সমাস আলোচনা পার্ট টু

সমাস আলোচনা পার্ট টু

সমাস আলোচনা: না তৎপুরুষ বা নঞ তৎপুরুষ  সমাস:

সমাস আলোচনা: না তৎপুরুষ বা নঞ তৎপুরুষ : যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ নঞ বা না-ব্যয়ের সঙ্গে পরপদ বিশেষ্য বা বিশেষণের সমাস হয় তাকে বলে না-তৎপুরুষ বা নঞ তৎপুরুষ সমাস।

সমাস-আলোচনা-পার্ট-টু

 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সংস্কৃতে ‘নঞ’ একটি অব্যয়, এর অর্থ হল না।  নঞ অব্যয়টি বাংলায় প্রসারণে না’, ‘নয়’, নাই’, ‘নেই’ হয় এবং সমস্তপদে এই না’ অব্যয়ের রুপ পালটে ‘অ’, ‘আ’, ‘অন’, ‘অনা’, ‘গর’, ‘বে’, ‘বি’ রূপে অবস্থান করে। অবশ্য কখনো কখনো ‘না’ ৰূপেও থেকে যায়।

পরপদের আদিতে ব্যঞ্জন থাকলে সমস্তপদে ‘অ’ এবং স্বরবর্ণ থাকলে অন’ হয়। অবশ্য কখনো-কখনাে অন’ না হয়ে নাও’ হয়। আরও স্মরণীয় যে, নঞ তৎপুরুষ সমাসে ন’ অব্যয়টি ‘না’ বা নয়’ রূপে ব্যবহৃত হয়। বলাবাহুল্য না-তৎপুরুষ নিষ্পন্ন বহু শব্দ আধুনিক বাংলায় ব্যবহৃত হয়।

সমাস আলোচনা: না-তৎপুরুষ সমাসেরকিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

 না অথবা নয় মিল=অমিল, নয় কাজ = অকাজ, নয় শান্ত = শান্ত, নয় কুষ্ঠিত – অকুণ্ঠিত, নয় জ্ঞাত = অজ্ঞাত, নয় স্পষ্ট = অস্পষ্ট, নয় ধর্ম = অধর্ম, না শিক্ষিত অশিক্ষিত, নয় জানা = অজানা, নয় দেখা = অদেখ, নয় চেনা = অচেনা, না ব্যক্ত = অব্যক্ত, অমুখ, নয় মজুর = নামঞ্জুর, নয় বলা = নাবলা, নয় চেনা = অচেনা, নয় অধিক = অনধিক, নয় অতিদীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ, নয় রাজি অরাজি, নয় আদর = অনাদর, নয় অভ্যাস = অনভ্যাস, নয় উচিত = অনুচিত, নয় ঐক্য = অনৈক্য, নয় এক = অনেক, নয় আবাদী = অনাবাদী, নয় অবনত = অনবনত, নয় অনুকুল = অননুকূল, নয় আয়ত্ত = অনায়ত্ত, নয় কড়া = অ-কাড়া, নয় ধােয়া = আবােয়া, নয় কাচা = আ-কাচা, নয় কাল = আকাল, নয় গাছ। আগাছা, নয় ফোটা = আফোটা, নয় সৃষ্টি। অনাসৃষ্টি, নয় বৃষ্টি অনাবৃষ্টি, নয় হিসেবী = বেহিসেবী, নয় দখল = বেদখল, নয় মানান = বেমানান, নয় আদব (ভদ্রতা) = বেয়াদব, নয় আক্কেল = বেয়াক্কেল, নয় সুর = বেসুর, নয় বন্দোবস্ত = বেন্দোবস্ত, নয় রসিক। বেরসিক, নয় তাল = বেতাল, নয় খরচ = নিখরচ, নয় ভেজাল = নির্ভেজাল, নয় হাজির = গরহাজির, নয় মিল = গরমিল নয় রাজি = গররাজি, নয় হাজির গরহাজির, নয় জোড় = বিজোড়, নয় যােগ = বিয়ােগ, নয় যুক্ত = বিযুক্ত, নয় সদৃশ = বৈসদৃশ্য, নয় দেহ = বিদেহ, নয় তৃষ্ণা বিতৃষা ইত্যাদি। 

সমাস আলোচনা: উপপদ তৎপুরুষ সমাস: 

উপপদ তৎপুরুষ ঃ যে-তৎপুরুষ সমাসে উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের সমাস হয়, সমস্তপদে উপপদের বিভক্তি লুপ্ত হয় এবং কৃদন্ত পদটির অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে বলা হয় উপপদ তৎপুরুষ সমাস।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উপপদ’ ও ‘উপসর্গ’ এক নয়। কৃৎ-প্রত্যয়যুক্ত পদের পূর্বে যেমন উপসর্গ বসে তেমনি অন্যশব্দেও বসে। উপসর্গ ভিন্ন অন্য শব্দকেই উপপদ বলে।

উপপদ-তৎপুরুষের ক্ষেত্রে উপপদ বলতে বােঝায় কৃৎ-প্রত্যয়জাত পদের অব্যবহিত পূর্বপদকে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের কর্ম, করণ, অপাদান অথবা অধিকরণ কারক-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ব্যাসবাক্যের শেষ পদটি হয় যা’, ‘যে’ বা ‘যিনি’।

সমাস আলোচনা: উপপদ-তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ 

হাড় ভেঙে যা = হাড়ভাঙা, কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার, পঙ্কএ জন্মে যা =পঙ্কজ, মধু পান করে যে = মধূপ, আকাশে চরে যে = খেচর, কর দান করে যে = করদ, গৃহে থাকে যে = গৃহস্থ, জলে চরে যে = জলচর, গিরিতে অবস্থান করেন যিনি = গিরিশ, গণিত জানেন যিনি =গণিতঞ্জ, শাস্ত্র জানেন যিনি = শাস্ত্রঞ্জ ,  যে

 সূত্র ধারণ করে যে = সূত্রধর, বর দান করে যে = বরদ, মনকে হরণ করে যে = মনোহর, বেদ জানেন যিনি = বেদজ্ঞ, ছেলে ধরে যে = ছেলেধরা, বর্ণ চুরি করে যে = বর্ণচোরা, সর্বনাশ করে যে= সর্বন্যশা, মিত ভাষণ করে যে = মিতভাষী, সর্বগ্রাস করে যে = সর্বগ্রাসী, ধামা ধরে যে = ধামাধরা, ভার বহন করে যে = ভারবাহী, সর্বত্র গমন করে যে = সর্বত্রগামী, জাদু করে যে = জাদুকর, শত্রুকে হত্যা করে যে = শত্ৰুগ্ন ইত্যাদি।

সমাস আলোচনা ব্যাপ্তি-তৎপুরুষ সমাস

যে তৎপুরুষ সমাসে ব্যাপ্তি অর্থে কালবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য বা বিশেষণের সমাস হয় তাকে বলে ব্যাপ্তি তৎপুরুষ সমাস।

সাধারণত এই সমাসের ব্যাসবাক্যে ধরে, ব্যাপিয়া, জুড়ে ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় এবং সমস্ত পদে ত| লুপ্ত হয়।

কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 চিরকাল ধরে সুখী = চিরসুখী, চির কাল ধরে শত্রু = চিরশত্রু,  চিরকাল ধরে স্থায়ী চিরস্থায়ী, মাস ব্যাপি অশৌচ = মাসাশৌচ,  চির কাল ধরে সুন্দর = চিরসুন্দর, চিরকাল ধরে ঋণী = চিরঋণী, চির কাল ধরে কুমার = চিরকুমার, চির কাল ধরে জীবিত = চিরজীবী, চির কাল ধরে প্রসিদ্ধ = চিরপ্রসিদ্ধ, চির কাল ধরে বিবৃতি = চিরবিস্মৃত। বিশ্ব ব্যাপি যুদ্ধ=বিশ্বযুদ্ধ

ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ ঃ যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ ক্রিয়া বিশেষণবাচক পদের সঙ্গে পরপদ বিশেষণের সমাস হয় তাকে বলা হয় ক্রিয়াবিশেষণ-তৎপুরুষ।

এই সমাসের ব্যাসবাক্যে ‘ভাবে’, রূপে’ অন্যপদ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সমস্ত-পদে তা লােপ পায়।

কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

অর্ধভাবে ফুট = অস্ফুট, অর্ধভাবে জীবিত= অর্ধজীবিত, দৃঢ়ভাবে বদ্ধ = দৃঢ়বদ্ধ, নিম রূপে রাজি = নিমরাজি, অর্ধ ভাবে সিক্ত = অর্ধসিক্ত, আধ ভাবে মরা = আধমরা, ঘন রূপে সন্নিবিষ্ট = ঘনসন্নিবিষ্ট, আধা ভাবে পাকা = আধপাকা, অর্ধ ভাবে মৃত = অর্ধমৃত, 

 (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংস্কৃতে ব্যাপ্তি অর্থে দ্বিতীয় বিভক্তি হয়। তাকে অনুসরণ করে বাংলায় পূর্বে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস গড়ে উঠেছিল। বিভক্তি অনুসরণে তৎপুরুষের নামকরণ পরবর্তীকালে পরিহার করা হয় কিন্তু ব্যাপ্তিসূচক পদ-নিপন্ন তৎপুরুষকে কর্ম-তৎপুরুষের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নতুন পাঠ্যক্রমের নির্দেশনায় ব্যাপ্তি-তৎপুরুষ বুপে স্বতন্ত্র তৎপুরুষ সমাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।)

 অর্ধ ভাবে উদয় = অর্পোদয়, তা বৃপে আবৃত = তাৰাবৃত,  সুপ্ত ভাবে মা = সুপ্তম, অর্ধ ভাবে গ্রাম = আগ্রাম, ইত্যাদি।

সমাস আলোচনা উপসর্গ-তৎপুরুষ  সমাস

উপসর্গ-তৎপুরুষ : যে-তৎপুরুষ সমাসে উপসর্গের সঙ্গে কৃদন্ত পদের এবং অব্যয়ের সঙ্গে নামপদের যােগে সমাস নিষ্পন্ন হয় তাকে বলে উপসর্গতৎপুরুষ।

উল্লেখ্য যে, সংস্কৃতে প্র, পরা, অতি প্রভৃতি উপসঃ যোগে যে-তৎপুরুষ সমাস গড়ে ওই তাকে বলা হয় প্রাদি তৎপুরুষ সমাস। বাংলায় তাকেই উপসর্গ-তৎপুরুষ সমাস বলা হয়েছে।

কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

– = প্রকৃষ্ট ভাবে ভাত = প্রভাত, অতিরিক্ত প্রাকৃত = অতিপ্ৰকৃত, মুখের সম্মুখে = অভিমুখ, অতিরিক্ত মানব = অতিমানব, তাপের পশ্চাৎ = অনুতাপ, মানুষকে অতিক্রান্ত = অতিমানুষ, অতিশয় যােগ = অতিযােগ, অতিরিক্ত লােমযুক্ত = অতিলোম, বেলাকে অতিক্রম = উদ্বেল, শৃঙ্খলাকে অতিক্রম = উচ্ছশৃঙ্খল, লােভকে অতিক্রম = অতিলোভ, মন্ত্রির সদৃশ = উপমন্ত্রী, কথার সদৃশ= উপকথা, হ্রদের সদৃশ = উপহ্রদ, মাতার সদৃশ = উপমাতা, কূলের সমীপে উপকূল, জীবন পর্যন্ত = আজীবন, কর্ণ পর্যন্ত = আকর্ণ, সাধ্যকে অতিক্রম না করে = যথাসাধ্য, শক্তিকে অতিক্রম না করে = যথাশক্তি, অক্ষির সম্মুখে = প্রত্যক্ষ, সমুদ্র পর্যন্ত আসমুদ্র, আচার্যের সদৃশ = উপাচার্য, ভাষার সদৃশ = উপভাষা, মূর্তির সদৃশ = প্রতিমূর্তি, গমনের পশ্চাৎ = অনুগমন, পক্ষের বিপরীত = প্রতিপক্ষ, কূলের বিরুদ্ধ = প্রতিকূল, বিবৃদ্ধ বিমাতা, প্রকৃষ্টভাবে চেষ্টা প্রচেষ্টা, অতিশয় তপ্ত = প্রতপ্ত, অনুরূপ ধ্বনি প্রতিধ্বনি, বাল্যকে অক্রিম = অতিবাল্য, বেলাকে অতিক্রম = উদ্বেল, গরহাজির, বেহিসেবি, কু-অভ্যাস, ভরাডুবি, পাতিলেবু, ভরসধে, বদহজম। =

দ্বন্দ্বসমাস

হর ও গৌরী= হরগৌরী, দিন ও রাত = দিনরাত, জায়া ও পতি = দম্পতি, জন্ম ও মৃত্যু = জম্মমৃত্যু, মেয়ে ও জামাই = মেয়ে জামাই, সুখ ও দুঃখ = সুখদুঃখ, হৃষ্ট ও পুষ্ট তৃষ্টপুষ্ট, টাকা ও কড়ি = টাকাকড়ি, সত্য ও মিথ্যা = সত্যমিথ্যা।

উপরের উদাহরণগুলিতে লক্ষ করলে দেখা যায় সমাসবদ্ধ বা সমস্তপদগুলি যথাক্রমে রো, ৱািত, দম্পতি, জন্মমৃত্যু, মেয়ে-জামাই, সুখদুঃখ, হৃষ্টপুষ্ট, টাকাকড়ি, সত্যমিথ্যা— এগুলি গড়ে উঠেছে দুই বিশেষ্য পদ, অথবা দুই বিশেষণ পদ, দুই বিপরীতার্থক শব্দ, ব্যাসবাক্যের পূর্বপদ ও পরপদ উভয়পদের অর্থ সমস্তপদে অক্ষুন্ন রয়েছে। 

যে-সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ অর্থাৎ উভয় সমস্যমান পদের অর্থ দ্বন্দ্ব সমাস সমস্তপদে অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে বলা হয় দ্বন্দ্ব সমাস।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ধরনের সমাসে প্রধানত দুই বিশেয্যপদের মধ্যে সমাস হয় না । কখনাে দুই বিশেষণ, দুই ক্রিয়ায়, দুই সমার্থক শব্দ দিয়ে, দুই বিপরীতার্থক শব্দ দিয়ে সামাস হতে পারে। আজকাল দুই সর্বনামেও দ্বন্দ্ব সমাস নিপন্ন হচ্ছে। 

দুই বিশেষ্যপদে দ্বন্দ্ব সমাস লক্ষ কর :  হাত ও পা = হাত পা, দুধ ও ভাত = দুধভাত, গুরু ও শিষ্য = গুরুশিষ্য, দেব ও দৈত্য = দেবদত্য, স্বামী ও স্ত্রী = স্বামিস্ত্রী, ধর্ম ও কর্ম = ধর্মকর্ম, ছেলে ও মেয়ে = ছেলে মেয়ে, ছাগল ও ভেড়া = ছাগল-ভেড়া, দেব ও দ্বিজ দেবজি, দেব ও দেবী= দেবদেবী,  

 চন্দ্র ও সূর্য = চন্দ্র-সূর্য, জল ও স্থল = জলস্থল, দেনো ও পাওনা = দেনা পাওনা, পড়া ও শুনা = পড়াশুনা, বই ও বাতলা = বুইকাতলা, কৈ ও মাগুর – কৈ মাগুর, বন ও জঙ্গল = বনজঙ্গল, গােরু ও বাছুর = গােরুবাছুর।

– দুই বিশেষণ পদে দ্বন্দ্ব সমাস লক্ষ কর : গণ্য ও মান্য = গণ্যমান্য, ছােটো ও বড়াে = ছােটোবড়াে, কুত্র ও বৃহৎ = কুদ্ৰবৃহৎ, ঠাণ্ডা ও গরম = ঠাণ্ডাগরন, সত্তা ও দানা = সহদানা, লাল ও কালো = লালকালো, ভালো ও মন্দ = ভালোমন্দ, ন্যায় ও হ্য’ = ন্যন্যায়, লাল ও নীল = লালনীল, চেনা ও অচেনা = চেনাচেনা, জানা ও অজানা = জানা-জানা ।

দুই সমার্থক অথবা প্রায় সমার্থক শব্দে দ্বন্দ্ব সমাস ? লােক ও জ = লোক, ভয় ও ভর = ভর, ই ও ভ= ছাইভ, জব ও জড় = জীবজন্তু, চর ও চাপ = চতুচাপ, টক ও টেলি = কিলি, হে ও মানব = নর, গ! ও গতর = -গর, কাপড় ও চোপড় = কাপড়-চোপড়, অস্ত্র ও শত্রু = অশ, ভুল ও ভ্রান্তি = সুতি নাল ও মশলা = মালমশলা, হাট ও বাজার = হাটবাজার, তালাপ ও সংলাপ = তনসাল, দোকান ও গাঢ় = দোকানপা, পাইক ও পেয়ান = পাইপে না, ঘড়ি ও বাড়ি = ঘটিবাটি, হাঁড়ি ও কুঁড়ি = হাঁড়িকুড়ি, আত্মীয় ও সুজন = তায়-স্বজন, মন ও হতে = নাই । :

সমাস আলোচনা : দুই বিপরীত শব্দে দ্বন্দ্ব সমাস লক্ষ কর :

 ধনী ও দরিদ্র = ধনীদরিদ্র সেরি, বেচা ও কেনা = বেচাকেন, স্বর্গ ও নরক = স্বর্গনরক, আয় ও ব্যয় = আয়ব্যায়, বাঁচা ও মরা = বাঁচামরা, ভালো ও মন্দ = ভালোমন্দ, দিন ও রাত = দিনরাত, আগা ও গোড়া = আগাগোড়া, পূর্ব ও পশ্চিম পূর্বপশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ = উত্তরদক্ষিণ, পাপ ও পুণ্য = পাপপুণ্য 

সমাস আলোচনা : বহুব্রীহি সমাস

বীণা পাণিতে যার = বীণাপাণি, শূলপাণিতে যার = শূলপাণি, দশ আনন যার = দশানন  পীত আম্বর যার = পীতাম্বর, ত্রি (তিন) লােচন (নয়ন) যার = ত্রিলােচন

উপরের উদাহরণগুলিতে সমস্তপদগুলি যথাক্রমে বীণাপাণি, শূলপাণি, দশানন, পীতাম্বর, ত্রিলােচন—এদের ব্যাসবাক্যের অন্তর্গত পূর্বপদ ও পরপদ কোনোটার অর্থই সমস্তপদে থাকছে না। সেক্ষেত্রে ভিন্ন একটি অর্থকে নির্দেশ করছে। যেমন— বীণাপাণি’ শব্দটি সরস্বতীকে, শূলপাণি শব্দটি শিবকে, দশানন’ শব্দটি রাবণকে, পীতাম্বর কৃষ্ণকে, ত্রিনয়ন শব্দটি শিবকে নির্দেশ করছে।

বহুব্রীহি সমাস : যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ কোনো পদেৱই অর্থ সমস্তপদে প্রাধান্য পায় না, অন্য অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে বলা হয় বহুব্রীহি সমাস।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যখন বহুব্রীহি সমাস বিশেষ্যে-বিশেয্যে হয় তখন সমস্যমান দুটি পদে একই বিভক্তি হয় না। যেমন চন্দ্র চূড়াতে যার = চন্দ্রচূড়। এখানে পূর্বপদ চন্দ্র শূন্যবিভক্তি এবং পরপদ ‘চূড়াতে’-তে বিভক্তি যুক্ত। এ ধরণের বহুব্রীহিকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি বলা হয়। আবার, যখন সমাস বিশেষণে-বিশেষ্যে হয় তখন উভয়পদে সমান বিভক্তি থাকে। যেমন—গৌর অঙ্গ যার = গৌরাঙ্গ। এখানে পূর্বপদ গৌর’ এবং পরপদ ‘অঙ্গ’ উভয়ক্ষেত্রে শূন্য বিভক্তি। এ ধরনের বস্রীহি সমাসকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি বলা হয়। এতদিন ধরে এরা বব্রীহি সমাসের উপবিভাগের অন্তর্গত ছিল। কার্যত বাংলা ব্যাকরণে এর কোনাে গুরুত্ব নেই। 

বহুব্রীহি সমাসের শ্রেণিবিভাগ।

 মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি , সংখ্যা বহুব্রীহি, ব্যতিহার বহুব্রীহি ,নাবহুব্রীহি, সহার্থক বহুব্রীহি।

মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি ও যে  বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যে আগত এক বা একাধিক পদ সমাসবদ্ধ পদে লুপ্ত হয় তাকে বলা হয় মধ্যপদলােপী বহুব্রীহি।

কিছু উদাহরণ লক্ষ কর : চাদের মতাে সুন্দর মুখ যার = চাঁদমুখ, চন্দ্রের ন্যায় সুন্দর বদন যার = চন্দ্রবদন, চন্দ্রবদনা (স্ত্রী), মৃগের নয়নের মতাে নয়ন যার = মৃগনয়না, শ্বর (কুকুরের) পদের মতাে পদ যার = শ্বাপদ, হাঙরের দাঁতের মতাে দাঁত যার = হাঙরদাঁতী, অন্যদিকে মন যার = অন্যমনস্ক, কমলের মতাে অক্ষি যার = কমলাক্ষ, বৃষের মতাে স্কন্ধ বৃহস্কধ, কপােতের অত্রি ন্যায় অক্ষি যার = কপােতাক্ষ, বিড়ালের অক্ষির ন্যায় অক্ষি যার = বিড়ালাকক্ষ, কমলের ন্যায় লােচন যার = কমললােচন, সূর্য তেজের ন্যায় তেজ সূর্যতেজা, শশীর ন্যায় সিদ্ধ বদন যার= শশীবদনা (স্ত্রী)। 

ব্যতিহার বহুব্রীহি ঃ পরস্পর একজাতীয় ক্রিয়ার বিনিময় বােঝাতে একই শব্দের পুনরাবৃত্তি দিয়ে যে সমাস নিষ্পন্ন হয় তাকে বলে ব্যতিহারবহুব্রীহি।

উল্লেখ্য যে, ব্যতিহার-বহুব্রীহিতে কার্যের বিনিময় অর্থ অবশ্যই প্রকাশ পেতে হবে এবং কখনাে কখনাে সমস্ত পদের পূর্বপদে ‘আ’, আর পরপদে ‘ই’ যুক্ত হয়। কার্যত যে শব্দদ্বৈতের মধ্যে পরস্পর ক্রিয়া বােঝাবে না, তা কিন্তু ব্যতিহার বহুব্রীহি হবে না।

ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

– পরপর কানে কানে যে শােনা = কানাকানি, পরপর হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি, পরপর চুলে চুলে আকর্ষণ করে যে যুদ্ধ = চুলাচুলি, পরপর দন্ডে দন্ডে যে যুদ্ধ = দন্ডদণ্ডি, পরপর লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি, পরস্পর গালি দিয়ে যে ঝগড়া = গালাগালি, পরপর কেশে কেশে যে যুদ্ধ = কেশাকেশি, পরপর গলায় গলায় যে মিল = গলাগলি।

সহাৰ্থক বহুব্রীহি ও সহাক (সম বা সমান) পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয় তাকে বলে সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাস।

সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ?

 পুত্রের সঙ্গে বর্তমান যে = সপুত্রক, স্ত্রীর সহিত বর্তমান যে = সস্ত্রীক, ফলের সঙ্গে বর্তমান  = সফল, টীকার সঙ্গে বর্তমান যা = সটীক, শশকের সঙ্গে বর্তমান যে = শশক, হর্ষের সঙ্গে বর্তমান যে = সহর্ষ, শব্দের সঙ্গে বর্তমান যা = সশব্দ, জীবনের সঙ্গে বর্তমান= সজীব, বান্ধবের সঙ্গে বর্তমান যে = সবান্ধব, প্রশংসার সঙ্গে বর্তমান যা = সপ্রশংস, জ্ঞানের সঙ্গে বর্তমান যে = সজ্ঞান।

না বহুব্রীহি/  নঞ বহুব্রীহি : নঞর্থক পূর্বপদের সঙ্গে যে বহুব্রীহি সমাস নিষ্পন্ন হয় তাকে বলে নঞর্থক বহুব্রীহি।

না বহুব্রীহি সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

নাই পুত্র যার = অপুত্রক, নাই দয়া যার = নির্দয়, নাই চেতনা যার = অচেতন, নাই শােক যার = অশােক, নাই পয় যার = অপয়া, নাই সীমা যার = অসীম, নাই আকার যার = নিরাকার, নাই মল যাতে = নির্মল, নাই লজ্জা যার = নির্লজ্জ, নাই রাজা যেখানে = অরাজক, নাই বোধ যার = অবোধ, নাই কারণ যাহাতে = অকারণ, নাই নাথ যার = অনাথ, নাই সন্তান যার = নিঃসন্তান, নাই তাল যার = বেতাল, নাই কসুর যার = বেকসুর, নাই হায়া (লজা) যার = বেহায়া, নাই ওয়ারিশ যার = বেওয়ারিশ।

সংখ্যাবহুব্রীহি ঃ যে বহুব্রীহি সমাসে সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে বিশেষ্যের সমাস হয় এবং সমস্তপদ অন্য অর্থ নির্দেশ করে তাকে বলে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি।

উল্লেখ্য যে, দ্বিগুর সঙ্গে এই সমাসের আপাত সাদৃশ্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। দ্বিগু সমাসে সমস্ত পদে সমষ্টি বা সমাহার বােঝায়, সংখ্যা বহুব্রীহিতে সমস্যমান পদ দুটির অর্থকে না বুঝিয়ে অতিরিক্ত কোনো অর্থকে নির্দেশ করে। যেমন—তে মাথা’—তে (তিন) মাথার সমাহার। তেমাথা’ শব্দটি দিয়ে তিনটি মাথার সমষ্টিকে বােঝাচ্ছে—এটি দ্বিগু, কিন্তু দশানন’—দশটি আনন যার, দশানন’ শব্দটি দিয়ে লঙ্কারাজ রাবণকে নির্দেশ করছে।

সংখ্যা বহুব্রীহি সমাসে কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 পঞ্চ আনন যার = পঞ্চানন, ষট আনন যার = ষড়ানন, এক অন্ত যার = একান্ত, দ্বি (দুই) দ্বিপদ, দ্বি (দুইদিকে) অধা যার = দ্বিধা, দশ ভুজ যার = দশভুজা (স্ত্রী), সে (তিন) তার যার = সেতার, দো (দুই) নল যার = দোনলা, ত্রি (তিন) নয়ন যার = ত্রিনয়ন।

দ্বিগু-সমাস:-

ত্রি (তিন) ভুবনের সমাহার = ত্রিভুবন, পঞ্চ বটের সমাহার = পঞ্চবতী, শত অব্দের সনহার = শতাব্দী, সপ্ত অহের সমাহার = সপ্তাহ, তিন কড়ি মূল্যে ক্রিত = তিনকড়ি।

উপরের উদাহরণগুলিতে লক্ষ করলে দেখা যায় সমস্ত পদগুলি যথাক্রমে ত্রিভুবন, পঞ্চবটী, শতাব্দী, সপ্তাহ ও তিনকড়ি। প্রথম চারটি উদাহরণে দেখা যায় ব্যাসবাক্যের তর্গত পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ ও পরপদটি বিশেষ্য এবং সমস্তপদের দ্বারা সমষ্টিকে নির্দেশ করছে এবং উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য থাকছে। আবার সর্বশেষ উদাহরণের ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ সংখ্যাবাচক বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকছে কিন্তু সমষ্টিকে নির্দেশ করছে না। দ্বিগু সমাসের এও আর এক বিশেষত্ব।

দ্বিগুসমাস : যেসমাসের পূর্বপদ হিসেবে সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে পরপদ হিসেবে বিশেষ্যের সমাস হয় এবং সমস্তপদ সমষ্টিকে নির্দেশ করে তাকে বলা হয় দ্বিগুসমাস।

বাংলায় প্রচলিত শব্দের ভিত্তিতে দ্বিগুসমাসকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়—(১) তদ্ধিতার্থক দ্বিগু, (২) সমাহার দ্বিগু।

তদ্ধিতার্থক দ্বিগু : যে-দ্বিগু-সমাসে তন্ধিতপ্রত্যয়-নিপন্ন শব্দ গঠিত হয় তাকে বলা হয় তদ্ধিতার্থক দ্বিগু।

কার্যত তদ্ধিতার্থক দ্বিগু-নিপন্ন শব্দ ব্যক্তির নামবাচক শব্দ হিসেবে গড়ে ওঠে, কখনো সমষ্টিকে নির্দেশ করে না। যেমন—তিন কড়ি মূল্যে ক্রিত = তিনকড়ি, সাত কড়ি মূল্যে ক্রিত = সাতকড়ি, পাঁচ কড়ি মূল্যে ক্রিত = পাঁচকড়ি। এই সমাস নিষ্পন্ন শব্দ কড়ির সমষ্টিকে নির্দেশ করে না, কড়ি বা কড়ির সমষ্টি দিয়ে যে ব্যক্তিকে কেনা হয়েছে সেই ব্যক্তিকে বােঝায়।

সমাহার দ্বিগু : যে-দ্বিগু সমাসের সমস্তপদ সমষ্টি বা সমাহারকে নির্দেশ করে তাকে বলা হয় সমাহার-দ্বিগু।

এই দ্বিগু সমাসের প্রচলন বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই দ্বিগু-সমাসের সমস্ত পদের অন্তর্গত উত্তরপদে ঈ বা আ  যুক্ত হয়। যেমন—শত আব্দের সমাহার = শতাব্দী (ঈ), 

তে (তিন) প্রান্তরের সমাহার = তেপান্তর, নবরত্নের সমাহার = নবরত্ব, সপ্ত ঋষির সমাহার = সপ্তর্ষি, তিন মাথার সমাহার = তেমাথা, পঞ্চ  বটের সমাহার = পঞ্চবটী, এি (তিন) পদের সমাহার = ত্রিপদী, চতুঃ (চার) পদের সমষ্টি। চতুষ্পদী, ত্রি লােকের সমাহার = ত্রিলােকী, তে (তিন) পাযার সমষ্টি = তিনপাযা, নয়গ্রহের সমাহার = নবগ্রহ, এি (তিন) ভুবনের সমাহার = ত্রিভুবন, পঞ্চ ভূতের সমাহার = পঞ্চ ‘ভূত, সপ্ত অব্দের সমষ্টি = সপ্তাহ ইত্যাদি।

নিত্য সমাস

নিত্য সমাস : যে সমাসের ব্যাসবাক্য হয় না অথবা ব্যাসবাক্য করতে হলে অন্যপদের সাহায্যে ব্যাসবাক্য করতে হয় তাকে বলে নিত্য-সমাস।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিত্য সমাস কোনো স্বতন্ত্র শ্রেণির সমাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। ব্যাসবাক্যহীন সমাসকেই নিত্য সমাস বলা চলে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন- দেশান্তর = ‘দেশের অন্তর এই ব্যাসবাক্য করলে শব্দটি প্রকৃত তাই আসে না। অন্য দেশে = দেশান্তর করলে প্রকৃত অর্থ আসে। কৃষ্ণসর্প = কৃষ্ণ (কালো) যে সর্প—এই ব্যাসবাক্যে কালো রংয়ের সাপকে বােঝা। কিন্তু কৃথসপ’ বলতে একজাতীয় সাপকে  বােঝায়। সুতরাং প্রচলিত নিয়মে এর ব্যাসবাক্য করা যায় না

অ-লােপ সমাস

অ-লােপ সমাস: যে-সমাসের সমস্তপদে সমস্যমান পূর্বপদের বিভক্তি লােপ পায় না তাকে বলা হয় অ-লােপ সমাস।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অ-লোপ (অলুক) সমাস স্বতন্ত্র কোনো সমাস নয় । দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি সমাসে যেখানে পূর্বপদের বিভক্তি লােপ পায় না। সেখানেই সংশ্লিষ্ট সমাসের অ লোপ সমাস ধরা হয়। এই বিচারে প্রধানত অ-লােপ দু, অ-লোপ তৎপুরুষ, অলােপ বহুব্রীহি সমাস নিষ্পন্ন বহু শব্দ বাংলায় প্রচলিত আছে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *