনের অনুপযুক্ত। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী মুঘল সম্রাটের ন্যায় ইহারা ছিলেন অযোগ্য এবং সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের মূলে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব ছিল।
জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন
দ্বিতীয়ত, দিল্লীর সুলতানি শাসনের সহিত দেশের জনগণের কোন যোগসূত্র ছিল না। এই যোগসূত্র স্থাপন করিয়া সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টাও বেশিরভাগ সুলতানের দেখা যায় নাই, সে উপলব্ধিও তাঁহাদের ছিল না। দেশবাসী হইতে বিচ্ছিন্ন রাজশক্তির স্থায়িত্ব কোন সময়েই দীর্ঘ হয় না।
পরধর্ম সম্বন্ধে অনুদান নীতি
তৃতীয়ত, শাসক ও শাসিতের এই ব্যবধান বেশির ভাগ সুলতানগণের পরধর্ম সম্বন্ধে অনুদার নীতি অনুসৃত নীতির ফলেই বৃদ্ধি পাইয়াছিল। দেশবাসীর বিরাট অংশ ছিল হিন্দু; তাহাদের সম্বন্ধে এবং তাহাদের ধর্ম সম্বন্ধে সুলতানগণের অনুদার জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন নীতি তাহাদিগকে সব সময়েই বিদ্রোহী করিয়া তুলিত। রাজপুতদের যুদ্ধবিগ্রহ, বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠা, হিন্দু জমিদারগণের বিরোধিতা— এ সমস্তই সুলতানি শক্তিকে বিশেষভাবে দুর্বল করিয়াছিল। এই ধর্মান্ধতা এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ।
হিন্দুদের বিরোধিতা এবং অসহযোগিতা
চতুর্থত, দেশবাসীর সমর্থন হইতে বঞ্চিত সুলতানি শক্তি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইয়া উঠিয়াছিল তাঁহাদের সামরিক শক্তির উপর। দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সুলতানগণের একনায়কত্ব এবং স্বৈরাচারী শাসন সামরিক শক্তিকেই একমাত্র আশ্রয় করিয়া টিকিয়াছিল। কিন্তু ইহাতে কোন সাম্রাজ্যই দীর্ঘস্থায়ী হয় না; অল্পকালের মধ্যেই সামরিক শক্তিতে ঘুণ ধরিয়া যায় এবং তাহার পতন অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠে।
জায়গিরদারী ও সামন্ত প্রথার কুফল
পঞ্চমত, সুলতানি সামরিক শক্তি আবার প্রতিষ্ঠিত ছিল জায়গিরদারি এবং সামন্ত-প্রথার উপর। বিশেষ করিয়া ফিরোজ শাহ্ কর্তৃক সামন্ত-প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের ফলে কেন্দ্রীয় সামরিক জায়গিরদারি ও সামন্ত-প্রথার কুফল শক্তিই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। কোন কারণে সুলতান দুর্বল হইলেই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি বিদ্রোহোন্মুখ হইয়া উঠিত এবং সাম্রাজ্যের সংহতি বিনষ্ট করিত। উলসী হেগ-এর মতে ফিরোজ তুঘলকের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করিয়াছিল। উচ্চাভিলাষী আমীর ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ কেন্দ্রীয় সরকারকে উপেক্ষা করিয়া বিদ্রোহী হইয়া উঠেন। ষষ্ঠত, অভিজাত শ্রেণীই ছিল সুলতানি সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ। তাহারাই ছিল জায়গিরদার, রাজকর্মচারী এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তা।
অভিজাত শ্রেণীর নৈতিক অধঃপতন ও ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য
চতুর্দশ শতাব্দী হইতেই তাহাদের নৈতিক অবনতি খুব স্পষ্ট হইয়া দেখা দেয়; ফলে সমগ্র শাসনব্যবস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত হইয়া উঠে।
সপ্তমত, ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য সাম্রাজ্যের স্বার্থ ও নিরাপত্তার নানা দিক দিয়া বিঘ্নিত করিয়া তুলিয়াছিল, সমস্ত আবহাওয়াকে বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছিল। এইরূপ দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বল শাসনব্যবস্থা যে কোন আঘাতেই ভাঙ্গিয়া পড়িবে ইহাই স্বাভাবিক। সেই আঘাত আসিল তৈমুর ও বাবরের ক্রীতদাসের সংখ্যাধিক্য আক্রমণের মধ্য দিয়া। শেষদিকের সুলতানগণ ও সুলতানি শাসনব্যবস্থা সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা রাখিত না।
১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে মধ্য-এশিয়ায় তৈমুরলঙ্গ তাহার বিরাট বাহিনী লইয়া দিল্লীর সুলতানির উপর চরম আঘাত হানিল। তাহার অবাধ হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনের ফলে সমগ্র সাম্রাজ্যে অব্যবস্থা দেখা দিল। কেন্দ্রীয় শক্তি একেবারে দুর্বল হইয়া পড়িল, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন দিকে প্রাধান্য বিস্তার করিতে লাগিল। এই আঘাতের পর সুলতানি শক্তি আর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইতে পারে নাই। ইহার ২৮ বৎসর পর লোদীবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদী পানিপথের প্রান্তরে বাবরের বাহিনীকে প্রতিরোধ করিতে পারিল না, সুলতানি রাজত্বেরও পরিসমাপ্তি হইয়া গেল।
দিল্লীর সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের মূলে তৈমুরলঙ্গের আক্রমণের ভূমিকা
১৩৮৮ খ্রীষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ্ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লীর সুলতানি-পদ লইযা তুলক বংশধরগণের মধ্যে এক অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দিয়াছিল। সেই অবসরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ একের পর এক স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া যখন সুলতানি শক্তিকে দুর্বল করিয়া ফেলিতেছিল, তখনই আসিল বহির্দেশ হইতে তৈমুরলঙ্গের আক্রমণ। এই আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের উপর চরম আঘাতের কাজ করিল।
১৩৬৯ খ্রীষ্টাব্দে সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহণ করিয়া তৈমুর চিঙ্গিজ খাঁর সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের জন্য সচেষ্ট হইয়া উঠিলেন। পারস্য, আফগানিস্তান, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশ জয় করিয়া তিনি ভারতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারের কোন উদ্দেশ্য তাঁহার ছিল বলিয়া মনে হয় না। ভারতের পৌত্তলিকতার বিনাশসাধনই তাঁহার প্রধান উদ্দেশ্য, বলিয়া তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধনরত্ন লুণ্ঠনের সুযোগ গ্রহণই তাঁহার অভিযান পরিচালনা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাঁহার বিশাল দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে একে একে সিন্ধু ও তাহার উপনদীগুলি অতিক্রম করিয়া এবং পথিপার্শ্বস্থ শহরগুলি লুণ্ঠন করিয়া দিল্লীর উপকণ্ঠে উপস্থিত হইল। সুলতান নাসিরুদ্দিন মহম্মদ ও তাঁহার মন্ত্রী মল্ল ইকবাল তাহাকে বাধা দিবার যে সামান্য চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা ব্যর্থ হইল। দিল্লীতে প্রবেশের মুখে একলক্ষ হিন্দু বন্দীকে হত্যা করিয়া এবং শহরের অভ্যন্তরে যথেচ্ছাচার হত্যাকাণ্ড চালাইয়া তৈমুর এক পৈশাচিক ও নারকীয় কাণ্ডের অনুষ্ঠান করিলেন। আরও কয়েকটি শহরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাইয়া সমগ্র ভূমিখণ্ডকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করিয়া ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর ভারত ত্যাগ করিলেন।
তৈমুরের এই ভারত আক্রমণের ফল হইয়াছিল সুদূরপ্রসারী। সুলতানি সাম্রাজ্যের রাজধানী একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইল, সমগ্র উত্তর ভারতে এক অরাজকতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিল। ফলে প্রদেশগুলি একে একে স্বাধীন হইয়া গেল। ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বসিয়া পড়িল। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হইল, চারিদিকে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল।
ইহার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ দিল্লীর সুলতানির পতন ত্বরান্বিত হইয়া উঠিল। তবে তৈমুরের আক্রমণের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ফল ছিল নগণ্য। কিন্তু তাঁহার আক্রমণ সুলতানি সাম্রাজ্যের দুর্বল চরিত্র প্রকট করিয়া তুলিল। এই অবস্থা হইতে পরবর্তী সৈয়দ ও লোদী বংশীয় সুলতানগণ সাম্রাজ্যকে আর পুনর্জীবিত করিতে পারিল না। একথা সত্য যে সুলতানি সাম্রাজ্য পূর্ব হইতেই ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইতেছিল; তৈমুরের আক্রমণ সেই পতনকে ত্বরান্বিত করিয়া দিল মাত্র।