মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো টেকজ সঞ্জীব
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো টেকজ সঞ্জীব
প্রশ্ন) মৌর্য শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর।
মৌর্য শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা কর।
মেগাস্থিনিসের বিবরণ ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের তথ্যাদির ভিত্তিতে মৌর্য শাসনব্যবস্থার বিবরণ দাও।
মৌর্য শাসনব্যবস্থা আলােচনা কর। এই শাসনব্যস্থায় অশোক কি কি পরিবর্তন সাধন করিয়াছিলেন?
উত্তর।
মৌর্য শাসনব্যবস্থা বিবরণ
মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থার তথ্যাদির সূত্র :
সাধারণত তিনটি সূত্র হইতে মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থার মূল তথ্যগুলি সংগৃহীত হইয়াছে ঃ
(ক) চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় গ্রীকদূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ,
(খ) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং
(গ) সম্রাট মেগাস্থিনিস, কৌটিল্য ও অশােকের বিভিন্ন শিলালিপি। ইহা ছাড়া পরবর্তীকালের শকক্ষত্রপ রুদ্রদমনের জুনাগড় শিলালিপি হইতে চন্দ্রগুপ্তের প্রাদেশিক শাসনের তথ্যাদি জানা যায়। অন্যান্য উপাদানগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হইল—দিব্যবদন, মুদ্রারাক্ষস ও জৈন পরিশিষ্ট পার্বণ। প্রধানত এই সমস্ত সূত্র হইতেই মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
(১) চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থা :
মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামাে গড়িয়া উঠিয়াছিল চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের মধ্যেই। সম্রাট অশােকের সময় সেই কাঠামোে মূলত অপরিবর্তিতই থাকিয়া যায়; তিনি প্রজারঞ্জনের জন্য ও ধর্মনীতি প্রচারের জন্য শাসনব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করিয়া আরও উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন মাত্র।
মৌর্য শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি :
মেগাস্থিনিসের বিবরণ, অর্থশাস্ত্র ও অশােকের অনুশাসনলিপি বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যায় যে, মৌর্য শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত কেন্দ্রীভূত। ডঃ রমিলা থাপারের মতে সমকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার তাগিদে মৌর্যযুগে আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা নির্মিত হইয়াছিল। ইহার অপর একটি উল্লেখযােগ্য দিক হইল , ইহা ছিল একটি সুসংবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত শাসন পদ্ধতি। স্মিথের মতে মৌর্য শাসনব্যবস্থা আকবরের শাসনব্যবস্থা অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট ছিল।
কিন্তু স্মিথ ও অন্যান্য পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ মৌর্য শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু রমিলা থাপার প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে সমকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য মৌর্যযুগে আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়িয়া উঠিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহা অবিমিশ্র স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয় নাই।কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হইতে জানা যায় যে, মৌর্য রাজাগণ কখনও নিজ ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন নাই এবং প্রজাবর্গের কল্যাণ সাধন করাই ছিল তাহাদের শাসননীতির মূল সূত্র।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক :
মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থার দুইটি দিক ছিল—কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ শাসক ছিলেন রাজা। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক রাজার তাহাকে সাহায্য করিতেন অমাত্য, মন্ত্রি ও মন্ত্রিপরিষদ।
(ক) মৌর্যযুগের রাজারা তাহাদের ক্ষমতাকে ভগবান প্রদত্ত বলিয়া প্রচার করিবার চেষ্টা করিতেন না। কিন্তু শাসনব্যবস্থায় রাজাগণ ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করিতেন। তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহক, প্রধান বিচারপতি, প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান আইনপ্রণেতা। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া শাসনকার্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করিতেন।
(খ) তিনি পুরাণ প্রকৃতি’ অর্থাৎ পুরাতন রীতিনীতির রাজ-সুশাসন; সামরিক অনুসরণে রাজ অনুশাসন (royal rescripts) প্রবর্তন করিয়া আইন প্রণয়নের কর্তব্য সম্পাদন করিতেন।
(গ) প্রধান সামরিক নেতা হিসাবে তিনি সেনাপতিগণের যুদ্ধ-পরিকল্পনাসমূহ বিচার করিয়া দেখিতেন। প্রয়ােজন হইলে তিনি নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিতেন।
(ঘ) রাজা স্বেচ্ছাচারমূলক ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন না। শাসনব্যবস্থা পরিচালনা কব্বিার জন্য তিনি সর্বদাই মন্ত্রী ও অমাত্য এবং মন্ত্রিপরিষদের সহিত সহযােগিতা করিতেন। মন্ত্রী বা অমাত্যদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চপদস্থ ছিলেন মহামন্ত্রীগণ। মী, অমাত্য ও মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী ছাড়াও একটি মন্ত্রিপরিষদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যে পরিষদের সহিত রাজা প্রয়ােজনে শলাপরামর্শ করিতেন।
(ঙ) শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজা অনেক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী নিযুক্ত করিতেন। হিসাব-পরীক্ষক, উদ রাজকর্মচারী পুরােহিত, পরিদর্শক প্রভৃতি। মহামন্ত্রীগণের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত বহুসংখ্যক রাজকর্মচারী ছিল যাহারা সাধারণভাবে ‘অধ্যক্ষ’ নামে পরিচিত ছিল, বেমনগরাধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষ প্রভৃতি। প্রদেশপাল, উপরাজ্যপাল, প্রধান বিচারপতি, নৌ-সেনাপতি প্রভৃতি নিয়ােগে রাজা মন্ত্রিপরিষদের সহিত আলােচনা করিতেন।
(চ) এত বড় বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার জন্য মৌর্য সম্রাটগণ বহুসংখ্যক গুপ্তচর নিযুক্ত করিতেন। ইহারা সেনাবাহিনীর ও দেশের সমস্ত সংবাদ রাজাকে সরবরাহ করিত। ।
নগরের শাসনব্যবস্থা :
রাজধানী পাটলিপুত্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ত্রিশজন সদস্য লইয়া গঠিত একটি নগর-পরিষদ’ ছিল। এই সদস্যদের মধ্য হইতে আবার প্রত্যেকটিতে নগর-পরিষদ ও তাহার পাচজন সদস্য লইয়া ছয়টি বাের্ড ছিল এবং এক-একটি বাের্ডের উপর ছয়টি বিভাগ বিশেষ বিশেষ বিভাগের দায়িত্বভার ছিল, যেমন—শিল্পোৎপাদন, বিদেশীয়দের অভ্যর্থনা, জন্ম-মৃত্যুর হিসাবরক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের তত্ত্বাবধান এবং বিক্রীত দ্রব্যের উপর এক-দশমাংশ কর আদায় করা। মেগাস্থিনিস শুধুমাত্র পাটলিপুত্র নগর সম্বন্ধেই তাহার বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন। তবে ইহা খুবই স্বাভাবিক যে, ঐ সময়ে ভারতের সমস্ত প্রধান নগরেই ঐ ধরনের নগরশাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
রাজস্ব ।
ভাগ বলি ও অন্যান্য কর:
সেই সময় ভূমিরাজস্বই ছিল রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎস। জমির ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজার ‘ভাগ হিসাবে সংগৃহীত হইত। উৎপন্ন দ্রব্যের এক-চতুর্থাংশ হইতে এক-অষ্টমাংশ পর্যন্ত বলি’ হিসাবে লওয়া হইত। ইহা ছাড়া বিক্রীত মূল্যের এক-দশমাংশ কর, জন্ম-মৃত্যু কর, জলকর, জরিমানা প্রভৃতি হইতেও রাজস্ব আদায় হইত। মৌর্যযুগে ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের (assessment) ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হইত। কিন্তু ভূমি রাজস্ব সংরক্ষণের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা লওয়া হয় নাই। যাহা হউক, রাজস্ব কর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মৌর্যযুগের ব্যবস্থাদি ছিল সত্যই প্রশংসনীয়।
মৌর্যযুগে অর্থনীতি :
মৌর্যযুগে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি প্রচলিত ছিল। তবে রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়িয়া উঠার ফলে বিভিন্ন শিল্প সংঘ ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়াছিল। রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে শিল্প ও কারিগরদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসংস্থায় নিয়ােগ করিতেন এবং এইসব শিল্পীরা রাষ্ট্রীয় কর হইতে মুক্ত ছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের বিচারব্যবস্থা :
রাজা ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারক। তিনি শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মণ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন করিতেন। রাজকীয় বিচারালয় ছাড়াও বিভিন্ন জনপদে ও নগরে বিশেষ বিশেষ নিম্ন বিচারালয় ছিল। যেমন—স্থানীয়’, ‘দ্রোণমুখ’ ও ‘সংগ্ৰহণ’। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ অপরাধ বিচারের জন্য ছিলেন ‘গ্রামিক বা গ্রাম্য প্রধানগণ।
মেগাস্থিনিসের বিবরণ হইতেই চন্দ্রগুপ্তের সামরিক সংগঠন ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য ছয় লক্ষ পদাতিক, ত্রিশ হাজার অশ্বারােহী, নয় হাজার হস্তী ও বহুসংখ্যক রথ ছিল। ত্রিশ জন সদস্য সামরিক পরিষদ ও তাহার লইয়া গঠিত একটি পরিষদের উপর সামরিক বিভাগ পরিচালনার ছয়টি বিভাগ ভার ছিল। এই পরিষদ আবার ছয়টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল এবং তাহারা এক-একটি বিশেষ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিল, যেমন—পদাতিক, অশ্বারােহী, যুদ্ধরথ, হস্তীবাহিনী, রসদ ও যানবাহন এবং নৌবাহিনী। নৌবাহিনী যতদূর সম্ভব জলদস্যু দমনের জন্য নিযুক্ত থাকিত। সামরিক ব্যবস্থার মধ্যে পরিখা, প্রাচীর, শিবির, সামরিক ব্যবস্থা ও যুদ্ধাস্ত্র দুর্গ এবং যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে তরবারি, খড়্গ, বর্শা, তীর, বর্ম ইত্যাদির উল্লেখ আছে। গুপ্তচর বিভাগ সৈন্যবাহিনীর অঙ্গ ছিল। সৈন্যগণ সাধারণত রাজকোষ হইতেই বেতন পাইত।
মৌর্যসাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা :
চন্দ্রগুপ্তের সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্য চারিটি প্রদেশে বিভক্ত প্রদেশপালকুমার বা ছিল—প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণাপথ। অশােকের সময় মহাপাত্র পঞ্চম প্রদেশ কলিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্রাট স্বয়ং রাজধানী হইতে ‘প্রাচ্য শাসন করিতেন। অন্যান্য প্রদেশগুলির শাসনভার কুমার’ উপাধিধারী রাজপুত্র বা ‘মহামাত্র’ উপাধিধারী উচ্চ রাজকর্মচারীদের উপর ন্যস্ত করা হইত। প্রদেশসমূহ কতকগুলি
‘জনপদে’ বিভক্ত ছিল, যাহার শাসনভার ‘সমাহরত্রি’দের উপর ন্যস্ত ছিল। জনপদের এক-চতুর্থাংশের শাসনভার ছিল স্থানিক’দের উপর। পাচ হইতে দশটি গ্রামের শাসনভার ন্যস্ত হইত ‘গােপ’দের উপর। গ্রামের গােপ ও গ্রামিক শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন গ্রামবাসীদের দ্বারাই নির্বাচিত ‘গামিক’ নামক কর্মচারীগণ। অন্তপালগণ’ সীমান্তরক্ষী কর্মচারী ছিলেন এবং অপাল ও কুটপাল দুর্গোর ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন ‘দুর্গপাল’ বা ‘কৃটপাল’গণ। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, চন্দ্রগুপ্তের শাসন-প্রণালী ছিল শক্তিশালী, ইহার ফলে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ও বৈদেশিক আক্রমণ হইতে চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থার দেশকে রক্ষা করার উপযােগী ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার শাসনব্যবস্থা ভিত্তি জনকল্যাণমূলকও ছিল। সেইজন্য চন্দ্রগুপ্তের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য
অশােকের শাসনব্যবস্থা ।
সম্রাট অশােকের আমলে মৌর্য শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক ছিল যে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু মৌর্য আমলের স্বৈরতন্ত্র এক উচ্চ রাজ কর্তব্যের আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হত এবং মন্ত্রিপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিত।
(ক) রাজধানীর নিকটস্থ কেন্দ্রীয় অঞ্চলসমূহ পাটলিপুত্র হইতেই শাসিত হইত ; কিন্তু দূরবর্তী প্রদেশগুলির জন্য প্রাদেশিক’ নামে শাসনকর্তা নিযুক্ত হইত। সাধারণত রাজপরিবারভুক্ত কুমারগণকেই এই দায়িত্বভার অর্পণ করা হইত।
(খ) অশােকের অনুশাসনসমূহে তিন শ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যথারাজুক, যুত ও মহামাত্র । রাজুকগণকে এক-একটি বিরাট অঞ্চলের শাসনভার দেওয়া হইত এবং তাহাদের স্থান ছিল খুব উচ্চ। প্রজার সাংসারিক ও নৈতিক উন্নতিবিধানই ছিল তাহাদের প্রধান দায়িত্ব। পুরুষ’ নামক কর্মচারীগণ রাজুক ও সম্রাটের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখিতে সাহায্য করিতেন।
(গ) যুতগণ রাজকীয় সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, রাজস্বের আয়ব্যয় এবং হিসাবরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিতেন।
(ঘ) মহামাত্রগণওউচ্চরাজকর্মচারী কর্মচারীগণ ছিলেন এবং বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। স্ত্রী-জাতির সম্মানরক্ষা ও তত্ত্বাবধানের জন্য স্ত্রী-অধ্যক্ষ মহামাত্র নামে এক শ্রেণীর কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
(ঙ) অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে ব্রজভূমিক’ বা গােচারণভূমির অধ্যক্ষ ‘করণক’ বা বিচারক, প্রতিবেদক’ বা সংবাদ সরবরাহকারক দায়িত্ব ‘লিপিকার’ বা কেরানী, ‘আয়ুক্ত’ বা স্থানীয় কর্মচারী এবং দূত প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
(চ) সম্রাট অশােক ‘ধর্মমহামাত্রক’ নামক এক শ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন ; তাহারা দেশবাসীর মধ্যে ধর্মভাব বৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য পরিভ্রমণ করিতেন।
(ছ) পৌরশাসনের ভার ছিল ‘নগর ব্যবহারিক’ নামক কর্মচারীদের উপর । (জ) শাসনব্যবস্থাকে উদার, মানবতাবাদী করিয়া তুলিবার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। বিচার ব্যাপারে ‘দন্ড-সমতা’ ও ‘ব্যবহার-সমতা নীতির প্রবর্তন করিয়া তিনি প্রচলিত দন্ডবিধির কঠোরতা অনেকখানি লাঘব করিয়াছিলেন।
(ঝ) বন্দীদের সম্বন্ধেও শাসন ও বিচারবিভাগের তিনি যথেষ্ট উদার মনােভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন।
(ঞ) তাহার উদারতা শাসনব্যবস্থার একটি উল্লেখযােগ্য নূতন বিষয় ছিল এই যে, প্রায় তিন বৎসর ও পাচ বৎসর অন্তর বিশিষ্ট রাজকর্মচারীগণ দেশ পরিভ্রমণ করিতেন। ঐ সময় । বন্দীদের প্রতি নীতি, তাহারা ধর্মপ্রচার করিতেন এবং দেশের মধ্যে কোথাও কোন অন্যায় রাজকর্মচারীদের দেশ অত্যাচার সংঘটিত হইতেছে কি না তাহাও দেখিতেন।
সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে, প্রজাবর্গের মঙ্গলসাধনের জন্যই অশােক তঁাহার শাসনব্যবস্থাকে পরিচালিত করিয়াছিলেন। সুশাসক হিসাবে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারেন ।
মৌর্য শাসনের প্রকৃতি :
ইহা সর্বজনস্বীকৃত যে, মৌর্যযুগের শাসনব্যবস্থা ছিল উন্নত ধরনের। শাসনব্যবস্থার নিপুণতা, রাজকর্মচারীদের কর্মকুশলতা, উন্নত ধরনের শাসনব্যবস্থা বিভিন্ন শাসনবিভাগের সুষ্ঠু পরিচালনা প্রভৃতি তাহার সাক্ষ্য দেয়। ঐতিহাসিক ডক্টর স্মিথের মতে মৌর্য শাসনব্যবস্থা আকবরের শাসনব্যবস্থা অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট ছিল।
ডক্টর স্মিথ সমেত অনেক পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের মতে মৌর্যৱজিগণ ছিলেন সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী। তাঁহাদের শাসনব্যবস্থা ছিল কঠোর স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করিয়া দেখা যায় যে, তাঁহাদের মত অতিরঞ্জিত ও ভ্রান্ত্ব। কারণ, একথা যদিও সত্য যে, রাজাকে কেন্দ্র করিয়া মৌর্যশাসনচক্র আবর্তিত হইত তথাপি একথা ভুলিলে চলিবে না যে সম্রাটগণকে ‘পুরাণ প্রকৃতি’ অর্থাৎ প্রাচীন রীতিনীতি অনুযায়ীই নীতি নির্ধারণ করিতে হইত এবং মহামন্ত্রিগগের ও মন্ত্রিপরিষদের সহিত পরামর্শ করিয়াই রাজকার্য পরিচালনা করিতেন। ইহা ছাড়া জনকল্যাণের দিকে রাজ্যসীমার ক্ষমতা দৃষ্টি রাখিয়াই সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হইত। অনেক অঞ্চলের উপজাতিরা অনায়াসে স্বায়ত্তশাসন উপভােগ করিত; গ্রামবাসীরা তাদের শাসনকর্তা ‘থমিক’কে নির্বাচিত করিতে পারিত।
এই সকল কারণে মৌর্য শাসনব্যবস্থাকে ‘সীমাহীন স্বৈরাচার’ বলিয়া আখ্যা দেওয়া যায় না।
মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য