মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা কর |Various elements of medieval Indo-history in bengali

 

  মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা কর |Various elements of medieval Indo-history in bengali

 

অথবা,

 

মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের উপাদানগুলির শ্রেণীবিন্যাস কর। উপাদানগুলির তুলনামূলক গুরুত্ব নিরূপণ কর।

 

; উত্তর। মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনার উপকরণের অভাব নাই । বরং প্রাচুৰ্য্যই রহিয়াছে । সমসাময়িক ঐতিহাসিক সাহিত্যে সভাকবির রচনা, বিদেশী বণি ও পর্যটকদের বৃত্তান্ত প্রভৃতি মধ্যযুগে লিখিত  উপকরণের অস্তিত্ব রহিয়াছে। তবে সেগুলি মাঝে মাঝে পরস্পর-বিরােধী ; বর্তমান ঐতিহাসিকগণকে অত্যন্ত  সাবধানতার সহিত সেগুলি হইতে সত্য নিরূপণ করিয়া ইতিহাস রচনা করিতে হয় । এই যুগের ইতিহাস রচনার উপাদানসমূহকে সাধারণত চারিভাগে ভাগ করা চলে : (১) সরকারী দলিলপত্র, (২) ঐতিহাসিক সাহিত্য, (৩)  বিদেশী পর্যটক ও বণিকদের বৃত্তান্ত, (৪) মুদ্রা ও শিল্প নিদর্শন। 

মধ্যযুগের-ভারত-ইতিহাসের-বিভিন্ন-উপাদানগুলি-সংক্ষেপে-আলােচনা-কর -Various-elements-of-medieval-Indo-history-bengali

 

(১) মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনায় সরকারী দলিলপত্র :

 কোন দেশের ইতিহাস রচনায় সরকারী দলিলপত্র নিঃসন্দেহে একটি নির্ভরশীল সূত্র । সুলতানি ও মােগল যুগে সরকারী দলিলপত্র রক্ষা করিবার সুবন্দোবস্ত ছিল। এই সকল দলিলপত্রের অধিকাংশই পরবর্তী যুগের  যুদ্ধবিগ্রহের এবং অযত্নের ফলে নষ্ট হইয়া যায়। সম্রাট আকবরের  গ্রন্থাগারে রক্ষিত প্রায় ২৪০০০ মূল্যবান পাণ্ডুলিপির একটিও রক্ষা পায় নাই। যাহা কিছু দলিলপত্র বিভিন্ন স্থানে রক্ষা পাইয়া গিয়াছে, তাহা হইতে এই যুগের ইতিহাস রচনার কিছু উপকরণ সংগ্রহ করা গিয়াছে ।

 

(2) মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক রচনা : 

 সুলতানি ও মােগল উভয় আমলেরই অনেক ঐতিহাসিক সাহিত্য পাওয়া গিয়াছে। সুলতানি আমলের রচিত গ্রন্থগুলি প্রায় সবই রাজানুগৃহীত সভাকবিদের দ্বারা রচিত, সুতরাং সেগুলি অনেক  স্থলে অতিরিক্ত পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা যুগের রচনা ছিলেন মূলত দরবারী ঐতিহাসিক। মােগল আমলে অবশ্য সভাকবি ছাড়াও অন্যান্য মুসলমান ও হিন্দু ঐতিহাসিকদের স্বতন্ত্রভাবে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও জীবনচরিত পাওয়া যায়।

 

(ক) আল-বিরুণী :  গজনীর সুলতান মামুদের সভাকবি সুপণ্ডিত আবিরুণী ভারতবর্ষে থাকিয়া একটি মূল্যবান গ্রন্থ, ‘তহ্-ফিক-ই-হিন্দ’ রচনা করিয়া গিয়াছেন। মুসলমান আক্রমণের সমসাময়িক ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে, হিন্দু সমাজের আল-বণীর রীতিনীতি, আচার ব্যবহার সম্বন্ধে তিনি একটি মনোেজ্ঞ বিবরণ রাখিয়া গিয়াছেন। মধ্যযুগের প্রাক্কালে ভারতীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রা ও সভ্যতার স্তর সম্বন্ধে তঁাহার রচনা হইতে অনেক তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে।

মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানগুলি সংক্ষেপে আলােচনা কর

 (খ) মিনহাজ-উদ্দিন সিরাজ : তাহার রচিত ‘তবকৎ-ই-নাসিরী’ ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত। ইহাতে মুসলিম জগতের ইতিহাস  সাধারণভাবে আলােচিত থাকিলেও ভারতে মুসলমান আগমন এবং ১২৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লীর দাস সুলতানদের সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় ।

 

(গ) সুলতানি আমলের অন্যান্য ইতিহাস প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন ও আলাউদ্দিন খাজীর আমলে সভাকবি আমীর খসরু, সুলতান  জিয়াউদ্দিন বলবন হইতে ফিরােজ তােঘলক পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস বারণী, আইন-উল-মূলক রচয়িতা জিয়াউদ্দিন বারণী, মহম্মদ-বিন-ততাঘল আমলের আইন-উল মূক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মােগল সম্রাট আকবরের সভাসদ ঐতিহাসিক ফেরিস্তাও সুলতানি আমল সম্বন্ধে ইতিহাস রচনা ফিরিস্তা ফতােয়াৎ-ইকরিয়া গিয়াছেন। সুলতান ফিরুজ শাহের নিজস্ব রচিত ‘ফতােয়াৎ ফিরুজশাহী ই-ফিরুজশাহী’ গ্রন্থে ফিরুজ শাহের শাসনব্যবস্থার একটি ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায় ।

 

(ঘ) মােগল যুগের ঐতিহাসিক সাহিত্য আরও বেশি ; বাবর সংক্রান্ত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন মীর্জা হায়দার, শের শাহের ঘটনা লিখিয়াছেন আব্বাস শেরওয়ানী । আকবরের রাজত্বকালের বিশদ ও তথ্যপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় আবুল-ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ ও ‘আকবরনামা’ গ্রন্থদ্বয়ের মধ্যে। মধ্যযুগের লেখকদের মধ্যে মীর্জা হায়দার আব্বাস আবুল ফজলই সর্বপ্রথম ধর্ম নিরপেক্ষ ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া  ইতিহাস রচনায় মনােনিবেশ করেন। তাহার পূর্বের লেখকগণ  শুধুমাত্র সম্রাটদের কার্যকলাপ, রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। বাউনী রচিত ‘মুন্তাখার-উৎ-তােখারিখ’ গ্রন্থখানিও

 

সমসাময়িক ঐতিহাসিক সাহিত্যের অন্যতম । ফেরিস্তার ‘তারিখ-ই-হিন্দ’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য।

 

(ঙ) পরবর্তী ঐতিহাসিক সাহিত্যের মধ্যে মুতামিদ খানের রচনা ‘ইকবাল নাম-ই-জাহাঙ্গীরী’,শাহজাহানের রাজত্বকাল সম্বন্ধে আবদুল হামিদ লাহােরীর রচনা ‘বাদশাহী-নামা’, ঔরঙ্গজেব সম্বন্ধে কাফী খা রচিত ‘মুন্তাখানার কাফী খা উল-লুবাক’ প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য।

 

(চ) এই যুগে লিখিত আত্মজীবনী ও জীবন চরিতগুলিও ইতিহাস রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। বাবরের ও জাহাঙ্গীরের স্বরচিত জীবন-স্মৃতি দুইখানি,  জৌহর রচিত হুমায়ুনের জীবনচরিত এবং হুমায়ুনের ভগিনী ‘তুমায়ুননামা’ গুলবদন রচিত ‘হুমায়ুননামা’ প্রভৃতি গ্রন্থের সাহায্যে সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বহু তথ্য পাওয়া গিয়াছে।

 

(ছ) এই যুগ সম্বন্ধে সমসাময়িক হিন্দু লেখকদেরও অনেক ইতিহাস ও সাহিত্য আছে। শিবাজীর সমসাময়িক মারাঠা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সভাসদ বখর’,  ও শিখদের ‘গ্রন্থ-সাহেব’, রাজপুতদের ‘চারণগীতি’ প্রভৃতি ‘গ্রস্থ সাহেব উল্লেখযােগ্য। সুজন রায়, কেবলরাম, ঈশ্বরদাস প্রমুখ হিন্দু পণ্ডিতগণ ফারসি ভাষায় কয়েকটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন।

 

(জ) এই যুগে বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ হইতে তদানীন্তন ভার তর সামাজিক অবস্থা, চিন্তাধারা, ধর্মমত ও ধর্মাচরণ সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা গিয়াছে । 

 

 

(৩) মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনায় বিদেশী পর্যটকদের বিবরণী:

  সুলতানি ও মােগল আমলে বহু বিদেশী বণিক ও পর্যটক ভারতে আসিয়াছিলেন। তাহাদের লিখিত বিবরণ হইতে সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যাহা  নিঃসন্দেহে মধ্যযুগীয় ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপকরণ।

 (ক) বিদেশী পর্যটক আফ্রিকাবাসী ইববতুতা (Ibn Batuta) সুলতান  মহম্মদ-বিন-তােঘলকের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে ছিলেন এবং তিনি সেই সময়ের একখানি নিখুঁত ইতিবৃত্ত রচনা করিয়া গিয়াছেন। 

(খ) ইতালীয় পর্যটক নিকোলাে কন্টি, পারসীক পর্যটক আবদুর রজ্জাক, পর্তুগীজ পর্যটক পায়েজ ও নুনিজ, রুশ পর্যটক আথানুসিয়াস, নিকিতিন প্রমুখ দাক্ষিণাত্যে ভ্রমণ করিয়া সেখানকার  অবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা করিয়াছেন। মার্কোপােলাের নামও উল্লেখযােগ্য।

 (গ) পঞ্চদশ শতাব্দীতে চীন দেশীয় পর্যটক মাউহন ইওরােপীয় পর্যটক বঙ্গদেশ ভ্রমণ করিয়া সেই দেশের অবস্থার একটি চিত্র লিখিয়া গিয়াছেন।

 (ঘ) খ্রীষ্টান ধমর্যাজক ও ধর্মপ্রচারক মসেরেট, জেভিয়ের প্রমুখের রচনা, ইওরােপীয় পর্যটক র্যাল ফিচ, স্যার টমাস রাে, হকিন্স, বার্ণিয়ার, টেভারনিয়ে প্রমুখের বিবরণ এই যুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক তথ্য পাওয়া যায় ।

 

 (৪)মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ও শিল্প নিদর্শন : 

সুলতানি ও মােগল যুগের মুদ্রাগুলি বিশ্লেষণ করিয়া ঐ যুগের ধাতুশিল্প এবং বিভিন্ন সুলতান ও বাদশাহের মুদ্রানীতি সম্বন্ধে পরিচয়  লাভ করা যায়। ঐ সময়গুলির চিত্র, ভাস্কর্য, স্থাপত্য নিদর্শন হইতে ঐ ভারতীয় স্থাপত্য যুগের ভারতীয় স্থাপত্য ও অন্যান্য শিল্পকলার উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাস রচনার উপাদান গুলির মূল্যায়ন:

মধ্যযুগের ইতিহাসের উপাদানগুলি আলােচনা করিয়া দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ লেখকদের গ্রন্থগুলি রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাস রচনায় সহায়তা করে, অন্যদিকে বৈদেশিক পর্যটক ও লেখকদের বিবরণীতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্যাদি পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিক উপাদানগুলির উপযােগিতা হইল সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে। তবে লিখিত উপাদানগুলি তুলনামূলকভাবে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাহাতে সন্দেহ নাই ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *