সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য ও নীতি, সাফল্য ও ব্যর্থতা আলোচনা করো
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য ও নীতি, সাফল্য ও ব্যর্থতা আলোচনা করো
■ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উৎপত্তির বিষয়টি সংক্ষেপে আলােচনা কর।
উত্তর। পৃথিবীকে যুদ্ধের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করা এবং এক চিরস্থায়ী শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত যত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ (United Nations) নামক আন্তর্জাতিক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য। বিশ্ব-ইতিহাসের এক দুর্যোগময় অধ্যায়ে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার নতুন আশ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠে এই সংগঠনটি। দুটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিশ্বব্যাপী মন্দা, ইতিহাসের অদৃষ্টপূর্ব ধ্বংসলীলা, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিপর্যয়—এগুলির যাতে ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গঠনের উদ্যোগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই শুরু হয়ে যায়।
১৯৪১ সালের ১৪ই আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট আটলান্টিক মহাসাগরে একটি যুদ্ধ জাহাজে মিলিত হয়ে বিশ্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের আশার ভিত্তিতে আটটি নীতি ঘােষণা করেন। এই ঘােষণা আটলান্টিক সনদ (Atlantic Charter) নামে পরিচিত এবং এটাকেই অনেকে জাতিপুঞ্জ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত করেন। ঐ চার্টারে নাৎসি স্বৈরাচারকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করার 1 সংকল্প নেওয়া হয় এবং নিরস্ত্রীকরণকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্তরূপে গণ্য করা হয়। ১৯৪১ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর সােভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, চেকোশ্লোভাকিয়া, গ্রীস, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, লুকসেমবার্গ, পােল্যান্ড, যুগােশ্লাভিয়া এবং ফ্রান্সের প্রতিনিধিগণ সনদে স্বাক্ষর করেন।
- আরো পড়ুন.. সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার গঠন, কার্যাবলী ও ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা
- সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে আলােচনা কর।
১৯৪২ সালের ১লা জানুয়ারি ওয়াশিংটনে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া একটি ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করে আটলান্টিক চার্টারে উল্লিখিত নীতি ও আদর্শকে স্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীকালে আরও ২২টি রাষ্ট্র ঐসব আদর্শ গ্রহণ করে। ওয়াশিংটন সম্মেলনে সর্বপ্রথম সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ কথাটি ব্যবহার করে এটিকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঘােষণাপত্র’ (The United Nations Declaration) আখ্যা দেওয়া হয়। জাতিপুঞ্জের ঘােষণায় বলা হয় যে আটল্যান্টিক সনদে সংযােজিত সকল নীতি ও উদ্দেশ্যের প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শন, জীবন, স্বাধীনতা, জাতীয় মুক্তি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মানব অধিকার ও ন্যায় বিচার সংরক্ষণের জন্য শত্রুর পরাজয় অত্যাবশ্যক।
১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সেভিয়েত রাশিয়ার বৈদেশিক মন্ত্রীরা এবং মস্কোয় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মস্কোয় অনুষ্ঠিত একটি অধিবেশনে (Moscow Conference) মিলিত হয়ে ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল নীতি ও উদ্দেশ্যসমুহ সম্পর্কে আলােচনা করেন এবং যতশীঘ্র সম্ভব একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন। এই সংগঠন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় দেশের সার্বভৌম সমতার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সকল দেশের কাছেই এর সদস্যপদ গ্রহণের পথ উন্মুক্ত থাকবে—এই মর্মে একটি যৌথ ঘােষণা প্রকাশ করা হয়। একদিক থেকে এই যৌথ ঘােষণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের কথা এত সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করল।
মস্কো অধিবেশনের পর ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সেভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে যথাক্রমে জভেল্ট, চার্চিল ও ডালিন তেহেরানে একটি অধিবেশনে (Teheran Conference) মিলিত হয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের সম্ভাবনা ও সমস্যা সম্পর্কে অনুপুঙ্গ আলোচনা করেন। এই অধিবেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের একটি যৌথ বিবৃতিতে ঘােষণা করা হয় যে বিশ্বের ছােট-বড় সকল রাষ্ট্রের সহযােগিতার ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তােলাই হল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ হল ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে ওয়াশিংটনের সন্নিকটে ডাম্বারটন ওঁক-এ অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন (Dumbarton Oaks Conference)। প্রথম পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিগণের মধ্যে আলােচনা হয়। আলােচনা চলে ১৯৪৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলােচনা শুরু হয় ২৯শে সেপ্টেম্বর থেকে এবং চলে ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে চীনও যােগদান করে। এই সম্মেলনের শেষে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাঠামাে সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ডাম্বারটন ওকসের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন বিশ্ব সংগঠনের নামকরণ হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’। এই সম্মেলনে প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্দেশ্য, নীতিসমূহ, প্রধান সংস্থাসমূহ, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে সংগঠনের চারটি বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়। (১) একটি সাধারণ সভা থাকবে যা সকল সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত হবে। এর কাজ হবে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যাপারে আলােচনা করা। (২) একটি নিরাপত্তা পরিষদ থাকবে, যা ১১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এদের মধ্যে ৫ জন হবে স্থায়ী সদস্য এবং বাকি ৬ জন অস্থায়ী সদস্য। অস্থায়ী সদস্যগণ সাধারণ সভা কর্তৃক দু’বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ভবিষ্যতে যুদ্ধ প্রতিরােধ এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। (৩) ডাম্বারটন ওকস্ পরিকল্পনায় একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় এবং সচিবালয় গঠনের কথা হয়। (৪) প্রস্তাবে সাধারণ সভার তত্ত্বাবধানে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ গঠনের উল্লেখ করা হয়।
ডাম্বারটন ওক এর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়াল্টায় (Yalta) অপর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও চীন—এই ৫টি স্থায়ী সদস্যকে ভেটো-ক্ষমতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইয়াল্টাতেই তিন রাষ্ট্রপ্রধান (রুজভেল্ট, চার্চিল ও তালিন) স্থির করেন যে, ঐ বৎসর ২৫ শে এপ্রিল সানফ্রান্সিসকো শহরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের এক সভা অনুষ্ঠিত হবে এবং ঐ সভায় ডাম্বারটন ওকস্ ও ইয়াল্টায় গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হবে।
১৯৪৫ সালের ২৫শে এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। বিভিন্ন দেশের প্রায় ৮৫০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিল। সমকালীন বিশ্বের ৮০ শতাংশ মানুষের এতি’ন’ং এই নেন শগ্রহণ করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার ক. S”শ সম্মেলনই হল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বশেষ স্তর। স্বভাবতই এই মুন ‘আন্তর্জাতিক সংগঠন সম্পর্কিত জাতিপুঞ্জের সম্মেলন’ (United Nations ( International Organisations) নামে পরিচিত। সম্মেলন চলে ঐ হংহং ২৬ শ জুন পর্যন্ত। এই সম্মেলনেই একটি প্রস্তাবনা এবং ১১১টি অনুচ্ছেদ ২২নত জাতিপুঞর সনদের চূড়ান্ত রূপ দান করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, হয়ত ইউনিয়ন এবং চীন এই পাঁচটি রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে ইং করা হয়। তাছাড়া আরও স্থির হয় যে, যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গবে এই ৫টি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের ভেটো দানের ক্ষমতা থাকবে। পাঁচটি। বৃহৎ শক্তিকে ভােট প্রদানের অধিকার দেওয়ার মধ্য দিয়ে একথাই বােঝানাে হয়েছে যে, জাতিপুঞ্জের ন্যায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব এবং কর্মদক্ষতা ঐ বৃহৎ পঞ্চশক্তির (Big Five) ঐক্যবদ্ধ সহযােগিতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। বৃহৎ পঞ্চশক্তি এবং হকারী দেশগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সমর্থিত হবার পর ১৯৪৫ সালের ২৪ শে তার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই সারা বিশ্বে ২৪ শে অক্টোবর তারিখটি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে থাকে। সকালে এর সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৫১, আজ (মে, ১৯৯৪) তা বেড়ে ১৮৫তে ভয়েছে। এইচ. জি. নিকোলাস (H. G. Nicholas)-এর মতে, “জাতিসংঘ (League of Nations) প্রতিষ্ঠার ২৬ বৎসর পরে আর একটি ব্যাপক বিশ্বসংস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য হয়ে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় প্রয়াস শুরু হল।”
প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ডঃ রাধারমণ চক্রবর্তীর মতে, “এ পর্যন্ত হতরাষ্ট্র সংগঠনের যতগুলি প্রচেষ্টা হয়েছে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ তার মধ্যে সর্বাধিক সংহতির প্রতিশ্রুতি বহন করে এনেছে। রাজনীতি, মতাদর্শ, ভৌগােলিক অবস্থান নির্বিশেষে সহ বিশ্বের সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ। সর্বোপরি, এর তৎপরতা ও কার্যক্রম শুধু নিরাপত্তার সংকীর্ণ প্রয়ােজনে নয়, সারা পৃথিবীর মনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অগ্রগতি ও সহযােগিতার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে।”
■ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য এবং নীতিসমূহ আলােচনা কর।
উত্তর। পৃথিবী থেকে অশান্তি তথা যুদ্ধের মূল কারণগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করে শন্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সদর দম্য দূর করা, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তুসিন গঠন করা হল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যগুলিকে সামনে বােহেতির সনদ রচনা করা হয়েছে। সনদের প্রস্তাবনা ও অন্যান্য ধারায় এই 4তঠনের উদ্দেশ্য তথা লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে।
তার সলিত তি:ওর জনসাধারণ আমাদের জীবনে পরপর দুটি যুদ্ধ যে। তবন, একঃ নরে এসেছে তা থেকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের রক্ষা করার জন্য কৃতসংকল্প। আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার, মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবােধের ওপর ও নারী, পুরুষ, ছােট বড় সকল রাষ্ট্রের সম অধিকারের ওপর আস্থা হাপন করছি ও আমরা এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করব যেখানে ন্যায়বিচার এবং চুক্তি ও আতর্জাতিক আইনের অন্যান্য উৎস থেকে উদ্ভুত বাধ্যবাধকতা সসম্মানে পালিত হবে ও বৃহত্তর স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক অগ্রগতি ও জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা যাবে।”
সনদের ১নং ধারায় জাতিপুঞ্জের চারটি মূল উদ্দেশ্যের কথা ঘােষণা করা হয়েছে।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং সেই উদ্দেশ্যে কার্যকরভাবে সমষ্টিগত ব্যবস্থা অবলম্বন করে শান্তিভঙ্গের সবরকম আগ্রাসী কার্যকলাপ প্রতিহত করা। এছাড়া শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিরােধের সুষ্ঠু সমাধান করাও হল জাতিপুঞ্জের প্রাথমিক কর্তব্য।
দ্বিতীয়ত, সমস্ত জাতির সমানাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলা এবং স্থায়ীভাবে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবতাবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করা এবং জাতি, ধর্ম, ভাষা ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিটি রাষ্ট্রকে সহযােগিতার বন্ধনে আবদ্ধ করা।
চতুর্থত, উপরােক্ত সাধারণ উদ্দেশ্যগুলি কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
সনদের অন্য কয়েকটি ধারাতেও জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সনদের ৫৫নং ধারায় বলা হয়েছে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ।
(১) উন্নত জীবন যাত্রার মান, পূর্ণ নিয়ােগ ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতির প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে ;
(২) আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্যগত ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান করবে, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির প্রসারণ ঘটাবে এবং শিক্ষাগত সহযােগিতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করবে ;
(৩) জাতি, ধর্ম, ভাষা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানব অধিকারের প্রতি বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধার মনােভাব গড়ে তােলার চেষ্টা করবে।
সবশেষে সনদের ৭৩নং ধারায় বিশ্বের পরাধীন দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে একটি অঙ্গীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যেসব রাষ্ট্র পরাধীন জনগণের শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে তারা ঐ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থকেই সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেবে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঐসব অঞ্চলের জনগণের উন্নতির পবিত্র দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
মূল্যায়ন ও ওপরের আলােচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাই জাতিপুঞ্জের প্রধান লক্ষ্য (“Tine maintenance of peace is he primary purpose (of the Charter.”Benjamin (Cohen)। এজন্য জাতিপুঞ্জের কার্যক্রমে মধ্যহত. মিটমাট, আদালতের বিচার প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা যেমন রয়েছে, তেমনি একই সঙ্গে শান্তিভঙ্গ ঘটলে বা যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিলে আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিবিধানের যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। আবার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার কাজটি যে কেবলমাত্র রাজনৈতিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়—এই সত্যটিও এখানে ব্যক্ত হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে যতদিন না বিভিন্ন জাতির মধ্যে সামাজিক অসাম, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও সাংস্কৃতিক বিভেদ দূরীভূত হচ্ছে, ততদিন বিশ্ব থেকে যুদ্ধকে অপসারণ করা যাবে না এবং পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের মধ্যে প্রকৃত মৈত্রী গড়ে উঠবে না।
তবে বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনােভাব আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে এবং একথা ভীষণভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘােষণার ঘটনা থেকে। ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয়ের পর থেকে বিশ্ব রাজনীতির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমােদন ছাড়া জাতিপুঞ্জ তার কোন সিদ্ধান্তকেই কার্যকর করতে সক্ষম নয়। তাই স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা আজও কল্পলােকেই থেকে গিয়েছে।
● সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নীতিসমূহ :
বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযােগিতা সুনিশ্চিত করতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে যেসব উদ্দেশ্য ব্যক্ত হয়েছে, সেগুলিকে বাস্তবে রূপদানের জন্য সনদের ২নং ধারায় ৭টি নীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। নীতিগুলি হল :
(১) সকল সদস্যরাষ্ট্রের সার্বভৌম সমানাধিকারের নীতির ওপর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত।
(২) প্রত্যেক সদস্যরাষ্ট্র তার সদস্যগত অধিকার ও সুযােগ-সুবিধা সুনিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে সনদে ঘােষিত দায়-দায়িত্ব নিষ্ঠাসহকারে পালন করবে। বিরােধের
(3) সকল সদস্যরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে এমনভাবে তাদের আন্তর্জাতিক বিচার বিপন্ন না হয়।
নিষ্পত্তি করবে যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায় (৪) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল সদস্যরাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের ভৌগােলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী বলপ্রয়ােগের হুমকি প্রদর্শন বা বলপ্রয়ােগ থেকে বিরত থাকবে।
(৫) সকল’ সদস্যরাষ্ট্র জাতিপুঞ্জকে সর্বতােভাবে সহযােগিতা করবে এবং কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হলে সদস্যরাষ্ট্রগুলি সেই রাষ্ট্রকে কোন প্রকার সাহায্য করবে না।
(৬) শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে জাতিপুঞ্জের সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রগুলিও যাতে সনদে বর্ণিত নীতিগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।
(৭) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে নরে সপ্তম অধ্যায় অনুসারে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এই নীতি
মূল্যায়ন : সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে সনদের ১ ধারায় বর্ণিত উপরােক্ত নীতিগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দু’একটি ক্ষেত্রে এমন সব অসঙ্গতি রয়েছে যেগুলি উপেক্ষা করা যায় না।
প্রথমত, সনদের প্রথম নীতিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌম সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং সেই অনুসারে সাধারণ সভায় প্রত্যেক সদস্যরাষ্ট্রকে একটি করে ভােট দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আবার একই সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদে’ বৃহৎ পঞ্চশক্তিকে স্থায়ী সদস্যপদ এবং ভেটো দান ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকার নেওয়া হয়েছে। গুডরিচ, (L. M. Goodrich, E. Hambro and A. P. Simons) প্রমুখ লেখকগণ পঞ্চপ্রধানের হাতে এই ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগের বিষয়টিকে সার্বভৌম সমানাধিকার নীতির এক নগ্ন লঙঘন (‘…Impairment of the principle of juritical cquality’) বলে মন্তব্য করেছেন।
দ্বিতীয়ত, সনদের দ্বিতীয় নীতিতে সদস্যরাষ্ট্রগুলির নিজ নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে অধিকাংশ রাষ্ট্রের কাছেই এই কর্তব্য পালনের চেয়ে জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়।
তৃতীয়ত, সনদের তৃতীয় ও চতুর্থ নীতিতে যথাক্রমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসা এবং অন্য রাষ্ট্রের ওপর বল প্রয়োগ বা বলপ্রয়ােগের ভীতি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার কথা বলা হলেও প্রায়শই এই নীতিগুলিকে উপেক্ষিত হতে দেখা যায়।
চতুর্থত, সনদের যষ্ঠ নীতিতে সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রগুলিও যাতে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে তা দেখার কথা বলা হয়েছে। জাতিপুঞ্জের এই অধিকারের নৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তােলেন। তাছাড়া সদস্য রাষ্ট্রগুলিই যেখানে সনদে বর্ণিত নীতিগুলির সঙ্গে সব সময় সঙ্গতি রেখে চলে না, সেখানে সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রকে সদীয় নীতির প্রতি অনুগত রাখার প্রয়াস কতদুর সফল হতে পারে সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়।
পঞ্চমত, সনদের সপ্তম নীতিতে কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হলেও আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলতে ঠিক কী বােঝায় তা সনদের কোথাও পরিষ্কারভাবে বলা হয় নি। ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সুবিধামত এই নীতিটিকে ব্যাখ্যা করে থাকে। বস্তুত এই নীতিটি থাকার ফলে জাতিপুঞ্জের কর্তৃত্ব বহুলাংশে ক্ষুন্ন হয়েছে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ঘােষিত নীতিগুলির মধ্যে এই ধরনের কিছু অসঙ্গতি আছে সত্য। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই নীতিগুলির মধ্য দিয়েই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল নীতি ব্যক্ত হয়েছে।
● সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের গঠন :
সূচনাতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫১। ক্রমে ক্রমে এর সদস্যসংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ১৮৫ (মে, ১৯৯৫)-তে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে পৃথিবীর প্রায় সকল, রাষ্ট্রই আজ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে সেগুলি রূপায়ণের জন্য ছয়টি প্রধান সংস্থা রয়েছে। সংস্থাগুলি হল :
(১) সাধারণ সভা (The General Assembly),
(২) নিরাপত্তা পরিষদ (The Security Council),
(৩) অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (The Economic & Social Council), (৪) অছি পরিষদ (The Trusteeship Council),
(৫) আন্তর্জাতিক বিচারালয় (The International Court of Justice),
(৬) কর্মদপ্তর বা সচিবালয় (The Secretariat). উপরােক্ত প্রধান সংস্থাগুলি ছাড়াও প্রয়ােজনবােধে কিছু সহায়ক সংস্থা বা বিভাগ গঠন করা যায় [“Such subsidiary organs as may be found necessary may be established in accordance with the present Charter.” Art. 7(2)) I আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’ পারমাণবিক শক্তি কমিশন’, মানবিক অধিকার কমিশন’, ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO), সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন’ (UNCTAD), ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
■ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন কর। [Evaluate of the U.N.)
the success and failure উত্তর। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করা এবং সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে সমৃদ্ধির পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করার মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৫ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ নামক বিশ্ব সংস্থাটির জন্ম হয়। এই বিশ্ব সংস্থাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভগ্নস্তুপের ওপর শুধু একটি শান্তির সৌধ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হবে না, সমগ্র মানবজাতির এক মহাসংসদরূপে (Parliament of man) অথবা একটি বিশ্ব-যুক্তরাষ্ট্র (federation of the world) হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে—এই উচ্চাশা সেদিন সকলের মনে উঁকি দিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি কতখানি তার লক্ষ্যের দিকে এগােতে পেরেছে, আর মানবজাতির আশা-আকাঙ্খকে কতখানি বাস্তবায়িত করতে পেরেছে? এই প্রশ্নটিকে ঘিরে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরােধের অন্ত নেই। সুম্যান (Schuman), পামার ও পারকিনস (Palmer and Perkins), নিকোলাস (Nicholas) প্রমুখ চিন্তাবিদদের মতে,
জাতিপুঞ্জ তার উদ্দেশ্য রূপায়ণে পুরোপুরি ব্যর্থ। সুম্যান তো বলেছেন, “সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ হল নতুন মােড়কে পুরনাে জাতিসংঘ” (“The United Nations is a League of Nations in a new guisc.’)। বস্তুতপক্ষে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আজ অবধি যেভাবে জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, সংকট মুহূর্তে যেভাবে জাতিপুঞ্জকে প্রায় অচল করে দেবার চেষ্টা চালানো হয়েছে, সর্বোপরি জাতিপুঞ্জকে যেভাবে বৃহৎ শক্তিবর্গের (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) ক্রীড়নকে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে জাতিপুঞ্জ সম্পর্কে গভীর হতাশার সঞ্চার হওয়া আশ্চর্যের নয়। অপর একদল লেখক ও বিশেষজ্ঞের মতে, ব্যর্থতা, হতাশা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ তুলে ধরা হল ঃ
● সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্য :
(১) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কোরিয়া সমস্যা, সুয়েজ সমস্যা, কঙ্গো সমস্যা, ভিয়েতনাম সমস্যা, সাইপ্রাস সমস্যা, সিরিয়া ও লেবাননের সমস্যা, কিউবা সমস্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জ উল্লেখযােগ্য অবদান রাখে।
(২) যুদ্ধ প্রতিরােধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত এই পাঁচ দশকে পৃথিবীতে ছােটখাটো বিবাদ লেগে থাকলেও আন্তর্জাতিক স্তরে কোন বড় বিবাদ বাধে নি। এটি জাতিপুঞ্জের সাফল্যেরই দ্যোতক। বস্তুত সুয়েজ সমস্যা, কোরিয়া সমস্যা, কঙ্গো সমস্যা, আরব-ইস্রায়েল যুদ্ধ প্রভৃতির যে-কোনটিকে কেন্দ্র করে বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারত। কিন্তু প্রধানত জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপের ফলেই তা ঘটে নি।
(3) অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সাফল্য ও শুধুমাত্র বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশগুলির প্রগতি সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের অবদান কম নয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, ইউনেস্কো (UNESCO), বিশ্ব ব্যাঙ্ক (IBRD), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)—জাতিপুঞ্জের অধীনস্থ এই সমস্ত সংস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছে।
(৪) মানবাধিকার রক্ষা ও মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের অবদান কম নয়। ১৯৪৮ সালে জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে মানবিক অধিকারের সার্বিক ঘােষণা (Universal Declaration of Human Rights) একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এছাড়া আন্তর্জাতিক ‘ শিশুবর্য’, ‘নারীবর্ষ’, ‘প্রতিবন্ধীবর্য’, ‘বিশ্ব খাদ্য ও আবাসন দিবস’ প্রভৃতি পালনের মাধ্যমে জাতিপুঞ্জ মানবাধিকার সংরক্ষণে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
(৫) নিরস্ত্রীকরণ ঃ জাতিপুঞ্জ তার জন্মলগ্ন থেকে নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে, আণবিক অস্ত্র পরী। নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ সভার অধিকাংশ অধিবেশনেই নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে এবং অস্ত্র প্রতিযােগিতার বিপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।
(৬) ঔপনিবেশিকতার অবসান :
জাতিপুঞ্জের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এশিয়া, আফ্রি | তাতিন আমেরিকার বহু উপনিবেশ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। তা: ইয়ে। এছাড়া অছি পরিষদের ১১টি অছি তাঞ্চলের মধ্যে ১টি বাদে সবকটি অঞ্চল স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
(৭) অন্যান্য ক্ষেত্রে সাফল্য ও বিশ্বের জনগণের বৌদ্ধিক বিকাশে, আন্তর্জাতিকতাবাদের। শেলির কারিগরি ও প্রযুক্তি বিদ্যাগত দক্ষতার প্রসারে জাতিপুঞ্জের উৎসাহ ও উদ্যোগের ঘাটতি নেই।
■ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা :
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্য ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে। জাতিপুত্রের মূল উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের। সাফল্যের থেকে ব্যর্থতাই বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইস্রায়েল বিরােধ, কাশ্মীরকে কেক করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ, কিউবা, গুয়েতমালা ও ভিয়েতনামে মার্কিন হস্তক্ষেপ, লেবাননে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণ, সাম্প্রতিককালে (১৯৯১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক সৈন্যবাহিনী কর্তৃক ইরাক আক্রমণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকালে পাকিস্তানের ব্যাপক নরহত্যা ও নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাতিপুঞ্জ কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। হাইতিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করে সামরিক শাসন কায়েম হল, সােমালিয়ায় মার্কিন হেলিকপ্টার বােমা ফেলে অজ নরীহ সামালিকে নিহত অথবা পঙ্গু করল, অথচ জাতিপুঞ্জ থেকে কোন প্রতিবাদ শােনা গেল না। নিরস্ত্রীকরণ তথা অস্ত্র প্রতিযােগিতা রােধে জাতিপুঞ্জ আলােচনা চালিয়েছে বা প্রস্তাব নিয়েছে সত্য, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি। পৃথিবীতে আণবিক মারণাস্ত্রের ব! ভাণ্ডার রয়েছে, তা দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকশ বার ধ্বংস করা যায়। বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার প্রভৃতি সংস্থাগুলি অর্থনৈতিক সাহায্যের নামে অনুন্নত দেশের হনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে, এমনকি তাদের স্বাধীনতাকেও বিপন্ন করে তুলেছে। দক্ষিণ তফ্রকা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, প্রিটোরিয়া, জিম্বাবােয়ে প্রভৃতি দেশে মানবাধিকারের চরম হমেন ঘটে চলেছে, অথচ জাতিপুঞ্জ এসব ক্ষেত্রে নীরব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ এক নতুন সংকটরূপে দেখা দিয়েছে। সলােমান রুশদি, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ ব্যক্তিদের বছে নাসবাদীদের হীন চক্রান্ত চলেছে, অথচ জাতিপুঞ্জের কোন ইতিবাচক ভূমিকা
জাতিপুঞ্জের এই ব্যর্থতার পশ্চাতে যে কারণগুলি বর্তমান সেগুলি হল নিম্নরূপঃ নত, তর্জতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের। নিরাপত্তা পদে তিতাবৰ বৃহৎ পঞ্চশক্তির ঐকমত্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বেশির ভ, ৫৫ ৫৬ ও ঐকমত্যে পৌছাতে পারে নি। ফলে শান্তিরক্ষার ব্যাপারে ব’ নারে.. পদক্ষেপ নিতে উদ্যত হয়েছে, তখনই পঞ্চশক্তির মধ্যে কেউ • 7ে. . ?Vcl()) রোগের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদকে অচল করে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ‘ভেটো’ ব্যবস্থা ছাড়াও সনদের বিশেষ কয়েকটি ধারা জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। উদাহরণস্বরূপ ‘আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে যুদ্ধ করার সম্মতি, আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তৃতীয়ত, নিজস্ব কোন সৈন্যবাহিনী না থাকা জাতিপুঞ্জের দুর্বলতার অন্যতম কারণ। চতুর্থত, জাতিপুঞ্জের নিজস্ব কোন আয়ের উৎস নেই। সদস্য রাষ্ট্রগুলির বিশেষ করে পশ্চিমী দেশগুলির অর্থসাহায্যের ওপর জাতিপুঞ্জকে নির্ভর করতে হয়। জাতিপুঞ্জের নিজের পায়ে দাঁড়ান যত তাসম্ভব হয়ে উঠেছে, পশ্চিমী দেশগুলি ততই তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে।
পঞ্চমত, অনেকের মতে, আঞ্চলিক শক্তিজোট এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলির উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিপুঞ্জকে দুর্বল করে দিয়েছে।
যষ্ঠত, জাতিপুঞ্জের দুর্বলতার অপর একটি কারণ এর স্বেচ্ছামূলক সদস্যপদ। সপ্তমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয়ের আগে পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক জোট এবং সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে যে ঠাণ্ডা লড়াই (Cold War) চলেছিল, তা জাতিপুঞ্জকে ভীষণভাবে দুর্বল করে দেয়।
অষ্টমত, সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর (১৯১১) থেকে বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর এটাই জাতিপুঞ্জকে আগের থেকেও বেশি স্থবির করে দিয়েছে। পানামা, নিকারাগুয়া, আইভরি কোস্ট, ইকোয়েডর প্রভৃতি দেশে হাজার মানবাধিকার লঙ্নের ঘটনা ঘটছে ; কিন্তু এগুলি জাতিপুঞ্জের নজরে পড়ছে না। কী করে পড়বে? টিকি যে আমেরিকার কাছে বাঁধা। নিরাপত্তা পরিষদে ইরাকের ব্যাপারে নেতিবাচক ভােট দেওয়ার অপরাধে ইয়েমেনে সমস্ত রকম মার্কিন সাহায্য বন্ধ হয়ে গেল।
উপসংহার :
ওপরের আলােচনা থেকে দেখা যাচ্ছে জাতিপুঞ্জের সাফল্য যেমন আছে, ব্যর্থতাও তেমনি কম নয়। এই সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সঙ্গী করেই জাতিপুঞ্জ অর্ধশতাব্দী পার করে দিল। এইভাবেই জাতিপুঞ্জ আরও অনেকদিন টিকে থাকবে। কারণ এর প্রয়ােজন যে এখনও ফুরায়নি। তাই পল লুসাকার সঙ্গে একমত হয়ে বলতে পারি, যে প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক শান্তির স্বার্থে জাতিগুলি একসময় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেছিল, সে প্রেরণার আজও সমান প্রয়ােজন