History

ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান বা কৃতিত্ব নির্ণয় কর টেকজ সঞ্জীব

 

 ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান বা কৃতিত্ব নির্ণয় কর টেকজ সঞ্জীব

ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান বা কৃতিত্ব নির্ণয় কর টেকজ সঞ্জীব

ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান

 (খ) রাজা হিসাবে অশােকের আদর্শ কি ছিল? তিনি কিভাবে, তাহার রাজধর্ম বাস্তবে কতটা রূপায়িত হইয়াছিল ?

 

(গ) কেন মহামতি অশােককে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয় ? 

সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল

উত্তর। অশােকের সিংহাসন আরােহণ ঃ বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র অশােক খ্রীষ্ট পূর্ব ২৭৩ অব্দে মগধের সিংহাসন লাভ করেন। তাহার সিংহাসন আরােহণ ভারতের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।

ভারতের-ইতিহাসে-অশােকের-স্থান-বা-কৃতিত্ব-নির্ণয়-কর-টেকজ-সঞ্জীব

 

(১) অশােকের শিলালিপিগুলি হইতে তাহার জীবনের ও সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জানিতে পারা যায় সত্য, কিন্তু তাহার বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিন্দুসারের রাজত্বকালে তিনি উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা ছিলেন। তক্ষশীলার বিদ্রোহ  দমন করিয়া তিনি পিতার প্রিয়পাত্র হইয়াছিলেন এবং তিনি পরে তক্ষশীলার শাসনকর্তাও নিযুক্ত হইয়াছিলেন। 

 

অশােকের সিংহাসনলাভ (খ্রীষ্ট পূর্ব ২৭৩ অব্দে) এবং তাহার অভিষেকক্রিয়ার (খ্রীষ্ট পূর্ব 269 অব্দে) মধ্যে চারি বৎসর ব্যবধান দেখা যায়। এই ব্যবধানের কারণ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ একমত হইতে পারেন নাই। বৌদ্ধগ্রন্থে তাহার সিংহাসনলাভের জন্য সিংহাসনের জন্য ভ্রাতৃবিরােধ একটি বীভৎস ভ্রাতৃবিরােধের উল্লেখ আছে। অভিষেকক্রিয়ার বিলম্বের ইহাই প্রধান কারণ বলিয়া অনেকে মনে করেন। যাহাই হউক, অশােকের রাজত্বকালের প্রথম চারি বৎসর রহস্যাবৃত।

 

অশােকের সাম্রাজ্যবিস্তার

 

 (2) অশােকের সাম্রাজ্যবিস্তার : অশােকের রাজত্বকালের প্রথম পর্যায়ে (২৬৯ খ্ৰীষ্ট পূর্ব—২৬১ খ্রীষ্ট পূর্ব) অশােক পিতা ও পিতামহের অনুসৃত রাজ্যবিস্তার নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন। এই রাজ্যবিস্তার নীতি “অসুর বিক্রয়” নামে পরিচিত। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অশােক সাম্রাজ্যবিস্তারের দিকে দৃষ্টি দিয়াছিলেন। একটি বৌদ্ধগ্রন্থে স্বশ ও কলিঙ্গের বিরুদ্ধে উল্লেখ আছে যে, অশােক ‘স্বশ’ নামক দেশ জয় করিয়াছিলেন, কিন্তু অশােকের শিলালিপিতে এই যুদ্ধের কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। একমাত্র কলিঙ্গযুদ্ধের কথাই উল্লেখ পাওয়া যায়। অভিষেকের নয় বৎসর পরে তিনি শক্তিশালী কলিঙ্গরাজ্য আক্রমণ করেন (খ্রষ্ট পূর্ব ২৬০)। চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে এই রাজ্য স্বাধীন ছিল এবং ইহার সামরিক শক্তিও প্রবল ছিল। 

 অশােকের কলিঙ্গযুদ্ধের ফলে অশােকের ত্রয়ােদশ প্রস্তরলিপিতে এই যুদ্ধের বিবরণ ও ফলাফল উল্লিখিত  আছে। এই যুদ্ধে প্রায় দেড় লক্ষ কলিঙ্গবাসী বন্দী ও প্রায় এক লক্ষ নরনারী নিহত হন। এইভাবে অশােক কলিঙ্গরাজ্যটিকে মৌর্য-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কলিঙ্গযুদ্ধের মর্মান্তিকতা ও বীভৎসতা অশােকের মনের এক বিরাট পরিবর্তন আনিয়াছিল। সম্রাট অশােক যুদ্ধের দ্বারা দেশজয়ের ও সাম্রাজ্যবিস্তারের চিরাচরিত নীতি পরিত্যাগ করিয়া ধর্মপ্রচার দ্বারা মানবহৃদয় জয় করিবার আদর্শ গ্রহণ করিলেন। এইভাবে দেখা যায় কলিঙ্গযুদ্ধ মগধ তথা ভারত-ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচনা করে ।

ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান

অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি

 

(৩) সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি : উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যের সহিত নববিজিত স্বশ ও কলিঙ্গ সংযুক্তির পর অশােকের সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র ভারত জুড়িয়া বিস্তৃত হইয়াছিল। পরােক্ষভাবে অশােকের শিলালিপিগুলির প্রাপ্তিস্থান দ্বারা এবং  প্রত্যক্ষভাবে শিলালিপিগুলিতে, কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী’তে, হিউয়েন হইতে সীমা নির্ধারণ সাঙ-এর বিবৃতিতে দেশ ও স্থানের উল্লেখ দ্বারা আমরা অশােকের সাম্লাজ্যের বিস্তৃতি জানিতে পারি। 

(ক) উত্তর-পশ্চিমে অশােকের সাম্রাজ্য সিরিয়ার অধিপতি দ্বিতীয় এন্টিওকাসের রাজ্যের প্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হইয়াছিল, অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিকে আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুপ্রদেশ তাহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, 

(খ) শিলালিপিতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত কম্বােজ, যবন ও যােন জাতি এবং গান্ধার তাহার শাসনাধীন ছিল বলিয়া উল্লেখ আছে।

 (গ)  ‘রাজতরঙ্গিণী’ ও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ অনুযায়ী কাশ্মীরও তাহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

(ঘ) রুমিয়েনদি স্তম্ভলিপি অনুসারে দেখা যায় যে, নেপাল ও তরাই অঞ্চল তাহার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।

 (ঙ)  পূর্ব দিকে পুণ্ড্রবর্ধন, অর্থাৎউত্তরবঙ্গ সমতটে অর্থাৎ পূর্ববঙ্গে এবং পবদন, সমতট ও তালিপ্ত তাম্রলিপ্তে হিউয়েন সাঙ অশােকের ঝুপ লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু সম্ভবত কামরূপ অর্থাৎ বর্তমান আসাম অশােকের সাম্রাজ্যের বাহিরে ছিল। 

(চ) পশ্চিমদিকে সৌরাষ্ট্রের রাজা অশােকের বশ্যতা স্বীকার করিতে অর্থাৎ অশােকের সাম্রাজ্য আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। 

(ছ) দক্ষিণ-ভারতে পেনার নদী পর্যন্ত অশােকের  সাম্রাজ্য প্রসারিত হইয়াছিল; ত্রয়ােদশ প্রস্তরলিপিতে তাহার সীমান্ত রাজ্য হিসাবে তামিলনাদের চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র প্রভৃতির উল্লেখ আছে। উপরি-উক্ত স্থানগুলি হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, কামরূপ ও তামিল রাজ্যগুলি  ছাড়া প্রায় সমগ্র ভারতই অশােকের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল ।

 

 

 অশােকের ধর্ম’ বলিতে কি বােঝায় ?ধর্মপ্রচারক হিসাবে অশােকের কার্যকলাপ আলােচনা কর।  

 

অশোকের ধম্ম

 

অশােকের ধর্মবিজয় ও ধর্মমত

 

উত্তর:   পিতা বিন্দুসারের মৃত্যুর পর ২৭৩ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে অশােক যখন সিংহাসন লাভ করেন তখন তিনি ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। ইহার তের বৎসর পর কলিঙ্গযুদ্ধের মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী তাহার জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন আনিয়া দেয়। মানুষের জীবনের এক বিরাট দুঃখ ও অপচয় তাহার হৃদয়কে অশান্ত করিয়া তােলে । অবশেষে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উপগুপ্তের নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তিনি যেন শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়া পাইলেন এবং ভবিষ্যতের প্রকৃত পথ তাহার কাছে উদ্ভাসিত হইল। 

 সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য  যুদ্ধের পথ তিনি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিলেন। তিনি প্রতিবেশী সমস্ত চীনে নীতি পবির্তন রাষ্ট্রের নিকট প্রকাশ্যে ঘােষণা করিলেন যে, অতঃপর তিনি তাহাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হইয়া বন্ধুত্ব কামনা করিবেন। তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন যে, যুদ্ধের দ্বারা নয়,  ধর্মপ্রচারের মধ্য দিয়া তিনি মানুষের হৃদয় জয় করিবেন। সুতরাং অশােক সর্বপ্রকারে তাহার নীতি প্রচার করিয়া ‘ধর্মবিজয়’ শুরু করিলেন। অধ্যাপক রাধাকুযুদ মুখােপাধ্যায় মন্তব্য করিয়াছেন যে, কলিঙ্গযুদ্ধের শােচনীয় পরিণাম অশােকের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রূপান্তর ঘটাইয়াছিল।

 

অশােকের ধর্মের চরিত্র

ভারতের ইতিহাসে অশােকের স্থান

 অশােক যে ধর্ম (ধমাে’) প্রচার করিয়াছিলেন তাহা প্রধানত ছিল নীতিমূলক। তিনি বুদ্ধদেবের ‘নির্বাণ লাভ’ বা অন্য কোন ধর্মসম্বন্ধীয় তত্ত্বকথা প্রচার করিবার চেষ্টা করেন নাই। তিনি যে নীতিগুলি প্রচার করিয়াছিলেন তাহা সমস্ত ধর্মেরই সুরকথা । সকল ধর্মের প্রতিই তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল (দ্বিতীয় স্তম্ভলিপিতে  অশােক তাহার ধর্মনীতি ব্যাখ্যা করিয়া লিখিয়াছেন যে, ধর্ম হইতেছে। পাপের স্বল্পতা, কল্যাণকর্মের প্রাচুর্য্য, দয়া, দান, সত্য ও শৌচ এইসব কারণে অনেকে অশােকের ধর্মকে কোন বিশিষ্ট ধর্ম না বলিয়া কেবলমাত্র কর্তব্যকর্মের নীতি বলাই সমীচীন মনে করেন । ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার মনে করেন, অশােক ধর্মের নামে যাহা প্রচাব করিয়াছিলেন তাহা ছিল প্রকৃতপক্ষে নৈতিক অনুশাসন ; . ডঃ রমিলা থাপার এই অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন যে, অশােকের ধর্মের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের মনে সামাজিক দায়িত্ববােধ ও সচেতনতা জাগ্রত করিয়া ভােলা। মানবতাবাদী সমাজ গঠনই অশােকের ধর্মীয় কার্যকলাপের মর্মবাণী । কিন্তু একথা  অস্বীকার করার উপায় নাই যে, তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন, বৌদ্ধ-সংঘের সহিত তিনি জড়িত ছিলেন এবং তাহার  উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাবই সব চেয়ে বেশি ছিল। ভান্ডারকর, ডঃ রায়চৌধুরী, বড়ুয়া প্রমুখের মতে অশােক নিঃসন্দেহে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন এবং এই সম্পর্কে অশােকের প্রথম প্রস্তরলিপিতে উল্লেখ রহিয়াছে। তিনি তাহার যমকে করিয়া তুলিয়াছিলেন অনেক বেশী উদার, বাস্তবধর্মী ও মানবতাবাদী, অহিংসা এবং পরধাসহিষ্ণুতা ছিল তাহার মূল নীতি।

 

সম্রাট অশোক প্রশ্ন উত্তর

 

দেশের অভ্যন্তরে ধর্মপ্রচার :

 

 রাজা হিসাবে অশােক নিছক কর্তব্য সম্বন্ধে এক নতুন আদর্শ অনুসরণ করিয়াছিলেন। রাজ-কর্তব্য সম্পর্কে তাহার এই আদর্শ বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিল। তিনি ঘােষণা করিয়াছিলেন, সকল মানুষই প্রচারের প্রেরণা আমার সন্তান ; আমি যা কিছু করিয়াছি তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য হইল তাহাদের ইহজগৎ ও পরজগতে সুখী করিবার। এই কর্তব্য সম্পাদন করিয়া আমি জীবের প্রতি আমার ঋণ শােধ করিতে চাই।” 

 প্রচারের জন্য দেশবাসীর দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইলেন।

 (১) তিনি স্বয়ং বিহারযাত্রার পরিবর্তে  ধর্মযাত্রায় বহির্গত হইতে আরম্ভ করিলেন। নানা তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করিয়া এবং জনসাধারণের ধর্মসভা আহ্বান করিয়া তিনি দেশবাসীকে   ধর্মশিক্ষা দিতেন।

 (২) তিনি রাজুক, যুত, মহামাত্র প্রভৃতি পর্যায়ে ধর্মপ্রচার রাজকর্মচারীগণকেও ধর্মপ্রচারে সহায়তা করিবার জন্য দেশভ্রমণে বহির্গত হইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।

 (৩) জনসাধারণের মধ্যে ধর্মভাব জাগাইবার জন্য তিনি ধর্মমহামাত্র’ নামে এক নূতন ধরনের রাজকর্মচারী নিযুক্ত করেন। 

(৪) নানারকম অলৌকিক দৃশ্য দেখাইয়া স্বর্গীয় আলেখ্য তুলিয়া ধরিয়া তিনি জনসাধারণকে ধর্মপথে আকর্ষণ করিতেন। 

(৫) তিনি পর্বতগাত্রে, প্রস্তরখন্ডে, ভূপে ওস্তম্ভে সহজবােধ্য ভাষায়  ধর্মের মূল কথাগুলি উৎকীর্ণ করিয়া জনসাধারণের মধ্যে ধর্মভাব  জাগাইতে সাহায্য করিয়া ছিলেন।

 (৬) বৌদ্ধধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষা করিবার জন্য তিনি পাটলিপুত্র নগরে এক বৌদ্ধধর্মসভা, আহ্বান করিয়াছিলেন ইতিহাসে যাহা তৃতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতি নামে খ্যাত। 

(৭) এই ধর্মসভার সিদ্ধান্ত  অনুসারে তিনি কাশ্মীর, গান্ধার, নেপাল, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি স্থানে  মজ্জন্তিক, মজ্জিম, মহাধর্ম, রক্ষিত প্রভৃতি বৌদ্ধ ভিক্ষুকগণকে পাঠাইয়া ছিলেন। 

(৮) বৃক্ষরােপণ, কৃপখনন, চিকিৎসালয় স্থাপন জনহিতকর কার্য দেশবাসীর প্রভৃতি জনহিতকর কাজের মাধ্যমে তিনি এক আদর্শ ধার্মিকের দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিয়াছিলেন । 

 

এইরূপে কোন বল প্রয়ােগ না করিয়া তিনি তাহার ধর্মকে দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন এবং তাহাদের হৃদয় জয় করিয়াছিলেন।

 

বৰ্হিদেশে ধর্মপ্রচার 

 

 স্বদেশের ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যেই তাঁহার ধর্মপ্রচার সীমাবদ্ধ ছিল না। বিদেশে ধর্মপ্রচারের জন্যও তিনি যথেষ্ট উদ্যোগী হইয়া উঠিলেন।   তৃতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি দেশ-দেশান্তরে ধর্মদূত পাঠাইয়াছিলেন।

 (১) মহাবংশ’ নামক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, অশােক তাহার দূতগণকে বিভিন্ন তামিলরাজ্যে প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং ভ্রাতা (অথবা পুত্র) মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে সিংহলে পাঠাইয়াছিলেন।

 (২) মহারক্ষিত নামে একজন প্রচারক সিরিয়া, মিশর, কাইবিন, ম্যাসিডনিয়া, ইপিরাস প্রভৃতি গ্রীক দেশগুলিতে প্রেরণ করিয়াছিলেন।

