ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নিরূপণ কর।

 

 ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নিরূপণ কর।

ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব:

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব:

 

 (খ) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্ষ কে ছিলেন? উঁহার রাজ্যবিস্তারের সম্বন্ধে কি জান? 

(গ) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ্যজয়ের কাহিনীর বিবরণ দাও। 

ভারতের-ইতিহাসে-চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্যের-কৃতিত্ব-নিরূপণ-কর।

 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশ পরিচয়

 

উত্তর। (১) চন্দ্রগুপ্তের বংশ-পরিচয় : খ্রীষ্ট পূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ভারত ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করিয়াছিল। ভারতে অখণ্ড ঐক্য রাজনৈতিক সাম্রাজ্য গঠনে মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল প্রথম সফল পদক্ষেপ। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা  ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্য। কিন্তু তাহার বংশ-পরিচয় সম্বন্ধে মতভেদ আছে কোন কোন হিন্দু কিংবদন্তী অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন নন্দরাজের উপপত্নী মুরা নামক শূদ্রানীর গর্ভজাত সন্তান এবং মুরার নাম অনুসারেই এই বংশ পবনের মােরিয় নামক মৌর্যবংশ নামে অভিহিত হইয়াছে। পুরাণে তাহাকে শূদ্র গর্ভজাত বেশ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু মহাপরিনির্বাণ’ সূত্র নামক প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে চন্দ্রগুপ্তকে পিপ্পিলিবনের ‘মােরিয়’ নামক ক্ষত্রিয় বংশজাত বলিয়া লেখা আছে। জৈন এ পরিশিষ্ট পার্বণে চন্দ্রগুপ্তকে ‘ময়ূর পােষক’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। সমস্ত তথ্যাদি ভাল করিয়া বিচার-বিবেচনা করিয়া বর্তমান ঐতিহাসিকগণ চন্দ্রগুপ্তকে ‘মােরিয়া নামক ক্ষত্রিয় বংশজাত, এই মতকেই অধিকতর গ্রহণযােগ্য বলিয়া মনে করেন।

 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মগধের সিংহাসন অধিকার

 

(2) মগধের সিংহাসন অধিকার : চন্দ্রগুপ্তের বাক্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় নাই। তিনি নন্দবংশের রাজগণের বিরােধী ছিলেন এবং ধননন্দকে ধ্বংস করিবার জন্য আলেকজাণ্ডারের সাহায্য চাহিয়াছিলেন। কিন্তু সেখানে নিরাশ হইলে তিনি নিজ শক্তি গঠন করিবার দিকে মনোেনিবেশ করেন। অতঃপর তিনি খ্রীষ্ট পূর্ব ৩২১ অব্দের পূর্বেই তক্ষশীলার চাণক্য নামক এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় শেষ ন সুটকে পরাজিত করিয়া মগধের সিংহাসন অধিকার করেন।

 

সিংহাসন অধিকার করিয়াই চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তার এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু উপত্যকা গ্রীক লমুক্ত করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। আলেকজাণ্ডারের ভারত ত্যাগের কিছুকাল পরেই স্থানে স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিয়াছিল, কারণ ভারতবাসীরা বৈদেশিক শাসনকে কোন সময়েই বরদাস্ত করিতে পারে নাই। তাহার মৃত্যুর পর গ্রীক শিবিরেও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। চন্দ্রগুপ্ত এই সুযােগে তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন এবং কয়েকটি যুদ্ধে তাহাদের  পরাজিত করিয়া গ্রীক শাসনের অবসান ঘটাইতে সক্ষম হন। চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে বৈদেশিক শত্ন থাকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত করিয়াছিলেন অথবা প্রথমে নলবশে ধ্বসে করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতভেদ আছে। 

মনে করেন যে চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্য প্রথমে কৌটিল্যের সহায়তায় আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর পাঞ্জাব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন এবং ইহার পর পূর্ব-ভারতে নন্দবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অন্যদিকে ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন যে চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে নন্দবংশকে উৎখাত করিয়া মগধে ক্ষমতা দখল করেন এবং ইহার পর পশ্চিম-ভারতে গ্রীক শাসনের অবলুপ্তি ঘটান।

 

সেলুকাসের পাঞ্জাব আক্রমণ 

 

 (৩) সেলুকাসের সহিত যুদ্ধ : আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর তাঁহার সাম্রাজ্য বিভিন্ন সেনাপতির মধ্যে বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল। সেলুকাস সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের অধিপতি হইয়াছিলেন এবং ভারতবর্ষে গ্রীক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি খ্রীষ্ট পূর্ব ৩০৫ অব্দে সসৈন্যে অগ্রসর হইলেন। এই যুদ্ধের কোন বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। গ্রীক ঐতিহাসিকগণও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। তবে চন্দ্রগুপ্তের সহিত তাহার সন্ধির উল্লেখ আছে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে হিরাট, কাবুল, কান্দাহার ও মাকরাণ এই চারটি প্রদেশ প্রদান করেন। চন্দ্রগুপ্তও তাহাকে পাচশত হস্তী উপহার দেন। 

 স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উভয়ের মধ্যে এক বৈবাহিক সম্বন্ধও স্থাপিত হয় এবং সেলুকাস মেগাস্থিনিস নামক এক দূতকে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় প্রেরণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের সন্ধির শর্তগুলি লক্ষ্য করিলে স্পষ্টই দেখা যায় যে, গ্রীক সেনাপতিকে পরাজয় বরণ করিয়া এবং ভারতে সাম্রাজ্য পুনঃস্থাপনের আশা ত্যাগ করিয়া এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দান করিতে হইয়াছিল। ইহার পর সেলিউকাস মেগাস্থিনিস নামে এক রাষ্ট্রদূতকে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় পাঠান। এই সন্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে স্মিথ মনে করেন যে, দুই হাজার বৎসর পূর্বে প্রথম ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তের অধিকার অর্জন করেন—যাহা পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাটগণ অথবা ইংরাজরা অর্জন করিতে পারেন নাই।।

 

চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তৃতি

 

(৪) চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তৃতি : উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রীক শাসনের অবসান ঘটাইয়া চন্দ্রগুপ্ত নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। পর পর অভিযান পরিচালনা করিয়া তিনি মালব, সৌরাষ্ট্র এবং মহীশূরের কিয়দংশ তঁাহার সাম্রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন। তামিল কবি মামুলনার-এর রচনা অনুসারে দক্ষিণ-ভারতে তিনেভেলি জেলা পর্যন্ত যে তাহার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল তাহা জানা যায়। অশােকের রাজত্বকালে উত্তরাপথ, তিনেভেলি অবন্তী, দক্ষিণাপথ, প্রাচ্য ও কলিঙ্গ এই পাঁচটি প্রদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। অশােক কলিঙ্গ জয় করিয়াছিলেন; সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে, কলিঙ্গ ছাড়া বাকী প্রদেশগুলি চন্দ্রগুপ্তের সময়েই মৌর্য সাম্রাজ্যের  অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। 

 দক্ষিণ-ভারতে চন্দ্রগুপ্ত কতদূর রাজ্যবিস্তার করিয়াছিলেন তাহা লইয়া যথেষ্ট মতভেদ রহিয়াছে। কারাের মতে চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্য দক্ষিণ-ভারত বিজয় সম্পন্ন করিয়াছিলেন। ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন নন্দরাজারা ইতিপূর্বেই দাক্ষিণাত্য দখল করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই নন্দবংশের অবসানের পর দাক্ষিণাত্য মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। মহীশূরে প্রাপ্ত কয়েকটি শিলালিপি হহতে জানা যায় যে, উত্তর-মহীশূরের কুণ্ডল প্রদেশ পর্যন্ত নন্দ রাজাদের আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছিল। প্লুটার্ক ও জাষ্টিনের বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন বলিয়া লিখিত আছে। এই সমস্ত তথ্য হইতে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ভারতের বিশাল অংশ জুড়িয়া তাহার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হইয়াছিল এবং তাহাকে ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বলিয়া অভিহিত করা যায়। প্রজাহিতৈষী রাজা হিসাবে চন্দ্রগুপ্ত

 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

 

(৫) চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব : যােদ্ধা, সুদক্ষ শাসক ও ভারতীয় সম্রাটগণের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছেন। তিনি অসাধারণ প্রতিভাবান ও শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন।

 (ক) সামান্য অবস্থা হইতে তিনি যথেষ্ট শক্তি গ্রহণ  করিতে সক্ষম হন এবং অত্যাচারী নন্দরাজকে ধ্বংস করিয়া প্রজামঙ্গলকারী সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। বিদেশীর কবল হইতে দেশকে মুক্ত করিয়া তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করেন; সেলুকাসের আক্রমণ প্রতিহত করিয়া তিনি কেবল দেশকে বিদেশী শাসনের গ্লানি হইতে মুক্ত করেন নাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সম্মান বৃদ্ধি করিয়াছিলেন।

 

(খ) প্রায় সমগ্র দেশকে এক সাম্রাজ্যের মধ্যে আনিয়া এক শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করিয়া তিনি সর্বভারতীয় ঐক্যকে বাস্তবে রূপ দিয়াছিলেন।

 (গ) শুধু যােদ্ধা সর্বভারতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হিসাবে নয়, সংগঠক হিসাবেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। তিনি যে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার প্রচলন করিয়াছিলেন তাহাতে তাহার বিশাল সাম্রাজ্যের সংহতি এতটুকু নষ্ট হয়ে যায় নাই। বিদেশী লেখকগণ তাহার শাসনব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন।

চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব

 

 (ঘ) কিন্তু শাসনব্যবস্থা যে কেবল কেন্দ্রীভূত ছিল তাহা নহে, জনসাধারণের কল্যাণে এই শাসনব্যবস্থা নিয়ােজিত হইয়াছিল হইয়াছিল ; জনসাধারণের কল্যাণ ছিল তাহার  শাসনব্যবস্থার মূলনীতি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধুমাত্র বীর যােদ্ধা, সুশাসক ছিলেন তাহা নয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশেও তাহার দৃষ্টি ছিল। তঁাহার নির্মিত রাজপ্রাসাদ, উদ্যান প্রভৃতি তাহার শিল্পবােধের পরিচায়ক। এইভাবে ভারতে এক গৌরবময় সৃজনশীল যুগের সূচনা হয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *