কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর টেকজ সঞ্জীব
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর টেকজ সঞ্জীব
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর
মনুষ্য ফল
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এখানে কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর আলোচনা করা হয়েছে।
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল বিষয়বস্তু
আফিম একটু বেশি মাত্রায় সেবন করলেই কমলাকান্ত চক্রবর্তী দিব্য দৃষ্টিতে পথিবীর সব মানুষই ফল’ বলে মনে হয়। মনে হয়, মানুষের আকৃতি, প্রকৃতি, প্রয়ােজনীয়তা এবং পরিণাম ফলের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। পেশাগত বা প্রকৃতিগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ফলের সঙ্গে তুলনীয়।
ধনী ব্যক্তিরা ঐ সংসারে কাঁঠাল শ্রেণীতে গণ্য। কেউ অকালপক্ক, কেউ অকর্মণ্য কেউ বা কুসঙ্গে এচোড়েই পাকে, কতক কখনাে পাকে না। রসালো কাঁঠালের গন্ধে আকৃষ্ট হয় সংসারের শৃগালেরা—এরা হলেন দেওয়ান, নায়েব, গােমস্তা, মোসায়েব, আশীর্বাদক। এ ছাড়াও আছে রস প্রত্যাশী মাছির দল-কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা, মাতৃ-দায়গ্রস্ত, টুলো পণ্ডিত, সংবাদপত্রের সম্পাদক, পুস্তক-প্রণেতা ইত্যাদি।
সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মীরা কমলাকান্তের দষ্টিতে আমের সঙ্গে তুলনীয়। সাগরপার থেকে আম এসেছে এদেশে। সুদৃশ্য সুস্বাদ; আবার টক—নানা স্বাদেরই আছে। কাঁচা-মিঠে আমগুলিও পাকলে পানসে হয়। আবার কোনাে কোনো আম টক হলেও কেবল দেখতে সুন্দর বলে বেশি দামে বিক্রি হয়ে ক্রেতা ঠকায়। কমলাকান্তের এতে আম খাওৱাৰ সহজ পদ্ধতি হল সেলাম-রপ জল এবং খােশামােদ রপ বরফ। বেগে ঠাণ্ডা করে উদরস্থ করা।
প্রাচীন সিধান্ত নস্যাৎ করে কমলাকান্ত স্ত্রীজাতিকে সংসার বক্ষে নারকেলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অথাৎ লৌকিক কথায় স্ত্রীলােকদের কলাগাছের সাথে তুলনা কলেও তিনি তা মানতে রাজি নন। তাঁর যুক্তি স্ত্রীলোক কাঁদি কাঁদি ফলে না। কলা আর বীলােক উভল্পেই বানরের প্রিয়। তাছাড়া স্ত্রীজাতিকে মাকাল ফল বলেও মানতে রাজি নর কমলাকান্ত! গাছে নারকেল কাদি কাঁদি ফললেও ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ কাঁদি শুদ্ধ পাড়ে না। কুলীন ব্রাহ্মণরা অবশ্য বেশি নারকেল পাড়ার অপরাধে অপরাধী। গাছের নারকেলের মতাে সংসারের নারকেলরাও নানা বয়সে নানা রপে গুণে শােভিতা।
কমলাকান্তের ডাবই পছন্দ ; নবীন শ্যামল উজ্জ্বল কিশােরীর স্নিগ্ধ প্রণয়গ্রহণ করার আগে কমলাকান্তের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে সংসার শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিতে হবে। নারিকেলের যেমন বয়োভেদে নানা অবস্থা শ্রীলােকদেরও সেই অবস্থা। অতি শৈশবে উভয়েই স্নিগ্ধকর, তারপর ডাব এবং সবশেষ নারিকেল। স্ত্রীলোকের বেলায় কিশােরী, যুবতী এবং বয়স্কা গৃহিণীররুপে নারিকেলের সাদৃশ্য। নারিকেলের মধ্যম অবস্থা ডাবের জল ও শাঁসের মত্যেই উপাদেয় হচ্ছে যুবতী অবস্থা। তারাই সংসারে আনন্দ বর্ষণ করে, পরিতৃপ্তি দান করে। সবশেষের অবস্থা নারিকেলের সাথে বয়স্কা গৃহিণী অথাৎ স্ত্রীলােকের তুলনা করা চলে। তাই নারিকেলের চারটি সামগ্রী ও জল, শাঁস, মালা এবং ছােবড়ার মতাে স্ত্রীলােকের চার সামগ্রী। জল স্ত্রীলোকের স্নেহের সঙ্গে তুলনীয়।
মনুষ্য ফল সারাংশ
সংসার মরুভূমিতে মাতা স্ত্রী-কন্যারা স্নেহ-প্রেম-ভক্তি সমস্ত সন্তাপ দূর করে দেয়। নারিকেলের শাঁসকে স্ত্রীলােকের বুদ্ধি বলা হয়েছে যা কচি অবস্থায় দানা বাঁধে না কিত পরিণত সময়ে দাঁত বসানাে যায় না। একে বলে গৃহিণীপনা। নারিকেলের -মালা স্ত্রীলোকের বিদ্যা সব সময়ই খণ্ডিত এবং কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রায়শঃই মুল্যহীন। স্ত্রীলােকের রপ নারিকেলের ছােবড়ার সঙ্গে তুলনীয়। দুই বাহ্য অংশ, তাই বর্জনীয় ছােবড়া দিয়ে রশি প্রস্তুত হয়। তাতে জাহাজ বাঁধা যায়। এই রুজু, গলায় বেঁধে কেহ প্রাণত্যাগ করে নাই সত্য কিন্তু রমণীয় রূপরুজু গলায় বেঁধে অনেকেই প্রাণত্যাগ করেছে। কারণ সংসারে অনেকেই স্ত্রীলােকের রপের দড়িতে বাঁধা পড়েন। অন্য ফলের মত নারিকেল সহজে পাড়া যায় না। সেজন্য পায়ে দড়ি বেঁধে গাছে উঠতে হয়। সংসারের নারিকেলও মুক্ত পুরুষ কমলাকান্তের কাছে দুর্লভ এবং পরিত্যাজ্য।
দেশহিতৈষীগণ কমলাকান্তের কাছে গন্ধহীন কেবল দষ্টিনন্দন শিমুল ফুলের মত। বসন্তের সুখের দিনে তাদের প্রকাশ। গ্রীষ্মের সুচনাতেই ফল ফেটে গিয়ে তাদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকটিত করে।
অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ এ-সংসারের ধুতরা ফল। ফুলের সৌন্দর্য তেমন নেই কিন্ত বীজের মাদকতা বিদ্যার্থী এবং বঙ্গীয় লেখকদের মত্ত করে রাখে।
দেশী লেখককুল কমলাকান্তের কাছে কেবল অল্পগুণসম্পন্ন তেঁতুল বলে গণ্য। তেঁতুল-কাঠ সব সহজদাহ্য, বঙ্গীয় লেখকরাও সমালোচনার আগুনে পােড়েন ভাল ।
দেশী হাকিমেরা কমলাকান্তের দৃষ্টিতে অপদার্থ সক্রিয়তাহীন কুষ্মন্ড রপে উপমিত। কুমড়া দেশী ও বিলাতি দুই জাতের। বিলাত প্রত্যাগত না হলেও বিলাতী -হওয়া যায়। এমন হাকিম আজকাল দেখা যাচ্ছে।
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর
মনুষ্য ফল প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ।। মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে নারীজাতি সম্পর্কে যে ধারণা ব্যক্ত হয়েছে তার পরিচয় দাও।
– অথবা, নারিকেলের চারটি সামগ্রী—জল, শস্য, মালা আর ছােবড়া’লেখক এ মন্তব্যে যা বােঝাতে চান তা বর্ণনা কর।
উত্তর : সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র অফিমখোর কমলাকান্ত চক্রবর্তীর ছদ্মনামে বিভিন্ন শ্রেণীর মানব-চরিত্রের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর ফলের সঙ্গে ব্যঙ্গাত্মক তুলনা ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। চতুর্দিকের পরিচিত মানবসমাজে আমাদের জীবনযাপন, কার্যকলাপ, মানব-ধর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলি পর্যালােচনা করে নেশাখােরগ্রস্ত কমলাকান্তের দৃষ্টিতে বেশ কিছু ফলের সঙ্গে কোনাে শ্রেণীর মানুষের আকৃতি ও প্রকৃতিগত সাদৃশ্য খুঁজে তা বর্ণনার মাধ্যমে যেমন হাস্য ও ব্যঙ্গরস আপ্লুত হয়েছে তেমনি প্রকাশিত হয়েছে লেখকের বিশ্লেষণী সমাজসচেতনতা এবং বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি।
‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে নারী-জাতির আলোচনা রয়েছে প্রায় সিংহভাগ জুড়ে। প্রাথমিক আলােচনায় বড় মানুষদিগের কাঁটাল ফলের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন স্তরে তার ব্যাখ্যায় মানব-জাতির বিভিন্ন স্তরের বৃত্তিবান সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করে সবকালীন সমাজের প্রতি নিঠুর বাস্তব চিত্র রপায়িত হয়েছে। তারপরেই আম্রফল কি ভাবে স্বচ্ছন্দে খেতে হয় তার ব্যাখ্যা দিয়েই নারীজাতি প্রসঙ্গে বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে এক দীর্ঘ আলােচনা বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়।
নারী প্রসঙ্গ আলােচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের লঘু পরিহাস এবং স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে এবং বৈষ্ণব সাহিত্যে নারীকে কলাগাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে । সে তুলনা কলাবৌ-এর লজ্জাশীলতার প্রতি কটাক্ষ নয়—সে তুলনা বর্তুলাকার ও কলাগাছের মসৃণ শ্যামচিক্কন সৌন্দর্যের সঙ্গে রমণীর আদর্শ উরুদেশের সদৃশ্য সমতুল্য। বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্য সেই সব অতীত সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়ে নারিকেলের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে রমণীজাতির সাদৃশ্যের কথা ঘোষণা করেছেন। –
নারিকেলের চারটি সামগ্রী—জল, শাঁস, মালা ও ছােবড়া ; এগুলিকে যথাক্রমে তুলনা করা হয়েছে স্ত্রীলােকের স্নেহ, বুদ্ধি, বিদ্যা ও রূপের সঙ্গে। প্রথমেই ধরা যাক নারিকেলের জল আর স্ত্রীলোকের স্নেহ—উভয়ই বড় স্নিগ্ধকর। কারণ কোনাে ব্যক্তি সংসারের চাপে ক্লান্তি বােধে গৃহে বিশ্রাম করার সময় সেই শীতল জল পান করলে সকল যন্ত্রণা দূর হয়। ঠিক সে-রকম ভাবেই মাতার আদর, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভক্তির সংস্পর্শে পুরুষের হৃদয় শীতল হয়। গ্রীষ্মের তাপে ডাবের জলের মতই সংসারে পুরুষের সর্বাধিক আকাক্ষিত বস্ত। বিশেষ করে কিশােরীর ভালবাসা ডাবের জলের মতই সব ক্লান্তিহারা। অবশ্য ঝুনাে নারিকেলের চেয়ে ডাবই কমলাকান্তের বেশী পছন্দ। কারণ নারিকেল ঝুনাে হলে জল ঝাঁঝ হয়ে যায়, কিন্তু ডাবের জল মিষ্টতায় পরিপূর্ণ। নারীজাতির কিশােরীর মিষ্টতা ডাব তাই লােভনীয়। উদাহরণ স্বরপ লেখক উল্লেখ করেছেন রামার মার বেশী বয়সে রামার বাপ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় ; কারণ, রামার মা তখন নারিকেলের মতই ঝুনো।
দ্বিতীয়তঃ নারিকেলের শস্য অথাৎ শাঁস যা স্ত্রীলােকের বুদ্ধির সঙ্গে তুলনীয়। করকচি অবস্থায় উহা থাকে না বললেই চলে। ডাবের অবস্থার উহা বেশ সুমিষ্ট এবং কোমল আর ঝুনাের বেলায় বড় কঠিন, দাঁত বসানাে, শক্ত। ঠিক এমনি ভাবেই স্ত্রীলােকের বুদ্ধি যৌবন প্রারম্ভে খুব একটা দানা বাঁধে না। কিন্তু পরিণত বয়সের দিকে যতই অগ্রসর হবে ততই বুদ্ধি বেশ দানা বাঁধতে থাকে। সবশেষে গৃহিণীপনার বুদ্ধি নারিকেলের শাঁসের মতই কঠিন। তখন গৃহিণীপনার রাজ্যে প্রবেশ করা কঠিন। তাই স্ত্রীর হাত থেকে মালকড়ি খসানাে স্বামীর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ; এমন কি পুত্র-কন্যাদের আবদারও অম্লান বদনে প্রত্যাখ্যাত হয়।
– তৃতীয়তঃ, নারিকেলের মালা—এটি স্ত্রীলােকের বিদ্য। শাঁসহীন নারিকেলের মালা সব সময়ে আধখানাই দেখা যায় এবং উহা সংসারে বড় একটা কাজে আসে না-স্ত্রীলােকের বিদ্যাও ঠিক সেরকম।
বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর
সর্বশেষে ছােবড়াকে স্ত্রীলােকের রপের সাথে তুলনা করেছেন কমলাকান্ত; ছােবড়া যেমন নারিকেলের বাহ্যিক অংশ, তেমনি রূপও স্ত্রীলােকের বাহ্যিক অংশ। অর্থাৎ নারিকেলের ছােবড়ার মতাে স্ত্রীলােকের রূপও বাহ্যিক আবরণ মাত্র। দুই-ই পরিত্যাজ্য। ছােবড়ার একটা গুণ রয়েছে—তা দিয়ে দড়ি হয়, উহা দিয়ে জাহাজ বাঁধা যায়। স্ত্রীলােকের রপের কাছিতেও অনেকে বাঁধা পড়েছে যার পরিণতিতে অনেকে প্রাণত্যাগ করেছে।
উপরােক্ত বিশ্লেষণগুলি কেবল অভিনব নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের এক জাতীয় দার্শনিক দৃষ্টির পরিচায়ক। নারীদেহের রূপ অনিত্য, তা কেবল মােহ সৃষ্টি করে, সংসারে প্ৰকৃত হিতের পথ রুদ্ধ করে দেয়—কেবল মানুষ পতঙ্গকে সেই দিকে ধাবিত করে, যার পরিণাম মৃত্যু। তাই এখানে বঙ্কিমচন্দ্র নারীজাতিকে নারিকেলের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে নারীজাতির স্নেহ, বিদ্যা, বুদ্ধি আর রূপের সাদৃশ্য হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছেন নারিকেলের জল, শাঁস, মালা আর ছােবড়া। অথাৎ কমলাকান্ত নারিকেলের চার সামগ্রীর সঙ্গে তুলনা করে রমণীদের রপগণ স্বভাবের প্রতি কটাক্ষ করেছেন। তাই তাঁকে দুঃখ করে বলতে হয়েছে—তাঁর ভাগ্যে নারিকেল-রূপী একটি নারীও জোটে নি।
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্যফল বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ।। আমার বােধ হয় মনুষ্যসকল ফল বিশেষ– ফলের সঙ্গে মনুয্যের । এই সাদৃশ্যে নিরুপণ কতখানি সার্থক হয়েছে, তা ‘মনুষ্যফল প্রবন্ধ অবলম্বনে নির্ণয় কর।
অথবা, মনুষ্যফল’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বিভিন্ন ফলের সাদৃশ্যে মানব সমাজের বিভিন্ন অভিব্যক্তি দেখেছেন। প্রবন্ধকে অনুসরণ করে পরিচয় দাও।
উত্তর : উদ্ধতিটি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মননশীল ব্যঙ্গমুলক সষ্টি কমলাকান্তের দপ্তর’-এর নির্বাচিত প্রবন্ধ মনুষ্য ফল থেকে গৃহীত হয়েছে। আফিম‘সেবী কমলাকান্ত দেশীয় মানবকুলকে বিভিন্ন পর্যায়ে এক একটি ফলের আকার প্রত্যক্ষ করে দেখাতে চান যে ভারতীয় মায়াবাদী দর্শনে বিভিন্ন স্তরে মানব জীবনের অনিত্যতার প্রতীক স্বরুপ। আলােচ্য প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র প্রাকৃতিক বস্তুর বৈচিত্র্যের বৈষম্যের ভিত্তিতে ওদের মাহাত্মের সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন শ্রেণীর স্বভাবের সাদৃশ্যকে বিশ্লেষণ করেছেন।
আফিম-সেবী নেশাগ্রস্ত কমলাকান্ত চক্রবর্তী দিব্যদৃষ্টিতে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের এবং এক একটি ধারাকে এক একটি ফল বিশেষ বলে মনে করেন। তাঁর ধারণা মানুষের আকৃতি, প্রকৃতি, উৎকর্ষতা সব কিছুই ফলের সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। বিশেষ করে পেশাগত বা প্রকৃতগত দিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে বিভিন্ন ধরনের – ফলের সঙ্গে তুলনীয়।
প্রথমেই বড় মনুষ্য অথাৎ ধনী ব্যক্তিরা এই সংসারে কাঁঠাল ফল স্বরপ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি দেখাতে চান ওদের কেহ কেহ অকালপক্ক, কেউ বা অকর্মণ্য, কেউ বা কুসঙ্গে এচোড়েই পাকে, আবার কতকগুলি কখনাে পাকে না। আবার কাঁটাল “আকৃতিতে বেশ বড়াে এবং উহার তীব্র গন্ধে আকৃষ্ট হয় সংসারের শৃগালেরা—এরাই হলাে দেওয়ান, নায়েব, গােমস্তা, মােসায়েব, আশীর্বাদক। এ ছাড়াও আছে রস প্রত্যাশী মাছির দল–কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মাতৃদায়গ্রস্ত, টুলাে পণ্ডিত, সংবাদপত্রের সম্পাদক, পুস্তক প্রণেতা ইত্যাদি।
এরপর কমলাকান্তের দৃষ্টিতে আমের সঙ্গে তুলনীয় হয়েছে সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মীদের চারিত্রিক গুণাবলী। যেমন আম এদেশে এসেছে সাগরপার থেকে
ঠিক সে-রকম উচ্চপদস্থ সরকারী আমলাৱা সাগরপার ব্রিটিশ রাজত্বে প্রধানতঃ ইংরেজরাই ঐ সব পদে আসীন ছিল। আম নানা স্বাদের হয়, কোনােটা সুস্বাদ, আবার কোনটা টকও হয়, কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর বলে বেশি দামে বিক্রয় হয়ে খরিদ্দার প্রতারিত হয়। কিন্তু, কমলাকান্তের মতে আম খাওয়ার সহজ পদ্ধতি হচ্ছে সেলাম-রপ জল এবং খােশামোদ রুপ বরফ সহযােগে ঠাণ্ডা করে উদরস্থ করা। ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরাও খোশামােদ প্রিয়। কোনাে কার্যোদার করতে হলে তাদের উৎকোচ বা অনুরােধ-উপরােধ দ্বারা বশীভূত করতে হতাে। আমের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে ইংরেজ রাজকর্মচারীদের চারিত্রিক আচরণের কথাই ইঙ্গিত দেয়।
সংস্কৃত ও বৈষ্ণব সাহিত্যে স্ত্রীলােকের উরুকে কলাগাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বাংলার প্রবাদ রয়েছে কলা-গাছ দ্রুত বাড়ে। মেয়েরাও ঠিক সে-রকম বৃদ্ধি পেয়ে অতি দ্রুত যৌবন অর্জন করে। কমলাকান্ত এখানে নারীর রূপ- লুব্ধ। পুরুষকে বাঁদরের সঙ্গে সাদৃশ্য কল্পনা করেছেন; কেননা বাঁদরের স্বভাব হচ্ছে কলাগাছের ফলের প্রতি অত্যধিক প্রলােভন।
মনুষ্য ফল প্রবন্ধে বিশেষ তুলনা প্রসঙ্গে কমলাকান্ত রমণীমণ্ডলীকে নারিকেল ফলের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে মিল আবিষ্কার করে প্রাচীন সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছেন। রমণীমণ্ডল’ সম্বন্ধে অতীতের নানা লােকশ্রতি বর্ণনা প্রসঙ্গে নিজস্ব মতকে প্রতিষ্ঠা করেছেন কমলাকান্ত। গাছে নারিকেল কাঁদি কাদি ফললেও ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ কাঁদি শুদ্ধ পাড়ে না। কুলীন ব্রাহ্মণরা অবশ্য নারিকেল পাড়ার অপরাধে অপরাধী। গাছের নারিকেলের মতাে সংসারের নারিকেলরাও নানা বয়সের নানা রপে গুণে সমৃদ্ধা। নারিকেলের এরূপ বয়োভেদে নানা অবস্থার জন্য স্ত্রীলােকের বিভিন্ন অবস্থার তুলনা করা হয়েছে। প্রারম্ভিক অবস্থায় উভয়েই নিৰ্ধকর-নারিকেলের বেলার কচি আর রমণীর বেলায় কিশােরী দুই-ই রমণীয়। নারিকেলের মধ্যম অবস্থা ডাব, উহার জল ও শাঁসের মতােই উপাদেয় হচ্ছে যুবতী অবস্থা—তারাই সংসারে আনন্দ ও পরিতপ্তি দান করে। সবশেষের অবস্থা ঝুনাে নারিকেল—যার জল বড় ঝাঁঝ, শাস বড় শক্ত ; নারিকেলের এ অবস্থার সঙ্গে বয়স্কা গৃহিনী অথাৎ স্ত্রীলােকের সাদৃশ্যতুল্য। অতএব কমলাকান্তের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে নারিকেলের চারটি সামগ্রী বামে হল, শাঁস, মালা ও ছােবড়ার সঙ্গে স্ত্রীলােকের স্নেহ, বুদ্ধি, বিদ্যা ও রূপ।
প্রথমেই ধরা যাক নারিকেলের জল আর স্ত্রীলােকের স্নেহ উভয়ই বেশ স্নিগ্ধকর। কারণ কোনাে ব্যক্তি সাংসারিক চাপে ক্লান্তি বােধের সময় সেই শীতল সুমিষ্ট জল পানে তার যন্ত্রণা দূর হয়ে যায়, ঠিক সে-রকম ভাবেই মাতার আদর, স্ত্রীর প্রেম, কন্যার ভক্তির স্পর্শে পুরুষের হৃদয় শীতল হয়। গ্রীষ্মের তাপে ডাবের জলই পুরযের সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত বস্ত। কারণ নারিকেল ঝুনাে হ’লে জল ঝাঁঝ হয়ে যায়, ডাবের জলের মিষ্টত সে হারিয়ে ফেলে। ঠিক নারী জাতির কিশােরীর সেই মিষ্টতা আর থাকে না যখন সে বয়কা স্ত্রীলােকে পরিণত হয়। তখন সে তার স্নিগ্ধকর স্নেহ টি হারিয়ে ফেলে।
দ্বিতীয়তঃ ঝুনো নারিকেলের শাঁস ডাবের শাঁসের তুলনায় বেশ শক্ত। ঠিক তেমনি ভাবেই স্ত্রীলােকের বুদ্ধি যৌবনের প্রারম্ভে খুব একটা প্রখর হয় না যতটা হয় গৃহিণীপনার মাধ্যমে। উভয়েই পরিণত বয়সে যথাক্রমে শাঁসে ও বুদ্ধিলে দাঁত বসানাে শক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ গৃহিনীপনার বুদ্ধি নারিকেলের শাঁসের মতই কঠিন তখন তার রাজ্যে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন কঠিন হয় যে স্ত্রীর হাত থেকে মালকড়ি খসানাে স্বামীয় পক্ষে বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, এমন কি কখনাে পুত্র-কন্যাদের আবদারও অম্লান বদনে প্রত্যাখ্যাত হয়।
তৃতীয়তঃ নারিকেলের মালা—এটি স্ত্রীলােকের বিদ্যা। শাসহীন নারিকেলের মালা সব সময়ে আধখানাই দেখা যায় এবং উহা সংসারে বড় একটা কাজে আসে না স্ত্রীলােকের বিদ্যাও ঠিক সে রকম।
চতুর্থতঃ ছােবড়াকে স্ত্রীলােকের রূপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ছোবড়া যেমন নারিকেলের বাহ্যিক অংশ, তেমনি রূপও হচ্ছে স্ত্রীলােকের বাহ্যিক অংশ। উহা শুধু, উভয়ের আবরণ মাত্র। দুই-ই পরিত্যাজ্য। ছােবড়ার একটা গুণ রয়েছে —তা দিয়ে দড়ি হয়, উহা দিয়ে জাহাজ বাঁধা হয়। স্ত্রীলােকের রূপের কাছিতে অনেকেই বাঁধা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
দেশহিতৈষীগণকে কমলাকান্ত গন্ধহীন কেবল দৃষ্টিনন্দন শিমুল ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ এই শিমুল ফুলের হাঁকডাক আছে, কিন্তু গন্ধ নেই বা আকর্ষণের ক্ষমতাও নেই, ঠিক যেন দেশ-উদ্ধারকারীদল, যারা মিথ্যে দেশাচার করে নরম-গরম বলি আওড়ায় মাত্র। এই বাক, সর্বস্ব ব্যক্তিদের কোনাে গুণ নেই। তারা যে কথা বলেন তা অর্থহীন, কেননা বাস্তবজীবনে তাদের স্বমূর্তি ভিন্নমুখী। শিমুলও তাই- —এরা বসন্তের সুখের দিনে প্রস্ফুটিত হয় এবং গ্রীষ্মের প্রারম্ভেই ফল ফেটে গিয়ে তুলো হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে দেয় মাত্র।
অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ এ-সংসারে ধুতরা ফল। এই ফুলের সৌন্দর্য তেমন নেই। কিন্ত বীজের মাদকতার মতো তাদের বচন আবত্তি পাঠে মানুষ অতি সহজেই মত্ত ও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল প্ৰশ্ন উত্তর
দেশী লেখককলকে অম্লগুণ সম্পন্ন তেঁতুল বলে কমলাকান্তের ধারণা হয়েছে। কারণ তেঁতুলের অম্লগুন ছাড়া আর কোনাে গুণই নেই। উহা বেশী খেলে অসুস্থতা দেখা দেয় ঠিক তেমনি বাঙালি পাঠকরা বাঙ্গালী লেখকদের রচনা অত্যধিক পাঠকরে মানসিক ব্যাধি অর্জন করতে পারে। কেননা অম্লরসের মত নিম্নশ্রেণীর সাহিত্য তাদের গলাধঃকরণ করতে হয়। আবার তেঁতুল কাঠ সহজদাহ্য, ঠিক সে-রকম ভাবে বঙ্গীয় লেখকরাও সমালােচনার অগ্নিতে পােড়েন ভাল।
দেশী হাকিমরা কমলাকান্তের দৃষ্টিতে অপদার্থ সক্রিয়তাহীন কুষ্মাণ্ড রপে বর্ণিত। কুমড়া দেশী ও বিলাতী দুই জাতের। বিলাত থেকে প্রত্যাগত না হলেও বিলাতী হওয়া যায়। এমন হাকিম এখন সবই সহজ প্রাপ্য।
কমলাকান্তের উপরোক্ত বিশ্লেষণীগুলি কেবল অভিনব নয়, এটি হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের এক জাতীয় দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা। মানব-সমাজকে বিভিন্ন পেশার ও শ্রেণীর বিভাজনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফলের সঙ্গে তুলনা করে তাদের স্বভাবের উৎকর্ষ অপকর্ষ, ত্রুটি-বিচ্যূতি প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি এমন ভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে যা বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব নিপুণ সমাজ পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।
‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধে আমাদের সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষকে এক এক জাতীয় ফলের সঙ্গে তুলনা করে কৌতুকের মাধ্যমে তাঁর বিশ্লেষণী সমাজ সচেতক দৃষ্টির পরিচয় রয়েছে প্রতি ছত্রে ছত্রে। কমলাকান্তের অনুভূতিকে সমাজের বড় মানুষ কাঁঠালের সঙ্গে তুলনীয়, সিভিল সাভিসের লােকেরা আমের সঙ্গে তুলনীয় এবং “রাণীমণ্ডলী এ সংসারের নারিকেল’। কেবল মন্তব্য নয়, নিজের সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যার দ্বারা সুগ্রথিত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কমলাকান্ত। ছদ্ম দেশপ্রেমিকরা তাঁর চোখে শিমুল ফুল, অধ্যাপক ব্রাহ্মণগণ সংসারের ধুতরা ফুল, দেশী লেখকরা তেঁতুল এবং দেশী হাকিমরা কুষ্মাণ্ডের সঙ্গে তুলনীয় যেন কমলাকান্তের একটা বাস্তব জাগ্রত বােধ। নারীজাতিকে নারিকেলের সঙ্গে তুলনা করে উহার চারটি সামগ্রীকে নারীজাতির চারটি অস্তিত্বের সঙ্গে যে ভাবে রসময় আলােচনা করে তিনি তুলেছেন তা শুধু, অভিনয়ই নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজ-চেতনার পরিধি যে কত বিরাট ছিল তারই স্বক্ষর বহন করে। এ ভাবেই তাঁর অন্তদৃষ্টিলর দ্বারা সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষ এবং সাহিত্য-শিল্পের অন্তঃসার শুন্যতা প্রদর্শন করে যে ভাবে হাস্যরসের খােরাক দিয়ে পাঠক সমাজকে সচেতন করার চরম সার্থকতা দেখিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র যা আজও কোনো লেখকের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
কমলাকান্তের দপ্তর মনুষ্য ফল ব্যাখ্যা মূলক প্রশ্ন উত্তর
ব্যাখ্যা।। আমার বােধ হয়, মনুষ্যসকল ফলবিশেষ—মায়াবন্তে সংসার বক্ষে বলিয়া রহিয়াছে, পাকিলেই পড়িয়া যাইবে।
উত্তর : উদ্ধৃতিটি সাহিত্য সম্রাট বকিমচন্দ্রের মননশীল ব্যঙ্গমুলক সষ্টি কমলাকান্ত পর্যায়ের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর নির্বাচিত ‘মনুষ্য ফল’ প্রবন্ধ থেকে গৃহীত। আফিন সেবী কমলাকান্ত বিশ্বের মানবকে ফলের আকারে প্রত্যক্ষ করে দেখতে চান যে ভাতের মাযাবাদী দর্শনে বিভিন্ন স্তরে মানব জীবনের অনিত্যতার প্রতীক স্বরুপ।
আফিমখাের কমলাকান্ত চক্রবর্তী দিব্য দৃষ্টিতে পথিবীর সব মানুষই ফলবিশেষ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে মানুষের আকৃতি, প্রকৃতি, প্রয়ােজনীয়তা, পরিণাম ইত্যাদি ফলের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। পেশাগত বা প্রকৃতিগত দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ফলের সঙ্গে তুলনীয়। এখানে মানব সমাজের পৃথক পৃথক বৃত্তি ও শ্রেণীর মানুষকে পৃথক পৃথক ফলের আকৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করে রকমারি ভুলভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি কটাক্ষ করেছেন কমলাকান্ত। ধনী জমিদার কাঁটাল, স্ত্রীলােক নারিকেল, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ধুতরাে, লেখক তেঁতুল, হাকিমকে কুমরোড় সঙ্গে তুলনা করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং সম্প্রদায়ের ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকগুলি এখানে বিস্তারিতভাবে দেখানাে হয়েছে, তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন এই প্রবন্ধের প্রথম স্তবকে।
কমলাকান্তের দপ্তর প্ৰশ্ন
ব্যাখ্যা।। আমি বলি রমনিমন্ডলী এ সংসারে নারিকেল।
উত্তর : উদ্ধৃতিটি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের মননশীল ব্যঙ্গমুলক সৃষ্টি কমলাকান্ত পর্যাযের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর নির্বাচিত ‘মনুষ্য ফল’ প্রবধ থেকে গৃহীত।
মনুষ্যসকল ফল বিশেষ তুলনা প্রসঙ্গে কমলাকান্ত রমণীমণ্ডলীকে নারিকেল ফলের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে মিল আবিষ্কার করেছেন। প্রাচীন সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে কমলাকাত স্ত্রীজাতিকে সংসার বক্ষের নারিকেলের সঙ্গে তুলনা করেছেন এখানে।
– ‘রমণীমণ্ডলী সম্বন্ধে অতীতের নানা লােকশ্রুতি নস্যাৎ করে কমলাকান্ত তার নিজস্ব মত প্রকাশ করতে গিয়ে আমি বলি’ বলার বেশ স্পষ্টবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। গাছে নারিকেল কাঁদি কাদি ফললেও ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ কাঁদি শুদ্ধ পাড়ে না। কুলনী ব্রাহ্মণরা অবশ্য বেশি নারিকেল পাড়ার অপরাধে অপরাধী। গাছের নারিকেলের মতাে সংসারের নারিকেরাও নানা বয়সে নানা রপে গুণে শােভিতা। নারিকেলের এরূপ বয়ােভেদে নানা অবস্থার সঙ্গে স্ত্রীলােকের বিভিন্ন অবস্থার তুলনা করা হয়েছে। প্রারম্ভিক অবস্থার উভয়েই স্নিগ্ধকর—নারিকেলের বেলায় করকচি আর রমণীর বেলার কিশোরী দুই-ই রমণীয়। নারিকেলের সংসারে আনন্দ ও পরিতপ্তি দান করে। সর্বশেষ অবস্থা ঝুনাে নারিকেল—যার জল ঝাঁজ, শাঁস বড় শক্ত ; নারিকেলের এ অবস্থার সঙ্গে ; বয়স্কা গৃহিণী অথাৎ স্ত্রীলােকের সাদশ্যতুল্য। তাই কমলাকান্ত রমণীমণ্ডলীকে এ সংসারের নারিকেল বলে উল্লেখ করেছেন।