হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন

 হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ।

হরপ্পা-সভ্যতার-সামাজিক-ও-অর্থনৈতিক-জীবন

 

উত্তরঃ

 

হরপ্পা সভ্যতার সমাজ জীবন : —-

———————

শ্রেণী বিভক্ত সমাজ :

        হরপ্পা সভ্যতার প্রাপ্ত নিদর্শন গুলি দেখে এই সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা সম্বন্ধে পন্ডিতরা অনুমান করেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ছিল। বড়ো ও ছোটো বাড়ি ও নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় যে,শহরের দ্বিতল বাড়িগুলিতে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বাস করত , ছোটো ছোটো খুপরি গুলিতে শ্রমিক ও দরিদ্ররা বাস করত ।শ্রমিক ও দরিদ্ররা বাস করত । এছাড়া কৃষক শ্রেণী ছিল । দুর্গে শাসক শ্রেণী থাকত । শস্যাগারের নিকট শ্রমিকরা বাস করত ।

খাদ্য, পশু, পোশাক পরিচ্ছদ :

     শস্য ভান্ডারের নিদর্শন দেখে মনে হয়,  সিন্ধুবাসী প্রধানত কৃষিজীবী ছিল । সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যাব, বার্লি, তিল, মটর, রাই, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদি । সিন্ধু অধিবাসীরা কৃষিকাজের সাথে সাথে পশুপালন করত । সুতী ও পশমের পোশাক ব্যবহার করত । নারী-পুরুষ উভয়ে অলংকার ব্যবহার করত । 

গৃহস্থালীর সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র :

         মাটি, তমা, ব্রোঞ্জ, পাথরের তৈরি বাসনপত্র ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম ব্যবহার করত । তমা, ব্রোঞ্জ, পাথরের তৈরি বর্শা, কুঠার, মুসল, তির প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করত । কিন্তু শিরস্ট্রেন, ঢাল, বর্ম প্রভৃতি আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র পাওয়া যায়নি ।

হরপ্পা সভ্যতার অথনৈতিক জীবন :-

        হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনে বহু জীবিকার সন্ধান পাওয়া যায় । কৃষিকাজে বেশি লোক যুক্ত ছিল । এছাড়া হরপ্পা বাসীরা পশুপালন, শিল্প ও কারিগরি এবং ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত ছিল । 

কৃষি ও অন্যান্য শিল্প :

        সিন্ধু অঞ্চলে পলিমাটি যুক্ত উর্বর জমিতে গম, বার্লি, রাই, মটর, তুলোর উৎপাদন হত । মাটির কলসি, গৃহস্থালির দ্রব্য, মূর্তি, খেলনা তৈরি করত । এই যুগের তৈরি তমা ও ব্রোঞ্জের অস্ত্রশস্ত্র যন্ত্রপাতি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয় । সোনা ও রুপোর অলংকার প্রস্তুত হত । ছুতোর, রাজমিস্ত্রি ও অলংকার শিল্পীরা এযুগে বাস করতেন ।

ব্যবসা বাণিজ্য ও যানবাহন :

         এই যুগে স্থল পথে ও জল পথে সিন্ধুবাসীরা ব্যবসা বাণিজ্য করত । যানবাহন হিসেবে উট, দু-চাকা বিশিষ্ট গরুর গাড়ি, নৌকা ব্যবহার করত । ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সম্ভবত সিলমোহর ব্যবহার করত । সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সঙ্গে ক্রীট, সুমের, ইরান, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, রাজস্থান এবং দেশীয় নগরগুলির সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য চলত।

      বিদেশ থেকে সোনা, রুপা, টিন, তামা আমদানি করা হত । সিন্ধু উপত্যকা থেকে তুলো, হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসপত্র, সুতীবস্ত্র রপ্তানি করা হত ।

সিলমোহর ও লিপি :

       সিন্ধু সভ্যতায় পোড়া মাটি, তমা ও ব্রোঞ্জের প্রচুর সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে । সিন্ধু সভ্যতায় যে সব লিপি পাওয়া গিয়েছে তা আজ পর্যন্ত পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি ।

মেহের গড় সভ্যতা

    পাকিস্তানের বোলান গিরিপথের নীচে বালুচিস্তানের কাচ্ছি সমভূমির অন্তর্গত মেহেরগড়ে প্রত্নতাত্বিক খননকার্যের ফলে এক প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা উন্মেচিত হয়েছে । দুই গিরি সংকুল অঞ্চলের মাঝামাঝি এই সমতল দেশটির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে বোলান নদী সহ কয়েকটি জলধারা ।

         এখান থেকে সিন্ধু প্রদেশের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রাখা সম্ভব ; তেমনি বোলান গিরিপথ ও কোয়েটা অঞ্চলের মাধ্যমে উত্তরের এবং পশ্চিমের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো সহজ ছিল । এই সভ্যতা ছিল খানিকট নগর ভিত্তিক, যা বয়সে সিন্ধু সভ্যতা থেকে পুরানো এবং নব্যপ্রস্তর যুগের প্রথম কাল থেকে তাম্রপ্রস্তর যুগ পর্যন্ত । এর সময় কাল ধরা হয়েছে অনুমানিক ৭০০০ থেকে ৩২০০ খৃস্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত ।

হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার :-

     মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্বিক এলাকার ব্যাপ্তি ছিল পাঁচশ একর জুড়ে । এই সভ্যতার সূচনা হয়েছিল বালুচিস্তান-সিন্ধু অঞ্চলেই । ক্রমে দক্ষিণ আফগানিস্তানের মুন্ডিগক, নাওশারো, দাম্ব সাদাত, ইরানের শহর ই-শোখাত অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, বানিজ্যিক ও নগরায়নের বিস্তার ঘটেছিল।

      ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জা ফ্রাঁসোয়া জারিজ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক প্রথায় খনন করে এই প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা আবিষ্কার করেন । মেহেরগড়ে আবিষ্কৃত উপকরণগুলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে ও অন্যান্য তথ্য থেকে এই সভ্যতার অগ্রগতিকে সাতটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে । প্রত্যেক পর্যায়ের সময়কাল ছিল বৈশিষ্ট্য ভিত্তিক ও অনুমান নির্ভর ।

হরপ্পা সভ্যতা:

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য :-

       এই ভূখণ্ডে সবচেয়ে প্রাচীন বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে । নব্য প্রস্তর যুগের এই সভ্যতার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়কাল ছিল আনুমানিক ৭০০০ থেকে ৫০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত । এই সময়ে গ্রামের মানুষ রোদে পোড়ানো সমান মাপের মাটির ইট দিয়ে তৈরি করা ছোটো ছোটো বাড়িতে বাস করত । কোনো কোনো বাড়িতে থাকত শস্যভান্ডার । গম ও যবের শস্যদানা কৃষির উপস্থিতি প্রমান করে । পাথরের কাস্তে দিয়ে শস্য কাটা হত। ছাগল, ভেড়া, গরু বশীভূত হয়েছিল। 

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য

      এখানকার অধিবাসীরা বনে পশুশিকার করত । এই বস্তিতে কোনো মাটির পাত্র ছিলনা । পশুর লোমের তৈরি কাপড় পাওয়া গেছে, যা ছিল বয়ন শিল্পের সূচনা । মৃত দেহকে তারা মাটিতে পুঁতে দিতো এবং লাল রং ব্যবহার করত । পরবর্তী পর্যায়ে কার্পাস উৎপাদন শুরু হওয়ায় সুতো কেটে কাপড় বোন শুরু হয়েছিল । শস্যের চাষ ছাড়াও খেজুর  ফলানো হত । কৃষি কাজের জন্য নদীতে ছোটো ছোটো বাঁধ বানিয়ে জল আটকে সেচের কাজ করা হয়েছিল । শিল্প বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল ।

হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন

        এর পরে মেহেরগড়ে  তৃতীয় পর্যায়ে তাম্র- প্রস্তর যুগের আবির্ভাব হয়েছিল । এই যুগের কাল ছিল আনুমানিক ৫০০০ থেকে ৩৬০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ পর্যন্ত । এই যুগে প্রযুক্তি বিদ্যাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল । আকরিক তমা গলিয়ে তাকে ব্যবহার যোগ্য ধাতুতে পরিণত করার কৌশল মেহেরগড়ের ধাতু শিল্পীরা আয়ত্ত করেছিল।  

        ঘূর্ণায়মান চাকার সাহায্যে আগুনে পুড়িয়ে নানা আকারের মৃতপাত্র তৈরি হত। এই মৃতপাত্রের উপর জ্যামিতিক নকশা, পশু পাখির ছবি, আঁকা হত । পরবর্তী পর্যায়ে সিলমোহর প্রচলনের  সূচনা হয়  এবং নগরায়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়েছিল ।

      

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *