ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান

 ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান

 

ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism in India)

ভারতের-ধর্মনিরপেক্ষতার-বৈশিষ্ট্য-আলোচনা-রাষ্ট্রবিজ্ঞান

 

ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ 

 

 ইংরেজী ‘সেকিউলারিজম’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘সেকিউলাম’ (sacculum) শব্দটি থেকে। ‘সেকিউলাম’ বলতে বিশ্বজনীনতাকে বােঝায়। সাধারণভাবে ‘সেকিউলারিজমে’র বাংলা করা হয় ধমনিরপেক্ষতা’। কিন্তু এরূপ পরিভাষা আদৌ গ্রহণযােগ্য কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। তবে কোন সর্বজনগ্রাহ্য বিকল্প বাংলা পরিভাষা না থাকায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। আবার, ভারত রাষ্ট্রকে ‘সেকিউলার’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে অভিহিত করা সমীচীন কিনা, তা নিয়েও রাষ্ট্রনেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরােধ রয়েছে। স্বাধীন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম স্রষ্টা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু গণ-পরিষদে মন্তব করেছিলেন, “আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে অভিহিত করি। ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি সম্ভবত একটি যথাযথ শব্দ নয়। কিন্তু একটি যথাযথ বিকল্প শব্দের অভাবে আমরা এই শব্দটি প্রয়ােগ করেছি।”

 

ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বােঝায়, সে সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু বলা যথেষ্ট কঠিন। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তীব্র মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এ বিষয়ে কোন মতবিরােধ নেই যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটির উৎপত্তি ঘটেছিল ইউরােপে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ইউরােপে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’  শব্দটির প্রয়ােগ লক্ষ্য করা গেলেও ব্রিটিশ সমাজসংস্কারক জর্জ জেকব হলােয়েক  সর্বপ্রথম একটি মতবাদ’ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলােচনা করেন। তাই তাকে ধর্মনিরপেক্ষতার জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৮৪৬ সালে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আন্দোলন শুরু করেন। 

 পরবর্তী সময়ে তার লেখা ‘প্রিন্সিপলস্ অব সেকিউলারিজম্’ (Principles of Secularism) এবং ‘দি অরিজিন অ্যান্ড দ্য নেচার অব সেকিউলারিজম্’ (The Origin and the Nature of Secularism) নামক গ্রন্থ দু’টিতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিসমূহ বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়। যদিও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী প্রতিবাদ আন্দোলন  হিসেবে সংগঠিত করেছিলেন, তথাপি তার ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে ধর্মের স্থান ছিল।

  বস্তুতঃ, তিনি ধর্মবিশ্বাসের বৈচিত্র্য এবং সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তিনি নাস্তিক কিংবা ধর্ম-বিরােধী ছিলেন না; বরং ছিলেন একজন অজ্ঞাবাদী (agnostic)। তার কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ছিল ধর্মীয় ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের পৃথকীকরণ। এরূপ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ‘ নিউ টেস্টামেন্ট’ (New Testament-এও বলা হয়েছে। যীশু খ্রীস্ট বলেছিলেন, “সীজারের যা প্রাপ্য তা সীজারকে দাও এবং ঈশ্বরের যা প্রাপ্য তা ঈশ্বরকে প্রদান কর”  কিন্তু প্রায় একই সময়ে যােশেফ ব্র্যাডলা (Joseph Bradlaugh) ভিন্নধর্মী ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তার ধর্মনিরপেক্ষতায় ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন এবং বিজ্ঞান সাধনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল। বস্তুতঃ, তিনি ছিলেন পুরােপুরিভাবে নাস্তিক (atheist)। তাই ঈশ্বরের নামে শপথ নিতে অস্বীকার রায় নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও একাধিকবার তাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল।

 

 পাশ্চাত্যে ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণকে বােঝায়। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্র বা রাজনীতির কেবল পৃথকীকরণকেই ধর্মনিরপেক্ষতা বলে মনে করলে ভুল করা হবে। এটি হােল ধর্মনিরপেক্ষতার সংকীর্ণ অর্থ। এম. এইচ.  তার ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স অ্যান্ড  নামক প্রবন্ধে ব্যাপক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা হােল বিশ্বের মানুষের কল্যাণের জন্য সেইসব চিন্তা ও কাজ, যেখানে ঈশ্বর বা অতিন্দ্রীয় শক্তির হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করা হয় না, কিংবা তাদের উল্লেখও থাকে না। ঈশ্বর-বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও কবি আলেকজান্ডার পােপ  অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রায় অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।* ওয়াই. বি. দামলী তার প্রসেস অব সেকিউলারাইজেশন’ (Process of Secularization) নামক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, একটি সর্বব্যাপী প্রক্রিয়া হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কেবল রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে পৃথকীকরণকেই বােঝায় না, সেই সঙ্গে

 [i] যুক্তিবাদ ও বােধশক্তির ওপর গুরুত্ব আরােপ, i) বিজ্ঞানসম্মত মনন, [i] ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, [iv] সর্বজনীনতা এবং জাতপাত, অঞ্চল, ধর্ম প্রভৃতির প্রতি সুনির্দিষ্ট আনুগত্য থেকে মুক্তি, [v] সামাজিক নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে কোন কিছু অর্জন এবং [vi] আইনের অনুশাসনকেও বােঝায়। এ. আর. ব্লাকশিল্ড (A. R. Blackshield) তার ‘সেকিউলারিজম্ অ্যান্ড সােসাল কনট্রোল ইন দ্য ওয়েস্ট ঃ দ্য মেটিরিয়াল অ্যান্ড দ্য ইথারিয়াল  নামক প্রবন্ধে উপরি-উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতার অন্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। সেগুলি হােল 

[i] বস্তুবাদ, [i] মানবতাবাদ, [ii] অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি, [iv] প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার, [v] শিল্পায়ন, [vi] রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, [vi] ধর্মীয় সহনশীলতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, [viii] সকলের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

 

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতি

 

তবে সাধারণভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্ম থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির পৃথকীকরণকেই বােঝায়। অনেকে এই ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতির মতাে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণের কথা তত্ত্বগতভাবে বলা হলেও বাস্তবে বিপরীত চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। ব্রিটেনে এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে চার্চকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করা হয়নি। তাছাড়া, সেখানকার রাজা বা রানীকে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে প্রােটেস্টান্ট হতে হয়। বস্তুতঃ, ব্রিটেনে প্রথার ভিত্তিতে ধর্ম এবং রাজনীতিকে পৃথক করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে একটি তথাকথিত আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কার্যে প্রায়শই ঈশ্বরের নাম নেওয়া হয়। এমনকি, ডলার বিলে ঈশ্বরের নামও প্রত্যক্ষ করা যায়।

  তবে ফ্রান্সে অনেক বেশি পরিমাণে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ ঘটানাে হয়েছে এবং মেক্সিকোতে ধর্মীয় যাজকমণ্ডলী কে ভােটাধিকার প্রদান করা কিংবা তাদের কোন রাজনৈতিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযােগ দেওয়া হয় না। অবশ্য একথা সত্য যে, ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে দেশগুলিতেও পুরসমাজ -এর ওপর বুর্জোয়াশ্রেণীর আধিপত্য’  সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ঐসব দেশে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচন বৈতরণী অতিক্রম করার কোনও প্রয়ােজনীয়তা নেই। তাই ঐসব দেশে এখন আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্র করে তেমন কোন বিতর্ক দেখা যায় না।

 

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা 

 

ভারত হােল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত দেশ। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ পবিত্র ভারতভূমিতে নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন না দিয়েও একই পরিবারভুক্ত মানুষের মতাে মিলেমিশে বাস করে। এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, পার্শী প্রভৃতি নানা ধর্মের মানুষ রয়েছেন। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ঐক্যের এক বিচিত্র ধারা লক্ষ্য করা যায়।‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’এবং বিবিধের মাঝে মিলনে’র এক সুমহান ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হােল ভারত। 

 আর্য উপজাতির ভারত অভিযানের সময় (খ্র.পূ. ২০০০-১৫০০) থেকে শুরু করে বহু জাতি ও উপজাতি ভারতভূমিতে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এখানে এসে স্থায়িভাবে বসবাস করতে শুরু করে এবং ভারতকে তাদের আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তােলে। বিভিন্ন গােষ্ঠীর মুসলমান আক্রমণকারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য। ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও কালক্রমে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিলন সাধিত হয়। এর ফলে গড়ে ওঠে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি, যা মিশ্র সংস্কৃতি (composite culture) নামে

পরিচিত। কিন্তু ব্রিটিশরা ভারতকে নিজেদের পদানত রেখে শােষণ করার জন্য ‘ বিভক্ত করে

 

শাসন করাে’ নীতি অনুসরণ করেছিল। ফলে হিন্দু-মুসলমান দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মনে বিদ্বেষ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়। জন্মলাভ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। কিন্তু পাকিস্তান (ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ) ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এস. এল. সিক্রী  বলেছেন, রক্তপাত ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির মুখে দাঁড়িয়ে ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা সাম্প্রদায়িকতার অলীক ও অমানবিক মতবাদটিকে পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতীয় ঐক্যের শেষ আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। •

 

 ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতি 

 

 পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি ও বিকাশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় সাধারণভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিকে একটি পাশ্চাত্য ধারণা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই কেউ কেউ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ভারতের মতাে একটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশ্চাত্য ধারণা আদৌ গ্রহণযােগ্য নয়। এস. পি. শাঠে  তার ‘সেকিউলারিজম, ল অ্যান্ড দ্য কনস্টিটিউশন অব্ ইন্ডিয়া’  নামক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছে যে, পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিরূপ  ভারতের পক্ষে আদৌ উপযােগী নয়। অনুরূপভাবে, কনসেপ্ট অব সেকিউলারিজম্ —এই শিরােনামে পৃথক পৃথক দু’টি প্রবন্ধে টি. এন. মদন ও এম. এম. টমাস  ভারতীয় অবস্থায় ইউরােপীয় অর্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়ােগ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বস্তুতঃ, ভারতের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ও ব্যবস্থার স্বাতন্ত্রের জন্য এরূপ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে সেইসঙ্গে একথাও ঠিক যে, ধর্মনিরপেক্ষতার রেণ্যটির উৎপত্তি পাশ্চাত্যে ঘটলেও তা আজ একটি সর্বজনীন ধারণায় রূপান্তরিত হয়েছে। অবশ্য দেশ, কাল ও ব্যক্তিভেদে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

 

ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে হলে রাষ্ট্র এবং সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ কা প্রয়ােজন। এর অর্থ—ভারতরাষ্ট্র এবং ভারতীয় সমাজ উভয়েই ধর্মনিরপেক্ষ কিনা, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা না হলে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা-সংক্রান্ত যে-কোন আলােচনা অসম্পূর্ণ হেরে যেতে বাধ্য।

 

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারত (India as a Secular State) :

 

 ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরােধ রয়েছে। যারা ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাদের মতে, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার যে-মানদণ্ডে রাষ্ট্রকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়, সেই মানদণ্ডে ভারত-রাষ্ট্রকে বিচার-বিশ্লেষণ করা আদৌ সমীচীন নয়। একটি বিশেষ আৰ্থে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় বলে তারা মনে করে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডি, ই, স্মিথ  বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হােল এমন একটি রাষ্ট্র, যা ব্যক্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করে, যা ধর্মীয় মতামত নির্বিশেষে সব ব্যক্তিকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করে এবং যা সাংবিধানিকভাবে বিশেষ কোন ধর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে না কিংবা বিশেষ কোন ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা বা বিরােধিতা করে না।

 

গণ-পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণ করে অনন্তসায়ন আয়েঙ্গার  বলেছিলেন, “আমরা রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে কী বােঝায়, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ বলতে একথা বলতে চাচ্ছি না যে, কোনও ধর্মের প্রতি আমাদের বিশ্বাস নেই এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটির অর্থ হােল রাষ্ট্র কোনও বিশেষ ধর্মকে সাহায্য করবে না কিংবা এক ধর্ম অপেক্ষা অন্য ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না।” বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন -এর মতে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে অধার্মিক, ধর্ম-বিরােধী কিংবা ধর্ম বিষয়ে উদাসীন রাষ্ট্রকে বােঝায় না। 

 কে. এম. পানিক্কার বলেছে, ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ফলে ভারত রাষ্ট্র অধার্মিক হয়ে যায়নি। এর ধর্মনিরপেক্ষতা এক অর্থে নেতিবাচক। কারণ, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ-সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা ধর্মীয় বিচার-বিবেচনাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং ভারতে বসবাসকারী সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতি সমভাব প্রদর্শন করে। এইচ. ভি. কামাথ -এর মতে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেমন ঈশ্বরহীন রাষ্ট্র হবে না, তেমনি তা অধার্মিক কিংবা ধর্মবিরােধীও হবে না। গণ-পরিষদে বিতর্কের সময় পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মিশ্র -ও অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রদত্ত একটি রায়ে সুপ্রীম কোর্ট এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, ভারতের সংবিধান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে। ভারত-রাষ্ট্রের কোনও বিধিসম্মত ধর্ম নেই।

  প্রতিটি নাগরিক তার পছন্দমতাে যে-কোন ধর্মকে ঘােষণা করার, চর্চা ও প্রচার করার পূর্ণ সুযােগ ও নিরাপত্তার দাবি রাখে। এই সংবিধান কেবল ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতারই দায়িত্ব নেয় ; যার ধর্ম নেই তার স্বাধীনতাকেও নিরাপত্তা যােগায়। এই সংবিধান ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা থেকে রাষ্ট্রকে যথার্থই নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মের বিচার না করে ভারতে প্রতিটি মানুষকে একটি নাগরিকত্বের অধিকার প্রদান করা হয়। সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিরা তাদের পূর্বোক্ত রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামাে’ (basic structure)র অন্তর্ভুক্ত বলে ঘােষণাও করেছিলেন।

  অনুরূপভাবে, জিয়াউদ্দীন বুখারি বনাম ব্রিজমােহন রামদাস মেহেরা ও অন্যান্য মামলায় রায় দিতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন বিচারপতি এম. এইচ. বেগ মন্তব্য করেছিলেন যে, সর্বপ্রকার ধর্মীয় পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নাগরিকদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণ নির্বিশেষে সকলের কল্যাণসাধনের চেষ্টা করবে। সব তীতের ও সব ধর্মের নাগরিকদের সুযােগ-সুবিধা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন ভূমিকা পালন করবে।

 

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বিষয়ে সংবিধানের নীরবতা:

 

 ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধানের সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করা হবে কিনা তা নিয়ে গণপরিষদের তুমুল বিতর্ক হয়েছিল । আয়েঙ্গার, কামাথ, পানিক্কার মিশ্র প্রমুখের জোরালাে দাবি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা ফলবতী হয়নি। এমনকি, অধ্যাপক কে. টি. শাহ  ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে দেশের মৌলিক আইন অর্থাৎ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দু’বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি সংবিধানের মধ্যে একটি নতুন ধারা সংযােজন করতে চেয়েছিলেন। প্রস্তাবিত এই ধারায় বলা হয়েছিল যে, ভারতে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় কোন ধর্ম, ধর্মীয় বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত বৃত্তির সঙ্গে তা কোনভাবেই যুক্ত থাকবে না। কিন্তু খসড়া কমিটির সভাপতি বি. আর. আম্বেদকর তার এই প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। 

 কারণ, সংবিধানের প্রস্তাবনায় চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার ক্ষেত্রে সকলকে স্বাধীনতা দানের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, সংবিধানের তৃতীয় অংশে মৌলিক অধিকার হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার এবং সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক অধিকার প্রদান করার ফলে ভারত-রাষ্ট্র কার্যতঃ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই পৃথকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার তিনি চরম বিরােধী ছিলেন। এর পর ১৯৭৬ সালে ৪২-তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি সংযােজন করা হয়। ভারতে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার বিপদ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বিশেষভাবে বিচলিত করেছিল। তাই তিনি সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনার এরূপ পরিবর্তন সাধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। 

 ১৯৭৬ সালের ১৬ই অক্টোবর নতুন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সংবিধান সংশােধন-বিষয়ক কনভেনশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া মন্তব্য করেছিলেন যে, সব ধর্মের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র বৃহৎ সব সম্প্রদায়ের সমান মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় রাষ্ট্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং বলা যায়, ভারতের মূল সংবিধানের কোথাও ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে বর্ণনা না করা হলেও ৪২-তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে তা করা হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বােঝায়, তা বলা হয়নি। ফলে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং হিন্দু মৌলবাদীরা নিজেদের ইচ্ছামতাে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির ব্যাখ্যা প্রদান করতে শুরু করে। 

 আবার, রাজনৈতিক মত দখলের লড়াই-এ লিপ্ত দলগুলি (বামপন্থীরা বাদে) সংবিধানে লিপিবদ্ধ সাতটি অক্ষর সমন্বিত এই শব্দটির প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রয়ােজনীয়তা আছে বলে মনে করে না। ফলে একদিকে যেমন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের (৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২) কলঙ্কময় ঘটনা ঘটেছে, অন্যদিকে তেমনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা চরম আকার ধারণ করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা প্রয়ােগ করে উত্তরপ্রদেশের প্রথম বি.জে.পি.-পরিচালিত সরকারের পতন ঘটায়। পরবর্তী সময়ে এস. আর. বেম্মাই বনাম ভারত ইউনিয়ন মামলায় সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৯৪ সালের ১১ই মার্চ এই রায় দেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা হােল ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং তা অঙ্গনীয়।

  মহামান্য বিচারপতিরা উত্তরপ্রদেশ সরকারের বরখাস্তকরণকে এই যুক্তিতে যথার্থ বলে মেনে নিয়েছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট সরকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস বা অন্তর্ঘাত করতে চেয়েছিল। এইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শকে মহামান্য আদালত উর্ধ্বে তুলে ধরলেও ধর্মনিরপেক্ষতা এখনও পূর্বের মতােই বিভ্রান্তিকর একটি শব্দ হিসেবে থেকে গেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে গড়ে তােলার পেছনে মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অবদান অবিস্মরণীয়। গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হােল সর্বধর্ম সমভাব। তিনি সব ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে মনে করতেন যে, রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা যেমন করবে , তেমনি আবার কোন ধর্মের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে। লয়েড রুডলফ  তার কালচারাল পলিসি অব ইন্ডিয়া  নামক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, মহাত্মা গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি ছিল সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সত্যের অনুসরণকারী ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববােধের অঙ্গীকার। ধর্মবিশ্বাসকে গান্ধী একান্তভাবে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করতেন। রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে গান্ধীর বক্তব্য হােল রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। 

 যতক্ষণ নাগরিকরা দেশের সাধারণ আইন মেনে চলবে, ততক্ষণ তাদের প্রত্যেকেই বিনা বাধায় প্রকাশ্যে নিজ নিজ ধর্ম অনুসরণ করতে পারবে। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের স্বতন্ত্রীকরণের দূরত্ব নির্ধারণ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “আমি যদি একজন একনায়ক হতাম, তাহলে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক করে দিতাম। আমি আমার ধর্মের নামে শপথ নিতাম এবং ধর্মের জন্য মৃত্যুবরণও করতাম। কিন্তু এটি হােল আমার ব্যক্তিগত বিষয়। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনও সম্পর্ক নেই।…রাষ্ট্র আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হবে, কিন্তু আপনার বা আমার ধর্মরক্ষার ব্যাপারে নয়।” সুতরাং গান্ধী ব্যক্তির ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্যের যতখানি সম্ভব ততখানি দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ধর্মকে মানব সমাজের পরিবর্তন ও অগ্রগতির একটি প্রতিবন্ধক (a hindrance) বলে মনে করতেন। কারণ, তাঁর মতে, অতিপ্রাকৃত এজেন্সীগুলির প্রতি বিশ্বাস সামাজিক ক্ষেত্রে এক ধরনের দায়িত্বহীনতার জন্ম দেয়। তবে তিনি ধর্ম নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন না। 

 কারণ, তিনি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, বাস্তবের স্পর্শে এসে তা একদিন আপনাআপনিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে । কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই উপমহাদেশের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নিতে পারেনি। তাই তাকে কিছুটা পিছু হঠতে হয়েছিল। তবে এই ঘটনাকে নেহরুর পরাজয় বললে ভুল হবে। অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে মৃত্যুর তিন বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬১ সালে তিনি লিখেছিলেন, “আমরা ভারতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলি। কেউ কেউ মনে করেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্মের বিরােধিতা করাকে বােঝায়। কিন্তু এই মত যথার্থ নয়।.ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হল এমন একটি রাষ্ট্র, যা সব ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সমভাবেই শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের সমান সুযােগ-সুবিধা প্রদান করে। এরূপ রাষ্ট্র বিশেষ কোন ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে না। সুতরাং বলা হয়, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হােল ধর্মীয় সহনশীলতা।

 

উপরি-উক্ত আলােচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ভারত একটি নীতি’ | হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে যতটা গ্রহণ করেছে একটি মতাদর্শ  হিসেবে ততটা নয়। টি, এন, মদনকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে, ভারতের মতাে একটি বহুধর্মীয় সমাজে আধুনিক রাষ্ট্রের একটি নীতি বা কৌশল  হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো সরকার কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব করবে না। অন্যভাবে বলা যায়, সব ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে রাষ্ট্র  সমদূরত্ব বজায় রাখবে। অপরদিকে মতাদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এমন একটি মতাদর্শকে বােঝায়, যার প্রবক্তারা সচেতনভাবে সর্বপ্রকার অতিন্দ্রীয়তা ও তার এজেন্সীগুলির নিন্দা করে এবং অধর্মীয় বা ধর্ম-বিরােধী নীতিসমূহকে ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও সামাজিক সংগঠনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। ভারত এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেনি। তাই অধ্যাপক রণধীর সিং  ফাইভ লেকচার্স অন মার্কসিস্ট মােড’  নামক গ্রন্থে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদৌ ধর্মনিরপেক্ষতা বলে মেনে নিতে রাজী নন।*

 

স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা

 

স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস চেষ্টা করলেও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠনের কাজে ঐকান্তিকভাবে আত্মনিয়ােগ করেনি। বরং বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ধর্মকে হাতিয়ার করে নির্বাচন-বৈতরণী অতিক্রম করার চেষ্টা স্বাধীন ভারতে করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৪৮ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার উপনির্বাচনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সমাজবাদী নেতা আচার্য নরেন্দ্র দেবকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা অসম্ভব বুঝতে পেরে কংগ্রেস ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

  রামচন্দ্রের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত অযােধ্যা ও তার সংলগ্ন ফৈজাবাদের মানুষ ধর্মীয় কারণে রামচন্দ্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের সেই ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব প্রায় গান্ধীর মতাে দেখতে বাবা রাঘবদাস নামে জনৈক ব্যক্তিকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন। শহরের দেওয়ালগুলি যেসব পােস্টারে ভরে গিয়েছিল, সেগুলিতে দেখানাে হয়েছিল যে, গান্ধীর স্টাইলে রাঘবদাস অযােধ্যায় প্রবেশ করছে এবং রামভক্ত হনুমান হাত জোড় করে তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। অনেকের কাছে গান্ধী হলেন ঈশ্বর-প্রেরিত দূত। তার রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্লোগানকে কলিযুগের অবসান ও সত্যযুগের সূচনা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রচার করা হয়। এইভাবে ধর্মপ্রাণ হিন্দু ভােটদাতাদের প্রভাবিত করার ফলে

রাঘবদাস বিপুল ভােটে জয়লাভ করেছিলেন।

 

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য

 

উপরি-উক্ত আলােচনার ভিত্তিতে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের  কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

  এগুলি হােল ঃ [i] ধর্মীয় বা ধর্ম-প্রতিম রাষ্ট্রের ধারণা বর্জন করে ভারতে একটি ধর্মীয় ভিত্তিহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [i] এখানে ধর্ম হােল একান্তভাবেই ব্যক্তিগত বা গােষ্ঠীগত বিষয়। তাই ধর্মের ভিত্তিতে ভারতে কোনরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করতে রাষ্ট্রকে দেখা যায় না। [iii] নাগরিকদের বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্ম-স্বীকার, ধর্ম-পালন ও ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা রয়েছে। সাধারণভাবে রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় বিষয়ের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারলেও জনশৃঙ্খলা, সমাজের স্বীকৃত নীতিবােধ, জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের প্রয়ােজনে রাষ্ট্র এই অধিকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে পারে। [iv] ভারতে ধর্ম কিংবা জাতপাত-নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমানাধিকার স্বীকৃতি লাভ করেছে। [v] এখানে সর্বধর্ম সমভাব’অর্থাৎ সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নীতি গৃহীত হয়েছে। [vi] ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাদি সংবিধান গ্রহণ করেছে। [vii] সংবিধানে

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলার ফলে ভারতে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের আদর্শ গৃহীত হয়েছে। জনকল্যাণকর ধারণাটি প্রকৃতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। বলা বাহুল্য, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি গান্ধীবাদী ও নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার সমন্বয় সাধনের ফলমাত্র।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *