ভারতে মানবাধিকার বিস্তারিত আলোচনা Teacj Sanjib

 ভারতে মানবাধিকার বিস্তারিত আলোচনা Teacj Sanjib

ভারতে-মানবাধিকার-বিস্তারিত-আলোচনা-Teacj-Sanjib

 

মানবাধিকারের অর্থ 

 

মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজের মধ্যে থেকে সে তার আত্মবিকাশের উপযােগী নানা ধরনের সুযােগ সুবিধা দাবি করে। এইসব সুযােগ-সুবিধাকে অধিকার  বলা হয়। কিন্তু অধিকার যেহেতু সমাজ-নিরপেক্ষ নয়, সেহেতু  সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অধিকারের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। তাই গ্রীন  প্রমুখ নৈতিক অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরােপ করলেও হবস,বেন্থাম, অস্টিন  প্রমুখ আইনগত অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তাঁরা নৈতিক অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে আদৌ স্বীকৃতি দেননি। আবার, ল্যাস্কি অধিকার বলতে সমাজ-জীবনের সেইসব অবস্থাকে বােঝাতে চেয়েছেন, যেগুলি ছাড়া ব্যক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ সম্ভব হয় না। গিলক্রিস্ট এর মতে, সমাজসচেতনতা থেকে অধিকারবােধের উৎপত্তি। 

 বােসাংকে  সামাজিক ও আইনগত অধিকারের সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তাঁর মতে, “অধিকার হােল সমাজ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।” সুতরাং অধিকার কেবল ব্যক্তিগত হতে পারে না, তা সমষ্টিগতও বটে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কল্যাণের সহায়ক না হলে কোন দাবি আইনের চোখে অধিকার বলে বিবেচিত হয় না। বার্কার (Barker) বলেছেন, “অধিকার হােল সব মানুষের সম্ভাব্য সর্বাধিক পরিমাণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযােগী সেইসব প্রয়ােজনীয় শর্ত  যেগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও রক্ষিত হয়। সুতরাং, মানবাধিকার বলতে কোন্ অধিকারগুলিকে বােঝায়, তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরােধ রয়েছে। বহুকাল পূর্ব থেকে মানবাধিকারকে কেন্দ্র করে যে-বিতর্ক চলে আসছে, তার পরিসমাপ্তি এখনও ঘটেনি। 

 তাই বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে স্থাপিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন’ -এর উদ্যোগে যখন মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিশ্ব-ঘােষণাপত্র’ রচনার জন্য আলাপআলােচনা চলছিল, তখন মানবাধিকার’ ও ‘মৌলিক স্বাধীনতার সংজ্ঞা নির্ধারণ ও প্রকারভেদ নিয়ে পূর্বতন সােভিয়েত ইউনিয়ন-সহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগামী ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির তীব্র মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক অধিকারগুলিকে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের চাবিকাঠি বলে চিহ্নিত করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক অধিকার অপেক্ষা পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর অধিক গুরুত্ব আরােপের পক্ষপাতী ছিল। পরস্পর-বিরােধী এই দু’ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে শেষ পর্যন্ত কমিশন মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশ্বঘােষণাপত্রের একটি খসড়া প্রণয়ন করে। ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনে ৪৮-০ ভােটে ঐ খসড়াটি গৃহীত হয়। 

 পূর্বতন সােভিয়েত ইউনিয়নসহ ৬টি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সৌদি আরব ও দক্ষিণ আফ্রিকা ভােটদানে বিরত থাকে। ঐ ঘােষণাপত্রের ৩০টি ধারায় লিপিবদ্ধ মানবাধিকারগুলিকে কার্যকর করার উদ্দেশে ১৯৫১ সালের শেষদিকে সাধারণ সভা দু’টি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’  প্রণয়ন করার জন্য কমিশনকে অনুরােধ জানায়। এর একটিতে পৌর ও রাজনৈতিক অধিকারগুলি এবং অপরটিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলি থাকবে। শেষ পর্যন্ত কমিশন ১৯৫৪ সালে এই দু’টি ‘অঙ্গীকারপত্র’ বিচার বিবেচনার জন্যে সাধারণ সভার নিকট পেশ করে। এই দু’টি অঙ্গীকারপত্র হােল –

  [i] পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র  এবং [ii] অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র । এই দু’টি অঙ্গীকারপত্র ১৯৬৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সাধারণ সভা কর্তৃক গৃহীত হয়।

 

মানবাধিকার কাকে বলে

 

মানবাধিকার বলতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ প্রভৃতি নির্বিশেষে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযােগী পৌর, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহকে বােঝায়। এইসব অধিকারের মধ্যে জীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার,

 

ন্যায়বিচারের অধিকার, যথেচ্ছ গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি লাভের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে  সাম্যের অধিকার, দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার,  বিশ্বাস ও মতপ্রকাশের অধিকার, সংগঠন গড়ে তােলার অধিকার, ভােটাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, কর্মের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, ভােটদান ও সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার, সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার, বৈজ্ঞানিক উন্নতিতে অংশীদার হওয়ার অধিকার প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযােগ্য।

  মানবাধিকারের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ১৯৯৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রণীত মানবাধিকার রক্ষা আইন’ (The Protection of Human Rights Act-এ বলা হয়েছে, “মানবাধিকার’ বলতে সংবিধান কর্তৃক প্রত্যাভূত  কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্রের অঙ্গীভূত  এবং ভারতের আদালত কর্তৃক বলবৎকরণযােগ্য  ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সমতা ও মর্যাদা-সংক্রান্ত অধিকারসমূহকে বােঝায়।”* এখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’ বলতে ১৯৬৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা কর্তৃক গৃহীত ‘পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’-কে বােঝানাে হয়েছে।

 

ভারতে মানবাধিকার (Human Rights in India)

 

প্রাক-স্বাধীন ভারতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি:

 

 ভারতে মানবাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ আমলে। প্রবহমান জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারাটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধারা।

১৯১৮ সালে বােম্বাইকংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে যে-অধিকারের ঘােষণাপত্র (Declaration of Rights) গৃহীত হয়েছিল, তাতে বাক্স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, আইনানুগ বিচার পাওয়ার স্বাধীনতা, জাতিগত বৈষম্য থেকে মুক্তি প্রভৃতিকে মৌলিক নাগরিকঅধিকারের দাবি হিসেবে তুলে ধরা হয়। মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী ভারতের নতুন সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে যখন আলাপ-আলােচনা চলছিল, তখন সেই সংবিধানের মধ্যে ঐসব অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা সেই দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল। 

 এরপর ১৯২৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে নিখিল ভারত নিপীড়িত রাজনৈতিক কর্মী দিবস’পালন করা হয়। হিজলী কারাগারের বন্দীদের ওপর পুলিশের গুলি চালনার প্রতিবাদে ১৯৩১ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতার মনুমেন্টের নীচে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক জনসভায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদী ভাষণ দিয়েছিলেন। ঐ জনসভার মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি ও নাগরিক-স্বাধীনতার দাবিতে একটি নাগরিক কমিটি’গঠিত হয়। তবে এই কমিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ সক্রিয়তা প্রদর্শন করতে পারেনি এবং স্বল্পকালের মধ্যেই তার বিলুপ্তি ঘটেছিল। এরপর ১৯৩৬ সালের ১লা জুলাই নরেন্দ্রনাথ বসুর সভাপতিত্বে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে অবিভক্ত বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বন্দীমুক্তি কমিটি। এর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন মৃণালকান্তি বসু। ঐ বছরের ২৪শে আগস্ট বােম্বাইতে জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল সারা ভারত পৌর স্বাধীনতা সঙ্ঘ’ । 

 এই সংগঠনের সভাপতি ও কার্যকরী সভাপতি ছিলেন যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সরােজিনী নাইডু। সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন কে. বি. মেনন। ২১-জন সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী সমিতির মধ্যে যারা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন জওহরলাল নেহরু, মৌলনা আবুল কালাম আজাদ, শরৎচন্দ্র বসু, জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জাকির হােসেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অমৃত কাউর, ভুলাভাই দেশাই প্রমুখ। পুলিশি অত্যাচার, রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নিপীড়ন, রাজনৈতিক ও গণসংগঠনগুলির ওপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা, বিনাবিচারে আটক প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করা ও জনমত গড়ে তােলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সঙ্ঘ ঐকান্তিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত এই সংগঠনটির অস্তিত্ব ছিল।

 

ভারতের সংবিধানে মানবাধিকারের স্বীকৃতি:

 

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সংবিধানের স্রষ্টারা সংবিধানের মধ্যে মানবাধিকার লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় এবং প্রস্তাবনার মধ্যে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার লিপিবদ্ধ করে তারা বিশ্বের কাছে ভারতের  গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা এবং মর্যাদা ও সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। সংবিধানের তৃতীয় অংশ (Part-ll)-এ নাগরিকদের সাম্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। 

 এইসব অধিকার আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য। তাছাড়া, চতুর্থ অংশ (Part-IV)-এ কতকগুলি অর্থনৈতিক, সামাজিক, আইন ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার-বিষয়ক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদর্শ সংক্রান্ত নীতিসমূহ ঘােষিত হয়। এগুলি আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য নয়। এছাড়া, ৩২৬ নং ধারায় সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার স্বীকৃতিলাভ করেছে। সর্বোপরি, সংখ্যালঘু এবং তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য কতকগুলি বিশেষাধিকার প্রদান করা হয়েছে। সংরক্ষণমূলক বৈষম্য’ (Protective Discrimination) নামে পরিচিত ব্যবস্থার মাধ্যমে সংবিধানের ষােড়শ অংশের বিভিন্ন ধারায় এইসব বিশেষাধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে।

 

মানবাধিকার কমিশন গঠন:

 

সংখ্যালঘু, তফসিলী জাতি ও উপজাতি মহিলাদের মতাে সমাজের দুর্বল অংশের কল্যাণ বিধানের জন্য সংবিধানে লিপিবদ্ধ বিধিব্যবস্থাগুলি যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময় নানা ধরনের কমিশন নিয়ােগ করেছে। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হােল সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় কমিশন’  তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য জাতীয় কমিশন’  এবং মহিলাদের জন্য জাতীয় কমিশন’ । ১৯৬৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা কর্তৃক গৃহীত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’টিকে ভারত সরকার ১৯৭৯ সালের ১০ই এপ্রিল অনুমােদন করেন। এরপর, ১৯৯৩ সালে মানবাধিকার রক্ষা আইন’ (The Protection of Human Rights Act, 1993) প্রণীত হয়। এই আইন অনুসারে ঐ বছরেই গঠিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ । পশ্চিমবঙ্গেও ১৯৯৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি রাজ্য-সরকার একটি গেজেট নােটিফিকেশনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছেন। 

 

• মানবাধিকারের রূপায়ণ :

 

‘মানবাধিকারসংক্রান্ত বিশ্ব-ঘােষণাপত্রে’র ২৮ নং ধারায় একথা ঘােষণা করা হয়েছে যে, ঘােষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত অধিকার ও স্বাধীনতাগুলি মানুষ যাতে পরিপূর্ণভাবে ভােগ করতে পারে, সেজন্য একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা হবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৮ নং ধারাতেও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। এই ধারাতে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়ের ভিত্তিতে এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা  গড়ে তুলবে, যেখানে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির কল্যাণ সাধিত হবে। তাছাড়া, আয় এবং মর্যাদা ও সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাসের জন্য রাষ্ট্র প্রয়াস চালাবে। এইভাবে মানুষের আত্মবিকাশের উপযােগী পরিবেশ লাভের অধিকার ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃতি লাভ করার ফলে ভারতে মানবাধিকার এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

  কারণ, আত্মবিকাশের অধিকার হােল মানুষের এমন একটি অহস্তান্তরযােগ্য অধিকার, যেটি ছাড়া মানুষ তার কোন অধিকার ও স্বাধীনতাই পুরােপুরিভাবে ভােগ করতে পারে না। কিন্তু ভারতে তত্ত্বগতভাবে মানুষের আত্মবিকাশের উপযােগী সামাজিক পরিবেশ লাভের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করলেও চরম দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি ভারতবাসীর অধিকার ভােগের উপযােগী সামাজিক পরিবেশ লাভের স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভারতে ‘মিশ্র অর্থনীতির প্রবর্তনের ফলে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবারের হাতে দেশের সম্পদের বেশির ভাগ অংশই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। 

 আইনগতভাবে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী ব্যবস্থার বিলােপ সাধিত হলেও পূর্বতন জমিদাররা স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে রেখে দিতে সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া, ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমিদারদের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, সেই অর্থ দিয়ে প্রাক্তন জমিদাররা নতুন উপায়ে গ্রামীণ জনসাধারণকে শােষণ করছে। বস্তুতঃ, , ভারতের বুর্জোয়াজমিদার শাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অবস্থার কোন উন্নতি সাধিত হয়নি, বরং ক্রমশঃ তারা শােচনীয় অর্থনৈতিক সংকটের আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। আবার, ধর্ম ও জাতপাতকে হাতিয়ার করে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার কাজে আত্মনিয়ােগ করার ফলে মানবাধিকারের উপযােগী সামাজিক পরিবেশ লাভের আশা সুদূর পরাহত হয়েছে। 

 বস্তুতঃ, ভারতীয় সমাজ আজ ধর্মব্যবসায়ী ও জাতপাত শিকারীদের অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তার ফলে ধর্মীয় ও জাতপাতগত সংঘর্ষ ভারতীয় সমাজ-জীবনকে অস্থির করে তুলেছে। এমতাবস্থায় মানবাধিকার কার্যতঃ প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

 

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও মানবাধিকার

 

ভারতীয় সংবিধানে ১৯-২২ নং ধারায় নাগরিকদের স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃতিলাভ করেছে। এগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হােল জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রণীত নানা ধরনের নিবর্তনমূলক আটক আইনের অপপ্রয়ােগের  ফলে বহু নাগরিক এই মূল্যবান অধিকারটি থেকে বঞ্চিত হয়েছে।  জাতীয় এবং রাজ্য-মানবাধিকার কমিশনের কাছে এরূপ অধিকারভঙ্গের বহু অভিযোেগ সরকারের বিরুদ্ধে আনীত হয়েছে। বিশেষতঃ, বিচারাধীন বন্দীদের ওপর থানা বা জেল হাজতে অমানবিক অত্যাচারের ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। এমনকি, বিচারাধীন মহিলা বন্দীদের ধর্ষণ করার অভিযােগও উঠেছে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অনেক সময় বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ প্রতিরােধ করার উদ্দেশে যে-সশস্ত্রবাহিনী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়, তাদের বর্বরােচিত আচার-আচরণের কথা অনেক ক্ষেত্রে আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে। 

 একটি উদাহরণের সাহায্যে এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করা যায়। ১৯৮৭ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মণিপুরের সেনাপতি-জেলার গুইনাম গ্রামে কয়েকদিন ধরে আসাম রাইফেলস্ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযােগের মতাে বীভৎস তাণ্ডব চালায়। নাগা পিপলস মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস’ (NPMHR)-এর উদ্যোগে অরুণ পৌমাই-এর নেতৃত্বে একটি দল ঐ ঘটনা সরজমিন তদন্ত করে গৌহাটি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৯৫ সালে মহামান্য আদালত হত্যা ও ধর্ষণের অভিযােগে আসাম রাইফেলসের ৪ জন জওয়ানকে শাস্তিদান করেন। বস্তুতঃ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমনের নামে বহুক্ষেত্রে যে-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার ফলে ভারতীয় জনগণের মানবাধিকার বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষা কমিটি ও ফোরামগুলি অভিযােগ তুলেছে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সুপ্রীম কোর্ট সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে একথাও সত্য যে, ভারতের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপও মানবাধিকারের পরিপন্থী। অধ্যাপক মােহিত ভট্টাচার্য সন্ত্রাসবাদকে মানবাধিকারের নতুন সমস্যা’  হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীরা সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বহু মানুষকে হতাহত করছে। তাদের কার্যকলাপ নিশ্চিতভাবেই জীবনের অধিকার’ নামক মানবাধিকারটির পরিপন্থী।

 

হরিজনদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা:

 

ভারতীয় সংবিধানে তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির অধিকার রক্ষার জন্য যেসব বিধিব্যবস্থা লিপিবদ্ধ রয়েছে, বাস্তবে সেইসব অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কারণ, ভারতীয় সমাজজীবন থেকে এখনও পর্যন্ত অস্পৃশ্যতা নামক সামাজিক ব্যাধিটির পূর্ণ  নিরসন করা সম্ভব হয়নি। তাই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও হরিজন নিগ্রহ ও হরিজন হত্যার ঘটনা ঘটে। যে-হরিজনদের অস্পৃশ্য প্রতিকারের ব্যবস্থা বা অশুচি বলে চিহ্নিত করে তথাকথিত উচ্চ জাতের মানুষরা তাদের স্পর্শ বা ছায়া সযত্নে এড়িয়ে চলে, তাদের অনেকেই কিন্তু হরিজন রমণীদের ধর্ষণ করে। সেক্ষেত্রে তাদের শুচিতা বিনষ্ট হয় না। এইসব ঘটনা প্রতিরােধের উদ্দেশে ১৯৮৯ সালে তফসিলী জাতি ও উপজাতি (অত্যাচার নিবারণ) আইন প্রণীত হয় এবং ১৯৯০ সালে ৭ সদস্যবিশিষ্ট তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির জন্য জাতীয় কমিশন’  নিয়ােগ করা হয়। এই কমিশনের কাজ হােল তফসিলী জাতি ও উপজাতিগুলির অধিকার ও স্বাধীনতাভঙ্গের অভিযােগ তদন্ত করে দেবা এবং সে সম্পর্কে সরকারের কাছে সুপারিশ করা। কিন্তু এত সব করেও সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের অধিকার যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা অদ্যাবধি সম্ভব হয়নি। 

 

ভারতীয় সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও সংখ্যালঘু বলতে কী বােঝায়, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। সংবিধানের ৩০ নং ধারায় ধর্ম বা ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু

 

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাগত বিরােধ ও মানবাধিকার

 

সম্প্রদায়গুলির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতে এই দু’ধরনের সংখ্যালঘু ছাড়াও অন্যান্য ধরনের সংখ্যালঘু রয়েছে। তাই প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ববিদ ইমতিয়াজ আহমদ  মন্তব্য করেছেন  যে, ভারতে সংখ্যালঘু’ শব্দটিকে সংকীর্ণ অর্থে সংজ্ঞায়িত করা  হয়েছে। তবে একথা সত্য যে, ভারতীয় সংবিধানের স্রষ্টারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, ভারত-বিভাজনের পেছনে একটি মিথ্যা আশংকা কাজ করেছিল। তা হােল—সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা ভারত শাসিত হলে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারসমূহ লঙ্ঘিত হবে। মুসলমান, খ্রীস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ও পার্শীদের মতাে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের উদ্দেশে ১৯৯২ সালে সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় কমিশন আইন’ প্রণীত হয় এবং এই আইন অনুসারে একটি কমিশনও গঠিত হয়েছে।

  কিন্তু দুঃখের বিষয়—স্বাধীনতার পর ৭৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মন থেকে নিরাপত্তাহীনতার ভাব বিদূরিত হয়নি; বরং বিগত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সাম্প্রদায়িক হিন্দু ও মুসলমানদের রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতা ও ‘মিশ্র সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছে। তাই ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর হিন্দু মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা অযােধ্যার বিতর্কিত বাবরি মসজিদটির ধ্বংসসাধন করেছে। ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনগুলি হিন্দুত্ব’ ও হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগান তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কার্যতঃ জেহাদ ঘােষণা করেছে। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী ফিদা হুসেনের চিত্র-প্রদর্শনী পুড়িয়ে দেওয়া, ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গজল গায়ক গুলাম আলিকে মুম্বাইতে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া, দীপা মেহেতা-পরিচালিত ‘ফায়ার’ ছায়াছবি বন্ধ করে দেওয়া, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতা দিলীপকুমারের বাড়িতে তাণ্ডব চালানাে, কর্নাটকের চিকমাগালুরের কাছে সুফি বাবা বুদানগিরির দরগাকে মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করার নামে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতাে আর একটি ঘটনা ঘটানাের অপপ্রয়াস, গুজরাটে খ্রীস্টানদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালানাে এবং ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলকে মুম্বাইতে খেলতে না-দেওয়ার জন্য ফিরােজশা কোটলার পিচ খুঁড়ে দেওয়া, গুজরাটের ডাড় জেলায় গীর্জাতে অগ্নিসংযােগ করা, ওড়িশার কেওনঝড়ে দুই শিশুপুত্র-সহ অস্ট্রেলীয় খ্রীস্টান মিশনারী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা প্রভৃতির মাধ্যমে হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল ও সংগঠনগুলির ফ্যাসিবাদী মনােভাব বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের ফ্যাসিবাদী মনােভাবের আর একটি উদাহরণ হােল ২০০০ সালে বারাণসীতে দীপা মেহেতার ‘ওয়াটার’ ছায়াছবির চিত্রগ্রহণ বানচাল করে দেওয়া। 

 সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের এরূপ দায়িত্বহীন কার্যকলাপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হিংস্র হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ভারতে ইসলাম বিপন্ন’—এই শ্লোগান তুলে মুসলিম মৌলবাদীরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছে। যেসব মুসলিম দল ও সংগঠন এইসব কাজে লিপ্ত হয়েছে সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হােল মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলামি, মজলিশ-ই ইত্তেহাদুল মুসিলমিন, মুসলিমমজলিস-এ-মুসাওয়ারাত, তবলিক-ই-জামাত প্রভৃতি। এইভাবে উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সাম্প্রতিককালে বিনষ্ট হওয়ার ফলে মােরাদাবাদ, দিল্লী, মীরাট, ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংগঠিত হয়েছে। আবার, ভাষার

 

প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অশান্তির আগুন বিভিন্ন সময়ে জ্বলে উঠেছে। ভাষা-সম্পর্কিত সরকারী নীতি হিন্দী কিংবা অহিন্দী ভাষাভাষী মানুষদের কোন পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে ইংরেজীবিরােধী আন্দোলন শুরু হয়। আবার, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, কেরালা প্রভৃতি রাজ্যে হিন্দী বিরােধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। সাম্প্রতিককালে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনেরও দাবি উঠেছে। এইভাবে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ওপর হিন্দী জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে—এই আশংকা থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে অশান্তির সূত্রপাত ঘটে। বলা বাহুল্য, এর ফলে একদিকে যেমন ভারতের ঐক্য ও সংহতি বর্তমানে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে তেমনি ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা ভাষাকেন্দ্রিক সংঘর্ষ বহু মানুষের জীবন ও সম্পত্তির অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

অক্ষম ব্যক্তিদের মানবাধিকার:

 

  বর্তমান ভারতে প্রায় ৬ কোটি অক্ষম ব্যক্তি (disabled persons) রয়েছে। অক্ষম ব্যক্তি বলতে অন্ধ, বধির, বােবা, মানসিক প্রতিবন্ধী ও মানসিক রােগীদের বােঝায়। ভারতীয় সমাজে এইসব মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। সংবিধানে সকলের জন্য অক্ষম ব্যক্তিদের সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও এইসব অসহায় মানবাধিকার মানুষ বড়জোর করুণা ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারে না। তবে আশার কথা, বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠনের চাপে পার্লামেন্ট ১৯৯৫ সালে একটি আইন  প্রণয়ন করেছে। ১৯৯৬ সালের ৭ই ফ্রেব্রুয়ারি থেকে এই আইনটি কার্যকর করার কথা কেন্দ্রীয় সরকার ঘােষণা করলেও বাস্তবে আইনটি কার্যকর করার ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগের বিশেষ অভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এইসব অক্ষম ব্যক্তির জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও অন্য কোথাও তা করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অনুরূপভাবে, ১৯৯৩ সালে প্রণীত মানসিক স্বাস্থ্য আইন’ (The Mental Health Act) প্রণীত হয় এবং ঐ বছরের ১লা এপ্রিল থেকে সেটিকে কার্যকর করার কথা সরকার ঘােষণা করেন। কিন্তু বর্তমান ভারতে প্রায় ৩৭টি মানসিক হাসপাতাল থাকলেও বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সুপ্রীম কোর্টের রায়ে সেগুলির নিকৃষ্ট পরিচালন ব্যবস্থার সমালােচনা করা হয়।

 

নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা:

 

মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিশ্ব-ঘােষণাপত্র এবং সাধারণ সভা কর্তৃক গৃহীত ‘পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্র’ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্রে নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার  ব্যাপারে নানাপ্রকার বিধিব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এমনকি,  ভারতের সংবিধান এবং ভারত সরকার কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন আইনে নারী ও শিশুদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারতে নানাভাবে তাদের সেই অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং হচ্ছে।

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন (West Bengal Human Rights Commission)

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন গঠন

 

২০০০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত ভারতের চারটি রাজ্যে রাজ্য-মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। এই রাজ্যগুলি হােল পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও অসম।জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার ঐ রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হবে বলে ঘােষণা গঠন করেছে। ১৯৯৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি রাজ্য সরকারের গেজেট নােটিফিকেসন অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়। ঐ বছরের এপ্রিল মাসে রাজ্য কমিশনের সভাপতি ও কয়েকজন সদস্য কার্যভার গ্রহণ করেন।

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন যাঁদের নিয়ে গঠিত হয়, তারা হলেন : [i] একজন সভাপতি, যিনি কোন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন ;

 

[i] একজন সদস্য, যিনি কোন হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন অথবা আছেন ; [i] একজন সদস্য, যিনি পশ্চিমবঙ্গের যে-কোন জেলা বিচারকের আদালতে জেলা বিচারক (District Judge) ছিলেন অথবা আছেন ।

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের প্রথম সভাপতি হলেন চিত্ততােষ মুখার্জি এবং সদস্যরা হলেন সামসুদ্দিন আমেদ, রমাপ্রসাদ সমাজদার, রথীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও উমা আমেদ।

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলী:

 

পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর অনুরূপ। কেবল এই কমিশন রাজ্যের মধ্যে মানবাধিকারভঙ্গের ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছে তার  সুপারিশ পাঠায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অনুসন্ধান-সংক্রান্ত যেসব ক্ষমতা ভােগ করে, রাজ্য কমিশনও অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য রাজ্য কমিশনের নিজস্ব তদন্তকারী দল রয়েছে। 

 প্রয়ােজনে কমিশন কোন তদন্ত পরিচালনার সময় কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্য সরকারের কোন আধিকারিক অথবা তদন্তকারী সংস্থার সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। ভুক্তভােগী স্বয়ং কিংবা তার পক্ষে কোন ব্যক্তি ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে লিখিত দরখাস্ত কমিশনের কাছে দাখিল করতে সক্ষম। অভিযােগ দাখিল করার জন্য কোন স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি বা খরচ লাগে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যে-তারিখে ঘটেছে, সেই দিন থেকে এক বছরের মধ্যে অভিযােগ দাখিল করতে হয়। এই সময়সীমার পর অভিযােগ দাখিল করা যায় না। কমিশন প্রতি বছর রিপাের্ট তৈরি করে এবং বিভিন্ন প্রমাণিত মানবাধিকার-ভঙ্গের জন্য সম্ভাব্য ব্যবস্থা সম্পর্কেও সুপারিশ করে। আশার কথা কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশই রাজ্য সরকার মেনে নেয়। তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে মানবাধিকার কমিশন যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *