মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা গুলি আলোচনা করো Teacj Sanjib
মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা গুলি আলোচনা করো Teacj Sanjib
মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা
তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১২ খ্রিঃ)
আলাউদ্দিন খলজীর মৃত্যুর পর চার বছরের মধ্যেই খলজী শাসনের অবসান ঘটে। তাঁর দুর্বল বংশধর মুবারক খলজীকে জনৈক খসরুশাহ্ নামক ব্যক্তি হত্যা করেন এবং ক্ষমতা দখল করেন। খসরুশাহ্ মাত্র কয়েকমাস রাজত্ব করার পর দিপালপুরের শাসনকর্তা গাজী মালিক তাঁকে সরিয়ে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাম নিয়ে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
মহম্মদ বিন্ তুঘলক (১৩২৫-৫১ খ্রিঃ) ঃ
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জুনা খাঁ মহম্মদ-বিন-তুঘলক নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ ২৬ বছরের রাজত্বকালে তিনি বেশ কতকগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন যার কোনোটিতেই সাফল্য লাভ করতে পারে নি। অসাধারণ পণ্ডিত, বিনয়ী, ন্যায়পরায়ণ, উদার ও প্রজাবৎসল এই সুলতান বিশেষ উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হওয়া সত্বেও মধ্যযুগের ইতিহাসে তিনি এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। অনেক ঐতিহাসিকই তাঁকে “খামখেয়ালী সুলতান” বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর চরিত্রে . দোষ ও গুণের অদ্ভুত এক সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
মহম্মদ-বিন-তুঘলকের পরিকল্পনা ঃ
মহম্মদ-বিন-তুঘলক তাঁর সময়কালে যেসব পরিকল্পনাগুলি গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল (ক) গঙ্গা যমুনা দোয়াব অঞ্চলের রাজস্ব বৃদ্ধি। (খ) রাজধানী স্থানান্তর। (গ) তামার মুদ্রার প্রচলন। (ঘ) কারাজল ও খোরাসান জয়ের পরিকল্পনা।
(১) গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের কর বৃদ্ধি ঃ
সাম্রাজ্যের আয় বৃদ্ধির জন্য ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গঙ্গাযমুনার দোয়াব অঞ্চলে ভূমি-রাজস্ব কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন। বারণীর মতে এই কর বৃদ্ধির হার ছিল ৫ থেকে ১০ গুণ। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবক্ষয়ের জন্য কৃষকরা এই বাড়তি রাজস্ব দিতে অক্ষম হয়। পরে সুলতান নিজের ভুল সংশোধন করার জন্য কৃষি-ঋণ, কৃষি সরঞ্জাম, বীজ সরবরাহ, জলসেচ ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি নিজে তদারক না করায় তাঁর বিপুল পরিমাণ অর্থ নষ্ট হয়। ফলে তাঁর পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনা
(২) রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৬-১৩২৭ খ্রিস্টাব্দ) :
সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সুশাসনের জন্য সুলতান দিল্লি থেকে ৭০০ মাইল দূরবর্তী দেবগিরিতে তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি তার নতুন নাম দেন “দৌলাতাবাদ”। রাজধানী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির অধিবাসীদেরও দৌলতাবাদ যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই দীর্ঘ ৭০০ মাইল পথের কষ্টে বহু লোক প্রাণ হারায়। তার উপর নতুন রাজধানীতে অতিরিক্ত জনসংখ্যায় নাগরিক প্রয়োজন ও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ৮ বছরের মধ্যেই সুলতান রাজধানী আবার দিল্লিতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। ফলে তার এই পরিকল্পনাটিও ব্যর্থ হয়।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক কেন তামার মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন
মহম্মদ বিন তুঘলকের তামার নোটের প্রচলন পরিকল্পনা
(৩) তামার নোটের প্রচলন (১৩২৯-৩০ খ্রিঃ) ঃ
দিল্লি থেকে রাজধানী দৌলতাবাদে স্থানান্তরিত করলে মোঙ্গলরা অরক্ষিত দিল্লি আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণের কোনো মোকাবিলা না করে সুলতান প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাদের বিদায় করেন। ফলে রাজকোষের অত্যধিক ব্যয় ও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যয়ের সঙ্গে উৎকোচ মেটানোর এই বাড়তি ব্যয়ভার রাজকোষে ঘাটতির সৃষ্টি করে। এইভাবে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য হলে এই ঘাটতি পূরণের জন্য সুলতান তামার নোট প্রচলন করেন। অনেকেই এই প্রতীকী মুদ্রার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু নোট যাতে কোনোরকমে জাল না হয় তার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা তামার মুদ্রা জাল করতে থাকে। সোনা রূপার মুদ্রা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। জাল নোটে বাজার ছেয়ে গেলে বিদেশি বণিকরা
তামার নোট নিতে অস্বীকার করে। ফলে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সুলতান বাধ্য হন বাজার থেকে সমস্ত তামার নোট
তুলে নিতে। শুধু তাই নয়, জাল নোট সহ সবাইকে নোটের পূর্ণ মূল্য রাজকোষ থেকে মেটাতে হয়। এতে রাজকোষ আরও শূন্য হয়ে যায়। সুলতানের · এই অভিনব প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
মহম্মদ বিন তুঘলকের কারাজল ও খোরাসান জয়ের পরিকল্পনা
(৪) কারাজল ও খোরাসান জয়ের পরিকল্পনা ঃ সুলতান মধ্য এশিয়া জয়ের জন্য এক বছর ধরে প্রায় পৌনে চার লক্ষ সৈন্যের ব্যয়ভার বহন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোরাসান ও ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুলতানের প্রতিকূলে যাওয়ায় তিনি এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। তবে পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে কাংরা ও হিমালয়ের পাদদেশে কারাজল ও কুর্মাচলে অভিযান পাঠান। সেখানকার রাজারা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করলেও কুমাচল থেকে ফেরার পথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্যাভাবে সুলতানের সৈন্যবাহিনী একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
মূল্যায়ন ঃ
মহম্মদ-বিন-তুঘলকের প্রতিটি পরিকল্পনা ব্যর্থতার জন্য ঐতিহাসিক নিজামুদ্দিন, জিয়াউদ্দিন বারণী, ফেরিস্তা, প্রমুখ ঐতিহাসিকরা তাঁর কঠোর সমালোচনায় মুখরিত। এই ঐতিহাসিকেরা সুলতানের পরিকল্পনাগুলিকে উন্মাদের চিন্তাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরী প্রসাদ, জি ব্রাউন, ইরফান হাবিব প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতানের প্রতিটি পরিকল্পনাকেই সৃজনধর্মী প্রতিভার পরিচায়ক ও যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁর ধৈর্যহীনতা, ত্রুটিপূর্ণ প্রয়োগ পদ্ধতি ও বাস্তব বুদ্ধির অভাবে পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ হয়ে যায়।
সর্বোপরি মধ্যযুগীয় শাসক হয়েও এবং ইসলাম ধর্মে প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভক্তি থাকা সত্ত্বেও সুলতান তার শাসন ব্যবস্থাকে শরিয়তের বিধান ও উলেমাদের নির্দেশ দ্বারা প্রভাবিত হতে দেননি। আলাউদ্দিনের মত তিনিও রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করে রেখেছিলেন। রাজ্যশাসন ব্যাপারে তিনি ন্যায়-নীতি ও নিজ বিবেককেই বেশি মূল্য দিতেন। তাই শিক্ষিত সংস্কার মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ এই শাসক সম্পর্কে ঐতিহাসিক স্ট্যানলি লেনপুলের ভাষায় বলতে যায়, “শুভ উদ্দেশ্য ও উচ্চ আদর্শ থাকা সত্ত্বেও চিত্তের স্থৈর্য, ধৈর্য ও মাত্রাবোধের অভাবে মহম্মদ-বিনতুঘলকের জীবন এক মহান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল”।