পোস্টমাস্টার গল্পের প্রশ্ন উত্তর বাংলা টেকজ সঞ্জীব
পোস্টমাস্টার গল্পের প্রশ্ন উত্তর বাংলা টেকজ সঞ্জীব
পোস্টমাস্টার গল্পের প্রশ্ন উত্তর
এখানে পোস্টমাস্টার গল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর আলোচনা করা হয়েছে
পোস্টমাস্টার’ গল্পের মূল আকর্ষণ কোথায়
প্রশ্ন । পােস্টামাস্টার’ গল্পে পােস্টমাস্টারের সাথে গ্রাম্য বালিকা রতনের কীভাবে কেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার বষরণ দাও।
উত্তর : উলাপুর গ্রামের পােস্ট অফিসে নতুন পােস্টামাস্টার এলেন কলকাতা থেকে। গণ্ডগ্রামে অপরিচিত পরিবেশে তিনি অস্বস্তি বােধ করতে লাগলেন। এই সময়ে গ্রামেরই এক পিতৃমাতৃহীনা বারাে-তেরাে বছরের এক অনাথা বালিকা চারটি খেতে পাওয়ার পরিবতে তাঁর কাজকর্ম করে দিত। তার নাম রতন।
রতন বাবুর খুবই অনুগত ছিল। একদিন পােস্টমাস্টার রতনকে তাঁর মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। রতন তার মা, বাবা, ছােটোভাই সকলের কথা জানালাে গভীর দুঃখে। কারণ তার আর কেউ নেই। পােস্টমাস্টার রতনের সব কাহিনী শুনলেন। আর একদিন সন্ধ্যাবেলা পােস্টমাস্টার তাঁর ছােটোভাই, মা, দিদির কথা, প্রবাসে যাদের সততই মনে পড়ে, এই গ্রাম্য বালিকার কাছে তা অসংকোচে বললেন। আগ্রহে তাদের কাহিনী শুনে তাদের সঙ্গে এক কাল্পনিক মা-দাদা-দিদি সম্পর্ক গড়ে তুলতাে।
একদিন বষাকালে মেঘমুক্ত মধ্যাহ্নে পল্লীপ্রবাসী সামান্য বেতনের পােস্টমাস্টারের মনে এক ভাবের উদয় হলাে ; তিনি রতনকে ডেকে বললেন তাকে তিনি লেখা পড়া শেখাবেন। রতনও রাজি হল। পড়াশুনাও শুরু হল। একদিন বর্ষার সকালে রতন বইপত্তর নিয়ে পােস্টমাস্টারের ঘরে এসে দেখলাে তাঁর শরীর বেশ অসুস্থ। রতন স্নেহময়ী নারীরপে জননী ও দিদির মতাে সেবা শুশ্রষায় পােস্ট মাস্টারকে সুস্থ করে তুললাে। কিন্তু পােস্টমাস্টার আর এই গণ্ডগ্রামে নােংরা পরিবেশে চাকুরী করতে রাজী হলেন না। বদলির জন্যে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন।
আবেদন নামঞ্জুর হ’লে পােস্টমাস্টার চাকুরী ছেড়ে দিলেন। রতন পােস্টমাস্টারের সঙ্গে তাঁর বাড়ি যেতে চাইলাে। পােস্টমাস্টার রাজি হলেন না, বরং তাঁর স্থলে—যে নতুনবাব আসবেন, তাঁর কাছে রতনের থাকার ব্যবস্থা করে যাওয়ার আশ্বাস দিলেন। রতন কেদে উঠল এবং উচ্ছসিত কণ্ঠে ঐ প্রস্তাবের প্রতিবাদ করল। পােস্টমাস্টার যথা-নির্দিষ্ট দিনে গ্রাম ছেড়ে কলকাতার পথে রওনা হলেন। যে প্রীতিপণ মধুর সম্পর্ক রতনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তা ছিন্ন করে যেতে পােস্টমাস্টারের খুবই কষ্ট হলাে। তিনি রতনকে তাঁর বিদায়কালে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রতন তা গ্রহণ করে নি এবং আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না’-বলে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।
বালিকার এই নিঃস্বার্থ সেবার কথা পােস্টমাস্টারের মনে বার বার জেগে উঠল। নদীপথে নৌকায় বসে পোেস্ট মাস্টার রতনের জন্যে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করতে লাগলেন ; একটা সামান্য গ্রাম্য বালিকার করণে মুখচ্ছবি যেন বিশ্বব্যাপী এক অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করতে লাগলাে। বিরহী পােস্টমাস্টারের উদাস হৃদয়ে এক তত্ত্বের উদয় হলাে—“জীবনে এমন কত -বিচ্ছেদ ; কত মত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পথিবীতে কে কাহার!”
পােস্টমাস্টার গল্পে তিনটি চরিত্র
প্রশ্ন ।। পােস্টমাস্টার গল্পে তিনটি চরিত্র পােস্টমাস্টার, রতন এবং প্রকৃতি। এই তিন চরিত্রের স্বরূপ পরিস্ফুট কর।
উত্তর : ‘পপাস্টমাস্টার’ গল্পে কাহিনী সামান্য। কলকাতার ছেলে গ্রামে পােস্টমাস্টার হয়ে এসেছে। গল্পের নায়ক তিনিই। গ্রাম্য পরিবেশের সঙ্গে সম্ভবত তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। অফিসের কাজ সামান্য—অবশিষ্ট সময় কাটে কি করে ? নিজের রাস্তা নিজেই করে নেন—অল্প বেতন, তাই এ-ছাড়া উপায়ই বা কি ? অবশ্য এতে তাঁর কিছুটা সময় কাটে। কলকাতার ছেলেরা নদীতে স্নান করতে যেতে বােধ হয় সাহসই পায় না। রতন নদী থেকে জল এনে দেয়, সেই তােলা জলেই সে স্নান করে। ভালাে করে অপরিচিতের সঙ্গে সে আলাপ করতে পারে না। তাই অবসর সময়ে তাঁর বাইরে যাবার প্রয়োজন হয় না।
শহরের ছেলের সঙ্গে গ্রামের মানুষের যােগাযােগ স্থাপিত না হলেও গ্রাম্য প্রকৃতির প্রভাব তিনি এড়াতে পারেন নি। রােমান্টিক পরিবেশে তাঁকে দিয়ে দু’চারটে কবিতাও লিখিয়ে নিয়েছেন। কবিতার ভঙ্গী দিয়েই তিনি সকলের মন ভােলাতে চেয়েছিলেন। অট্টালিকার পর অট্টালিকা এবং পাকা পাকা রাস্তার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও পল্লীর প্রশংসায় রচিত হয়েছে তাঁর কবিতা।
প্রকৃতির প্রভাব মানুষের থেকেও অধিক ঃ সন্ধ্যার সময় যখন ঝােপে ঝােপে ঝিল্লি ডাকত, তখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসে গাছের কম্পন দেখে এই তথাকথিত পল্লী প্রেমিক কবিরও হৃৎকম্প উপস্থিত হতাে। এই প্রকৃতির ইঙ্গিত ভবিষ্যতে পােস্টমাস্টারকে একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল।
অন্ধকার গাছের কম্পনে অতিপ্রাকৃতের কল্পনা জাগিয়ে তুলতাে তাঁর মনে। তখন সঙ্গীর প্রয়ােজন হতাে, তিনি রতনকে ডেকে তামাক সেজে দিতে বলতেনশ প্রকৃতি একদিকে হৃৎকম্প জাগায়, অন্যদিকে রােমান্টিক করে তোলে। তাই রতনের জীবনইতিহাস জানতে চান তিনি। রতনের কাহিনী শুনতে শুনতে অনেক সময় অধিক রাত হয়ে গেলে আর তাঁর কাজের ইচ্ছা থাকতাে না। বিদেশে একক জীবনে রতনের কাহিনী তাঁর নিজের ওপর নিশ্চিতরূপে প্রভাব বিস্তার করতাে। নিশ্চয়ই মনে পড়তো মায়ের কথা, দিদির কথা, ভাইয়ের কথা। ভাবের আবেগে তিনিও নিজ গহের কথা, মা, দিদি, ভাইয়ের কথা শুনাতেন এই ক্ষুদ্র বালিকাকে। আবেগ প্রবণ, ইচ্ছক চিত্ত কোনাে ব্যক্তি ব্যতীত আর কারও নিকটে তাে একথা বলা চলে না। পােস্টমাস্টার রতনের মধ্যে সেই আবেগ লক্ষ্য করেছিলেন। নিজের মনের আবেগ দিয়ে রতনের মনের আবেগকে স্পষ্ট করে তিনি অনেক স্বস্তি পেতেন।
প্রকৃতির নিন্ধ শােভা পােস্টমাস্টারকে বিস্মৃতির অতলে টেনে নিয়ে যেত। তিনি যে পােস্টমাস্টার সে কথাটিই হয়তাে তিনি ভুলে যেতেন—প্রকৃতির কাছে একটি
ভাইকে নিয়ে আনন্দে সে কত না খেলেছে ! পােস্টমাস্টারের কপায় সে জেগে উঠেছে বুঝেছে যে সেও মানুষ।
– পাখীর করুণ অভিযােগ তাঁর মনেও অভিযোেগ জাগিয়ে তুলতাে—এই সময়ে কাছে একটি কেহ নিতান্ত আপনার লােক থাকিত—হৃদয়ের সহিত একান্তসংলগ্ন একটি স্নেহপলি মানবমতি। প্রতি তাঁকে যেন টেনে নিয়ে চলছিল এক বিশেষ দিকে। পাখীর কমণ ঘরে, গলব-মম’রে তিনি নিজ চিত্তেরই প্রকাশ দেখলেন। প্রতি যেন মানব,তি ধারণ করে তর্জনী নির্দেশে তাঁকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। ছুটির দিনে প্রায়ই তার মনে প্রকৃতির বাণী এসে পৌছায়।
একতি, বিশেষ করে ছুটির দিনে তাঁর মনকে ঘরের দিকে ফিরিয়ে দেয়। তাই অবসর সময় তিনি নতুন কাজ খুজে নিলেন—রতনকে একটু একটু করে পড়ালেন। কিছুদিনের মধ্যে যুক্তাক্ষরও আয়ত্ত করে নিল রতন।
বর্ষাকালে গােস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রােগ তাঁর চেতন মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তাই তাঁর অবচেতন মনে যে কথাগুলাে ছিল তা আত্মপ্রকাশ কলা। তিনি যে বদলির দরখাস্ত করেছিলেন এবং তা না-মঞ্জর হয়েছে সে কথা তিনি পবে প্রকাশ করেন নি। চাকরী ছেড়ে যাবার কথাও তাঁর মনে আসেনি। প্রকতির প্রভাব, বক্ষর মম’র ধনি, আবার পাখীর করণ অভিযােগ তাঁকে ঘর মুখাে করে তুলেছিল রােগ। তাঁকে শেষ সিদ্ধান্তেই চাকুরী ছেড়েই তিনি চলে যাবেন, আর বানে ফিরবে না।
সঙ্গে যাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল রতন। এই আকাক্ষা নিতান্ত অবাভাবিক মনে হয়েছিল তাঁর। তিনি হেসেছিলেন কথাটা শুনে, বলেছিলেন, সে কী করে হবে। বাড়ী যাবার তাড়ায় তখন তিনি আবেগহীন। নৌকায় উঠে কিন্তু তাঁর আবেগ জেগে উঠেছিল, মনে পড়ছিল বালিকার করুণ মুখখানা। মানুষের মনোভাবের কত না পরিবর্তন ঘটে। মানুষ নিজেকে চিনতে পারে না-পােস্টমাস্টারও নিজেকে চিনতে পারেন নি এখানে।
পোস্টমাস্টার গল্পের রতনের চরিত্র বিশ্লেষণ
রতন বারাে-তেরাে বৎসরের অনাথিনী বালিকা। পােস্টমাস্টারের যাবতীয় কাজ করে দেয়; ঠিক সময়ে পায় দু’বেলা আহার। তার মন ছিল সম্পূর্ণ মত, দাবীও শেব কিছ, তার ছিল না। লেখক জানিয়েছেন, ‘বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা বর ন্য। লেখকের একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। বনের মনে একথা কোনদিনও জাগে নি।
কারণ প্রকৃতি বহিরাগত পােস্টমাস্টারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাঁকে চাকুরী ছেড়ে গহে কিরে বাবার সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল বটে, কিন্তু গ্রামের মেয়ে রতনের ওপর তেমন কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। রতনের মনকে জাগিয়ে তুলেছিলেন পোস্টমাস্টার বরং। তিনি তাকে পড়াতে আরম্ভ করলেন। তার জীবনের কাহিনী শুনতে চাইলেন এবং নিজের বাড়ীর কথা তাকে শােনালেন। কাজের মেয়ে উন্নীত হরেছে বঢ়ের মেরেতে। যে আত্মসচেতন ছিলনা সে তার বাল্যকালের কথা স্মরণ রেছে : তারও মা ছিল, পিতার সঙ্গে বিশেষ স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক ছিল—ছােট ভাইকে নিয়ে আনন্দে সে কত না খেলেছে ! পােস্টমাস্টারের কপায় সে জেগে উঠেছে বুঝেছে যে সেও মানুষ।
পােস্টমাস্টারও তাঁর গহের কথা বহুদিন শুনিয়েছে রতনকে। রতন যেমন মানুষ হয়ে ওঠেনি, হয়েছে পােস্টমাস্টারের আত্মীয়—তাঁর মা তাঁরও মা, তার দিদি তারও দিদি, তাঁর ছােট ভাইও তার দাদা। পপাস্টমাস্টার মুখােমুখী হয়েছিলেন প্রকৃতির, রতনও একেবারে পােস্টমাস্টারের মুখােমুখি হয়েছে।
তারপরেই পােস্টমাস্টার হলেন অসুস্থ। রােগশয্যায় শাঁখাপরা কোমল হাতের সেবা পেতে ইচ্ছা করে পােস্টমাস্টারের মনেও সেই ইচ্ছে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, রতন তাে আর নিছক কাজের মেয়ে নয়, পােস্টমাস্টারের আত্মীয় জনের মধ্য একজন বলে সে নিজেকে মনে করেছিল। পােস্টমাস্টারের ইচ্ছা আপণ রইলাে না। বালিকা রতন আর বালিকা রইলাে না—সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করে বসলাে। বৈদ্য ডাকল, ওষধ খাওয়াল এবং সারারাত্রি শিয়রে বসে কাটাল। মনে মনে সে দাদাবাবর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে উঠলাে।
রােগ-শয্যা থেকে উঠে পােস্টমাস্টার জানালেন যে, তিনি বাড়ী চলে যাবেন, আর ফিরবেন না। রতনের মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগলাে। যিনি আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি চিরতরে চলে যাবেন। সে নিজেকে দাদাবাবর আত্মীয় মনে করে, তারই জোরে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলাে, আমাকে তােমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে? তার আশা ছিল যে, দাদাবাব, তাকে আত্মীয় রূপেই গ্রহণ করবেন। কিন্তু পােস্টমাস্টার জানালেন যে, সে কী করে হবে। স্বর্গলােক থেকে পতন হলাে রতনের। বুঝল যে, দাদাবাব, তাকে কাজের লােক ছাড়া অন্য কিছু মনে করেন না। সে কী করে হবে’ কথাটা বালিকাকে পাগল করে তুললাে। পােস্টমাস্টার বন আর নাই বুঝন—বালিকা এখন আর তুচ্ছ কাজের মেয়ে নয়। সে পেপাস্টমাস্টারের দেওয়া অর্থ গ্রহণে অস্বীকার করলাে, পরবর্তী পােস্টমাস্টারের কাজে বহাল হতেও আর চাইল । বালিকা একেবারে প্রৌঢ়ত্বে পৌছে গেছে—তার মন জেগে উঠেছে পর্ণ দীপ্তিতে তার জন্যে কাউকে আর ভাবতে হবে না।
সে জেগে ওঠার বিপদ এখানেই। যে-কোনাে একজন পােস্টমাস্টারের কাছে আর সে থাকতে পারে না। পােস্ট-অফিসটা প্রদক্ষিণ করে সে কেবলই অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলাে। এই পোেস্ট-অফিস যেন তার কাছে মন্দির—ওখানকার দেবতা তার মনকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে কিন্তু সে জাগরণ দেবতার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। অতএব, এই ছােট গল্পে একটি বালিকার চিত্ত-জাগরণের চিত্র বড় সুন্দর করে একেছেন রবীন্দ্রনাথ।
পোস্টমাস্টার গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
পোস্টমাস্টার গল্পের প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন । পােস্টমাস্টার গল্পের কাঠামাে গঠনে রবীন্দ্রনাথেয় কৃতিত্ব বিশদ আলােচনা কর।
অথবা, ছােটগল্প হিসাবে পােষ্টমাষ্টার গল্পের সার্থকতা বিচার কর। উত্তর : ‘দেনাপাওনা’ গল্পটিতে বহ, চরিত্রের সমাবেশ ঘটানাে হয়েছে কিন্তু মাত্র তিনটি চরিত্র ছাড়া আর কাউকেই সামান্যতম প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। গল্পটি নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা করা যেত। কিন্তু পােস্টমাস্টার’ গল্পে চরিত্র মাত্র দুটির মধ্যে একটি নতমুখী, কাজের মধ্যেই যে আত্মগােপন করেছিল ? অন্যজনও যে বিশেষ সক্রিয় তাও নয়। কিন্তু এই গল্পে আর একটি চরিত্র আছে— যার বিশেষ প্রভাব পড়েছে সমগ্র কাহিনীতে—সে চরিত্র প্রকৃতি। এখানেও রবীন্দ্রনাথ গপের আরম্ভ থেকেই পাঠকদের গল্পের মধ্যে টেনে নিয়ে
গেছেন। কিন্তু গল্পের উপসংহারে একটি তত্তৰ শুনিয়েছে। সাধারণতঃ উপসংহারে একটু নাটকীয়তা থাকে—এ গল্পে তা নেই। নাটকীয়তা সষ্টি করা হয়েছে গল্পের প্রায় শেষের দিকে। পােস্টমাস্টার আকস্মিকভাবে জানালেন যে তিনি চলে যাচ্ছেন। তিনি যে বদলির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন সে কথা কেউ জানত না। সামান্য অসুখের পর একলা বিদেশে তাঁর চিত্তে যে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল তাই কথাটাকে যেন ঠেলে বের করে দিয়েছিল। বড়দের সেবায় পােস্টমাস্টারকে বেশী করে মায়ের কথা, দিদির কথা মনে করিয়েছে। রতন যে তাঁর চিত্তকে স্পর্শ করতে পারে নি এ কথাটা স্পষ্ট হয়েছে। ছোটগল্পে মনস্তত্ব বিশ্লেষণের অবকাশ নেই। লেখক তা
বিশ্লেষণ করতে বসেননি। কিন্তু গল্পের বিষয়-বস্তুতে তা বিশ্লেষিত হয়েছে। রতন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘দাদাবাব, আমাকে তােমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে ? প্রত্যুত্তরে পােস্টমাস্টার হেসে বলেছিলেন, সে কী করে হবে। পােস্টমাস্টারের এই উত্তর খুবই স্বাভাবিক কিন্তু এটি তাঁর চেতন মনের কথা। তাঁর অবচেতন মনে রতনের কি কোনাে স্থানই ছিল না ? নৌকায় উঠে তাঁর অবচেতন মন অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করে, মনে হয়—হৃদয়ের মধ্যে অনন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন—একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করণে মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। এই প্রকৃতির প্রভাব পােস্টমাস্টারের অন্তরের গভীর থেকে তাঁর মনকে উদঘাটিত করেছিল। তাই পােস্টমাস্টারের, একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি। কিন্তু নদীর স্রোতের টান এবং পালে বাতাসের টান সেই ইচ্ছাকে ফলবতী হতে দেয় নি। প্রকৃতিই পােস্টমাস্টারের মনের আকাঙ্ক্ষাকে ফলপ্রসূ হতে দেয় নি এবং তাঁর আকাঙ্ক্ষা সফল করার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। প্রকৃতি এখানে প্রাণবন্ত এবং তার প্রভাব ক্ষুদ্রতর থেকে প্রসারিত হয় বিশ্বের সবদিকে। এই গল্পেও প্রকৃতি সামান্য একটি অনাথিনী বালিকাকে এবং ক্ষুদ্র একটি পােষ্টমাষ্টারকে বিবের পটভূমিতে তুলে অপরপ মহিমায় পণ করে দিয়েছে। ।
এই গল্পে কাহিনী সামান্য কিন্তু মনােবিশ্লেষণ হয়েছে ব্যঞ্জনাময়, তার জন্যও লেখককে অনেক কথা বলতে হয়নি—প্রকৃতির একটি চিত্র এ’কেও অনেক সময় সেকাজ তিনি সেরেছেন অতি সুন্দরভাবে।
পোস্টমাস্টার গল্প
এই গল্পের কয়েকটি মুহত অনন্ত মহত হয়ে উঠেছে। একটি সম্পণ অনাত্মীয় অনাথিনী গ্রাম্য বালিকা কিসের জোরে বলে বসলাে, আমাকে তােমাদের বাড়ী নিয়ে যাবে? কেবল রতনের ক্ষেত্রেই নয়—বিশ্বব্যাপী সমস্ত রতনদেরই এই আকাঙ্ক্ষা। একটি রতনকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিলেন । মনে হয় যেন এই কথাটা বয়ে চলেছে সমস্ত বায়; মণ্ডলের ওপর দিয়ে সর্বত্রই স্নেহ আশ্রয় প্রার্থী। রতনের আবেদনটি চিরকালীন আবেদন হয়েই রইলাে। চিরকালীন হয়ে রইলাে পােস্টমাস্টারের ইচ্ছাটাও। মানুষের মধ্যে কোথাও এমন মানুষ আছে যে, স্নেহে আশ্রয় দিতে চায়। সেই সত্যকেও রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন এই গল্পের মাধ্যমে। গাপটি ট্রাজিক গল্পের উপসংহারে নাটকীয়তা না থাকলেও পাঠক চিত্ত বিশ্রাম পাবে না। গল্প শেষ হওয়ার পর তাদের দুটি আর থাকে না পােস্টমাস্টারে দিকে।
তারা সন্ধান করে ফিরছে রতনকে। সে কি অভাবের তাড়নায় নতন পােস্টমাস্টারের শরণাপন্ন হবে! না, স্নেহের টানে সকল কিছু ছেড়ে ভেসে বেড়াবে?