 (৩) ব্রহ্মদেশ এবং উহার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহে তিনি সােণ ও উত্তর নামে দুইজন প্রচারককে পাঠাইয়াছিলেন । সুতরাং, ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে ভারতবর্ষের সহিত পশ্চিমে ও পূর্বে বিভিন্ন দেশের যােগাযােগ ঘনিষ্ঠ হইয়াছিল এবং এই ধর্মপ্রচারের মাধ্যমেই ভারতীয় প্রচারকগণ ভারতীয় সভ্যতা ও কৃষ্টি ভারতের বাহিরে বিভিন্ন দেশে বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল । অশােকের দান অপরিমেয় ভারতের একটি ধর্মকে জগতের একটি বিশিষ্ট ধর্মে তিনি পরিণত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। 

 

 

সম্রাট অশোকের কৃতিত্ব বা ইতিহাসে অশোকের স্থান

 

 বিশ্বের অনেক ঐতিহাসিকগণই নিঃসঙ্কোচে শােককে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। একই সঙ্গে বহু গুণের সমন্বয়সাধন হইয়াছিল অশােকের জীবনে এবং তাহাই তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দান করিয়াছে ।

 

 (১)   মৌর্য সম্রাট হিসাবে সিংহাসনে আরােহণ করিয়া তিনি তাহার পিতা ও পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করিলেন এবং অস্ত্রবলে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য অগ্রসর হইলেন । কলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা তাহার রাজনৈতিক জ্ঞানেরও পরিচয় এবং দুর্ধর্ষ কলিন্সবাহিনীকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করিয়া তিনি তাহার সামরিক জ্ঞানেরও পরিচয় দিয়াছেন । 

(২) যুদ্ধে জয়লাভ করিয়াও অস্ত্ৰত্যাগ, যুদ্ধের পথকে সম্পূর্ণ পরিহার করিয়া প্রকাশ্যে  ঘােষণা করা, সত্যই অভূতপূর্ব । তাহার মানব হৃদয়ের অপূর্ব বিকাশ হইল, রাজ-আদর্শ সম্বন্ধে তিনি নূতন আলােক দেখিতে পাইলেন।

 (৩) তিনি প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের প্রতি আক্রমণাত্মক ভাব পরিহার করিয়া বন্ধুভাব গ্রহণ করিলেন এবং ধর্মপ্রচার কবিয়া তাহাদের হৃদয় জয় করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন ; অর্থাৎ  ভবিষ্যৎ জীবনে তিনি ধর্মাবজয়ের’ নীতি গ্রহণ করিলেন ; তাহারই অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় একটি স্থানীয় ধর্ম বিশ্বধর্মে পরিণত হইয়াছিল। 

(৪) কিন্তু, বৌদ্ধধর্মের প্রচারে তিনি তাহার সমস্ত মন-প্রাণ উৎসর্গ করিলেও পরধর্মের প্রতি তিনি কখনও  বিদ্বেষভাব পােষণ করিতেন না ; পূরণসহিষ্ণুতা ছিল তাহার শ্রেষ্ঠ  গুণ। 

 

সম্রাট অশোকের জনহিতকর কাজ

 

(৫) কেবল মাত্র ধর্মপ্রচারক নয়, মানবহিতৈষী হিসাবেও তিনি বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন দাবি করিতে পারেন। তিনি ঘােষণা করিয়াছিলেন যে, সকল মানুবই আমার সন্তান (সূব মুনিষে পুজা যমা’)। এই মহান ঘােষণার সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া তিনি সমস্ত মানুষের মঙ্গলের জন্য অসংখ্য জনহিতকর কার্য করিয়া গিয়াছেন। এমনকি অহিংসানীতিকে অনুসরণ করিয়া তিনি পশুর জন্যও অনেক চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়া গিয়াছে। 

(৬) জনসাধারণকে ধর্ম ও মানবীয় নীতিসমূহ শিক্ষা দিবার মে ও নীতি  তিনি বিভিন্ন স্থানে ধর্মলিপি উৎকীর্ণ করাইয়া ছিলেন । ধর্মসমাজ, ধর্মযাত্রা, ধর্মমঙ্গল প্রতিষ্ঠাও তাহার নিষ্ঠার পরিচয় বহন করে। তাহার অনেক আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিবার প্রচেষ্টায় তিনি কোন পথকেই পরিহার করেন নাই। নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি তাহার নীতি ও আদর্শকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতেন।

 (৭) তিনি কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ রাজনীভিজ্ঞ, যােদ্ধা, ধর্মপ্রচারক ও মানবহিতৈষী ছিলেন তাহাই নহে। তিনি একজন সুশাসকও ছিলেন। তাঁহার বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে কোথাও কোন সময় শান্তি ও শৃলার অভাব দেখা যায় নাই। সুতরাং শাসন ব্যাপারে তাহার শৈথিল্য ছিল না বা জ্ঞানেরও অভাব ছিল না।

 (৮) একথাও তুলিলে চলিবে না যে তিনি হইতেছেন প্রথম সম্রাট যিনি প্রায় সমস্ত ভারতকে রাজনীতিগতভাবে এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। এক আদর্শ ও এক ভাষা তিনি সমগ্র দেশে ছড়াইয়া দিয়াছিলেন। একটি দেশকে গড়িয়া তুলিবার পক্ষে ভারতে কৈসান ইহ তাহার শ্রেষ্ঠ দান। 

(৯) সমগ্র দিক দিয়াই তিনি নিঃস্বার্থভাবে দেশের উন্নতিসাধন করিয়াছিলেন। দেশের সর্বত্র বহু ভূপ, চৈত্য, স্তম্ভ প্রভৃতি নির্মাণ করাইয়া তিনি দেশের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের প্রভূত উন্নতিসাধন   করিয়াছিলেন। খরােষ্ঠি ও ব্রাহ্মী লেখার প্রচলন তাহার রাজত্বকালেই। শুরু হইয়াছিল। তাহার অসংখ্য শিলালিপি ও অনুশাসন-লিপি দেশের সাহিত্য-সৃষ্টিতেও প্রেরণা যােগাইছিল । 

 

মৌসাম্রাজ্যের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করিতে যাইয়া অনেক ঐতিহাসিক অশােকের ধর্মনীতিকেই পরােক্ষভাবে দায়ী করিয়াছিলেন। তাহাদের বক্তব্য অনুসারে অশােকের অহিংসা-ধর্মপ্রচারের ফলেই দেশ নিবীর্য হইয়া পড়ে এবং ফলে পরবর্তী যুগে মৌর্য-সাম্রাজ্যের পতন হয়। আবার অন্যপক্ষে অনেকে এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন যে বিশ্বের ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যের উত্থানের কয়েক শতাব্দী পরেই তাহার পতন শুরু হয়। সুতরাং মৌর্যসাম্রাজ্যেরও পতন সেই স্বাভাবিক নিয়ম অনুসরণ করিয়াই হইয়াছে ইহার জন্য অশােককে কখনও দায়ী করা যায় না। তবে মৌর্যসাম্রাজ্যের পতন যে কারণেই হােক, অশােকের শ্রেষ্ঠত্ব তাহাতে কিছুই ম্লান হয় না ।

 

সর্বজনস্বীকৃত শ্রেষ্ঠত্ব

 

পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিখ্যাত সম্রাটের আবির্ভাব দেখা যায়। অনেকে সম্রাট অশােককে রােমান সম্রাট কনস্টানটাইনের সহিত তুলনা করিয়াছেন। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির দিক দিয়া দুইজনের মধ্যে সাদৃশ্য থাকিলেও দুইজনের মধ্যে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল। অশােক তাহার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচার করেন নাই। কিন্তু এইরূপ সর্বতােমুখী প্রতিভাবান সম্রাট আর কোথাও দেখা যায় না। তঁাহার রাজ-আদর্শ আজও বিশ্বের শ্রদ্ধা অর্জন করে । তাহার প্রচারিত ধর্ম ও নীতি আজও সমাদৃত হয় । তাই তাহার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্রই স্বীকৃত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *