ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার বিস্তারিত আলোচনা ও প্ৰশ্ন উত্তর
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার বিস্তারিত আলোচনা ও প্ৰশ্ন উত্তর
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস
ইংরেজ কোম্পানির দেওয়ানি লাভ (১৭৬৫ খ্রিঃ) :
মােঘল সম্রাটের সঙ্গে চুক্তি ;১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ই আগষ্ট এলাহাবাদের দ্বিতীয় চুক্তির দ্বারা বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ সম্রাটকে দেওয়ার বিনিময়ে ইংরেজ কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার দেওয়ানি অধিকার লাভ করে। বাংলার নবাবের সঙ্গে অপর এক চুক্তির দ্বারা বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকা নবাবের শাসন পরিচালনার জন্য দেওয়া হবে স্থির হয়।
দ্বৈত শাসন : সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার পর ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ ও সিতাব রায় যথাক্রমে বাংলা ও বিহারে রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক কাজ করতে লাগলো। নবাব নামেই নবাব হয়ে রইলেন, কার্যত ইংরাজ কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হলেন। নবাবের হাতে রইল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানির হাতে রইল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। লর্ড ক্লাইভ প্রবর্তিত এই ব্যবস্থাকে দ্বৈত শাসন বলা হয়।
দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি ১৭৬৫-৬৬ সালে এক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ অর্থ রাজস্ব | হিসাবে আদায় করে। ইজারাদারেরা কৃষকদের কাছ থেকে কোম্পানির নামে চড়া হারে কর আদায় করত। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা লবণ, তামাক, সুপারী ও অন্যান্য পণ্যের উপর বিনা শুলে একচেটিয়া বাণিজ্য শুরু করে। কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য ইংল্যন্ডে থেকে অর্থ পাঠান বন্ধ হয়। ফলে রাজস্বের অর্থে কোম্পানি ব্যবসা করতে লাগলাে।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঃ ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। রেখে যান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সুবা বাংলার নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ, সীতাব রায় ও কোম্পানির অনুগত দুর্লভ রায়, জগৎ শেঠ প্রভৃতি কর্মচারীরা মাত্রাতিরিক্ত কর আদায় করতে লাগলেন। কোম্পানির দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারীদের অত্যাচারে বাংলার কৃষক সমাজ চরম দুর্দশায় পতিত হয়। এর সঙ্গে পরপর কয়েকবছর অনাবৃষ্টির ফলে বাংলা ১১৭৬ সাল ও ইংরাজী ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এক ভয়াবহ। দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলে। এই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের সাহায্য না করে জোর করে কর আদায় করা হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা রদ করে নবাবকে সরিয়ে নিজের হাতে প্রশাসনিক ও দেওয়ানী ক্ষমতা তুলে নেয়। |
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার
ইংরাজ মারাঠা সংঘর্ষ :
মারাঠা শক্তির পুনরুদ্ধার ঃ শিবাজীর পৌত্র মারাঠা রাজা শাহর শাসনকালে বালাজী বিশ্বনাথ পেশােয়া পদে নিযুক্ত হয়ে প্রকৃত শাসকে পরিণত হন। পরবর্তী পেশােয়া ছিলেন প্রথম বাজীরাও এর মত্যুরপর পেশােয়া হন বালাজী বাজীরাও। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠার। পরাজিত হওয়ার পর মারাঠা শক্তির বিপর্যয় শুরু হয়। মারাঠা পেশােয়া বালাজী বাজীরাও এই | পরাজয়ে ভগ্ন হৃদরে প্রাণত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মাধবরাও পেশােয়া হলেন। তার দক্ষ এগার বছরের শাসনে মারাঠা শক্তি পুনরায় দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু মারাঠাদের এই গৌরব দীর্ঘস্থায়ী হল না। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া মাধব রাওয়ের অকাল মৃত্যু হয়। ফলে মারাঠাদের মধ্যে বিপর্যয় নেমে আসে ।
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ :
মারাঠা অন্তর্দ্বন্দ্ব : পেশোয়া মাধবরাও-এর মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা নারায়ণ রাও পেশােয়া পদ লাভ করেন। কিন্তু নয় মাসের মধ্যে তাঁর পিতৃব্য রঘুনাথ রাও-এর যড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন এবং রঘুনাথ রাও | পেশােয়া পদ দখল করেন। ইতিমধ্যে নারায়ণ রাও-এর একটি পুত্র সন্তান জন্মালে মারাঠাদের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে মারাঠা নেতা নানা ফড়নবীশ ও অন্যান্য মারাঠা নেতৃমন্ডলী। বঘুনাথ রাওকে বিতাড়িত করে এই শিশু সন্তান মাধবরাও নারায়ণকে পেশােয়া পদে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সুরাটের সন্ধি :
রাজ্যচ্যুত রঘুনাথ রাও পেশােয়া পদ পুনরুদ্ধারের জন্য বােম্বাই-এর ইংরাজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুরাটের সন্ধি করেন। এই সন্ধির শর্ত অনুসারে ঠিক হয়, ইংরাজরা রঘুনাথ রাওকে পেশােয়া পদ দখলে সাহায্য করবে এবং এর বিনিময়ে তিনি ইংরেজদের সলসেট ও বেসিন বন্দর অর্পণ করবেন। রঘুনাথ রাও ও ইংরেজ বাহিনী আরাসের যুদ্ধে পেশােয়ার সেনাদলকে পরাজিত করে এবং প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। কিন্তু ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস্ সুরাটের সন্ধি মানতে রাজী ছিলেন না। তিনি এই সব বাতিল করে দিয়ে পেশােয়ার সঙ্গে পুরন্দরের সন্ধি (১৭৭৬ খ্রিঃ) স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় মাধব নারায়ণ রাওকে পেশােয়া বলে ইংরেজরা মেনে নেয়। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডের কোম্পানির কর্তৃপক্ষ সুরাটের সন্ধি অনুমােদন করে পাঠালে, ইংরাজরা রঘুনাথ রাও-এর পক্ষ নিয়ে পেশােয়ার বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে ইংরাজরা পরাজিত হয়ে ওয়াড়গাঁও-এর সন্ধি করতে বাধ্য হয়। হেস্টিংস্ এই অপমানজনক সন্ধি মানতে চায়নি। তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে মহীশূরের হায়দর আলীর ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সলবাই-এর সন্ধির দ্বারা কুড়ি বছর ইংরেজ ও মারাঠাদের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে।
বেসিনের সন্ধি (১৮০২ খ্রিঃ) : সলবাই সন্ধির পরে পেশােয়ার অভিভাবক রূপে নানা ফড়নবীশ পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। অপরদিকে সিন্ধিয়া, হােলকার, ভেঁসলে, গাইকোয়াড প্রভৃতি মারাঠা নায়কগণ পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষের মনােভাব পােষণ করতে লাগলেন। ক্রমে বেরারের ভোঁসলে, বরােদার গাইকোয়াড়, ইন্দোরের হােলকার স্বাধীনভাবে নিজ এলাকায় রাজত্ব করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে পেশােয়া মাধব নারায়ণের মৃত্যু হলে (১৭৯৬ খ্রিঃ) রঘুনাথ রাও-এর পুত্র দ্বিতীয় বাজীরাও পেশােয়া পদে অভিষিক্ত হন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নানা ফড়নবীশের মৃত্যুর পর মারাঠাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব জটিল আকার ধারণ করে। এই সময় হােলকার ও সিন্ধিয়া যুগ্মভাবে পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাওকে আক্রমণ করলে পেশােয়া ইংরেজদের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাজীরাও ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের সন্ধির দ্বারা অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতি গ্রহণ করে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণাধীণ হয়ে পড়েন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০৩-০৫ খ্রিঃ) ঃ
অন্যান্য মারাঠা নায়করা অপমানজনক অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। সিম্বিয়া, ভোসলে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। হােলকার ও গাইকোয়াড় নিরপেক্ষ রইলেন। পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও তার কৃতকার্যে অনুতপ্ত হয়ে গােপনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে উৎসাহিত করতে থাকেন। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধিয়া ও সিন্ধিয়া ভোঁসলের যুগ্ম বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ভোঁসলেকে পরাজিত করে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মানতে বাধ্য করে। এতদিন হােলকার যুদ্ধে-যােগদান করেন নি। তিনি মারাঠাদের স্বাধীনতা বিপন্ন দেখে ভরতপুরের রাজার সঙ্গে মিত্রতা করে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন (১৮০৪)। দিগ্-এর যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। এবং ভরতপুর দুর্গে আশ্রয় নেন। ইংরেজ সৈন্য ভরতপুর দুর্গ অবরােধ করলেও দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী গভর্নর জেনারেল জর্জ বারলো হােলকারের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের অবসান হয়।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৯ খ্রিঃ) :
সিন্ধিয়া, ভোসলে ও পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার মত অপমানজনক সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হওয়ায় এই সন্ধি থেকে অব্যাহতি লাভ করার জন্য। | পেশােয়া সচেষ্ট ছিলেন। দ্বিতীয় বাজীরাও মারাঠা নায়কদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মারাঠারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
ইংরেজ কোম্পানি যখন মধ্যভারতে পিন্ডারী দস্যু দমনে ব্যস্ত সেই সুযােগে পেশােয় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে পুনার নিকট ইংরেজ দুতাবাস আক্রমণ করেন। এর ফলে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ শুর হয়। পৃথক পৃথক যুদ্ধে ভোঁসলে এবং হােলকার পরাজিত হন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে পেশােয়া পরাজিত হয়ে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কোম্পানি পেশােয়ার রাজ্য কেড়ে নিয়ে পেশােয়াকে বৃত্তি ভােগী হিসাবে বিঠুরে নির্বাসিত করে। হােলকারের রাজ্য কোম্পানি দখল করে। সাতারাতে শিবাজীর বংশধর প্রতাপ সিংকে রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দান করেছিল। হােলকার অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি গ্রহণে বাধ্য হন। মারাঠা শক্তি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে মারাঠা নায়কদের অধীন ছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আর কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না।
মারাঠা শক্তির পতনের কারণ :
অভ্যন্তরীণ অনৈক্য : মারাঠা শক্তি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির মুঘল সম্রাটকে তাদের প্রভাবাধীন করেছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই আবক্ষয়ের পিছনে নানা কারণ ছিল।
প্রথমত, মারাঠা সাম্রাজ্যের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােয় (আধা যুক্তরাষ্ট্রীয়) হােলকার, ভোঁসলে, সিন্ধিয়া, গাইকোয়াড স্বাধীন ভাবে শাসন করতেন। তাদের উপর পেশােয়ার কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত। ফলে মারাঠা শক্তি দুর্বল হয় ও সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয়।
দ্বিতীয়ত, পেশােয়া পদ নিয়ে বিরােধের ফলে মারাঠা সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, পর্বত সংকুল অনুর্বর মারাঠা রাজ্য কৃষি কাজের অনুপযােগী ছিল। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য যথাযথ গড়ে তােলা হয়নি। সরকারি ব্যয় সংকুলানের জন্য চৌথ ও সরদেশমুখী আদায়ের উপর নির্ভর করা হত। ফলে আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা পতনের কারণ হয়।
চতুর্থত, মারাঠা রাষ্ট্রের সামাজিক সংহতির অভাব তাদের পতনের অপর কারণ। সামাজিক সংহতির পথে প্রধান বাধা ছিল বর্ণ প্রথা।
পঞ্চমত, চৌথ ও সরদেশমুখী আদায়ের জন্য তাদের যে বিরাট সেনাবাহিনী রাখতে হত, | তার ব্যয়ভার বহনের জন্য মারাঠাদের রাজকোষ আরও শূন্য হতে থাকে।
যষ্ঠত, চিরাচরিত গেরিলা রণকৌশল ত্যাগ করে মারাঠারা ইওরােপীয় যুদ্ধ পদ্ধতি গ্রহণ করলেও তারা বিদেশি যুদ্ধ পদ্ধতিতে সুশিক্ষিত হতে পারেনি।
সপ্তমত, ইংরেজদের যেমন দক্ষ ও রণনিপুণ সেনাপতি (আর্থার ওয়েলেসলি, লর্ড লেক) ছিল, মারাঠাদের তেমন উল্লেখযােগ্য নেতার অভাব ছিল।
অষ্টমত, মারাঠা রাষ্ট্রের ঐক্য ছিল কৃত্রিম, আকস্মিক ও অনিশ্চিত। এজন্য গ্র্যান্ট ডাক বলেছেন, “মারাঠাদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের দ্রুত জয় এবং মারাঠাদের দ্রুত পতন ছিল বিস্ময়কর।
প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর সংঘর্ষ (১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ) : |
মহীশুর রাজ্যের হিন্দু রাজার দুর্বলতার সুযােগে প্রধানমন্ত্রী নঞজরাজ সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। | একজন ভাগ্যান্বেৰ সৈনিক হায়দর আলি মহীশূরে নঞ্জরাজের অধীনে কর্মজীবন শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তিনি দিন্দিগুলের ফৌজদার নিযুক্ত হন ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে। হায়দর ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে নঞ্জরাজ ও নহীশূরের রাজাকে বন্দী করে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেন। হায়দের আলীর নেতৃত্বে মহীশুরেট উত্থানে ইংরেজরা আতঙ্কিত হয়ে হায়দারের বিরুদ্ধে মারাঠা ও নিজামকে নিয়ে শক্তিজোট গঠন করে। হায়দর আলী কুটনাতির দ্বারা নিজামকে সপক্ষে আনেন এবং মারাঠাদের | তবে নিরপেক্ষ রাখতে সক্ষম হন। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দর আলি ইংরাজ আশ্রিত কর্নাটক আক্রমণ করেন। এই ভাবে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে হায়দর পরাজিত হওয়ায় নিজাম ইংরেজদের পক্ষে যােগদেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে হায়দর অতর্কিতে মাদ্রাজ আক্ৰমণ করে অবরোধ করেন। ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ হায়দারের সঙ্গে সন্ধি করে । সন্ধির শর্ত অনুসারে উভয়পক্ষ পরস্পরের অধিকৃত স্থান ফেরত দেয়। আর স্থির হয় কোন পক্ষ তৃতীয় পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা পরস্পরকে সামরিক সাহায্য দেবে।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৮০-৮৪ খ্রিঃ) ঃ
ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি (১৭৮৪ খ্রিঃ) : মাদ্রাজ সন্ধির অল্পকাল পরে ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া মাধব রাও মহীশূর আক্রমণ করেন। হায়দর পূর্বশর্ত অনুসারে ইংরেজদের সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন। এতে হায়দর ক্ষুব্ধ হন। এদিকে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইংরেজরা মহীশূরের অন্তর্গত ফরাসি উপনিবেশ মাহে দখল করে। হায়দর ইংরেজ শক্তি খর্ব করার জন্য মারাঠা ও নিজামকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ বিরােধী শক্তি জোট গঠন করে। ইংরেজরা এর জেলা কেড়ে নেওয়ায় নিজাম ইংরেজদের উপর ক্ষুণ্ন ছিল। এই সুযােগে হায়দর ইংরেজ অনুগত কর্নাটক আক্রমণ করেন। এইভাবে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়। হায়দরের বিশাল বাহিনী কর্ণাটকের রাজধানী আর্কট দখল করেন। ইংরেজপক্ষ বিপদ বুঝে৷ বৃটনীতির দ্বারা মারাঠা ও নিজামকে কাদেরের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একলা হায়দর ইংরাজ সেনাপতি স্যার আরকূট এর (১৭৮১ খ্রিঃ) কাছে পাের্টোনােভাের যুদ্ধে পরাজিত হন। অপরদিকে তাঞ্জোরের যুদ্ধে হাদরের পুত্র টিপুসুলতান ইংরেজদের পরাজিত করেন। ইতিমধ্যে হাদরের মৃত্যু হয়। টিপু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে বিদনুর ও ম্যাঙ্গালাের দখল করেন। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালাের সন্ধি করতে বাধ্য হয়। দুইপক্ষ পরস্পরের অধিকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দেয়।
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০-৯২ খ্রিঃ) ঃ
ম্যাঙ্গালােরে সন্ধির ফলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সমাধান হলেও এই সধি দ্বারা কোনাে স্থায়ী সমাধান হয়নি। টিপু ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজ শক্তি বৃদ্ধির জন্য ফরাসিদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখেন। বড়লাট কর্ণওয়ালিস নিজাম ও মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। নিজামের কাছে প্রেরিত ইংরেজদের মিত্র রাজ্যের তালিকায় টিপুর নাম না থাকায় ক্ষুদ্ধ হয়ে টিপু সুলতান ইংরেজ মিত্র রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষকে তৃতীয় ইগ-মহীশূর যুদ্ধ বলে।
এই যুদ্ধে নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যােগ দেয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে টিপু সাফল্য লাভ করলেও বড়লাট নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর ইংরেজ বাহিনী ম্যাগালাের জয় করে টিপুর রাজধানী শ্রীরঙপত্তন অবরােধ করে।
শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি (১৭৯২ খ্রিঃ) : টিপু শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি করতে বাধ্য হন। টিপু তার রাজ্যের একাংশ নিজাম, মারাঠা ও ইংরেজদের ছিড়ে দিতে বাধ্য হন এবং ৩০ লক্ষ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে স্বীকৃত হন। জামিন স্বরূপ টিপুর দুই কে ইংরেজরা আটক করে।
সেইজন্য টিপু ফরাসিদের সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ফরাসি অভিজ্ঞ সেনানায়ক টিপুর পক্ষে শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি মেনে চলা সম্ভব ছিল না। তিনি তার হারানো রাজবংশ পেতে সচেষ্ট হন।সেইজন্য টিপু ফরাসিদের সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ফরাসি অভিজ্ঞ সেনানায়ক দ্বারা টিপু তার সৈন্যদের আধুনিক যুদ্ধ বিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তােলেন।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রিঃ
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলী ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। টিপুর ফরসি সম্পর্ক ও সমর সজ্জা দেখে তিনি শঙ্কিত হন। তিনি মারাঠাদের ও নিজামকে দলে টানার চেষ্টা করেন। নিজাম অধীনতা মূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। মারাঠারা এই মৈত্রী চুক্তির আহবানে সাড়া দেয়নি। ওয়েলেসলি টিপুকে অধীনতামূলক মিত্ৰতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আহ্বান করেন। টিপু ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ইংরেজ এবং নিজাম বাহিনী যৌথভাবে মহীশূর রাজা আক্রমণ করে (১৭৯৯ খ্রিঃ)। সদাশির ও মলভেলীর যুদ্ধে টিপু পরাজিত হয়ে রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে আশ্রয় নেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে ইংরেজরা টিপুকে পরাজিত করে ও নিহত করে। ইংরেজ ও নিজামের মধ্যে টিপুর রাজ্যের ৩ ভাগের দু’ভাগ বন্টিত হয়। তপর অংশে প্রাচীন হিন্দু রাজবংশের একজনকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
দক্ষিণ ভারতে হায়দর ও টিপু মহীশূর রাজ্যকে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে অন্যতম বাধা ছিল মহীশূর রাজ্য। ইংরেজরা মহীশূর রাজ্যের বিরুদ্ধে ১৭৬৬ থেকে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত অবিরাম যুদ্ধ করে এই রাজ্যটি অধিকার করে দক্ষিণ ভারতে প্রভুত্ব বিস্তারে সফল হয়েছিল।
মহীশূর রাজ্যের পতনের কারণ
দক্ষিণ ভারতে আঠারাে শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হায়দর আলীর নেতৃত্বে শক্তিশালী মহীশূর রাজ্যের উথান ঘটেছিল। কিন্তু মহীশূর রাজ্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই রাজ্যের পতন হয়েছিল। এই পতনের পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, হায়দর কুটবুদ্ধির দ্বারা মারাঠা ও নিজামকে নিয়ে জোট বদ্ধ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু টিপু এ ধরনের কোনাে সুযােগ পাননি।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন হিন্দু রাজবংশ উচ্ছেদ করায় প্রজাবর্গের সমর্থন থেকে হায়দার ও টিপু বঞ্চিত ছিলেন।
তৃতীয়ত, সামরিক ক্ষেত্রে হায়দর অশ্বারােহী বাহিনীর উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু টিপু পিতার সামরিক নীতি ত্যাগ করে অশ্বারােহী বাহিনীকে অবহেলা করেছিলেন।
চতুর্থত, টিপু ফরাসিদের সাহায্য প্রত্যাশা মত না পাওয়ায় মহীশূরের পতন ত্বরান্বিত হয়।
পঞ্চমত, হায়দারকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল একমাত্র ইংরেজদের বিরুদ্ধে, কিন্তু টিপুকে লড়তে হয়েছে ইংরেজ নিজাম ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে। ফলে টিপু ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া টিপুর দূরদৃষ্টি কম ছিল। তিনি কুটনীতি ও যুদ্ধনীতিতে পিতার সমকক্ষ ছিলেন না।
অধীনতা মূলক মিত্রতা ঃ
ওয়েলেসলির নীতি: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিস্তারে ও ভারতে ফরাসি প্রভাব দূর করতে গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলি তিনটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
প্রথমত, সােজাসুজি যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য অধিকার করা এই মহীশুর রাজ্যটি তিনি যুদ্ধের দ্বারা দখল করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, কোনো রাজ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত গােলযােগের সুযােগে সেই রাজ্যের শাসনকর্তাকে সামান্য ভাতা প্রদানের মাধ্যমে রাজ কেড়ে নেওয়া হয়। তাঞ্জর, সুরটি ও কর্নাটক রাজ্যকে এইভাবে ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিল।
তৃতীয়ত : অধীনতামূলক মিত্রতা নাতির দ্বারা অযােধ্যা, নিজামের রাজ্য, মারাঠা রাজ্য ইংরেজরা অধিকার করে নেয় । সর্বপ্রথম হায়দ্রাবাদের নিজাম অধীনতামূলক মিত্ৰতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন (১৭৯৮)। পরবর্তীকালে১৮০১ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যা, ১৮০২ খ্রিঃ পেশোয়। দ্বিতীয় বাজিরাও, ১৮০৩ খ্রিঃ সিন্ধিয়া ভোঁসলে প্রভৃতি রাজ্য এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
অধীনতামূলক মিত্রতা মূলকথা হলো দেশীয় রাজ্য কে নিরাপত্তার অজুহাতে ব্রিটিশ শক্তির উপর নির্ভরশীল করে তোলা ।একে বলে ছলনার বশ্যতা নীতি। এর চারটি শর্ত ছিল। প্রথমত, যে দেশীয় রাজা এই মিত্রতা আবদ্ধ হবে তারা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ বা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না । দ্বিতীয়ত, যেসব দেশীয় রাজা এই চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন তাদের ব্রিটিশ কোম্পানি নিরাপত্তা ব্যবস্থা করবেন । এর জন্যে সেই রাজ্যের একাংশ কোম্পানির
কাছে ছেড়ে দিতে হবে ব্রিটিশ সৈন্যদের খরচ নির্বাহ করার জন্য। তৃতীয়ত, চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় বাজার নিজস্ব সৈন্যদের ও ব্রিটিশ সেনাপতির অধীনে রাখতে হবে। চতুর্থত, অধীনতা মূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাজাদের দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি বা রেসিডেন্ট রাখতে হবে।
পরিণতি ঃ এই নীতির দ্বারা ইংরেজরা রক্ষকের ছদ্মবেশে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে যে সমস্ত রাজা স্বাক্ষর করেন, তারা সাম্রাজ্যবাদী ফাদে ধরা পড়েন। এই চুক্তির পরিনাম হল (ক) আত্মরক্ষার অধিকার হারানো, (খ) বৈদেশিক ক্ষেত্রে মিত্রহীন হওয়া, (গ) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য দেশীয় রাজাকে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করা, (ঘ) দেশীয় রাজার নিজস্ব সেনা বাহিনী হ্রাস করা বা ভেঙ্গে দেওয়া, (ঙ) কর্মচ্যুত দেশীয় রাজার সেনাদের আর্থিক দুদর্শার কারণে দস্যবৃত্তি গ্রহণ এবং (চ) চুক্তিবদ্ধ দেশীয় রাজারা প্রজাকল্যাণে উদাসীন হয়ে বিলাস ব্যসনে মগ্ন হয়ে পড়েন।
এই চুক্তি ইংরেজদের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল। কারণ (ক) কোম্পানির শক্তি সম্পদ বৃদ্ধি পায়। (খ) ভারতীয় শাসকদের অর্থে ইংরেজদের নিজস্ব সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বাহিত হয়। (গ) চুক্তিবদ্ধ দেশীয় রাজ্যের বিদেশনীতি ইংরেজদের হাতে চলে যায়। (ঘ) দেশীয় রাজ্যগুলি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দেশীয় রাজ্যগুলি সঘবদ্ধ হয়ে শক্তিজোট গড়তে পারে নি। (ঙ) ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিষ্কন্টক হয়।
সীমান্ত রাজ্যে ইংরেজের আধিপত্য বিস্তার ঃ
ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধ (১৮১৪-১৬ খ্রিঃ) : হিমালয়ের পার্বত্য অঞলের পাদদেশে অবস্থিত নেপাল রাজ্য। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে পৃথ্বীনারায়ণের নেতৃত্বে গুর্খা জাতি পূর্বে তিস্তা নদী থেকে পশ্চিমে শতদ্রুনদী পর্যন্ত সমগ্ৰ হিমালয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে গােরক্ষপুর জেলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় নেপাল, ব্রিটিশ রাজ্যের সীমান্তবর্তী হয়। নেপালীরা মাঝে মাঝে ব্রিটিশ শাসিত সমতল অঞ্চলে হামলা করত। এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ নেপাল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথমদিকে নেপালীরা ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে। শেষ পর্যন্ত অক্টারলােনির নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু অবরােধ করলে নেপালী সেনাপতি অমর সিং থাপা আত্মসমর্পণ করে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে সগৌলির সন্ধির দ্বারা যুদ্ধের অবসান হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে গাড়ােয়াল, কুমায়ুন, সিমলা, মুসৌরি, নৈনিতাল, আলমােড় প্রভৃতি অঞল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। নেপালের রাজ দরবারে ইংরেজ দূত রাখতে নেপাল সম্মত হয়।
সিন্ধু বিজয় : মধ্য এশিয়ায় রুশ আধিপত্য প্রতিহত করার জন্য এবং পারস্য ও আফগানিস্তানে ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তার ও ব্যবসা বাণিজ্যে সুবিধা অর্জনের জন্য সিন্ধু দেশে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়ােজন ছিল। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে সিধু দেশের আমীরদের সঙ্গে বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বে ইংরেজরা এক চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে ব্রিটিশরা সিন্ধু দেশে স্থলপথে ও জলপথে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা লাভ করে। ইংরেজদের চাপে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর আমীর লর্ড অকল্যাণ্ড -এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। অবশেষে গভর্ণর জেনারেল এলেনবরা ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাপতি চার্লস নেপিয়ার নানা অজুহাত দেখিয়ে সিন্ধুদেশ আক্রমণ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
ব্রহ্মদেশে আধিপত্য বিস্তার : ভারতের পূর্ব সীমানায় ব্রহ্মদেশের বনজ সম্পদের প্রতি ইংরেজ কোম্পানির বরাবর লােভ ছিল। ব্রম্মদেশে ইংরেজ বণিকদের স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল। ব্রহ্মরাজ বােদোপায় ভারত সীমান্ত আরাকান ও মনিপুর জয় করলে ইংরেজরা আপত্তি জানায়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মরাজ আসাম দখল করে কাছাড় আক্রমণ করলে ইংরেজ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে ব্রহ্মরাজ পরাজিত হয়ে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সঙ্গে ইয়ান্দাবুর
সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধি অনুসারে ইংরেজ কোম্পানি আসাম, কাছাড়, মনিপুর, আরাকান লাভ করে। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বণিকদের উপর দুর্ব্যবহারের অভিযােগে লর্ড ডালহেসী ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। এই যুদ্ধে কোম্পানি ব্রহ্মদেশের দক্ষিণ অঞ্চল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে।
আফগানিস্তান অভিযান : রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলি অধিকার করায় ভারতের ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়। গর্ভনর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড আফগানিস্তানে রুশ প্রভাব প্রতিরােধ করার জন্য প্রয়াস চালিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে আমীর দোস্ত মহম্মদের শাসনকালে একটি রুশ প্রতিনিধি দল আসায় লর্ড অকল্যান্ড দোস্ত মহম্মদকে অপসারিত করে ইংরেজ আশ্রিত শাহসুজাকে কাবুলের সিংহাসনে বসাবার জন্য আফগানিস্তান আক্রমণ করেন। এর ফলে প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৮- ৪২) শুরু হয়। এই যুদ্ধে দোস্ত মহম্মদকে বন্দী করে শাহ সুজাকে কাবুলের সিংহাসনে আমীর পদে বসান হয়। স্বাধীনতা প্রিয় আফগানরা এক বিদ্রোহের মাধ্যমে শাহ সুজাকে অপসারিত করে দোস্ত মহম্মদকে পুনরায় আমীর পদে বসাতে ইংরেজদের বাধ্য করে।
ইঙ্গ-শিখ সম্পর্ক – রণজিৎ সিংহ |
দশম গুরু গােবিন্দ সিংহ -এর মৃত্যুর পর বান্দার নেতৃত্বে খালসা বাহিনী স্বাধীন শিখ রাজ্য স্থাপন করেন। মােগল সম্রাট একাধিক অভিযানে বান্দাকে দমন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে বান্দাকে বন্দী করে হত্যা করা হলেও (১৭১৬ খ্রিঃ) স্বাধীনতাকামী শিখদের দমন করা সম্ভব হয়নি। আহম্মদ শাহ আবদালী ভারত ত্যাগের পর মােগলদের দুর্বলতার সুযােগে শিখ জাতি পাঞ্জাব সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে এক বিশাল স্বাধীন রাজ্য গড়ে তােলে। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পূর্বে সাহারানপুর থেকে পশ্চিমে আটক পর্যন্ত এবং উত্তরে কাংড়া ও জম্মু থেকে দক্ষিণে মুলতান পর্যন্ত শিখদের অধিকার বিস্তৃত হয়। এই বিরাট অঞ্চলে কোনাে ঐক্যবদ্ধ রাজ্য গড়ে না তুলে ১২টি মিসিল বা সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত করে শিখ সর্দার বা নায়করা নিজ নিজ মিসিলে স্বাধীনভাবে শাসন করতেন। এই মিসিলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শিখরাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সুকারচুকিয়া মিসিলের নায়ক মহাসিংহের পুত্র রণজিৎ সিংহ।
রণজিৎ সিংহ (১৭৮০-১৮৩৯ খ্রিঃ) :
পিতার মৃত্যুর পর ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র বারাে বছর বয়সে তিনি সুকারচুকিয়া মিসিলের অধিপতি হন। আফগানিস্তানের অধিপতি আহম্মদ-শাহ-আবদালীর পৌত্র জামান শাহের ভারত আক্রমণ কালে রণজিৎ সিংহ তাকে সাহায্য করায় জামান শাহ রণজিৎ সিংহকে লাহােরের শাসন কর্তা ও রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। কিছুকাল পরে রণজিৎ সিংহ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। রণজিৎ সিহ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীরের মিসিলগুলি দখল করেন এবং অমৃতসর জয় করেন। এরপর রণজিৎ সিংহ খন্ড শিখ রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হলে এই অঞ্চলের শিখ নায়কগণ ইংরেজদের শরণাপন্ন হন। রণজিৎ সিংহের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গর্ভনর জেনারেল মিন্টো শঙ্কিত হলেও ফরাসি আক্রমণের ভয়ে রণজিৎ সিংহের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হন। তিনি চার্লস মেটকাফকে আলােচনার জন্য রণজিৎ সিংহের কাছে পাঠান। দুই পক্ষের আলােচনার ভিত্তিতে ১৮০৯ খ্রি অমৃতরের সদ্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধিতে স্থির হয় যে রণজিৎ শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের অঞ্চলগুলির দাবি ত্যাগ করবেন এবং ইংরেজ কর্তৃপক্ষ শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীরের অধিপতি হিসাবে রণজিৎ সিংহকে স্বীকৃতি দেন। এরপর রণজিৎ সিংহ পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তারে অগ্রসর হয়ে একে একে ক্যাংড়া, পাঠানকোট, শিয়ালকোট ও মুলতান, কাশ্মীর, পেশোয়ার, আটক প্রভৃতি জয় করেন।
১৮৩১ খ্রিঃ সন্ধি : এরপর রণজিৎ সিংহ সিন্ধুদেশ দখলে তাগ্রহী হলে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে বাধা দানের আশঙ্কায় শিখ দরবারে দূত প্রেরণ করেন। ইতিমধ্যে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পেলে উইলিয়াম বেন্টিক বণজিৎ সিংহের সঙ্গে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এক চুক্তির দ্বারা স্থায়ী। মিত্রতা স্থাপন করেন এবং রনজিত সিংহকে সিন্ধু অঞ্চলের রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা থেকে বিরত করেন।
ত্রিশক্তি মৈত্রী: আফগানিস্থানের অধিপতি দোস্ত আলির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে ইংরেজ কোম্পানী দোস্ত আলিকে সরিয়ে তাদের অনুগত শাহ সুজাকে আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসানাের জন্য ইংরেজ, শাহ সুজা ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ই-আফগান প্রথম যুদ্ধ চলাকালে রণজিৎ সিংহের জীবনাবসান হয়।
কৃতিত্ব : ভারতের ইতিহাসে রণজিৎ সিংহ একজন দূরদর্শী রাজনীতিক, উদার দেশপ্রেমিক, ধর্মনিরপেক্ষ কূটনীতিক শাসক হিসাবে পরিচয় রেখে গেছেন। তিনি অখন্ড শিখ রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকারও পরিচয় দেন। তিনি প্রশাসনিক ও সামরিক সংস্কারের মাধ্যমে রাজ্যকে সুগঠিত, সংহত ও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। তিনি খালসা বাহিনীকে পাশ্চাত্য যুদ্ধ কৌশলে শিক্ষিত করেছিলেন। তথাপি রণজিৎ ব্রিটিশদের সঙ্গে আপােসমূলক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন শাসক। তিনি বিবদমান শিখ দলপতিদের ঐক্য বদ্ধ করেন।
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ :
রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে শিখশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। রণজিৎ সিংহের তিন পুত্র পরপর নিহত হলে নাবালক পুত্র দলীপ সিংহ রাজা হন। রাজমাতা ঝিন্দন তার অভিভাবিকা ছিলেন। এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযােগে খালসা বাহিনী রাজ্যে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। খালসা বাহিনীর ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে রাজমাতা খালসা বাহিনীকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করতে লাগলেন। এদিকে সিন্ধুদেশে ইংরেজ সৈন্য মােতায়েন দেখে ও শতদ্রু নদীর পূর্বতীরে ইংরেজ সেনা নিবাস স্থাপনে শঙ্কিত হয়ে খালসা বাহিনী ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে শতদ্রু নদী অতিক্রম করে ও ইংরেজদের আক্রমণ করলে প্রথম ইঙ্গ-শিখযুদ্ধের সূচনা করে।
এই যুদ্ধে খালসা বাহিনী পরাজিত হয়। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে লাহােরশান্তি চুক্তির দ্বারা খালসা বাহিনীর সংখ্যা সীমাবদ্ধ করা হয় এবং জলন্ধরের দোয়াব ও কাশ্মীর অঞ্চল ইংরেজরা লাভ করে। কোম্পানি এক কোটি টাকায় গােলাব সিংহের নিকট কাশ্মীর বিক্রয় করে। লাহাের দরবারে ইংরাজ রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়। ঐ বছরেই পুনরায় ভেরওয়ানের সন্ধি দ্বারা ইংরেজ রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৮ জন শিখ সর্দারের পরিষদের উপর পাঞ্জাব শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। স্বাধীনতা প্রিয় শিখদের পক্ষে লাহাের সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। লাহােরে ইংরেজ রেসিডেন্ট ও ইংরেজ সৈন্যদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে শিখরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাজমাতা ঝিন্দনকে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে চুনার দুর্গে নির্বাসিত করা হলে শিখদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে মূলতানের শিখ শাসনকর্তা মুলরাজ বিদ্রোহ করায় দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ শুরু হয়। মূলরাজের সঙ্গে যুক্ত হয় হাজারার শাসনকর্তা ছত্র সিংহ শের সিংহ। আফগানরাও শিখদের সঙ্গে যােগ দেয়। চিলিয়ানওয়ালার যুদ্ধে শিখরা জয়ী হলেও মুলতান ও গুজরাটের যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয়। শিখবাহিনী ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পন করে। লর্ড ডালহৌসি পঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। দলীপ সিংহকে বার্ষিক ৫০ হাজার পাউন্ড বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করে লর্ড ডালহৌসী বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করে লন্ডনে নির্বাচিত করেন।খালসা বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হয় শিখদের এই পরাজয়ের জন্য তাদের আত্মকলহ ও বিশ্বাসঘাতকতাকেই দায়ী করা হয়। পাঞ্জাব দখলের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমা আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
লর্ড ডালহৌসির সাম্রাজ্য বিস্তারনীতি
ঐতিহাসিক ইস বলেছেন, “ডালহৌসির পূর্ববর্তী শাসকরা সম্ভবপর হলো যুদ্ধ বা রাজ্য দখল এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু ডালহৌসি সর্বদা যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য বিস্তার করতেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিস্তারে লর্ড ডালহৌসির শাসন কাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের গভর্ণর জেনারেল ছিলেন। ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি তিনটি নীতি গ্রহণ করেন (১) যুধের দ্বারা রাজ্যজয় (2) স্বত্ববিলোপ নীতি এবং (৩) কুশাসনের অভিযোগে রাজ্য জয়। এছাড়া নানা অভিযোগে দেশীয় রাজ্য দখল।
(১) যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য জয় ঃ তিনি সর্বদা যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য জয় ও বিস্তার করতেন। যুদ্ধের দ্বারা তিনি পাঞ্জাব ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে অধিকার করেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে অধিকৃত হয় সিকিম। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ ব্রহ্ম জয় করেন এবং আরাকান ও টেনাসেরিম দখল করেন। )
(২) স্বত্ব বিলােপ নীতি : স্বত্ব বিলােপ নীতি ছিল ইংরেজ আশ্রিত বা সৃষ্ট রাজ্যে শাসকের সন্তান না থাকলে শাসকের মৃত্যুর পরে সেই রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে এবং কোনাে দত্তক পুত্র গ্রহণ করা স্বীকৃত হবে না। এই নীতি প্রয়ােগ করে ডালহৌসি সাতারা সম্বলপুর, ঝাসি, উদয়পুর, নাগপুর অধিকার করেন। এছাড়া কর্ণাটকের নবাবের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীকে বৃত্তি প্রদান বন্ধ করা হয়। পেশােয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেবেরও বৃত্তি বন্ধ করা হয়েছিল।
(৩) কুশাসনের অভিযােগে রাজ্য গ্রাস ঃ কুশাসনের অভিযােগে ডালহৌসি অযােধ্যা গ্রাস করেছিলেন। যদিও অযােধ্যায় কুশাসনের সকল দায়িত্ব ছিল ইংরেজদের। আসলে ইংল্যান্ডের মিল মালিকদের সস্তা দরে তুলাে সরবরাহের জন্য অযােধ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়ােজন বােধ করেছিলেন। তার কুশাসনের অভিযােগ রাজ্য জয় প্রসঙ্গে হেনরী লরেন্স বলেছেন, এটি চরমবিশ্বাসঘাতকতা’।
(৪) অন্যান্য অজুহাত : এছাড়া অন্যান্য কারণে ডালহৌসি কয়েকটি রাজ্য দখল করেছিলেন। (১) তিনি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজ কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযােগে সিকিমের একাংশ দখল করেন। (২) হায়দ্রাবাদের নিজাম অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ পরিশােধ না করায় ডালহৌসি বেরার প্রদেশটি ১৮৫৩ খ্রিঃ দখল করেন। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটেনের বস্ত্রশিল্পে তুলাের প্রয়ােজন মেটানো।
ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামাে প্রতিষ্ঠা ||
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাদের অধিকৃত ভূখণ্ডে কোনাে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়নি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে দেশকে শাসন করার দায়িত্ব গ্রহণ না করে তদারকির দ্বারা শােষণের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে লাগলাে। ফলে দেশে দেখা দিয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতা। ইংল্যান্ডে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে বুঝতে পারেন দেশ দখল করলে তার সুশাসনের ব্যবস্থা করতে হয়। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তােলার জন্য ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরাসরি কোম্পানি নিজের হাতে দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করল। ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তার ভারতে শাসনের দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল। সাম্রাজ্যবিস্তার, অর্থনৈতিক শােষন, বাণিজ্য বিস্তার করা।
রেগুলেটিং অ্যাক্ট
ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির কাজকর্মের অব্যবস্থা দেখে ইংল্যান্ডের জনমত কোম্পানির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই বিষয়ে সমালােচনা হয়। ফলে কোম্পানির শাসনকার্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্ট নামে একটি আইন পাশ করে। এই আইন অনুসারে বাংলার গভর্নরকে গভর্নর জেনারেল আখ্যা দেওয়া হয়। তাকে বাংলা, মাদ্রাজ, ও বােম্বাই প্রেসিডেন্সির নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হয়। শাসন কাজে সাহায্যের জন্য চার সদস্যের এক কাউন্সিল গঠিত হয়। কলকাতায় একটি সুপ্রিম কোর্ট (১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে) স্থাপিত হয়। এর প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন এলিজা ইম্পে। স্থির হয় গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলের মধ্যে মতভেদ হলে অধিকাংশের মত গৃহীত হবে। গভর্নর জেনারেলের উপর শান্তি রক্ষা, আইন প্রনয়ণ ও নির্দেশ প্রদানের অধিকার থাকবে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে অন্য প্রেসিডেন্সির উপর গভর্ণর জেনারেল’এর নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পিটের ভারত শাসন আইন
রেগুলেটিং অ্যাক্টের দোষ ত্রুটি দূর করার জন্য ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করা হয়। এই আইনে বলা হয় (১) ইংল্যান্ডে ছয়জন সদস্য নিয়ে বাের্ড অফ কন্ট্রোল গঠিত হবে। এরা কোম্পানির শাসনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। (২) গভর্নর জেনারেলের সদস্যের সংখ্যা চারজন থেকে তিন জন করা হয়। (৩) স্থির করা হয় গভর্নর জেনারেল জরুরী প্রয়ােজনে কাউন্সিলের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন। (৪) যুদ্ধ, শান্তি, রাজস্ব, সেনাবাহিনীর বিষয়ে সপার্ষদ গভর্নর জেনারেলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
বিচার ও পুলিশী ব্যবস্থা ও
হেস্টিংস-এর বিচার সংস্কার: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। প্রত্যেক জেলায় কালেক্টর ও কাজীর অধীনে যথাক্রমে মফস্সল দেওয়ানী ও মফঃস্বল ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন। এই মফঃস্বল দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের জন্য কলকাতায় সদর দেওয়ানি আদালত ও মুর্শিদাবাদে সদর নিজামত আদালত স্থাপন করা হয়। কলকাতায় সদর দেওয়ানি আদালতের দায়িত্ব ছিল সপরিষদ গভর্নর জেনারেলের উপর। তিনি মামলা মােকদ্দমা সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মফস্সল দেওয়ানি আদালত ৫০০ টাকা পর্যন্ত মামলার বিচার করতে পারত বেশি মূল্যের মামলার এক্তিয়ার ছিল সদর দেওয়ানি আদালতের। তিনি (হেস্টিংস) বিচারকদের মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করেন। জেলা দেওয়ানি আদালত থেকে প্রাদেশিক দেওয়ানি আদালতে আপীল করা যেত। একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর উপর বিচারকের দায়িত্ব থাকত।
ফৌজদারি বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলায় মফস্সল ফৌজদারি আদালত ছিল।সদর নিজামত আদালত জেলার ফৌজদারি আদালতগুলির কাজের তদারকি করত।
কর্নওয়ালিসের বিচার সংস্কার
লর্ড কর্ণওয়ালিস বিচার ব্যবস্থাকে আরো সুগঠিত করেন তিনি তেইশটি জেলা গঠন করেন। প্রত্যেক জেলায় একজন করে ইংরাজ কর্মচারীকে কালেক্ট হিসাবে নিযুক্ত করেন। জেলা কালেক্টররা রাজস্ব, শাসনকার্য, বিচার বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন দুইশত টাকা পর্যন্ত অর্থের রাজত্ব সংক্রান্ত মামলার বিচার করতেন রেজিস্টার নামে কর্মচারী সদর নিজাম আদালত তিনি কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন। গভর্নর জেনারেল ও তার পারিষদেহাতে কার্যের বিচার ভার অর্পিত হয়। জেলায় ফৌজদারি আদালত তুলে দিয়ে তিনি কলকাত ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় চারটি ভ্রাম্যমান আদালত স্থাপন করেন। প্রতি জেলায় বছরে দুবা। থাপন করেন। হিন্দু মুসলিম আইনের সাহায্যে ইংরেজ বিচারক বিচার করতেন। নরহত্যা সমাজে অপরাধ বলে গণ্য হয়। কর্ণওয়ালিস ভারতীয় আইনকে লিখিত ও সুস্পষ্ট আইনে নথিভুক্ত করেন। এই সংকলিত আইনকে কর্ণওয়ালিস কোড বলা হয়। তিনি ভারতে সিভিল সার্ভিসের সংগঠক ছিলেন।
লর্ড বেন্টিঙ্কের বিচার সংস্কার : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ফৌজদারি বিচারের ভার অর্পণ করেন। আদালতে দেশীয় ভাষা প্রবর্তন করেন। আদালতে ভারতীয় কর্মচারী নিযুক্ত করেন। ভারতীয় দণ্ড বিধি বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড রচনা করেন।
পুলিশ ব্যবস্থা : ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনকালে পুলিশি ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিলনা। ওয়ারেন হেস্টিংস শাসন গ্রহণ করে পুলিশী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি জেলায় থানা স্থাপন করে একজন ফৌদজার ও ৩৪ জন সেপাই রাখার ব্যবস্থা করেন।
দেশের সর্বত্র শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য কর্ণওয়ালিস পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করেন। আগে জমিদাররা নিজ এলাকায় শান্তি শৃংখলা রক্ষা করত। কর্ণওয়ালিস এই ব্যবস্থা রদ । করে জেলাকে কয়েকটি থানায় ভাগ করেন। প্রত্যেক থানায় ভারতীয় দারােগার উপর শান্তি রক্ষার দায়িত্ব থাকত। দারােগার অধীনে কয়েকজন কনস্টেবল থাকত। প্রত্যেক জেলায় শান্তি রক্ষার দায়িত্ব থাকত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উপর। কলকাতার একজন পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। গ্রামের শান্তি শৃংখলা রক্ষা করত চৌকিদার। চৌকিদারের বেতন যােগাত গ্রামের মানুষ।