History

বাবরের কৃতিত্ব আলােচনা কর ইতিহাস টেকজ সঞ্জীব

 বাবরের কৃতিত্ব আলােচনা কর ইতিহাস টেকজ সঞ্জীব

বাবরের কৃতিত্ব

বাবরের কৃতিত্ব আলােচনা কর

প্রশ্ন ।। বাবরের কৃতিত্ব সম্বন্ধে আলােচনা কর।

 

অথবা, সামরিক নেতা ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বাবরের মূল্যায়ণ কর।

বাবরের-কৃতিত্ব-আলােচনা-কর-ইতিহাস-টেকজ-সঞ্জীব

 

অথবা, “ইতিহাসে ভারত-বিজেতা রূপে রূপে বাবর বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছেন” (লেনপুল)—মন্তব্যটি আলােচনা কর। ভারতে বাবরের সাফল্যের কারণ কি? অথবা, ভারতের ইতিহাসে ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দের গুরুত্ব নির্ধারণ কর। 

 

অথবা, তুমি কি বাবরকে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রূপে মনে কর?

 

মুঘল সম্রাট বাবরের কৃতিত্ব

 

উত্তর। 

বাবরের প্রথম জীবন : 

 

 পানিপথের ঐতিহাসিক প্রান্তরে লােদী বংশের সৈন্যবাহিনীকে বিধ্বস্ত করিয়া বাবর ভারতে মােগল-সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করিয়াছিলেন। ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারের প্রচেষ্টা তাহার সার্থকতায় মন্ডিত হইয়াছিল।  কিন্তু তাহার পূর্ববর্তী জীবন ছিল নানা ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ে ভরা। পিতার দিক দিয়া তিনি ছিলেন তৈমুরের এবং মাতার দিক দিয়া চিঙ্গিস খার বংশধর। 

 বর্তমান রুশ-তুর্কীস্থানের অন্তর্গত ফরঘনা নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি আমীর  ওমর শেখ মির্জার পুত্র জহির-উদ্দিন মহম্মদ ১৪৮৩ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইনিই পরবর্তী যুগের ইতিহাসে বাবর নামে বিখ্যাত হইয়া উঠেন। বাল্যকালে তিনি শিক্ষার যথেষ্ট সুযােগ পাইয়াছিলেন এবং এই সময় হইতেই অত্যন্ত দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ হইয়া উঠেন।

 

পিতার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে মাত্র একাদশ বৎসর বয়সে বাবর ফরঘনার সিংহাসনে আরােহণ করেন। এই সময় হইতেই তিনি তৈমুরের সাম্রাজ্য  পুনঃসঞ্জীবিত করিবার স্বপ্ন দেখিতে থাকেন। সমরখন্দের সিংহাসন  লইয়া তৈমুরের বংশধরগণের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিলে তিনি এই সুযােগ গ্রহণ করিতে অগ্রসর হন। সাময়িকভাবে তিনি সমরখন্দ দখল করিতে পারিলেও শেষ

 

  পর্যন্ত তাহাকে উজবেগ দলপতি সাহেবানী খার নিকট ১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দে সম্পূর্ণ পর্যদস্ত হইতে হয়  এবং আপন পিতৃরাজ্যও হারাইতে হয়। অতঃপর তিনি হৃতসর্বস্ব হইয়া ভাগ্যান্বেষণে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিতে লাগিলেন। এই সময় কঠোর জীবন যাত্রার মধ্য দিয়া তিনি তাহার জীবনের অনেক অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং এই সময়েই তাহার মনে হিন্দুস্থান জয়ের সংকল্প দানা বাধিয়া উঠে।

 

দ্বিতীয় পর্যায় : ১৫০s খ্রীষ্টাব্দে তিনি কাবুল রাজ্যটি দখল করিতে সক্ষম হন। ইহার পর তিনি সমরখন্দের উপর উজবেগ আধিপত্য ধ্বংস করিবার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হন।  অবশেষে সেই আশা ত্যাগ করিয়া তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অর্থাৎ হিন্দুস্থানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা তাহাকে এক অপূর্ব সুযােগ দান করিল। রাজনীতিগতভাবে ভারত তখন ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং আত্মকলহে দুর্বল। পরীক্ষামূলকভাবে তিনি কয়েকবার প্রাথমিক অভিযান প্রেরণ করিলেন এবং বজৌর দুর্গ, ঝিলামের তীরে ভির নামক স্থান ও চীনাব নদীর অববাহিকা অঞ্চল দখল করিলেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অভিযানের জন্য তিনি সুযােগের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ : দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা শীঘ্রই তাহাকে সেই সুযোেগ দান করিল। দিল্লীর লােদীবংশীয় সুলতান ইব্রাহিম লােদীকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য অভিজাতবর্গের একটি বিরাট অংশ তখন অতিমাত্রায় আগ্রহশীল হইয়া উঠিয়াছিল। অবশেষে লাহােরের শাসনকর্তা দৌলত খা এবং সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার। সুলতানের পিতৃব্য আলম খাঁ একত্রে বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আহ্বান জানাইলেন। বাবর এই আমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করিয়া ১৫২৪ খ্রীষ্টাব্দে সসৈন্যে পাঞ্জাবে উপস্থিত হইয়া লাহাের দখল করিলেন। দৌলত খাঁ ও আলম খাঁ বাবরের সহায়তা চাহিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এখন তাহারা বাবরের আসল উদ্দেশ্য বুঝিতে  পারিয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণ আরম্ভ করিলেন। ফলে বাবরকে কাবুলে ফিরিয়া যাইতে হইল। কিন্তু পরবৎসর, ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সসৈন্যে পাঞ্জাবে উপস্থিত হইয়া দৌলত খাকে বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য করিলেন এবং পানিপথের প্রান্তরে তাহার সুশিক্ষিত অশ্বারােহী ও গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ইব্রাহিম লােদীকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। দিল্লী বাবরের পদানত হইল। কিন্তু এই   যুদ্ধের ফলেই সমগ্র হিন্দুস্থানের উপর বাবরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই; পানিপথের যুদ্ধজয় মােগল সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মাত্র।

 

বাবর মােগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা:

 

  পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়লাভের পর দিল্লী ও আগ্রা বাবরের পদানত হইল। অতঃপর তিনি তাহার আধিপত্য চতুর্দিকে বিস্তৃত করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। দোয়াব অঞ্চলের আফগান অভিজাতবর্গ দমন হইল; জৌনপুর, গাজিপুর, গােয়ালিয়র প্রভৃতি স্থান তাহার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইল। কিন্তু অনতিকালের মধ্যেই তাহাকে সম্মিলিত এত শক্তির সম্মুখীন হইতে হইল। তুর্কী-আফগান সুলতনির পতনোম্মুখ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করিয়া মেবারের রাণা সঙ্গ (বা সংগ্রাম সিংহ)

 

-হিন্দুস্থানে রাজপুত প্রাধান্য স্থাপনের আশা পােষণ করিতেছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি বাবরে সহিত পূর্ব হইতেই সংযােগ স্থাপন করিয়াছিলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি বাবরের অভিযানে কোনরূপ সাহায্য করেন নাই। এখন বাবরকে নির্বিবাদে হিন্দুস্থানে  তাহার আধিপত্য বিস্তার কবিতে দেখিয়া তিনি এক বিশাল  রাজপুত-সঙ্ঘ গড়িয়া তুলিলেন। ১৫২৭ খ্রষ্টাব্দে বানুয়ার প্রান্তরে উভয় পক্ষের সেনাবাহিনীর সাক্ষাৎ হইল। সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধকৌশলের অপকর্ষতার ফলে রাজপুত বাহিনীর শােচনীয় পরাজয় ঘটিল। ভারতে রাজপুত  প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আশা চিরতরে বিনষ্ট হইল। অধ্যাপক পার্সিভ্যাল স্পীয়ার মন্তব্য করিয়াছেন “It (খানুয়ার যুদ্ধ) was the imperial swan song of the Rajputs.” খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল দুইটি। প্রথমত, মােগল শক্তিকে প্রতিহত করবার মত উপযুক্ত কোন শক্তিও আর রহিল না। দিল্লীতে বাবরের সিংহাসন নিরাপদ হইল, তাহর প্রাধান্য দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হইল। দ্বিতীয়ত, তাহার রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থল কাবুল হইতে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হইল। 

 

খানুয়ার যুদ্ধের পরবৎসর, ১৫২৮ খ্ৰীষ্টাব্দে, বাবর দুর্ভেদ্য রাজপুত দুর্গ চান্দেরী দখল করিলেন। অতঃপর ১৫২৯ খ্ৰীষ্টাব্দে গােগর (বা ঘাগরা) নদীর তীরে তিনি বাংলা ও বিহারের আফগানদের সম্মিলিত বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করিলেন। এই চান্দেরি দুর্গ : বাংলাযুদ্ধে জয়ের ফলে এক বিরাট অংশে বাবরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত  হইল। হিমালয়ের পাদদেশ হইতে দক্ষিণে গােয়ালিয়র পর্যন্ত এবং মধ্য-এশিয়ার অক্ষুনদী হইতে পূর্বে গােগরা নদী পর্যন্ত তাহার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইল। ১৫৩০ খ্রষ্টাব্দে তাহার মৃত্যু হয়।

 

বাবরের সাফল্যের কারণ :

 

বাবরের জয়লাভের একাধিক কারণ দেখা যায়। যদিও তুলনামূলক বিচারে বাবরের শক্তি ছিল সামান্য কিন্তু বাবরের নেতৃত্বে মুঘলবাহিনী ছিল সুশৃঙ্খল ও সংঘবদ্ধ। অন্যদিকে ইব্রাহিম লােদীর সৈন্যবাহিনী ছিল অদক্ষ ও অনিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন গােষ্ঠী হইতে সৈন্য সংগ্রহ করার ফলে গােষ্ঠী নেতাদের প্রতিই তাহারা বেশী অনুগত ছিল। বাবরের জয়লাভের অপর একটি কারণ হইল গােলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহার যুদ্ধে গােলাবারুদের ব্যবহার ভারতীয়দের নিকট অজানা ছিল। তৃতীয়ত, অভিজাত সম্প্রদায় ও রাজপুতদের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ইব্রাহিম লােদী একক প্রচেষ্টায় সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ভারতীয়দের বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা বাবরের জয়লাভের পক্ষে সহায়ক হয়।

 

বাবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব:

 

 মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে বাবর ভারতবর্ষে মােগল শক্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছিলেন। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিশ্বের ইতিহাসে তাহার নাম চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ দুঃসাহসী সৈনিক,  সুদক্ষ সেনাপতি এবং আত্মবিশ্বাস ও দুর্দমনীয় আকাঙ্খায় ভরপুর ।  এই সমস্ত গুণাবলী তাহার সাম্রাজ্যবিস্তারে সহায়ক হইয়াছিল কিন্তু শাসক হিসাবে তিনি বিশেষ কোন গুণের পরিচয় দিতে সক্ষম হন নাই। অভ্যন্তরীণ 

 

বাবরের শাসক হিসাবে ব্যর্থতা

 

শাসনব্যবস্থা উন্নত করিবার জন্য তিনি নূতন কোন আইনকানুন প্রবর্তন বা ব্যবস্থা অবলম্বন করেন নাই; পুরাতন সুলতানি শাসনব্যবস্থাই চালু রাখিয়াছিলেন। জায়গিরদারি ব্যবস্থা পূর্বের মতই রহিয়া গেল এবং কেন্দ্রীয় শাসনকে শক্তিশালী করার জন্যও বিশেষ কোন ব্যবস্থা অবলম্বিত হইল না। সুতরাং দেখা যায়, বাবর সাম্রাজ্য সুসংহত করিবার উপযােগী কোন শাসন কাঠামাে রচনা করিতে পারেন নাই। ফলে, তাহার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সংহতি রক্ষার কোন নিশ্চয়তা ছিল না।  তাহার অমিতব্যয়িতা ও অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থার ফলে রাজকোষের অবস্থাও খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল। পরবর্তী সম্রাট হুমায়ুনকে এই সকল ঘটনার জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হইয়াছে

 

 সম্রাট বাবরের কৃতিত্ব

 

বাবর এর গুনাবলী

 

কিন্তু একথা স্বীকার করিতে হইবে যে, বাবর মধ্যযুগীয় খ্যাতনামা সম্রাটগণের অন্যতম ছিলেন। তিনি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেন। মধ্য-এশিয়ায় তাহার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, ভারতে তাহার পরিসমাপ্তি ঘটে, আশ্চর্যের কথা, তৈমুর ও চেঙ্গিসের বংশধর বাবর ভারতে যে রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি নির্মাণ করিয়াছিলেন তাহা তাহার উত্তরাধিকারী আকবরের নেতৃত্বে পরিপূর্ণতা লাভ করিয়াছিল। মধ্য-এশিয়ার তুর্কী-বংশােদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও বাবরের মধ্যে চিঙ্গিস খা বা তৈমুরের নৃশংসতা, লুণ্ঠন বা ধ্বংসসাধন কোন কিছুই পরিলক্ষিত হয় নাই। তিনি গোড়া  সুন্নী মুসলমান ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না।বিদ্যানুরাগ, সঙ্গীতানুরাগ, আশ্রিতের প্রতি অনুকম্পা প্রভৃতি তাহার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। তঁাহার সাহিত্যানুরাগ ছিল গভীর; তুর্কী ও ফার্সী ভাষায় তাহার বিশেষ দখল ছিল। ফার্সী ভাষায় তিনি নিজেই বহু কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। তাহার রচিত ‘জীবনস্মৃতি বাবরের সাহিত্যানুরাগ (Memories’) একখানি অমূল্য গ্রন্থ। তাঁহার বিভিন্ন প্রতিভা লক্ষ্য করিয়াই ঐতিহাসিকগণ তাহাকে ভারতের উল্লেখযােগ্য সম্রাটগণের সমপর্যায়ভুক্ত বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *