সাজাহান চরিত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাংলা নাটক টেকজ সঞ্জীব
সাজাহান চরিত্র দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাংলা নাটক টেকজ সঞ্জীব
প্রশ্ন ।। দ্বিজেন্দ্রলালকে অনুসরণ করে সাজাহান চরিত্রের পিতৃসত্তা ও সম্রাট-সত্তার দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট কর।
অথবা,
সম্রাটের কর্তব্যবােধ ও পিতার স্নেহ–সাজাহান চরিত্রে এই দুটি প্রবৃত্তির মধ্যে কোটি জয়ী হয়েছে এবং তার ফলে চরিত্রটির পরিণতি কিরূপ হয়েছে, নাট্যকাহিনী বিশ্লেষণ করে তা সমালােচনা কর।
অথবা,
‘ পিতা সাজাহান ও সম্রাট সাজাহানের অন্তর্দ্বন্দ্বই সাজাহান চরিত্রটিকে অনন্যতা দান করেছেনাট্যকাহিনীর সূত্র অবলম্বনে এই উক্তিটির তাৎপর্য বিচার কর।
সাজাহান চরিত্র
উত্তর। দ্বিজেন্দ্রলাল সাজাহান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজাহানের নাম অনুসারেই নাটকটির নামকরণ করেছিলেন। ফলে এই চরিত্রটির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়াই নাট্যকারের অভিপ্রায়।
দিল্লীর সম্রাট সাজাহানের করুণ ভাগ্যবিপর্যয়ের চিত্ৰই নাটকের মূল বিষয়। এবং সে বিপর্যয় সমগ্র ভারতের প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাট সাজাহানের নয় ;—দারা, সুজা, মােরাদ ও ঔরংজীব—এই চার পুত্র এবং জাহানারা ও রােশেনারা—এই দুই কন্যার পিতা ব্যক্তি সাজাহানের জীবন বিপর্যয়ের কাহিনীকেই নাট্যকার তাঁর নাটকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন।
সাজাহানের চরিত্রে প্রথম থেকেই দুটি পরস্পর বিরােধী লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। একটি তার সম্রাটত্ব ; আর একটি তার পিতৃত্ব। একদিকে বজ্রের মত কঠোর রাজদন্ড তার হাতে, অপরদিকে কুসুমকোমল পিতৃস্নেহ তার বুকে। এই দুইএর দ্বন্দ্বেই সাজাহান চরিত্র উদ্ভাসিত। সম্রাটের কর্তব্যে মাঝে মাঝে তিনি যেমন সিংহের মত জেগে উঠেছেন আবার তেমনি পরক্ষণেই পিতৃস্নেহের প্রাবল্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন।
সাজাহান নাটকের প্রশ্ন উত্তর
সমগ্র নাটকের মাত্র পাঁচটি দৃশ্যে আমরা সাজাহানকে দেখতে পাই। প্রথম অঙ্কের সপ্তম দৃশ্যে প্রথম আমরা সাজাহানকে যে ভূমিকায় দেখতে পেলাম, তা হল—বিদ্রোহী পুত্রদের দমন করার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও জ্যেষ্ঠপুত্রের উপর সৈন্যাপত্বের ভার অর্পণ করলেন, আবার পিতৃস্নেহের চাপে পড়ে ঔরংজীবকে সহস্র সৈন্য নিয়ে আগ্রা দুর্গে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করেছে। কারণ ‘বেচারী মাতৃহারা পুত্রকন্যাদের প্রতি স্নেহান্ধ পিতার পক্ষে নিষ্ঠুর হওয়া অতি কঠিন কাজ। তাই সাজাহানের ইচ্ছা এবং পরামর্শ—’না দারা কাজ নেই। আমি তাদের বুঝিয়ে বলবাে….তাদের নির্বিরােধে রাজধানীতে আসতে দাও।’ আবার যখন ঔরংজীবের দুর্গে প্রবেশের সংবাদ পেলেন তখন বলে উঠলেন,—“আমি সাগ্রহে ঔরংজীবের অপেক্ষা করছি। সে আমার পুত্র, আমার উদ্ধত পুত্র, আমার লজ্জা, আমার গৌরব। তার স্থির বিশ্বাস—আসুক সে, আমি তাকে স্নেহে বশ করব’। এখানে দেখতে পাওয়া গেল, ওরংজীবের ঔদ্ধত্য সাজাহানের পিতৃ অভিমানকে আঘাত করেছে সত্য কিন্তু তার বীরত্ব পিতাকে গৌরবান্বিত করেছে।
দ্বিতীয় অঙ্কে দ্বিতীয় দৃশ্যে আগ্রার প্রাসাদকক্ষে বন্দী সাজাহান নিজের অবস্থা বিপর্যয়ে বিলাপ করছে। তখনও তার মনে সুদূর একটা আশা ছিল হয়তাে দারা সৈন্য নিয়ে ফিরে এসে তাকে উদ্ধার করবেন। কিন্তু কন্যা জাহানারা যখন জানালেন যে ঔরংজীব ভারত সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হচ্ছেন, দেশজুড়ে সেই অভিষেক উৎসব চলেছে, তখন বন্দী সাজাহান আক্রোশে ফেটে পড়েন। কিন্তু তখন তার পুত্রকে অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সে অভিশাপ, অবক্ষয়িত মানবাত্মার আর্ত চীৎকার ছাড়া আর কিছু নয়।
সাজাহান চরিত্র
এরপর চতুর্থ অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে দেখি অসহায় বন্দী সাজাহান, দারা এবং সুজার হতভাগ্যের সংবাদে বিচলিত। দারা ঔরংজীবের হাতে বন্দী ; তখন দারার নিরাপত্তা চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন তিনি। এখানেও সেই স্নেহাতুর পিতৃহৃদয়ের অভিব্যক্তি।
পরের অবস্থান পঞ্চম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে। আগ্রার রাজপ্রাসাদে সাজাহান তখন দুর্দশার চরমে পৌঁছেছেন। মাঝে মাঝেই উন্মাদের মত চীৎকার করতে থাকেন। জহরৎ আর জাহানারা তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেও তিনি শান্ত হওয়ার পরিবর্তে বাইরের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেন।
সাজাহান দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
পরিশেষে পঞ্চম অঙ্কের ষষ্ঠ দৃশ্যে আগ্রার প্রাসাদে সাজাহানের কাছে ঔরংজীব এসেছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে। শীর্ণদেহী ঔরংজীব পিতার পদপ্রান্তে বসে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। সাজাহান একবার ঔরংজীবের দুষ্কর্মের কথা স্মরণ করেন আবার অত্যন্ত বেদনার্ত হৃদয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে মার্জনা করেন। কিন্তু তােমার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম’ বলে যখন সাজাহান চোখ ঢাকলেন তখন ক্ষমা আর ক্ষমা থাকল না। ক্ষমা যে এতখানি করুণ হতে পারে তা সাজাহানের এই অন্তিম ইচ্ছার মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়েছে।
আলােচ্য নাটকে সাজাহান চরিত্রের তিনটি স্তর। এই তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়েই সাজাহানের সম্রাটসত্তা ও পিতৃসত্তার দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে, এবং মর্মান্তিক বিপর্যয় করুণ পরিণতি লাভ করেছে। নাটকের আরম্ভ থেকে আগ্রার দুর্গে বন্দী হওয়া পর্যন্ত—প্রথম স্তর। এই স্তরে সাজাহানের সম্রাট সত্তার আত্মাভিমান বজায় ছিল। ঔরংজীবের দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ এবং নিজেকে সম্রাট বলে ঘােষণা পর্যন্ত দ্বিতীয় স্তর। এই স্তরের শেষে সাজাহানের সম্রাট সত্তার সম্পূর্ণ পরাজয়। ঔরংজীব তার পিতা জীবিত থাকতেও যে সিংহাসনে বসতে এবং নিজেকে সম্রাটরূপে ঘােষণা করতে পারে, এটা পিতা সাজাহান কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এই-স্তরে সাজাহান অৰ্ধোন্মাদ। আর তৃতীয় স্তরে মােরাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হওয়াতে এবং দারার বন্দী হওয়া ও হত্যার আশঙ্কাতে সাজাহান প্রায় সম্পূর্ণ উন্মাদ। সর্বহারা, নিঃস্ব, রিক্ত পিতা সাজাহান এই অবস্থায় মর্মভেদী আর্তনাদ করে উঠেছেন।
সাজাহান চরিত্রের পিতৃসত্তা ও সম্রাট-সত্তার দ্বন্দ্ব
নাটকের সূত্রপাতে আমরা যখন সাজাহানের পুত্রদের অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের কথা শুনি, তখন সাজাহানকে দেখি একদিকে সম্রাটের কর্তব্যবােধে চিন্তিত ও অন্যদিকে পিতৃহৃদয় নিয়ে এই দুঃসংবাদে নিতান্তই বিচলিত। তাই জাহানারা যখন উদ্ধত সুজা, স্বকল্পিত সম্রাট মােরাদ ও তার সহকারী ঔরংজীবকে দমনের জন্য পিতাকে বারবার উত্তেজিত করেছে, তখন পিতা সাজাহানের মধ্যে যে অন্তর্বিরােধ, তা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নাট্যকার চিত্রিত করেছেন। সাজাহানের খেদোক্তিতে এই চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ঈশ্বর পিতাদের এই বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলে কেন? কেন তাদের হৃদয়কে লৌহ দিয়ে গড়নি?’ পরে ভাইদের কাউকে পীড়ন বা বধ করবেন না, দারার এই আশ্বাসে স্নেহকাতর পিতা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়ে বললেন–“বেশ, তাই হােক! তারা জানুক যে সাজাহান শুধু পিতা নয়, সাজাহান সম্রাট। বিদ্রোহী পুত্রদের শাস্তি বিধানের জন্য তিনি দারাকে সমস্ত ক্ষমতা অর্পন করলেন। কিন্তু তার চিত্তের দ্বন্দ্ব তাতেও প্রশমিত হল না। তিনি পিতৃহৃদয়ের আহ্বানকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন—এ শাস্তি তাদের একার নয়, এ শাস্তি আমারও। পিতা যখন পুত্রকে শাসন করে, পুত্র ভাবে যে পিতা কি নিষ্ঠুর! সে জানে না যে পিতার উদ্যত বেত্রের অর্ধেকখানি পড়ে সেই পিতারই পৃষ্ঠে। এখানে একবার সম্রাটত্বের অনুশাসন আবার পিতৃস্নেহের মহিমা দুই-ই যুগপৎভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
সাজাহানের এই Eror of judgement তাঁর জীবনের ট্রাজেডিকে ডেকে এনেছে, যার জন্য তিনি নিজেই দায়ী। পিতৃসত্তা এবং সম্রাটসত্তার মধ্যে আপস করতে গিয়ে সাজাহান নিজেই বিপর্যয় ডেকে এনেছেন, নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এই পিতৃসত্তাই আধিপত্য বিস্তার করেছে বলেই বিজয়ী পুত্র ঔরংজীবকে তিনি বিনা বাধায় আগ্রা দুর্গে সৈন্য নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। পুত্রের অকৃতজ্ঞতায় তিনি আঘাত পেয়েছেন, যার জন্য তার নিজের দায়িত্বও কম নয়। এর পরই আমরা দেখি, বন্দী সাজাহানের দ্বৈত সত্তার দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বই ক্রমশঃ তীব্রতর হয়ে পিতৃসত্তার জয় ঘােষণা করেছে শেষ পর্যন্ত।
ডঃ সাধনকুমার ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, “বাহ প্রতিক্রিয়া ও সাফল্যের হিসাবে নিষ্ফল হইলেও দ্বন্দ্ব হিসাবে অপূর্ব মহিমায় মণ্ডিত।…..সাজাহান নাটকের পরিণতি মার্জনীয়, কিন্তু এই মার্জনা, সমালােচক ব্যাডলে যাহাকে ‘self restitution of the divided spiritual unity’ বলিয়াছেন ঠিক তাহাই। সাজাহান যেভাবে আত্মস্থ বা প্রকৃতিস্থ হইতে চেষ্টা করিয়াছেন তাহা violent অর্থাৎ ভীষণ নহে, কিন্তু তাহা যে কারুণ্যময় এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। উপসংহারে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়াছে, তাহা অনুধাবন করিলেই উক্তির যথার্থ উপলব্ধ হইবে। যে স্নেহ-দৌর্বল্য সাজাহানকে দুঃখ-যন্ত্রণা আঘাতের মধ্যে ঠেলিয়া দিয়াছিল,
সেই স্নেহ-দৌর্বল্যেই, যে পুত্র তাহাকে নিষ্ঠুরতম আঘাত দিয়াছে, সেই কৃতঘ্ন পুত্রেরই শীর্ণদেহ, কোটরগত চক্ষু, শুষ্ক পান্ডুর মুখ দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিল। কিন্তু পিতা সাজাহানের একাংশ (ঔরংজীবের পিতা) মার্জনার জন্য অধীর আগ্রহে অগ্রসর হইতেই অন্যান্য অংশ (দারার পিতা, মােরাদের পিতা ও সুজার পিতা) মার্জনার পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হইয়া দেখা দিল। সাজাহানের মধ্যে আত্মবিচ্ছেদ (self split) তথা দ্বন্দ্ব তীব্রতম রূপ গ্রহণ করিল—মার্জনা এই দ্বন্দ্বের কারুণ্যে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। আর মার্জনা! ঔরংজীব-ঔরংজীব! না, সে সব মনে করব না! ঔরংজীব তােমার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম ; বলিয়া সাজাহান চক্ষু ঢাকিলেন।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাজাহান নাটক
নিষ্ঠুর অত্যাচারী যতই হােক না কেন, এখন ঔরংজীবই তাে সাজাহানের অবলম্বন তাদের তাে ফিরে পাবাে না। সাত বৎসর দুঃখে কেটেছে। এতদিন বড় জ্বালায় জ্বলেছি….একদিন সুখী হতে দে। ঔরংজীবকে ক্ষমা করার পশ্চাতে সাজাহান-হৃদয়ের যে আলােড়ন, সেই উত্তাল বিক্ষুব্ধ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ক্ষমার প্রসন্ন আলােকে শুধু ঔরংজীবই অভিষিক্ত হলেন , সমস্ত অতীতের বিক্ষোভ ভুলে সাজাহানও নিজের চিত্তকে সুস্থির করলেন। পিতৃসত্তার যে দ্বন্দ্বে নাটকের শুরু, পরিণতিতে সেই দ্বন্দ্বেরও সমাপ্তি ঘটল।