সমাস আলোচনা পার্ট ওয়ান| সমাস নির্ণয়| samas|

 সমাস আলোচনা পার্ট ওয়ান|সমাস নির্ণয়|samas|

 

 সমাস কি

 

সমাস হল সংক্ষেপ করা। একাধিক শব্দকে জুড়ে একটি নতুন শব্দ সৃষ্টি করার জন্যই সমাস ব্যবহার করা হয়। বাংলাভাষায় সমাস গঠনের রীতি প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত-ভাষা ও সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে এসেছে। সেই সূত্রে বাংলা সমাসের শ্রেণিবিভাগটি যথেষ্ট সংস্কৃত অনুগামী। অবশ্য একথা ঠিক সাধু ভাষায় ও তৎসম শব্দে সমাসের বহুল ব্যবহার আছে। দীর্ঘদিন এভাবে চলেছে কিন্তু ধীরে ধীরে ভারাক্রান্ত সংস্কৃত রীতির বন্ধন-মুক্তির প্রয়াস ও আধুনিক গদ্য রীতিতে শব্দ ব্যবহারের গুরুত্ব বিবেচনা করে সমাস পদ্ধতির বর্তমান বিশ্লেষণে  যথেষ্ট পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়—‘অব্যয়ীভাব সমাসকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে বাক্যাশ্রয়ী’ সমাস হিসেবে তার এক শ্রেণির সংযােজন হয়েছে এবং তৎপুরুষ সমাসের কিছু পরিমার্জনা করা হয়েছে।

সমাস-আলোচনা-পার্ট-ওয়ান-সমাস-নির্ণয়-samas

 

বলাবাহুল্য, আধুনিক বাংলার গদ্যরীতিতে সর্বত্র চলিতরূপের প্রাধান্য পেয়েছে। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব বৃহৎ সমাসবদ্ধ শব্দের পরিহার করা হয়। তৎসত্ত্বেও বলতে হয় চলিত গদ্যে সমাসের গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। কেননা শব্দের ব্যাপ্তিকে সংক্ষিপ্ত করার প্রয়ােজনে এবং সুশ্রাব্য করার আকাঙক্ষায় আজও যথেষ্ট সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার হয়।

 

প্রথমেই জানা দরকার কখন সমাস হয়। যে-কোনাে পদের মিলনে সমাস হয় না। সমাস হতে গেলে পদগুলির মধ্যে অনিবার্যভাবে পরস্পর সম্বন্ধ বা আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থসংগতি দুই থাকতে হবে। একাধিক পদের মধ্যে যদি এই আকাঙক্ষা ও একটি বিশিষ্ট অর্থ না থাকে তাহলে সমাস হতে পারে না।

  যেমন—রাজপুত্র’ একটি সমাসবদ্ধ পদ। এই সমাস পদটিকে অর্থ সংগতি রেখে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়—রাজার পুত্র। রাজার’ ও ‘পুত্র’ এই পরস্পর সম্বন্ধ দুটি পদের মধ্যে সমাস হয়ে একটি পদ হয়েছে—রাজপুত্র’ যার মধ্যে দুটি পদের অর্থ অক্ষুন্না আছে। এই দুটি পদের মধ্যে যদি এই অনিবার্য সম্বন্ধ বা আকাঙক্ষা থাকত তাহলে দুটি পদের মিলনে যে সমস্তপদ গড়ে উঠত তার তাও অক্ষুন্ন থাকত । বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলা যায়। যেমনরত সুমনকে রাজার পুত্র ভাবছে। এই বাক্যে রতন ও সুমন এই দুটি পদের মধ্যে অনিবার্য সম্বন্ধ আকাক্ষা নেই। আর নেই বলে দুটির মিলনে অর্থসংগতিও আসবে না। ক্ষে, রাজার’ ও ‘পুত্র’ এই দুটি পদের মধ্যে পরস্পর আকাঙক্ষা আছে, আর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে মিলনে গড়ে-ওঠা রাজপুত্র’ পদটির মধ্যে আর্থ-সংগতি গড়ে উঠেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সমাসের ক্ষেত্রে পরপর সম্বন্ধ ও অর্থ-সংগতি প্রত্যাশিত শুধু নয়, অনিবার্য।

 

সমাস:  অর্থ সংগতি রেখে পরস্পর সম্বন্ধ-বিশিষ্ট একাধিক পদের মিলনকে সমাস বলে।

 

পরস্পর পদের সমাসে সমস্ত পদ, সমস্যমান পদ, পূর্বপদ, উত্তর পদ, ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য প্রসঙ্গটি এসে যায়।

 

রাজার পুত্র = রাজপুত্র সমস্তপদ

 

 রাজার সমস্যমান। (পূর্বপদ)

 

পুত্র সমস্যমান । (উত্তরপদ)

 

রাজার পুত্র- ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য

 

সমস্ত পদ :  পরস্পর সম্বন্ধ-বিশিষ্ট একাধিক পদ মিলিত হয়ে যে নতুন পদ গঠন করে তাকে বলা হয় সমস্ত পদ। যেমন—উপরের উদাহরণে রাজপুত্র।

 

সমস্যমান পদ : যে-সব পদের মিলনে সমস্তপদ গড়ে ওঠে তাদের প্রত্যেকটিকে বলে সমস্যমান পদ। যেমন—উপরের উদাহরণে রাজার’ ও ‘পুত্র’।

 

যে সমস্যমান পদ পূর্বে বসে তাকে বলা হয় পূর্বপদ, যেটি পরে বসে তাকে বলা হয় পরপদ বা উত্তরপদ। এখানে রাজার পূর্বপদ ও ‘পুত্র’ পরপদ।

 

ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ বাক্য : সমস্যমান পদগুলির পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ যেবাক্যের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয় তাকে বলে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ বাক্য। যেমন— উপরের উদাহরণে ‘রাজার পুত্র।

সমাসের শ্রেণিবিভাগ :-

 

কর্মধারয় সমাস,তৎপুরুষ সমাস,

দ্বন্দ্ব সমাস, বহুব্রীহি সমাস, নিত্য সমাস, দ্বিগু সমাস, অলোপ সমাস, বাক্যাশ্রয়ী সমাস

 

 বাংলা সমাসকে প্রধানত আট ভাগে ভাগ করা যায়— (১) কর্মধারয় সমাস, (২) তৎপুরুষ সমাস, (৩) দ্বন্দ্ব সমাস, (৪) বহুব্রীহি সমাস, (৫) দ্বিগু সমাস, (৬) নিত্য সমাস, (৭) অ-লােপ সমাস ও (৮) বাক্যাশ্রয়ী সমাস।

 

কর্মধারয় সমাস

 

নীল যে উৎপল =নীলােৎপল, মহৎ যে জন = মহাজন, যিনিই রাজা তিনিই ঋষি= রাজর্ষি, কাচা অথচ মিঠে = কাচামিঠে।

 

উপরের উদাহরণগুলিতে নীলােৎপল’ শব্দের ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ নীল’ (বিশেষণ), পরপদ—‘উৎপল’ (বিশেষ্য) ; অনুরূপভাবে ‘মহাজন’ শব্দের ব্যাসবাক্যে পূর্বপদ—মহৎ (বিশেষণ) পরপদ—‘জন’ (বিশেষ্য) ; রাজর্যি’ শব্দের ব্যাসবাক্যে উভয় পদই বিশেষ্য এবং একই ব্যক্তিকে বােঝাচ্ছে ; কঁাচামিঠে’ শব্দের ব্যাসবাক্যে উভয় পদই বিশেষণ এবং একই বস্তুকে বােঝাচ্ছে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি সমস্তপদে তার ব্যাসবাক্যের অন্তর্গত উত্তর পদের অর্থই প্রাধান্য পেয়েছে এবং পূর্বপদ ও পরপদের মধ্যে বিশেষ একটি সম্বন্ধ আছে। লক্ষনীয় বিষয়, কখনাে-কখনাে দুটি সমস্যমানপদই বিশেষ্য অথবা বিশেষণপদ একই বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্দেশ করছে। তাহলে এই উদাহরণগুলি থেকে কয়েকটি ধারণা পােষণ করতে পারা যায়—(১) বিশেষ্য-বিশেষণের সমাস হচ্ছে, (২) বিশেষ্যবিশেষণের মধ্যে একটি সম্বন্ধ থাকছে অর্থাৎ পূর্বপদ ও পরপদের মধ্যে একটি সম্বন্ধ গড়ে উঠছে, (৩) উত্তরপদ অর্থাৎ পরপদের অর্থের প্রাধান্য থাকছে।

 

কর্মধারয় সমাসঃ যেসমাসে পরস্পর সম্বন্ধ-বিশিষ্ট বিশেষ্য-বিশেষণের সমাস হয়, সমস্ত পদে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় এবং দুই বিশেষ্য বা দুই বিশেষণ পদে একই বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্দেশ করে তাকে বলা হয় কর্মধারয় সমাস।

 

কর্মধারয় সমাস ও তার শ্রেণিবিভাগ

 

 

কর্মধারয় সমাসকে প্রধানত পাঁচভাগে ভাগ করা যায়- (১) সাধারণ কর্মধারয়, (২) মধ্যপদলােপী কর্মধারয়, (৩) উপমান কর্মধারয়, (৪) উপমিত কর্মধারয়, (৫) রূপক কর্মধারয়।

 

১. সাধারণ কর্মধারয় । এই কর্মধারয় সমাস নিস্পন্ন হয় পূর্বপদ বিশেষণ পরপদ বিশেষ্য, অথবা উভয়পদ বিশেষ্য, অথবা উভয়পদ বিশেষণ নিয়ে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই উত্তর পদের অর্থের প্রাধান্য থাকে।

 

কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 

বিশেষ্য + বিশেষ্য ।

 

– যিনি মাতা তিনিই ঠাকুরণ = মাতাঠাকরুণ, যিনিই পিতা তিনিই দেব = পিতৃদেব, যিনি দেব তিনিই ঋষি = দেবর্ষি, যিনি নর তিনিই দেবতা = নরদেবতা, যিনিই না তিনিই গোসাই নাগোঁসাই, যিনি ঠাকুর তিনিই মশাই = ঠাকুরমশাই, যিনি শিক্ষক তিনি মশাই = শিক্ষকমশাই, যিনি গিন্নি তিনি মা = গিন্নিমা, যিনি খা তিনিই সাহেব = খাঁ সাহেব, যিনি দারােগা তিনিই বাবু = দারােগাবাবু, যিনি গুরু তিনি মশাই গুরুমশাই।

 

বিশেষণ বিশেষণ :

 

যিনি গণ্য তিনিই মান্য = গণ্যমান্য, স্নিগ্ধ অথচ উডজুল = মিথােজল, মিঠা অথচ কড়া = মিঠেকড়া, যেই হৃষ্ট সেই পুষ্ট = হৃষ্টপুষ্ট, যেই চালাক সেই চতুর চালাকচতুর, যেই পণ্ডিত সেই মূখ = পণ্ডিতমূখ, ঘন যে নীল = ঘননীল, যে শান্ত সেই শিষ্ট = শান্ত শিষ্ট, যা ভীষণ তাই মধুর = ভীষণ মধুর, শীত অথচ উষ্ম = শীতােষ্ণ।

 

বিশেষণ + বিশেষ্য । 

 

সু যে পুরুষ = সুপুরুষ, নীল যে আকাশ = নীলাকাশ, পূর্ণ যে চন্দ্র = পূর্ণচন্দ্র, মহৎ যে রানি = মহারানি, সৎ যে গুরু = সদগুরু, লাল যে পাথর = লালপাথর, মিষ্টি যে অন্ন = মিষ্টান্ন, শুচি যে বস্ত্র = শুচিবস্ত্র, নব যে যৌবন= নবযৌবন, কু যে পুরুষ = কুপুরুষ, রক্ত যে চন্দন = রক্তচন্দন, কাচা যে কলা কাঁচকলা, নষ্ট যে নীড় = নষ্টনীড়, রাঙা যে বৌ = রাঙাবো, পুণ্য যে ভূমি = পূণ্যভূমি, সৎ যে জন = সজ্জন, ভাজা যে চাল = চালভাজা, ধন যে রাজা = রাজাধন, অধম যে নর = নরাধম, কু যে নজর = কুনজর, সু যে নজর = সুনজর, উত্তম যে পুরুষ = পুরুষােত্তম, সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ, ভাজা যে বেগুন = বেগুনভাজা, বাটা যে হলুদ = হলুদবাটা।

 

১. মধ্যপদলােপী কর্মধারয় ঃ যে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত পদ সমস্তপদে লােপ পায় তাকে বলা হয় মধ্যপদলােপী কর্মধারয়।

 

 আপাত সম্পর্কহীন দুটি পদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থসংগতি গড়ে তোলার জন্যই এই কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যে অন্যপদ নিয়ে আসতে হয়। যেমন—ঘি মিশ্রিত ভাত। ঘি-ভাত’ শব্দটি দেখলে মনে হয়— পূর্বপদ ‘ঘি’-এর সঙ্গে ‘ভাত’ এর কোনো তাপাত সম্বব নেই কিন্তু ব্যাসবাক্যে যখন মিশ্রিত এই অন্যশব্দ নিয়ে পদটিকে বিশ্লেষণ করা হল তখন ‘ঘি’ পদটির সঙ্গে ভাত’ পদটির অর্থগত যােগ সৃষ্টি হল। আবার অর্থগত যােগ সৃষ্টি করার জন্য যেমন অন্যপদ আনা হল তেমনি সমপদে তাকে লুপ্ত করা হল। এইজন্যই তো মধ্যপদলােপী।

 

মধ্যপদলােপী কর্মধারায় সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

 

সিদুর রাখবার কৌটা =সিদুর-কৌটা, মানি (টাকা) রাখবার ব্যাগ (থলি) মানিব্যাগ, হাতে পরবার ঘড়ি =হাতঘড়ি, হাতে চালবার পাখা = হাতপাখা, সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন, ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই, জয়সূচক ধ্বনি =জয়ধ্বনি, পথে অনুষ্ঠিত সভা = পথসভা, বট নামক গাছ = বটগাছ, ভিক্ষা লব্ধ অন্ন = ভিক্ষান, মৌ সংগ্রহকারী মাছি = মৌমাছি, পদ্মা চিহ্নিত বেদী = পদ্মবেদী, সূচি নিষ্পন্ন শিল্প = সূচিশিল্প, দই মিশ্রিত ভাত = দইভাত, দুধ মিশ্রিত সাবু = দুধসাবু, চিৎ তাবস্থাতে সাঁতার = চিৎসাঁতার, জন্ম উপলক্ষে উৎসব = জন্মোৎসব, আকাশ প্রেরিত বাণী= আকাশবাণী, স্বাধীনতা উপলক্ষে উত্যাপিত দিসব = স্বাধীনতা দিবস, বিধান নগর নামীয় স্টেশন =বিধাননগর স্টেশন, হাওড়া নামাঙ্কিত স্টেশন = হাওড়া স্টেশন, কলকাতা নামক শহর = কলকাতা শহর, বুক সমান জল = বুক জল, কীর্তি সূচক ধ্বজা = কীর্তিধ্বজ, অষ্ট অধিক দশ = অষ্টাদশ, পল (মাংস) মিশ্রিত অন্ন = পলান, ছায়া প্রধান তরু = ছায়াতরু, তেল মাখবার ধুতি তেলধুতি, কীর্তি প্রকাশক মন্দির = কীর্তি মন্দির, ষট অধিক দশ = ষােড়শ।

 

উপমান, উপমিত ও রূপক কর্মধারায় সমাস

 

এই তিনটি সমাস একই সঙ্গে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনটি সমাসের আলােচ্য বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কাব্যিক সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য উপমা প্রয়ােগের রীতি বাংলাভাষায় প্রচলিত আছে। এই উদ্দেশে আমরা অনেক সময় দুটি বিজাতীয় বস্ত্র মধ্যে তুলনা করে থাকি। এই তুলনার প্রকৃতি বুঝতে গেলে উপমান, উপমেয় ও সাধারণ ধর্ম কাকে বলে তা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

 

প্রধান বক্তব্য বিষয় অর্থাৎ যাকে ভিত্তি করে তুলনা করা হয় তাকে বলে উপমেয়, যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে বলে উপমান, যে কাল্পনিক গুণকে আশ্রয় করে এই বিজাতীয় দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করা হয় তাকে বলে সাধারণ ধর্ম। তুলনা বােঝাবার জন্য ন্যায়, মতাে, সম প্রভৃতি যে-শব্দগুলি ব্যবহার করা হয় তাদের বলা হয় সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

 

 

সাশবাচক পদটি উপমানবাচক পদ ও সাধারণধর্মবাচক পদের মাঝখানে অবস্থান করে এবং পূর্বপদ বিশেষ্য ও পরপদ বিশেষণ হয়।

 

উপমিত কর্মধারয় : যে-কর্মধারয় সমাসে উপমেয়বাচক পদের সঙ্গে উপমানবাচক পদের সমাস হয় সাধারণ ধর্ম উহ্য থাকে তাকে বলা হয় উপমিত কর্মধারয় সমাস।

 

এক্ষেত্রে পূর্বপদ উপমেয়বাচক পদ এবং পরপদ উপমানবাচক পদ, সাদৃশ্যবাচক পদ পরপদের পরে বসে এবং উভয় পদ বিশেষ্য হয়।

রূপক কর্মধারয় সমাস

রূপক কর্মধারয় : যে-কর্মধারায় সমাসে উপমেয়বাচক পদের সঙ্গে উপমানপদের অভেদ কল্পনা করে সমাস হয় তাকে বলা হয়, রূপক কর্মধারয় সমাস।

 

এক্ষেত্রে পূর্বপদ উপমেয়বাচক, পরপদ উপমানবাচক হয় এবং অভেদ কল্পনা করার জন্য ব্যাসবাক্যে সাদৃশ্যবাচক পদ রূপ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রেও উভয়পদ বিশেষ্য। কার্যত উপমিত কর্মধারয়ের সঙ্গে তেমন কোনাে পার্থক্য থাকে না শুধু রূপক কর্মধারয়ে অভেদ কল্পনা প্রাধান্য পায়।

 

উপমান কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ :

 

– তুষারের ন্যায় ধবল = তুষার ধবল, মিশের ন্যায় কালাে = মিশকালাে, তুষারের ন্যায়। শীতল তুষার শীতল, লৌহের ন্যায় কঠিন = লৌহ কঠিন, সিদুরের মতাে রাঙা = সিদুররাঙা, দূর্বাদলের ন্যায় শ্যাম = দুর্বাদলশ্যাম, কুন্দের ন্যায় শুভ্র = কুশুভ্র, ফুটির মতাে কাটা = ফুটিফাটা, হিমের ন্যায় শীতল = হিমশীতল, কুসুমের মতাে কোমল = কুসুমকোমল, শশকের ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত, শৈলের মতাে উন্নত = শৈলােনত, তুহিনের ন্যায় শীতল =তুহিন শীতল, ইস্পাতের ন্যায় কঠিন =ইস্পাত কঠিন, হীরকের মতাে উজ্জল= হরােকোজল, হস্তির ন্যায় মুখ = হস্তিমুখ। 

 

উপমিত কর্মধারয়ের উদাহরণ :

 

ও চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্র, পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুসিংহ, চরণ পদ্মের ন্যায় = রপর, নয়ন কমলের ন্যায় = নয়নকমল, কর পল্লবের ন্যায় = করপল্লব, মুখ সােনার মতো = সােনামুখ, মুখ কমলের মতাে =কমলমুখ, কমলমুখী (স্ত্রী), নর সিংহের ন্যায়= নরসিংহ, আঁখি পদ্মের ন্যায় = পদ্মাআঁখি, পুরুষ ব্যাঘ্রের ন্যায় = পুরুষব্যাঘ্র। 

 

রূপক কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ:

 

জ্ঞান রূপ আলোক = জ্ঞানালােক, শােকরূপ সিন্ধু = শােকসিন্ধু, সংসার রূপ সাগর = সংসার সাগর, ভব রূপ নদী = ভবনদী, শােক রূপ অগ্নি = শােকাগ্নি, প্রাণ রূপ পাখি= প্রাণপাখি, ক্ষুধা ৰূপ আনল = ক্ষুধানল, ভক্তি রূপ সুধা= ভক্তিসুধা, আঁখি রূপ পাখি= আঁখিপাখি, মন রূপ মাঝি= মনমাঝি, বচন রূপ অমৃত =বচনামৃত, শান্তিরূপ বারি =শান্তিবারি। 

 

তৎপুরুষ সমাস: 

 

গঙ্গাকে প্রাপ্ত = গঙ্গাপ্রাপ্ত, এ দ্বারা যুক্ত = শ্ৰীযুক্ত, শে|ক দ্বারা আকুল = শােকাকুল, বিলাত হইতে ফেরত = বিলাতফেরত, গাছে পাকা = গাছপাকা, ধানের ক্ষেত = ধানক্ষেত, বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়েপাগলা।

 

  উপরের উদাহরণগুলিতে লক্ষ করলে দেখা যায় সমস্তপদগুলিতে ব্যাসবাক্যের অন্তর্গত যেটি পরপদ তার অর্থ বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং পূর্বপদের কোথাও বিভক্তি, কোথাও তানুসর্গ লুপ্ত পেয়েছে। লক্ষ করলে আরও দেখা যায় পূর্বপদের বিভক্তি ও অনুসর্গগুলি এসেছে কর্ম, করণ, তাপাদান, তাধিকরণ, নিমিত্ত, সম্বন্ধ সম্পর্কের ভিত্তিতে। সুতরাং এর থেকে আমরা তৎপুরুষের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে পারি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পূর্বপদের লুপ্ত বিভক্তি অনুসারে তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ করা হয়। যেমন, কর্ম-বিভক্তি লুপ্ত হলে কর্মতৎপুরুষ, করণ-বিভক্তি লুপ্ত হলে করণ-তৎপুরুষ ইত্যাদি।

 

তৎপুরুষ সমাস : যে সমাসে সমস্তপদে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় এবং পূর্বপদের বিভিক্ত বা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গ লুপ্ত হয় তাকে বলে তৎপুরুষ সমাস।

 

তৎপুরুষ সমাস ও তার শ্রেণিবিভাগ

 

 কর্ম-তৎপুরুষ, উপসর্গ-তৎপুরুষ, নিমিত্ত-তৎপুরুষ ,ক্রিয়া-বিশেষণ তৎপুরুষ ,করণ-তৎপুরুষ, অধিকরণ-তৎপুরুষ ,না-তৎপুরুষ ব্যাপ্তি-তৎপুরুষ, অপাদান-তৎপুরুষ, সম্বন্ধ-তৎপুরুষ,উপপদ-তৎপুরুষ

 

পূর্বপদের লুপ্ত বিভক্তি অনুসারে তৎপুরুষ সমাসকে ছ-ভাগে ভাগ করা যায় কর্ম-তৎপুরুষ, করণ-তৎপুরুষ, অপাদান-তৎপুরুষ, অধিকরণ-তৎপুরুষ, নিমিত্ত-তৎপুরুষ, সম্বন্ধতৎপুরুষ।

 

এরপরেও পূর্বপদে নাসূচক অব্যয় লুপ্ত হয়ে -না-তৎপুরুষ বা ন-তৎপুরুষ, উপপদকে আশ্রয় করে উপপদ-তৎপুরুষ তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে।  যথাব্যাপ্তি-তৎপুরুষ, ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ ও উপসর্গ-তৎপুরুষ। সুতরাং বর্তমানে তৎপুরুষ সমাসের উপবিভাগ দাঁড়ালাে এগারােটি।

 

কর্ম-তৎপুরুষ ঃ যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সঙ্গে কর্ম-সম্বন্ধ গড়ে ওঠে এবং সমস্তপদে কর্ম-বিভক্তি লুপ্ত হয় তাকে বলে কর্মতৎপুরুষ সমাস। সাধারণত পূর্বপদের ‘কে’-বিভক্তি লুপ্ত হয়।

 

তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

 

দুধকে দোয়া = দুধদোয়া, গাকে টেপা = গাটেপা, ফুলকে তােলা = ফুলতােলা, ঘরকে ধোয়া = ঘরধােয়া, সুখকে প্রাপ্ত সুখপ্রাপ্ত, কাঠকে কাটা = কাঠকাটা, কলাকে বেচা = কলাবেচা, কাপড়কে কাচা = কাপড়কাচা, গাড়িকে চালানাে = গাড়িচালানাে, হাঁড়িকে ভাঙা = হাঁড়িভাঙা, বধুকে বরণ = বধুবরণ, মালাকে বদল = মালাবদল, দেবকে দত্ত = দেবদত্ত,

 ছেলেকে ভোলানাে = ছেলেভোলানা, মাতাকে ভক্তি = মাতৃভক্তি।

 

করণ তৎপুরুষ সমাস

 

করণ তৎপুরুষ : যে পুরুষ সমাসে পূর্বপদের সঙ্গে করণ-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সমস্ত পদে  বিভক্তি লোপ পায় তাকে বলে করণ-তৎপুরুষ। সাধারণত পূর্বপদের ‘এ’,  দ্বার।’, ‘দিযা’ অনুসর্গ লোপ পায়। বস্তুত করণ-তৎপুরুষে ‘দ্বারা’ ও দিয়ে অনুসর্গ’র ব্যবহার বেশি।

 

করণ তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 

মন দিয়ে গড়া = মনগড়া, হাত দিয়ে গড়া = হাতগডা, হাত দ্বারা চালিত = হতচালিত, , ইচ্ছার দ্বারা ধ = ইচ্ছাধ, গুণ দ্বারা হীন গুণহীন, বুদ্ধি দ্বারা ইন = বুদ্ধিহীন, জল দ্বারা শূন্য = জলশূন্য, ঝাঁটা দিয়ে পেটা = ঝাঁটাপেটা, মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা, অশ্রু দিয়ে ভরা = অশ্রুভরা, কণ্টক দ্বারা আকীর্ণ = কণ্টাকাকীর্ণ, রসে পুষ্ট = রসপুষ্ট, বাতে আহত = বাতাহত, দারিদ্রে ক্লিষ্ট = দারিদ্রকষ্ট ,তারায় ভরা = তারাভরা, জলে ভরা = জলাভরা,  মেঘ দ্বারা আচ্ছন্ন = মােঘাচ্ছন্ন, শিশির দ্বারা সিক্ত = শিশিরসিক্ত, শােক দ্বারা আকুল = শোকাকুল, দু দ্বারা পােষ্য = দুপােয্য, যৌবন দ্বারা দীপ্ত = যৌবনদীপ্ত।

 

অপাদান তৎপুরুষ সমাস

 

অপাদান তৎপুরুষ : যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সতে| অপাদান-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সমস্তপদে অপাদান বিভক্তি লোপ পায় তাকে বলে অপাদান-তৎপুরুষ।

 

সাধারণত পূর্বপদের ‘এ’, ‘তে’ বিভক্তি অথবা অপেক্ষা, চেয়ে, হইতে, থেকে অনুসর্গ

 

অপাদান তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 

‘ঘর থেকে পালানো = ঘরপালানো, দুগ্ধ হইতে জাত = দুধজাত, আদি হইতে অd = আদ্যাও, বিলাত থেকে ফেরত= বিলাতফেরত, নিদ্রা থেকে উখিত = নিদ্রোথিত, দল থেকে ছুট = দলছুট,  ঋণ থেকে মুক্ত = ঋণমুক্ত. মরণ থেবে উত্তর = মরণোত্তর।

 

অধিকরণ তৎপুরুষ ! যে  সমাসে পূর্বপদের সঙ্গে তাধিকরণ সম্পর্ক গড়ে  এ  বিভক্তি লােপ পায় তাকে বলে অধিকরণ-তৎপুরুষ। সাধারণত পদের  ‘ত’ বিভক্তি লোপ পায়, বাংলার অধিকরণ তৎপুরুষ সাধারণত পূর্বপদের নিমিত্ত, উদ্দেশে, জন্য অনুসর্গ সমপদে লােপ পায়।

 

অধিকরণ তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ কর 

 

 বনে বাস = বনবাস. লড়াইতে পটু = লড়াই পটু, বিশ্বে বিখ্যাত = বিশ্ববিখ্যাত, গৃহে বাস =গৃহবাস, বনে জাত = বনজ।  অধ্যয়নে রত = অধ্যয়নরত, বিদ্যা উৎসাহ। = বিদ্যোৎসাহী, রনে কুশল = রণকুশল, মনে তাহ = মর্মাহত। অগ্রে গণ্য = অগ্রগণ্য। পদে আনত = পদানত, শাস্ত্রে বিশারদ= শাস্ত্রবিশারদ, কণ্ঠে গত =কণ্ঠাগত ইত্যাদি।

 

নিমিত্ত-তৎপুরুষ যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সঙ্গে নিমিত-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এ সমস্তপদে নিমিত্ত -বিভক্তি লোপ পায় তাকে বলে নিমিত্ততৎপুরুষ সমাস

 

নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাসের কিছু উদাহরণ লক্ষ্য কর 

 

মরণের জন্য কাঠি = মরণকাঠি, বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়ে পাগলা, পূজার জন্য গৃহ = পূজাগৃহ, ডাকের নিমিত্ত মাশুল = ডাকমাশুল। কিশােরদের জন্য সাহিত্য = সাহিত্য, রান্নার জন্য ঘর = রান্নাঘর, ধানের জন্য জমি = ধানিজমি, ছাত্রদের জন্য বাস = ছাত্রাবাস, তীর্থের উদ্দেশে যাত্রা = তীর্থযাত্রা। সাজের জন্য ঘর = সাজঘর,  জলের জন্য কর = জলকর, যুপের নিমিত্ত কাষ্ঠ = ঘূপকাষ্ঠ, পাগলেরর জন্য গরদ = পাগলাগারদ, সত্যের নিমিত্ত আগ্রহ = সত্যাগ্রহ, বসতের জন্য বাড়ি= বসতবাড়ি, তপের নিমিত্ত বন = তপােবন, শিগর নিমিত্ত আয়তন = জন্য প্রেম = দেশপ্রেম, জপের জন্য মালা = জপমালা, মুক্তির জন্য সাধনা = মুক্তিসাধনা, পুরীর উদ্দেশে যাত্রা = পুরীযাত্রা, পুণ্যের নিমিত্ত মান = পুণ্যান, বিশ্রামের নিমিত্ত কক্ষ = বিশ্রামকক্ষ।

 

সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস

 

সম্বন্ধ তৎপুরুষ ঃ যে-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সঙ্গে সব-সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সমস্তপদে পূর্বপদের সম্বন্ধ-বিভক্তি লােপ পায় তাকে বলা হয় সম্বন্দ-তৎপুরুষ

 

সাধারণত পূর্বপদের ‘র এর)’, ‘দের’ প্রভৃতি বিভক্তি সমপদে লােপ বায়। কিছু উদাহরণ লক্ষ কর ।

 

সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ

 

বামুদের পড়া বামুনপাড়া, ঠাকুরের বাড়ি = ঠাকুরবাড়ি, তালের পাতা = তলিপাতা, তার এল = তাত্রল, রাজার পুত্র = রাজপুত্র, নরদের পতি = নরপতি, দেশের নেতা = দেশনেতা, পিতার তুল্য = পিতৃতুল্য, ভগিনীর পতি = ভগ্নিপতি, বৃষ্টির পাত = বৃষ্টিপাত, পুকুরের ঘাট = পুকুরঘাট, তালের গাছ = তালগাছ, পণ্ডিতদের মহল = পণ্ডিতমহল, সূর্যের উদয় = সূর্যোদয়, ব্রাহ্মণদের পড়া = ব্রাহ্মণপাড়া, জাহাজের ঘাট = জাহাজঘাট, মাতার মূর্তি = মাতৃমুতি, গাছের তলা = গাছতলা, রাত্রির পূর্ণ = পূর্বরাত্র, দিনের মধ্য = মধ্যদিন, বিশ্বে মিত্র = বিশ্বামিত্র, হংসের রাজা = রাজহংস, ছাগীর দুধ = ছাগদুধ, মৃগীর শিশু = মৃগশিশু, বনের পতি = বনস্পতি, হংসীর ডি = হংসডি, দৈবের প্রসাদ = দৈবপ্রসাদ, দ্বিজেদের শ্রেষ্ঠ = দ্বিতশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *