দাম গল্প নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিষয়বস্তু ও প্রশ্ন উত্তর নবম শ্রেণী বাংলা
দাম গল্প নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিষয়বস্তু ও প্রশ্ন উত্তর নবম শ্রেণী বাংলা
দাম গল্প নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিষয়বস্তু ও প্রশ্ন উত্তর
দাম
নারায়ণ গঙ্গােপাধ্যায়
বিষয়-সংক্ষেপ
দাম গল্পের বিষয়বস্তু
অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন স্কুলের ছাত্রমহলে বিভীষিকাস্বরূপ। অঙ্কে তাঁর এমনই আশ্চর্য পরিষ্কার মাথা ছিল যে, যে-কোনাে অঙ্ক একবার দেখে নিয়ে ব্ল্যাকবাের্ডে তা অতি অল্প সময়ে কষে দিতেন। পৃথিবীর যত অঙ্ক তা যেন তাঁর মুখস্থ ছিল। অঙ্কে যেসব ছাত্র খুব ভালাে তারাও তাঁকে ভয় পেত। আর সাধারণেরা তাে তাঁর ক্লাসে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। তাঁর হাতের চড় যে কী ভয়ংকর যারা একবার খেয়েছে তারা জানে। গল্পের কথক ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডি পার হওয়ার পর শুধু অঙ্কের বিভীষিকা থেকে নয়, অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের থেকেও যেন রেহাই পান।
গল্পের কথক এরপর যথাসময়ে এমএ পাস করে কলেজে বাংলা অধ্যাপনার কাজে যােগ দেন। একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে কথকের কাছে তাঁর ছেলেবেলার একটি গল্প লেখার অনুরােধ আসে। তারা এ কথাও জানান যে, তাঁদের পত্রিকায় কোনাে খ্যাতিমান সাহিত্যিক লেখেন না। আর তাতে কথক উৎসাহিত হয়ে তাঁর স্কুলজীবনের বিভীষিকা অর্থাৎ, তাঁর সেই স্মরণীয় মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটি গল্প লেখেন। তাতে যেমন কিছু কল্পনার খাদ মিশিয়ে দেন, তেমনি শিক্ষার ব্যাপারে কিছু সদুপদেশও দিয়ে ফেলেন। উপদেশের আসল বক্তব্য ছিল, পীড়ন-তাড়ন করে শেখানাে যায় না। পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দশ টাকা দক্ষিণা পেয়ে কথকের মনে হয়েছিল মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে ওইটুকুই তাঁর নগদ লাভ।
দাম গল্প
তারপর অনেক দিন পার হয়। কথক ভুলেই যান তাঁর সেই গল্পের কথা। এমন সময় বাংলাদেশের এক প্রান্তের এক কলেজ থেকে কথকের কাছে আমন্ত্রণ আসে তাঁদের বার্ষিক উৎসবে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তিনি পৌছানাের পর উচ্ছ্বসিত আতিথেয়তা পান। ইংরেজি ও বাংলা উদ্ধৃতিসহ আঁকিয়ে বক্তৃতা করে সভার শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। এমনকি মুগ্ধ প্রিন্সিপ্যাল স্বয়ং তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। কথক প্রশংসায় আত্মতুষ্ট হয়ে খুশি খুশি মনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় একটি ছেলে এসে খবর দেয় যে, এক বুড়াে ভদ্রলােক কথকমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি বাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
বুড়াে ভদ্রলােকের সঙ্গে গল্পের কথক দেখা করতে যান। আবছা অন্ধকার। ভদ্রলােক কথককে ‘সুকুমার’ বলে ডাকতেই, কথক চমকে যান। ইনিই কথকের ছেলেবেলার অঙ্কের মাস্টারমশাই। এখন বৃদ্ধ হয়ে একটু কুঁজো হয়েছেন। অবসর নেওয়ার পর ওই অঞ্চলে এসে আছেন। তিনি বললেন যে, তাঁর ছাত্রের বক্তৃতা শুনে খুব খুশি হয়েছেন। ছাত্রের জন্য তাঁর গর্ব হচ্ছে। তিনি দুঃখ করে বললেন যে, তিনি তাঁদের কেবল শাসন-তাড়ন করেছেন, কিছু দিতে পারেননি। বলতে বলতে পকেট থেকে একটি জীর্ণ পত্রিকা বের করে দেখান। তাতে তাঁকে নিয়ে কথকের লেখা গল্পটি তাঁর কাছে মূল্যবান সম্পদ। কত শ্রদ্ধা নিয়েই না তাঁর ছাত্র তাঁর কথা লিখেছে। তিনি কিছু অন্যায় করে থাকলে তা শুধরে দেওয়ার অধিকার ছাত্রের আছে, কারণ ছাত্রেরা সন্তানতুল্য। বলতে বলতে তাঁর চোখে জল এসে যায়।
কথকের মনে হলাে তিনি স্নেহমমতা-ক্ষমার মহাসমুদ্রের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই স্নেহ-মমতাক্ষমার মূল্য কোনাে ঐশ্বর্য দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। তাঁর আরও মনে হলাে তাঁকে তিনি মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন। এ অনুতাপ ও লজ্জা রাখার ঠাই বুঝি তাঁর নেই।
দাম গল্পের প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ‘এ অপরাধ আমি কী কর, এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব।’–বক্তা কোন্ কৃতকর্মকে অপরাধ রূপে চিহ্নিত করেছেন? গল্পে এই অপরাধবােধ ও আত্মগ্লানি দূর হয়ে কীভাবে বক্তাৱ আত্মশুদ্ধি ঘটল তা বুঝিয়ে দাও।
উত্তর :
বক্তা হলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘দাম’ গল্পের কথক সুকুমার। বাংলায় এমএ পাস করে তিনি তখন এক কলেজের অধ্যাপক। এক পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অনুরােধ আসে তার ছেলেবেলা নিয়ে গল্প লেখার। তিনি তাঁর ছেলেবেলার অঙ্কের মাস্টারমশাই, যিনি ছাত্রদের কাছে শাসনতাড়নে ভয়ংকর বিভীষিকা বলে মনে হতেন, তাঁকে নিয়ে গল্পটি লেখেন।
গল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তােলেন। অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির কথা—শাসনতাড়ন করে প্রকৃতপক্ষে কিছুই শেখানাে যায় না, ওটা ভ্রান্ত পদ্ধতি। ওই গল্পের জন্য সুকুমার দশ টাকা দক্ষিণাও পেয়ে যান। তখন তাঁর মনে হয়, মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষার কিছু না পেলেও এটুকুই তাঁর নগদ লাভ হয়েছে। পরে বুঝেছেন এ তাঁর কৃতকর্মর্জনিত অমার্জনীয় মস্ত অপরাধ।
বাংলাদেশের এক দূর প্রান্তের একটি কলেজের জন্মবার্ষিকীতে সুকুমার আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা দিতে যান। অঙ্কের মাস্টারমশাই তখন ওই অঞ্চলের বাসিন্দা। পুরােনাে ছাত্র সুকুমার এসেছে শুনে তিনি তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসেন। বক্তৃতা শােনার পরে কলেজ মাঠে মাস্টারমশাই একান্তে দেখা করেন সুকুমারের সঙ্গে। বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করার পর কথা প্রসঙ্গে মাস্টারমশাই তাঁর কৃতী ছাত্র সুকুমারের জন্য গর্ব প্রকাশ করেন। তিনি জামার পকেট থেকে শতচ্ছিন্ন এক জীর্ণ পত্রিকা বের করেন।
তিনি বলেন যে, সুকুমারের লেখা গল্পটি তিনি সকলকে দেখান এবং তাঁদের জানান যে, তাঁর ছাত্র তাঁকে অমর করে দিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন যে, তিনি যেমন ছাত্রদের ধরে ধরে মারতেন, মাস্টারমশাইকে গল্পলেখক তেমনি বেশ শুনিয়ে দিয়েছেন। এসব কথা শােনার পরে সুকুমার বুঝতে পারেন তাঁর কৃতকর্মজনিত অপরাধের বিষয়। তখন লজ্জায় আত্মগ্লানিতে সুকুমার যেন মাটিতে মিশে যান।
ওদিকে মাস্টারমশাই কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলে সুকুমার লক্ষ করেন মাস্টারমশাইয়ের দু-চোখে জলের ধারা। সুকুমারের তখন মনে হয় যে, স্নেহ-মমতা-ক্ষমার মহাসমুদ্রের প্রান্তে এসে তিনি দাঁড়িয়েছেন, তা কুবেরের ঐশ্বর্যভাণ্ডার দিয়েও পাওয়া যায় না, অথচ একে তিনি মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে বেচেছিলেন। এই বােধােদয় ও অনুতাপআনুশােচনার সুতীব্র দহন তাঁর আত্মশুদ্ধি ঘটায়।
দাম গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন প্রখ্যাত গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাম’ গল্প তাবলম্বনে গল্পকথক সুকুমারের চরিত্রটি আলােচনা করো।
প্রশ্ন বিখ্যাত গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাম’ গল্প অবলম্বনে মাস্টারমশাই চরিত্রটি আলােচনা করাে।
উত্তর :
চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য : খ্যাতিমান গল্পকার : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচিত ‘দাম’ গল্পের দুটি প্রধান চরিত্র -১) অঙ্কের মাস্টারমশাই ২) ছাত্র তথা গল্পের কথক সুকুমার।
অঙ্কের মাস্টারমশাইকে নিয়েই গল্পের কাহিনি। সেজন্য তিনিই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মাস্টারমশাই চরিত্রটি লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অপূর্ব সৃষ্টি। অপূর্ব এই অর্থে যে, তাঁর মধ্যে কঠোরতা ও কোমলতার সমাবেশ হয়েছে। তাঁর চরিত্রের এটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষাদানে ত্রুটি ও মূর্তিমান বিভীষিকা : মানুষটা শিক্ষাদান কাজে ভয়ংকর কঠোর। যেন বজ। তিনি অঙ্কে পারদর্শী, সুপণ্ডিত ও মেধাবী। যেজন্য তাঁর দক্ষতা, পাণ্ডিত্য ও মেধা নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ওই বিষয়ের শিক্ষাদানে তিনি যেন মমত্বহীন। পুরুষ মানুষ হয়ে অঙ্ক জানে না, এটা তাঁর কাছে অঘটন। কল্পনার অতীত। অঙ্ক না পারলেই তাঁর প্রকাণ্ড হাতে প্রচণ্ড চড় খেতে হয়। চড় খেয়েও কাঁদবার উপায় নেই। তাহলেই ক্লাসরুম ফাটানাে হুংকার। পা ধরে স্কুলের পুকুরে ছুড়ে ফেলবার ভয়ংকর শাসানি। আর ওই ভয়ের কারণেই ছাত্রদের কাছে তিনি যেন মূর্তিমান বিভীষিকা।
বােধােদয় : শাসন-তাড়ন করে তাঁর শেখানাের পদ্ধতি ভুল। তার প্রভাব ছাত্রদের সুফল দেয় না। বরং ক্ষতিই করে। তাঁর এই বােধােদয় হয়েছে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ছাত্র সুকুমারের গল্প পড়ে। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন ছাত্র সন্তানতুল্য। শিক্ষকের। ভুল শুধরে দেওয়ার অধিকার তার আছে।
আন্তর্জগৎ তিনি ছাত্রের গুণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন। তার লেখা গল্পের জন্য তার দেওয়া গর্ববােধ করেছেন। তার লেখা তাঁকে অমর করেছে। তিনি স্বীকার করেছেন। তাঁর নীরবে চোখের জল ফেলা তাঁর কোমল হৃদয়ের পরিচয় হয়ে ছাত্রের চোখে ধরা পড়েছে। সুকুমারের মনে হয়েছে, সে মাস্টারমশাইয়ের স্নেহ-মমতা-ক্ষমার এক মহাসমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থ-সম্পদ-ঐশ্বর্য দিয়ে যে স্নেহ-মমতা-ক্ষমার পরিমাপ হয় না। এভাবেই মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতা দুই বিপরীতধর্মী গুণের সমাবেশ দেখা গেছে।
দাম গল্পের রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন প্রখ্যাত গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাম’ গল্প তাবলম্বনে গল্পকথক সুকুমারের চরিত্রটি আলােচনা করো
উত্তর: বিশিষ্ট চরিত্র : প্রখ্যাত গল্পকার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম’ গল্পের কথক হলেন কলেজ অধ্যাপক সুকুমার। তাঁর আত্মকথনে ‘দাম গল্পের কাহিনি গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রে কাহিনির শুরু থেকে শেষ অবধি তিনি জড়িত। তিনি গল্পের বিশিষ্ট চরিত্রও।
ছেলেবেলায় অঙ্কের মাস্টার মশাইকে ঘিরে তাঁর চিন্তাভাবনা ও বােধ। যার ওপর ভিত্তি করে তিনি মাস্টারমশাইকে নিয়ে পত্রিকায় গল্প লিখেছিলেন। পরে পরিণত বয়সে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের অন্তর্জগৎ দর্শনের মধ্যে তাঁর বােধের যে ফারাক, যে অনুতাপ ও অনুশােচনা, তা গল্পের মর্মসত্য। সেই সূত্রেও গল্পকথক সুকুমার গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র।
অনুভূতিপ্রবণ ও দৱদি চিত্ত : শৈশবে সুকুমার মাস্টারমশাইকে স্নেহহীন, দয়া-মমতাহীন ও ক্ষমাহীন ভয়ংকর শিক্ষক হিসেবে দেখেছেন। সেই স্মৃতি ও সেই ভয়ংকর বজ্রকঠোর কণ্ঠস্বর তাঁর মনের চোরাকুঠুরিতে গা ঢেকে থেকেছে। যেজন্য ছেলেবেলার গল্প শােনাতে গিয়ে তিনি মাস্টারমশাইকে নিয়ে গল্প লিখেছেন। মাস্টারমশাইয়ের শাসন-তাড়নসর্বস্ব শিক্ষাপদ্ধতিকে গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় করেছেন।
সেই শিক্ষার অসারত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মাঝে দীর্ঘ ব্যবধানের পর এক কলেজের বার্ষিক উৎসবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটায় তাঁর লেখা গল্পের কথা প্রসঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের চোখে জল দেখে সুকুমারের আত্মােপলব্ধি হয়েছে। তাঁর চোখে ধরা পড়েছে মাস্টারমশাইয়ের অন্তর্জগতের ছবি। তাঁর সেই জগৎ অন্তহীন স্নেহ-মমতা-ক্ষমায় সমৃদ্ধ। মানুষের মধ্যে অন্তর ও বাইরের দুই রূপ, দুই চেহারা।
বাইরে কঠোরতা, অন্তরে কোমলতা। তা চিনে নিতে সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ ও দরদি চিত্ত সাহিত্যিক সুকুমারের সামান্যতম দেরি হয়নি। মাস্টারমশাইয়ের অন্তর ও বাইরের সামগ্রিক রূপদর্শন তখনই সম্পন্ন হয়েছে। আর তখনই অনুতাপে, অনুশােচনায় ও লজ্জায় বিদ্ধ হয়েছেন সুকুমার । বিদ্ধ হয়েছেন তাঁর মাস্টারমশাইকে মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে বিক্রির অপরাধে।