ভারতের ইতিহাসে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব নির্ণয় কর
প্রশ্ন ।। ভারতের ইতিহাসে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব নির্ণয় কর ?
ভারতের ইতিহাসে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব
অথবা, হর্ষবর্ধনকে “উত্তর-ভারতের শেষ শক্তিশালী হিন্দু সম্রাট” বলা কতদুর যুক্তিযুক্ত?
অথবা,
হর্ষবর্ধনের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব পর্যালােচনা কর।
উত্তর। গুপ্তসাম্রাজ্যর পতনের পর (৫৫০ খ্রীঃ) উত্তর-ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হইয়া একাধিক আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব হইয়াছিল । এই সকল রাজ্যগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষের ফলে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে এক ঘােরতর বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছিল। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে রাজনীতি পুনরায় স্থিতিশীল হইয়া উঠে ।
হর্ষবর্ধনের সিংহাসনে আরােহণ
৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ের অধিপতি শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হইলে রাজসভা সর্বসম্মতিক্রমে রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধনকে থানেশ্বরের সিংহাসনে স্থাপন করেন । ইহার কিছু পূর্বে তাহার ভগিনীপতি গ্রহবর্মণ মালবরাজ দেবগুপ্তের হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। সুতরাং কনৌজের সিংহাসনও শূন্য পড়িয়াছিল। এখন কনৌজের অমাত্যগণের অনুরােধে তিনি ঐ রাজ্যেরও শাসনভার গ্রহণ করিলেন। এই দুইটি রাজ্য সম্মিলিত হইয়া গাঙ্গেয়-উপত্যকায় একটি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব হইল । হর্ষবর্ধন কনৌজে তাহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিলেন ।
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ঐতিহাসিক উপাদান :
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ইতিহাস রচনা করিবার মত উপাদানের অভাব নাই । ঐ যুগের প্রচুর শিলালিপি, অনুশাসন ও মুদ্রা বর্তমান ঐতিহাসিকদের হস্তগত হইয়াছে। বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত এবং হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য ও সমসাময়িক সাহিত্য অনেক তথ্যাদি সন্নিবিষ্ট আছে। হুই-লি (Hwui-li) রচিত হিউয়েন-সাঙ-এর জীবনীতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য পাওয়া গিয়াছে। হর্ষবর্ধন যুদ্ধ ও শান্তি দুই ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন । তাহার কার্যকলাপকে চারিটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়—(ক) রাজ্যবিস্তার, (খ) শাসনব্যবস্থা, (গ) উদার-ধর্মনীতি, (ঘ) সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা ।
হর্ষবর্ধনের সমর অভিযান ও রাজ্যবিস্তার
(ক) সমর অভিযান ও রাজ্যবিস্তার : বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ হইতে আমরা জানিতে পারি যে, হর্ষবর্ধন সিংহাসনে উপবিষ্ট হইয়াই রাজ্যবিস্তারের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন এবং এক বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়িয়া তুলিলেন। (১) প্রথমে তিনি তাহার ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করিয়া তাহার ভ্রাতৃহন্তা গৌড়াধিপতি শশাঙ্ককে সমুচিত শাস্তি দিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণের সহিতও মৈত্রী স্থাপন করিলেন। এই অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। একথা সত্য যে, ৬১৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত শশাঙ্ক বাংলা, দক্ষিণ-বিহার ও উড়িষ্যায় রাজত্ব করিয়াছিলেন ; তাহার প্রমাণও আছে। তবে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর মগধ, গঞ্জাম প্রভৃতি স্থান হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ।
(2) হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ হইতে জানা যায় যে, হর্ষবর্ধন একটানা ছয় বৎসর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। শশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযানের পর তিনি সৌরাষ্ট্রের বলভী রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হইয়া রাজা ধ্রুবসেনকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু সম্ভবত ধ্রুবসেন তাহার রাজ্য কিছুদিনের মধ্যেই পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন এবং পরে হর্ষবর্ধন নিজেই তাহার সহিত নিজকন্যার বিবাহ দিয়াছিলেন ।
(৩) দক্ষিণ-ভারতের চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণ, দ্বিতীয় পুলকেশী কেট পরাজয় কর্তৃক উৎকীর্ণ ‘আইহােল’ শিলালিপিতে এই সংঘর্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু হর্ষবর্ধন দ্বিতীয় পুলকেশীর নিকট শােচনীয় ভাবে জিত হইলেন এবং এই পরাজয়ের ফলে দক্ষিণ-ভারত বিজয়ের সংকল্প ত্যাগ করিতে হইল । সব নদ নদীর উপকূলে এই যুদ্ধ হইয়াছিল । হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করিয়া দ্বিতীয় পুলকেশী পরমেশ্বরল উপাধি ধারণ করেন।
(৪) ‘হর্ষচরিতে’ উল্লেখ আছে যে, তিনি সিন্ধুদেশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াছিলেন ; তবে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, এই সাফল্য সম্ভবত সাময়িক কালের জন্য ছিল ।
(৫) সমসাময়িক গ্রন্থাদিতে উল্লেখ আছে যে, হর্ষবর্ধন ‘তুষারশৈল’ দেশ এবং কাশ্মীর আক্রমণ করিয়াছিলেন । কিন্তু এই দুইটি অভিযান সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্যাদি পাওয়া যায় নাই ।
হর্ষবর্ধনের রাজ্যসীমা
হর্ষবর্ধনের রাজ্যসীমার বিস্তৃতি সম্বন্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের মতভেদ আছে। অনেক স্থানে তাহাকে ‘উত্তর পথের সর্বাধিনায়ক’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে । কে. এম. পানিক্করের মতে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য বিন্ধ্য পর্বতের উত্তর দিকস্থ সমস্ত দেশ জুড়িয়া অবস্থিত ছিল ; এমন কি কাশ্মীর ও নেপাল তাহার রাজ্যভুক্ত ছিল বলিয়া তিনি মনে করেন ।
অপর একজন ঐতিহাসিক ডঃ রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায় মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর-ভারত জুড়িয়া তাহার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন এবং তাহার মৃত্যুর ফলে উত্তর-ভারতের জনৈক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের পরিসমাপ্তি ঘটে, কিন্তু এই মত ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার নুৰ ঐতিহাসিকদের পক্ষে প্রহণযােগ্য নয়। ডক্টর মজুমদারের মতে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য পূর্ব পঞ্চব, প্রদেশ, নগদ, উড়িষ্যা ও কঙ্গোদ—এই কয়েকটি দেশ লইয়া গঠিত ছিল মাত্র।
ডঃ মজুমদার মনে করেন, হর্ষবর্ধনকে উত্তর ভারতের শেষ পরাক্রমশালী সম্রাট বলা যায় না। তাহার মৃত্যুর পর প্রতিহার পাত উত্তর ভারতের ঐক্য অব্যাহত রাখেন।
হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থা
: (খ) শাসনব্যবস্থা : অধিকাংশ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিলেও হর্ষবর্ধন শাসনব্যাপারে কোন সময় অবহেলা প্রদর্শন করেন নাই ; তিনি নিঃসন্দেহে একজন সুশাসক ছিলেন। তিনি সমুদ্রগুপ্তের ন্যায় দিগ্বিজয়ী এবং অশােকের মত প্রজারঞ্জনকারী ছিলেন। (১) শাসন ব্যাপারে তিনি রাজার প্রাধান্য ও ব্যক্তিগত পরিদর্শনের উপর গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণে শাসনব্যাপারে তাহার অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা লিখিত আছে ।
হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গুপ্ত শাসনব্যবস্থার কাঠামােগত বিশেষ পার্থক্য না থাকিলেও হর্ষবর্ধনের সময়ে শাসনব্যবস্থায় মৌলিক চরিত্রগত পরিবর্তন দেখা যায়। এই যুগের শাসনব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক ও বিকেন্দ্রীভূত হইয়া উঠিয়াছিল। রাজকর্মচারী ও পুরােহিত সম্প্রদায়কে বেশী মাত্রায় ভূমিদান করার ফলে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি পাইয়াছিল । হর্যের সময় নিয়মিত সৈন্যবাহিনী না থাকায় তাহাকে সামন্ত রাজাদের সামরিক সাহায্যের উপর নির্ভর করিতে হইত।
(2) হর্ষবর্ধনের শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক—এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং ; তিনি একটি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করিতেন।
(৩) প্রদেশ মন্ত্রিপরিষদ বা ‘ভুক্তির শাসনভার রাজার মনােনীত রাজপুরুষগণ বা সামন্তগণের উপর ন্যস্ত থাকিত। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণ বেতনের পরিবর্তে ভূ-সম্পত্তি ভােগ করিতেন। তবে সামরিক কর্মচারীগণ বেতন পাইত ।
(৪) প্রদেশগুলি জেলা বা জায়গিৱ-ভােগী কর্মচারী বিষয়ে বিভক্ত ছিল। সর্বনিম্নে ছিল গ্রাম। কেন্দ্রে ও প্রদেশে সরকারী সরকারী কার্যাবলী লিপিবদ্ধ কার্যাদির বিবরণ লিখিয়া রাখা হইত। হিউয়েন-সাঙ দেশের শাসনব্যবস্থার দক্ষতা ও উদারতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়াছিলেন।
(৫) হর্ষবর্ধনের সময়ের দণ্ডবিধি গুপ্তযুগের দণ্ডবিধি অপেক্ষা বেশী কঠোর ছিল। কারাদণ্ড, বিভিন্ন অনুচ্ছেদন ঐ সময়ের প্রচলিত দণ্ডরীতি ছিল । অবশ্য দেশে দস্যু-তস্করের উপদ্রবও বৃদ্ধি পাইয়াছিল। (৬) জমির ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ব হিসাবে নির্ধারিত হইত ; ইহাই ছিল রাজকোষের প্রধান আয়। সরকারী বাজস্ব, শ্রমদান বাধ্যতামূলক কাজে শ্ৰমদান সময় সময় বাধ্যতামূলক করা হইত, তবে শ্রমিকগণের ইহার জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হইত ।
(৭) বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়কে রাজকোষ হইতে অর্থসাহায্য দেওয়া হইত । দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিশ্রামাগার নির্মাণ এবং শিক্ষাবিস্তারে শাসকগণ সর্বদাই উন্মুক্ত থাকিত। সেইজন্যই তাহার শাসনব্যবস্থাকে বলা হইয়া থাকে উদার ।
হর্ষবর্ধনের ধর্ম ও দানশীলতা
(গ) হর্ষবর্ধনের ধর্ম ও দানশীলতা : হর্ষবর্ধন প্রথম জীবনে খুব সম্ভবত শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন; কিন্তু রাজত্বের শেষের দিকে তিনি মহাযান বৌদ্ধমতের অনুরাগী হইয়াছিলেন। অন্যান্য ধর্মের প্রতি তিনি কেবলমাত্র সহিষ্ণুই ছিলেন না, শ্রদ্ধাশীলও সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, ছিলেন। হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ-ধর্মজ্ঞানীদের সভা আহান কবিয়া তাহাদের বিতর্ক শুনিতেন এবং তাহাদের পুরস্কৃত করিতেন । অশােকের ন্যায় তিনিও রাজ্যের মধ্যে অসংখ্য বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। জীব হত্যাও নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি কনৌজে এক বিশেষ ধর্মসভার অধিবেশন আহ্বান করিয়াছিলেন ।
হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জৈন ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঐ সভায় যােগদান
করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি গঙ্গার তীরে এক বিশাল মন্দিরযুক্ত মঠ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর হর্ষবর্ধন প্রয়াগের মেলা আহ্বান করিতেন। সেইস্থানে বুদ্ধ, সূর্য ও শিবের উপাসনার পর তিনি বুদ্ধ, সূর্য ও শিবের উপাসনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত ও জৈন-শ্ৰমণদিগকে মুক্তহস্তে দান হতে চান করিতেন। সাধুসন্ন্যাসী ও গরীবদুঃখীদিগকে তিনি পঁাচ বৎসরের সঞ্চিত সমস্ত ধন-সম্পত্তি দান করিয়া দিতেন।
সম্রাট অশােকের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া তিনি রাজ্যমধ্যে বহু সরাইখানা, বিশ্রামাগার, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি অসংখ্য দাতব্য-প্রতিষ্ঠানকে সরকারী সাহায্য দিতেন। হিউয়েন-সাঙ বলিয়াছেন যে, হর্ষবর্ধন বিভিন্ন ধর্মকার্যে এবং দান-ধ্যানে দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করিতেন।
হর্ষবর্ধনের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা
(ঘ) সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা : হর্ষবর্ধন কেবলমাত্র যােদ্ধা বা সুশাসকই ছিলেন না, তিনি শিক্ষা ও সাহিত্যের পরম অনুরাগী ছিলেন। হিউয়েন-সাঙ বলিয়াছেন যে, তিনি রাজকীয় ভূ-সম্পত্তি ও রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ সাহিত্যসেবীদের জন্যই ব্যয় করিতেন। তাহারই সময়ে তাহারই পৃষ্ঠপােষকতায় নালন্দা হনুরাগী, রাজসভায় দ্বনভনের সমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার একটি শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল। হর্ষচরিত’ ও ‘কাদম্বরী’ প্রণেতা বাণভট্ট তাহার সভাসদ ছিলেন। তাহা ছাড়া ময়ূর, কবি ভর্তিহরি, দিবাকর, হরিদত্ত, জয়সেন প্রমুখ বিদ্বান ব্যক্তিগণ তাহার সভা অলঙ্কৃত করিতেন।
হর্ষবর্ধন নিজেই ছিলেন একজন প্রতিভাশালী নাট্যকার ও কবি । নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ নামে তিনখানি সংস্কৃত নাটক হর্ষবর্ধন স্বয়ং রচনা
করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া কথিত আছে যে, তিনি আরও অসংখ্য কবিতা রচনা করিয়াছিলেন ।
হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব
হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব : হর্ষবর্ধন একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা-সম্পন্ন সম্রাট ছিলেন । (ক) ক্ষুদ্র থানেশ্বররাজ্যকে তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়াছিলেন। গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর-ভারতে যে রাজনৈতিক অনৈক্য, অনিশ্চয়তা ও উত্তর ভরতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইয়াছিল, হর্ষবর্ধন সাময়িকভাবে হইলেও তাহার অবসান ঘটাইয়া অনেকাংশে রাজনৈতিক অখণ্ডতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী তাহার সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াও তঁাহাকে উত্তরপথনাথ’ বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় পুলকেশী ও গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক ছাড়া সীমান্তবর্তী অন্যান্য রাজগণ তাহার প্রাধান্য স্বীকার করিতেন। হিউয়েন-সাঙ-এর বিবরণ হইতে জানা যায় যে, কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মণ এবং বলভীরাজ ধ্রুবসেনসহ কুড়িজন অনুগত রাজা কনৌজের ধর্মসভায় উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং উত্তর-ভারতে তাহার রাজনৈতিক প্রাধান্য একপ্রকার সার্বভৌমত্বে পরিণত হইয়াছিল।
(খ) বহির্দেশেও হর্ষবর্ধন স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন । তিনি ৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে চীনদেশে এক দূত প্রেরণ করেন। প্রত্যুত্তরে চীনসম্রাটও হর্ষবর্ধনের সভায় এক দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। পারস্য-সম্রাটের সহিতও সম্ভবত তাহার দূতবিনিময় হইয়াছিল ।
(গ) হর্ষবর্ধনের সামরিক দক্ষতার সহিত শাসনদক্ষতাও ছিল উল্লেখযােগ্য। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া শাসনব্যবস্থার দক্ষতা বজায় রাখিতে সদা সচেষ্ট থাকিতেন।
(ঘ) র্তাহার শাসনে প্রজার মঙ্গলসাধনই অগ্রাধিগণ্য ছিল। অশােকের ন্যায় তিনি বহুবিধ জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থাদি অবলম্বন করিয়াছিলেন।
(ঙ) অক্লান্ত পরিশ্রম ; হর্ষবর্ধন নিজে একজন উচ্চস্তরের কবি ও নাট্যকার ছিলেন। তাহার রাজসভায় গুণীর সমাদর ছিল । তাহার পৃষ্ঠপােষকতায় সমসাময়িক সাহিত্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সর্বদা তাঁহার সহানুভূতি লাভ করিত ।
(চ) সকল ধর্মের প্রতি হর্ষবর্ধন সমভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্মেই সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি বিশ্বাসী ছিলেন না ; সূর্য, শিব প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেব-দেবীরও উপাসনা তিনি করিতেন। ধর্মসভা আহ্বান করিয়া তিনি বিভিন্ন ধর্মমতের আলােচনায় উৎসাহ দিতেন। পরধর্মসহিষ্ণুতার ভারতীয় ঐতিহ্যকে তিনি আরও উচ্চে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন।
উপসংহার
সুতরাং হর্ষবর্ধন যে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। তবে তাহার কৃতিত্ব সম্বন্ধে কিছুকাল পূর্বে যে অতি উচ্চ ধারণা ছিল, আধুনিক ঐতিহাসিকগণের গবেষণার ফলে তাহা অহেতুক বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। একথা সত্য যে, তঁাহার শাসনব্যবস্থায় দেশ নিরুপদ্রব ও শান্তিপূর্ণ ছিল না এবং তাহার সৃষ্ট সাম্রাজ্যও তঁাহার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই । কিন্তু তবুও তঁাহার কৃতিত্ব এত বেশী যে ভারত-ইতিহাসে তাহার গৌরব ম্লান হইবার নয়। যুদ্ধ, ধর্ম, সংস্কৃতি, শাসনব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্নধর্মী কার্যকলাপের মধ্যে হর্ষবর্ধন যে কীর্তির স্বাক্ষর রাখিয়াছিলেন তাহার মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ও অশােকের নীতি ও তাহার অক্ষয় কৃতিত্ব কার্যকলাপের এক অভূতপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় । মধ্যযুগের ভারতের মহান্ সম্রাট আকবরের সঙ্গেও তঁাহার কার্যকলাপের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। তিনি আকবরের ন্যায় ছিলেন একাধারে সাম্রাজ্যবাদী ও উদারধর্মনীতির অনুসরণকারী ।
হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের গুরুত্ব