ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর
ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা
ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায়
প্রশ্নঃ ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলােচনা কর।
উত্তর।
ব্রিটিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। লর্ড মর্লি প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাবিনেট তােরণের প্রধান স্তম্ভ’ বলে বর্ণনা করেন। হারভে এবং বেথারের ভাষায়, “The Prime Minister is the outstanding figure in the British Constitution?
ব্রিটিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পদমর্যাদার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। মূলত তা প্রথাগত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। ১৯৩৭ সালের রাজমন্ত্রী আইনে (Minister of Crown Act) প্রধানমন্ত্রীর বেতন নির্ধারণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদটিকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে গ্ল্যাডস্টোন মন্তব্য করেন, “কোথাও এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যার এত বিপুল ক্ষমতা অথচ যাঁর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এত কম” (“….nowhere is there a man who has so much power, with so little a show for it…’) |
প্রধানমন্ত্রীর নিয়ােগ : বর্তমানে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ করেন। কমন্সসভায় কোন দল সুস্পষ্টভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে রাজা বা রানী নিজ বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ােগ করতে পরেন। পূর্বে লর্ডসভা অথবা কমন্সসভা যে-কোন কক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ােগ করা যেত। কিন্তু ১৯০২ সালে লর্ড সলসবেরীর পদত্যাগের পর থেকে লর্ডসভা থেকে কোন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীপদে নিয়ােগ করা হয় নি।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও ভূমিকাকে নিম্নলিখিতভাবে আলােচনা করা যেতে পারে :
(১) ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীর প্রধান পরামর্শদাতা :
প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজা বা রানীর প্রধান পরামর্শদাতা। কমন্সসভা ভেঙে দেওয়া, লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত করা, সম্মানসূচক উপাধি বিতরণ করা, যাজক ও বিচারক, রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধি নিয়ােগ করা প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন) আইনগতভাবে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানী কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং তাঁর কার্যকাল রাজা বা রানীর সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্তির ব্যাপারে রাজা বা রানীর বিশেষ কোন ক্ষমতা নেই। কারণ কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ করতে রাজা বা রানী বাধ্য থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পশ্চাতে যতদিন কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন থাকে ততদিন তাঁকে পদচ্যুত করা যায় না।(প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট ও রাজশক্তির মধ্যে সংযােগ রক্ষা করেন।) অগ ও জিঙ্ক (Ogg and Zink)-এর ভাষায় “The Prime Minister is the principal….channel of communication between
(২) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা : প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও ভূমিকাব মূল ভিত্তি হল তাঁর দল , দলের শক্তি বাড়লে প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী হয়। তাই দলের শক্তিবৃদ্ধি এবং সংহতি বক্ষাব দিকে তাকে বিশেষভাবে নজর দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, কর্মকুশলতা ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতার ওপর দলের ভাবমূর্তি অনেকাংশে নির্ভরশীল। দলের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কাজ হল : (ক) দলীয় শৃঙ্খলা ও সংহতি রক্ষা করা, (খ) দলীয় কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করা, (গ) জনসমক্ষে উপস্থিত হয়ে এবং প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে দলের ভাবমূর্তি বাড়ান ইত্যাদি। নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর কর্মতৎপরতা বহুল পরিমাণে বেড়ে যায়। অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে তার দল নির্বাচনে সাফল্য লাভ করতে সচেষ্ট
(৩) ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার নেতা :
(প্রধানমন্ত্রী শুধু দলের নেতা নন, তিনি মন্ত্রিসভারও নেতা। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ােগ করেন এবং তাদের মধ্যে দপ্তর বন্টন বা পুনর্বণ্টন করেন। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে যে কোন মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করতে পারেন। তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেন এবং বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সামগ্রিকভাবে মন্ত্রিসভার কার্যাবলী তদারকি করা এবং বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয় সাধন করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই মন্ত্রিসভার উন্থানপতন ঘটে। তিনি পদত্যাগ করলেই মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। এইসব কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাবিনেট তােরণের প্রধান স্তম্ভ’ বলা হয়ে থাকে। অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে তুলনায় প্রধানমন্ত্রীকে অনেক সময় ‘সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য’ বলা হয়। কিন্তু বাস্তবের বিচারে তিনি অন্যান্য মন্ত্রীদের তুলনায় এতই বেশি প্রভাবশালী যে তাকে অনেক সময় ‘একনায়ক’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। উইলিয়াম হারকোর্ট (Wiliam Harcourt) সঙ্গত কারণেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারকাদের মধ্যে বিরাজমান চন্দ্র’ (inter stellas luna minors) বলে বর্ণনা করেন।
(৪) কমন্সসভার নেতা : প্রধানমন্ত্রী হলেন কমন্সসভার নেতা বা নেত্রী। কমন্সসভায় তিনি সরকারী নীতিসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বক্তব্যকে সরকারী বক্তব্য হিসাবে গণ্য করা হয়। কমন্সসভার অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত রাখা, প্রয়ােজনে। কমন্সসভা ভেঙে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে রাজা বা রানীকে পরামর্শ দেওয়া, সরকারী নীতির ব্যাখ্যা দান, বিরােধীদের আনীত অভিযােগের উত্তর দান, সমালােচনায় বিব্রত কোন মন্ত্রী বা দলীয় সদস্যকে সাহায্য করা, সংসদীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ, বিরােধী নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এই সব কাজ প্রধানমন্ত্রী করে থাকেন কমন্সসভার নেতা বা নেত্রী হিসাবে) কমসভার নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে বিরােধীদলের সঙ্গেও সদ্ভাব রাখতে হয়, তাদের মতামতকে গুত্ব দিতে হয়, বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে বিরােধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে হয়। বার্ড শ একদা মন্তব্য করেন,“ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজের স্ত্রী অপেক্ষা বিবোধী দলের নেতাকে বেশি ভাল করে চেনেন” ।
(৫) ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্রনীতির প্রধান রূপকার :
(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের জন্য পৃথক মন্ত্রী থাকলেও প্রধানমন্ত্রীকেই পররাষ্ট্রনীতির মুখ্য প্রবক্তারূপে গ্রহণ করা হয়।)বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সরকারী ভাষ্য বলে গণ্য করা হয়। (আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, বিভিন্ন দেশের শীর্ষ বৈঠকে, কমনওয়েলথ-সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সন্ধি বা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।)
(৬) ক্যাবিনেট ও রানীর মধ্যে যােগসূত্র রচনা : (প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট ও রানীর মধ্যে সংযােগ সাধনের ভূমিকা পালন করেন। ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তগুলি তিনি রানীর নিকট উপস্থিত করেন এবং ঐসব বিষয়ে রানীর বক্তব্য তিনি ক্যাবিনেটে পেশ করেন।)
প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের নিযুক্ত করা, লর্ডসভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, কমসসভা ভেঙে দেওয়া, সম্মানসূচক উপাধি বিতরণ করা, বিচারক, যাজক, রাষ্ট্রদূত, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি রাষ্ট্রের পদস্থ সরকারী কর্মচারী প্রভৃতি নিয়ােগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীকে পরামর্শ দেন।
(৭) জরুরী অবস্থায় ভূমিকা : সাধারণ অবস্থায় মন্ত্রীসভার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধানমন্ত্রী কাজ করেন। কিন্তু জরুরী অবস্থায় তিনি মন্ত্রীসভার পরামর্শ ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ সুয়েজ খালের শেয়ার ক্রয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী ডিসরেলি অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভূতপূর্ব সােভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ক্যাবিনেটের পরামর্শ ছাড়াই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা
পদমর্যাদা : উপরােক্ত আলােচনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী অমিত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী। প্রধানমন্ত্রীর এই কর্তৃত্ব ও ভূমিকাই ব্রিটেনের মন্ত্রিপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থাকে প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী চালিত শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে। অধ্যাপক ফাইনার (Finer)-এর ভাষায়, “Cabinet government has given way to Prime Ministerial government.”
কেউ কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীকে একনায়ক’ (Dictator) বলার পক্ষপাতী। রামসে মুর, উইলিয়াম হারকোর্ট প্রমুক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, প্রধানমন্ত্রীর বিপুল ক্ষমতা তাঁকে একনায়কের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। তিনিই মন্ত্রীদের নিয়ােগ করেন, আবার অপসারণ করতেও পারেন ; তিনি রাজশক্তির প্রধান উপদেষ্টা ; রাজশক্তির প্রধান উত্তরাধিকারী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও সরকারের প্রধান। তাঁর নির্দেশেই আইন তৈরী হয়, বিদেশনীতি নির্ধারিত হয়।
তবে কেউ কেউ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে একনায়ক বলতে নারাজ। কারণ, তাঁদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হন। তাঁকে জনমতের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়, বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। সর্বোপরি তঁাকে দলের নির্দেশ মেনে কাজ করতে হয়। দলকে উপেক্ষা করার ফলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ন্যায় লৌহমানবীকেও সরে যেতে হয়েছিল।
উপসংহারে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও প্রভাব অনেকাংশে নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্বের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, গ্লাডস্টোন, ডিরেলি, চার্চিল প্রমুখ প্রধানমন্ত্রিগণ তাঁদের ব্যক্তিত্বের গুণে যে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, চেম্বারলেন, এটলী, ইডেন প্রভৃতির পক্ষে ততখানি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। এজন্যই এ্যাসকুইথ (Asquith) বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর পদটি কেমন হবে তা নির্ভর করে পদাধিকারী এই পদটিকে কিভাবে ব্যবহার করেন তার ওপর” ।
.প্রশ্ন । ব্রিটেনে লর্ডসভার গঠন, কার্যাবলী ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলােচনা কর।
উত্তর। গঠন := ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নাম লর্ডসভা (1louse of Lords) । এটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দ্বিতীয় কক্ষ। নরম্যান যুগে রাজাকে পরামর্শ দেবার জন্যে যে ম্যাগনাম কনসিলিয়াম’ (Magnum Councilium) গঠিত হয়েছিল, সেটিই কালক্রমে লর্ডসভায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে লর্ডসভার সদস্যসংখ্যা ১,১০০ জন। এঁরা কেউই প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। নিম্নলিখিত সাত প্রকার সদস্য নিয়ে লর্ডসভা গঠিত :
(১) রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু সদস্য।
(২) উত্তরাধিকার সূত্রে পিয়ার (Peer) সম্প্রদায়ভুক্ত লর্ডগণ। লর্ডসভায় এঁদের সংখ্যাই সর্বাধিক। বর্তমানে লর্ডসভার ১১০০ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ৯০০ জন সদস্যই এই শ্রেণীভুক্ত।
(৩) স্কটল্যাণ্ডের উত্তাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লর্ড উপাধিধারী সকলেই লর্ডসভার সদস্য। (৪) আয়ারল্যান্ডের লর্ডগণ। ১৯২২ সালে স্বাধীন আইরিশ রাষ্ট্র গঠিত হবার পর থেকে লর্ডসভায় কোন আইরিশ লর্ড নেই।
(৫) লর্ডসভার বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালনার জন্য দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞদের মধ্য থেকে ৯ জন বেতনভুক আপীল লর্ড (Lords of Appeal) মনােনীত করা হয়। ।
(৬) যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত ২৬ জন ব্যক্তিকে লর্ডসভায় মনােনীত করা হয় (৭) শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনকে আজীবন লর্ড উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
লর্ড চ্যান্সেলাব হলেন লর্ডসভাব সভাপতি। কমপক্ষে তিনজন সদস্য উপস্থিত থাকলেই লর্ডসভাব কাজ চলতে পারে। তবে কোন বিল পাসের ক্ষেত্রে অন্তত ৩০ জন সদস্যকে উপস্থিত থাকতে হয়। লর্ডসভা একটি স্থায়ী কক্ষ। আইনজ্ঞ লর্ডর (Law Lords) ছাড়া লর্ড সভার অন্যান্য সদস্য নিয়মিত বেতন পান না। সেজন্য লর্ডসভায় সদস্যদের উপস্থিতির হার অত্যন্ত কম। তবে ১৯৫৯-৬০ সাল থেকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। একটি হিসাব থেকে দেখা যায় ১৯৫৯-৬০ সালে অধিবেশন বসেছিল মাত্র ১১৩ দিন। সেক্ষেত্রে ১৯৮৫-৮৬ সালে অধিবেশন বসেছে ১৬৫ দিন। ঐ সময় গড় উপস্থিতির হার বেড়ে হয়েছে ১৩৬ থেকে ৩১৭ দিন।
ক্ষমতা ও কার্যাবলী : লর্ডসভা একটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। পূর্বে যখন ইংল্যান্ডে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল তখন লর্ডসভা শক্তিশালী ছিল। বিগত তিন শতাব্দী ধরে সামন্ততন্ত্রের প্রাধান্য হ্রাস এবং বুর্জোয়া সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ফলে সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূস্বরূপ লর্ডসভার ক্ষমতা ও গৌরব হ্রাস পায়। লর্ডসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা হল :
(ক) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা : ১৯১১ সালের পূর্বে আইন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লর্ডসভা যথেষ্ট ক্ষমতা ভােগ করত। সাধারণ বিলের ক্ষেত্রে লর্ডসভা ও কমন্সসভা সমক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। অর্থবিল ব্যতীত যে কোন বিল লর্ডসভায় উত্থাপন করা যেত এবং কন্সসভা কর্তৃক গৃহীত যে-কোন বিলকে লর্ডসভা সংশােধন বা প্রত্যাখ্যান করতে পারত। তবে জনসাধারণের সমর্থনপুষ্ট বিলে লর্ডসভা সাধারণত বিরােধিতা করত না। অর্থবিলকে সংশােধন করতে না পারলেও প্রত্যাখ্যান করতে পারত লর্ডসভা।
১৯৯১ এবং ১৯৪৯ সালে পার্লামেন্ট আইন প্রণীত হবার পর থেকে লর্ডসভার আইনসংক্রান্ত ক্ষমতা বিশেষভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইনে বলা হয়, কোন সাধারণ বিল যদি কমন্সসভার পর পর দু’টি অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় পাঠ এবং দ্বিতীয় অধিবেশনের তৃতীয় পাঠের মধ্যে ১ বছর অতিক্রান্ত হয় তবে সেই বিল লর্ডসভার অনুমােদন ছাড়াই আইনে পরিণত হবে। অর্থাৎ সাধারণ বিল পাসের ক্ষেত্রে লর্ডসভা সর্বাধিক ১ বছর বিলম্ব ঘটাতে পারে।
১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইনে বলা হয়, অর্থবিল কেবলমাত্র কমন্সসভায় উত্থাপিত হবে এবং কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত অর্থবিল লর্ডসভায় প্রেরিত হবার পর ১ মাসের মধ্যে লর্ডসভা সেই বিলে সম্মতি না দিলে তার অনুমােদন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট বিলটিকে রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য পাঠান হবে। কোন বিল অর্থবিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিলে কমন্সসভার স্পীকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে অর্থবিলের ক্ষেত্রে লর্ডসভার ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
(খ) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিভিন্ন বিলের ওপর আলােচনা, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, সরকারী নীতির ক্রটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লর্ডসভা শাসন বিভাগকে সংযত রাখে। এছাড়া প্রশাসনিক নির্দেশাদি অনুমােদন ও পরীক্ষা করে দেখার ক্ষমতা হল লর্ডসভার
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসন-সংক্রান্ত ক্ষমতা। বিচারপতিদের পদচ্যুত করার ব্যাপারে লর্ডসভা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে লর্ডসভা ও কমন্সসভা যৌথভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করে।
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও লর্ডসভার ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লর্ড চ্যান্সেলার ছাড়াও দু’চার জন নর্ডসভার সদস্যকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। লর্ডসভার কোন সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ কোন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা বিরল নয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য, সম্পাদিত কার্যাবলীর জন্য মন্ত্রিসভাকে লর্ডসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয় না; শুধু কমন্সসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকতে হয়।
(গ) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: লর্ডসভাকে ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অবশ্য সমগ্র লর্ডসভা নয়, কেবলমাত্র আইনজ্ঞ লর্ডগণই বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করে থাকেন। অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও লর্ডসভার বিচার বিষয়ক ক্ষমতা ভােগ করে। লর্ড উপাধি সংক্রান্ত যাবতীয় বিরােধের নিষ্পত্তি করে লর্ডসভা। এছাড়া সভার অধিকার ভঙ্গের অভিযােগে অভিযুক্তকে লর্ডসভা জরিমানা করতে পারে, এমনকি জেলে পাঠাতে পারে। বস্তুত বিশ্বের অন্য কোন দ্বিতীয় কক্ষকে লর্ডসভার ন্যায় এত বেশী বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা ভােগ করতে দেখা যায় না। তাই ম্যাকেঞ্জি বলেছেন : “The judicial function of the House of Lords is at once the oldest and the most characteristic.”
(ঘ) অন্যান্য ক্ষমতা: উপরােক্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলী ছাড়াও লর্ডসভা আরও কতকগুলি কাজ করে থাকে। যেমন, প্রথমত, লর্ডসভা এখনও বিধিবদ্ধ আইন (Stuatutory Law) অনুযায়ী রচিত আইন ও বিধিনির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা সংক্রান্ত বিষয় সমূহের আলােচনায় লর্ডসভা কমন্সসভাকে সাহায্য করতে পারে। তৃতীয়ত, বিশেষ স্বার্থ জড়িয়ে আছে এমন বিলগুলি নিয়ে লর্ডসভা আলােচনা করে। চতুর্থত, যেসব বিলের ক্ষেত্রে মতবিরােধের সম্ভাবনা কম, সে-সকল বিল লর্ডসভাতেই প্রথম আলােচিত ও গৃহীত হয়। পঞ্চমত, লর্ডসভায় অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানী-গুণী লােক থাকেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সুচিন্তিত মতামত জনমত গঠনে সাহায্য করে।
মূল্যায়ন : ১৯১১ এবং ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইন প্রণীত হবার পর থেকে লর্ডসভার ক্ষমতা ও গুরুত্ব এতই কমে গেছে যে অনেকের মতেই বর্তমানে এর কোন উপযােগিতা নেই। নানা দিক থেকে লর্ডসভার সমালােচনা করা হয়।
প্রথমত, সমালােচকদের মতে ব্রিটেনের ন্যায় গণতান্ত্রিক দেশে লর্ডসভার ন্যায় একটি অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কোনভাবেই খাপ খায় না। ফাইনার (Finer) ব্রিটেনের মত দেশে লর্ডসভার অস্তিত্বকে নেহাতই গরমিল (a gross anomaly) বলে মন্তব্য করেছেন।
দ্বিতীয়ত, লর্ডসভা শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, প্রতিক্রিয়াশীলও বটে। এর অধিকাংশ সদস্যই প্রচুর সম্পত্তির মালিক। কমন্সসভা যখনই কোন প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিতে, অগ্রসর হয়,
তখনই লর্ডসভা তাতে বাধা দেয়। তাই রামসে মির লর্ড সভাকে বিত্তবান শ্রেণীর দুর্গ (Common fortess of wealth) বলে বর্ণনা করেছেন। তৃতীয়ত, লর্ডসভায় সদস্যদের ব্যাপক অনুপস্থিতি এবং ঔদাসীন্য লর্ডসভাকে অপ্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সভায় উপস্থিতির হার কম হওয়ায় লর্ডসভার কাছ থেকে যে ন্যূনতম কাজগুলি আশা করা হয় সেগুলি করতেও এটি সক্ষম হয় না। এইসব কারণে অনেকে লর্ডসভার বিলােপের পক্ষপাতী।
উপসংহার : বর্তমান রাজনীতিতে লর্ডসভার গুরুত্ব হাস পেলেও এর কোন উপযােগিতা নেই একথা ঠিক নয়। সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসাবে লর্ডসভা এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। লর্ডসভা তার বিচার-বিবেচনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে কমন্সসভাকে সাহায্য করে। কখনও কখনও কমন্সসভার অবিবেচনা প্রসূত কাজে বাধা দিয়ে লর্ডসভা দেশকে বাঁচিয়েছে, এমন নজিরও আছে।
3
———******
প্রশ্ন । ব্রিটেনে কমন্সসভার গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে আলােচনা কর।
উত্তর। গঠন : কমন্সসভা হল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ। বর্তমানে কমসসভার মােট
ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা
সদস্যসংখ্যা হল 650 জন। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দ্বারা কমন্সসভার সদস্যগণ নির্বাচিত হন।
যােগ্যতা: কমন্সসভার সদস্য হতে হলে প্রার্থীকে (ক) কমপক্ষে ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে, (খ) ব্রিটিশ প্রজা হতে হবে, (গ) যে কোন ধর্মবিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সাধারণ আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতে হবে। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক, উন্মাদ, দেউলিয়া, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি, ধর্মযাজক, বিচারক, সরকারী কর্মচারী, সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ব্যক্তিরা কমন্সসভার সদস্য হতে পারবে না।
কার্যকালের মেয়াদ: 1911 সালের পার্লামেন্ট আইন প্রণীত হবার পর থেকে কমন্সসভার কার্যকালের মেয়াদ ৫ বছর করা হয়েছে। তবে কার্যকালের মেয়াদ শেষ হবার পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ক্রমে রাজা বা রানী কমন্সসভা ভেঙ্গে দিতে পারেন।
অধিবেশন। বছরে অন্ততঃ একবার কমন্সসভার অধিবেশন ডাকতে হবে। তবে জরুরী অবস্থার সময় কমন্সসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা যেতে পারে।
সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য এবং সভার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সদস্যদের মধ্য থেকে বােঝাপড়ার ভিত্তিতে একজন স্পীকার নির্বাচিত করা হয়।
ক্ষমতা ও কার্যাবলী : কমন্সসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা হলঃ
(১) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা : আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কমন্সসভা ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ সব বিলই কমন্সসভায় উত্থাপিত হয়। কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত বিল লর্ডসভা বাতিল করতে পারে না, তবে অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোন বিল পাসের ক্ষেত্রে লর্ডসভা ১ বছর বিলম্ব ঘটাতে পারে। 1 বছর অতিক্রান্ত হবার পর লর্ডসভার অনুমােদন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট বিলটি রাজা বা রানীর সম্মতিক্রমে আইনে পরিণত হয়।
তবে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কমন্সসভার ক্ষমতা যতটা তাত্ত্বিক, ততটা বাস্তব নয়। বাস্তবে দেখা যায় কমন্সসভার পরিবর্তে ক্যাবিনেটই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আইনের খসড়া রচনা করা, পার্লামেন্টে খসড়া আইন উত্থাপন করা ইত্যাদি কাজগুলি ক্যাবিনেটই করে থাকে। ক্যাবিনেটের পশ্চাতে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকে বলে এইসব বিলগুলিতে কমন্সসভার সম্মতি পেতে কোন অসুবিধা হয় না। গ্রীভস্ যথার্থই বলেছেন, “ব্রিটিশ আইনসভার কাজ আর যাই হােক আইন প্রণয়ন নয়। এটি কেবলমাত্র ক্যাবিনেটের নীতিগুলিকে ঘােষণা করার একটি মঞ্চ হিসাবে কাজ করে থাকে।”
(২) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : পার্লামেন্টের অনুমােদন ছাড়া সরকার কর ধার্য, কর সংগ্রহ করতে পারে না। তবে পার্লামেন্ট কর্তৃক সরকারী আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের এই ক্ষমতা কার্যত কমন্সসভারই ক্ষমতা। 1911 সালের পার্লামেন্ট আইন অনুসারে অর্থবিল কেবল মাত্র কমন্সসভাতেই উত্থাপিত হতে পারে। কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত অর্থবিল লর্ডসভার নিকট প্রেরণ করা হয় এবং ১ মাসের মধ্যে লর্ডসভা কর্তৃক অনুমােদিত না হলে তার অনুমােদন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট বিলটিকে রাজা বা রানীর ম্মিতির জন্য প্রেরণ করা হয়। অর্থবিলে রাজা বা রানী সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন। কোন বিল অর্থবিল কিনা তা নির্ধারণ করার চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী কমলাব স্পীকাৰ। কম। যে খাতে যে পরিমাণ অর্থ বাদি করে, সেই খাতে ৩ব বেশি অর্থ ব্যয় করার মত। সকাবের নেই। এছাড়া সরকারী গণিতিক কমিটি (Public Accounts (Committee), আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি (1stinate: (Committee) মহা হিসাব পরীক্ষক ‘Comptroller and Auditor General) প্রভৃতির মাধ্যমে কমল সরকারী আয় ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে পারে। প্রথমতঃ,
তবে সরকারী আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কমন্সসভার ক্ষমতা নানাভাবে সীমাবদ্ধ। সকাব ব্যয়মঞ্জরীর দাবি না জানালে কমন্সসভা নিজের উদ্যোগে কোন ব্যয় মঞ্জুর করতে পাবে না। দ্বিতীয়তঃ, রাজশক্তির অনুমােদন ছাড়া কমন্সসভা কোন কর ধার্য করতে পারে । তৃতীয়তঃ, বাজেটের জটিলতা, কমন্সসভার সদস্যদের বিশেষীকৃত জ্ঞানের অভাব, সময়ের অভাব, দলীয় শৃঙ্খলার কঠোরতা ইত্যাদি কারণে সরকারী আয়-ব্যয়ের ওপর কমন্সসভার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিছক আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(৩) সরকার গঠনের ক্ষমতা :
ব্রিটেনে মন্ত্রিসভা অর্থাৎ সরকার গঠনে কমন্সসভার ভূমিকা আছে। কমন্সসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতা বা নেত্রীকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়ােগ করেন এবং তার পরামর্শক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগ করেন। আইনগত বাধা না থাকলেও প্রধানমন্ত্রীকে কমন্সসভার সদস্য হতে হয়।
(৪) সরকারকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা : সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক নীতি অনুসারে মন্ত্রিগণকে কমন্সসভার নিকট যৌথভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকতে হয়। মন্ত্রিসভার পশ্চাতে যতদিন পর্যন্ত পার্লামেন্টেরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকে ততদিন পর্যন্ত মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। কমন্সসভায় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারী বিল প্রত্যাখ্যাত হলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। এছাড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিভিন্ন বিলের ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠান, দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, মুলতুবী প্রস্তাব, নিন্দাসূচক প্রস্তাব, অনাস্থা প্রস্তাব প্রভৃতির মাধ্যমে কমন্সসভা মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
তবে মন্ত্রিসভার পশ্চাতে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকে বলে কমন্সসভা কর্তৃক সরকারকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেহাতই আনুষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেনিংস যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “এক অর্থে যদিও এটি সত্য যে কমন্সসভা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সরকারই কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে” (Though in one sense it is true that the House controls the Government, in another and more political sense the government controls the House of Commons.)
(৫) তথ্য সরবরাহ সংক্রান্ত কাজ: সংবাদ ও তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবেও কমন্সসভা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রশ্নোত্তরকালে মন্ত্রীরা যেসব তথ্য কমন্সসভায় পেশ করেন সেগুলি নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত হয়ে থাকে এবং এইসব তথ্যের মাধ্যমে জনগণ সরকারী কার্যকলাপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করে।
(৬) জনমত গঠনের কাজ : কমন্সসভায় বিভিন্ন বিষয়ে সরকারী দল ও বিরােধী দলের মধ্যে যে বিতর্ক ও আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় তা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। এইভাবে সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যা ও ঘটনাবলী সম্পর্কে জনগণের চেতনার বিকাশ ঘটে এবং সুস্থ জনমত গড়ে ওঠে। এই জন্য জেনিংস
বলেছেন যে, কমন্সসভার আসল কাজ হল মত প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে কাজ
(৭) সংযােগ সাধনের কাজ : কমন্সসভা জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধনের কাজ করে থাকে। কমন্সসভার সদস্যরা নিজনিজ নির্বাচনী এলাকার অভাব অভিযােগগুলি সরকারের কাছে তুলে ধরেন এবং সরকার সেই অনুযায়ী নীতি-নির্ধারণ করে থাকে। স্যামুয়েল বীয়ার (S. Beer) কমন্সসভার এই সংযােগ-সাধনকারী কাজের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
(৮) ব্রিটেনের লড সভার অন্যান্য কাজ;
উপরােক্ত কার্যাবলী ছাড়াও কমন্স সভা আরও কতকগুলি কার্য সম্পাদন করে থাকে, যেমন— (১) কমন্সসভায় আলােচনা ও বিতর্কের পরিবেশে তরুণ ও উদীয়মান নেতারা আগামীদিনে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুভার নেবার মত উপযুক্ত হয়ে (২) যে-কোন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশের আইনসভার ন্যায় কমন্সসভা দেশের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠীর স্বার্থরক্ষামূলক কাজ করে থাকে ; (৩) জনগণের বিভিন্ন অভাব-অভিযােগের প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করে; (৪) সংবিধান সংশােধন করে ; (৫) বিচারপতিদের অপসারণের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে ইত্যাদি। ওঠে ;
উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যাচ্ছে কমন্সসভা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বর্তমানে নানা কারণে কমন্সসভার ক্ষমতা ও গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। এখন পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতার জায়গায় ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিতর্ক-মঞ্চ হিসাবে, জনমত গঠনের মাধ্যম হিসাবে এবং গণতন্ত্রের ধারক-বাহক হিসাবে কমন্সসভা আজও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চলেছে।