Political science

পারমাণবিক অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ-পারমাণবিক এনপিটি কি ? পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি

 পারমাণবিক অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ-পারমাণবিক এনপিটি কি ? পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

পারমাণবিক-অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ-পারমাণবিক-এনপিটি-কি-পারমাণবিক-অস্ত্র-নিষিদ্ধকরণ-চুক্তি

 

 

  (Nuclear Arms Control)

 

■ ভূমিকা (Introduction )

 

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা:

 

প্রতিটি যুদ্ধের বিভীষিকা ও নৃশংসতা মানুষকে শান্তিকামী ক’রে তোলে। কিন্তু মানব তিহাসের সর্বাপেক্ষা বড় শিক্ষা হোল—একটি যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই শুরু হয় স্বার্থের হানাহানি ; শুরু হয় নতুন ক’রে আর একটি যুদ্ধ। স্বার্থান্ধ মানুষ তখন হয়ে ওঠে বন্য শ্বাপদের চেয়েও হিংস্র। এই হিংস্র মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে বারংবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন শান্তির পূজারী মহামনীষীবৃন্দ। প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট (Immanual Kant) তাঁর ইটারন্যাল পিস’ (Eternal Peace, 1795) নামক গ্রন্থে চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি।

  কারণ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারের লিপ্সা এরূপ শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রধানতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে আমরা যে-বিশ্বে বাস করছি, তার সঙ্গে পুরানো বিশ্বের অনেক পার্থক্য। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতি উৎপাদন, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অবিশ্বাস্য উন্নতি ঘটিয়েছে। বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে মানুষ পরস্পরের কাছে এসেছে এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি দিক থেকে মানুষ বর্তমানে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া, যুদ্ধের পরিবর্তিত প্রকৃতি সম্পর্কেও আজ মানুষ বিশেষ সচেতন হয়ে উঠেছে। তারা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, আধুনিক যুগ হোল পারমাণবিক যুগ এবং আজকের দিনের যুদ্ধ হোল পারমাণবিক অস্ত্রের যুদ্ধ।

 এরূপ যুদ্ধ একবার শুরু হলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র বিশ্বই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৬ই ও ৯ই আগস্ট যথাক্রমে হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে কোনরকম প্রয়োজন ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দু’টি পারমাণবিক বোমা* ফেলেছিল নিজেকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করার উদ্দেশে। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ ধ্বংস ক্ষমতা দেখে সমগ্র বিশ্বের মানুষ আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল। হিরোসিমায় লক্ষাধিক মানুষ এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ বোমা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বোমার প্রতিক্রিয়ায় আরও কয়েক লক্ষ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

তাছাড়া, জাপানের সেই প্রজন্মের যেসব মানুষ বেঁচে থাকল, তাদের অধিকাংশই বিকলাঙ্গ অথবা মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হোল। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতি পরিমাপ করা অদ্যাবধি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করল যে, মানুষের সামনে মাত্র দু’টি পথ খোলা আছে—একটি হোল সর্বাত্মক ধ্বংস ও অপমৃত্যু এবং অপরটি হোল বিশ্বশান্তি ও মৈত্রী। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ-ক্লান্ত রাষ্ট্রসমূহের নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিলেন। এর ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হোল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ।

 

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

■ পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty NPT)

 

বারুচ পরিকল্পনা’:

 

পারমাণবিক যুগের ঊষালগ্ন থেকেই পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্তরে চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারী মাসে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ‘’ সাধারণ সভায় গৃহীত প্রথম প্রস্তাবে জাতীয় অস্ত্রভাণ্ডার থেকে পারমাণবিক অস্ত্র বর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হোল—যে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের নাগাসাকি ও হিরোসিমাতে আণবিক বোমা ফেলে ঐ দু’টি শহরকে কার্যতঃ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল, সে নিজেই বিশ্বের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক যাবতীয় আণবিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্দেশে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল।

  ‘বারুচ পরিকল্পনা’ (The Baruch Plan) নামে পরিচিত ঐ প্রস্তাব তখন গৃহীত হয়নি। বলা বাহুল্য, কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরূপ প্রস্তাব উত্থাপন করেনি। বারুচ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য বজায় রাখা। কিন্তু তার সে আশা যে ফলপ্রসূ হয়নি, তার প্রমাণ ১৯৪৯ সালে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৫২ সালে ব্রিটেন, ১৯৬০ সালে ফ্রান্স এবং ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এই পাঁচটি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

 

পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তি সম্পাদন পারমাণবিক অস্ত্র সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ১৮টি রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত নিরস্ত্রীকরণ কমিটি (The 18-nation Disarmament Committee)-তে তীব্র বিতর্কের পর ১৯৬৮ সালের ১লা জুলাই পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তি (এন.পি.টি) গৃহীত হয় এবং ১৯৭০ সালের ৫ই মার্চ থেকে কার্যকর হয়। তদানীন্তন বিশ্বের পাঁচটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র-সহ মোট ১৭৮টি দেশ ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বর্তমানে এন.পি.টি.-তে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা হোল ১৮১। লক্ষণীয় বিষয় হোল – ভারত, পাকিস্তান, কিউবা ও ইস্রায়েল ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। চুক্তিতে একথা বলা হয়েছিল যে, ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারির পূর্বে যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করেছে এবং তার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, কেবল তাদেরই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে। এইভাবে এন.পি.টি-র মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের দেশগুলিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়, যথা—[i] পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশ এবং [ii] পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশ।

 

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এন.পি.টি. গৃহীত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা অন্যরকম। ১৯৬৪ সালের ১০ই অক্টোবর ভারতই সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে উদ্যোগ

 

পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধে ভারতের প্রস্তাব:

 

গ্রহণ করেছিল। ভারত এবং অন্যান্য সাতটি রাষ্ট্র সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার ১৩৮২তম পুর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ‘পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার প্রতিরোধের উদ্দেশে একটি চুক্তি’(A Treaty  to prevent the Proliferation of Nuclear Weapons)-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। ঐ প্রস্তাব ১৯৬৫ সালের ১৯শে নভেম্বর সাধারণ সভায় গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করা হয় যে, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার প্রতিরোধের উদ্দেশে তিনটি প্রধান নীতি অনুসরণ করা হবে। এগুলি হোল—[ক] চুক্তিতে এমন কোন ফাঁক-ফোকর (loop-holes) থাকবে না, যার সুযোগ নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর বা শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে-কোন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার ঘটাতে সক্ষম হবে ; [খ] পারমাণবিক ও অ-পারমাণবিক শক্তিগুলির পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং [গ] সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চুক্তিটি অন্যতম দৃঢ় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে।*

 

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ সভায় গৃহীত এই প্রস্তাবটিকে বিকৃত ক’রে এর মধ্যে কয়েকটি অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক ধারা ঢুকিয়ে দিয়ে সেটিকেই চূড়ান্ত রূপ প্রদান করে। ফলে সাধারণ সভা কর্তৃক গৃহীত পূর্বোক্ত তিনটি প্রধান নীতির কোনটিই নতুন চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই নিরস্ত্রীকরণ কমিটির সভায় ভারত প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের যে-নীতিগত অবস্থান ভারত গ্রহণ করেছিল, তা নিশ্চিতভাবেই সমর্থনযোগ্য। কারণ, ঐ চুক্তির মাধ্যমে কেবল পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলি (the non-nuclear weapon states) ভবিষ্যতে যাতে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

 

এন.পি.টি.-র প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়:

 

প্রধানতঃ তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তি বা এন.পি.টি. স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই তিনটি লক্ষ্য হোল –[i] ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ করা, –    [ii] পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহার বন্ধ করা ও তার শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং [iii] পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করা ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ-সহ সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণকে উৎসাহিত করা। এন.পি.টি.-র ধারাগুলি বিশ্লেষণ করলে তার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হওয়া সম্ভব। এই চুক্তির ১নং ধারায় বলা হয়েছে যে, পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি (nuclear weapon states) কোন অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলিকে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে না এবং কোনভাবেই তাদের এরূপ অস্ত্র নির্মাণে সাহায্য, উৎসাহ ও প্ররোচনাদান করবে না। 

 চুক্তির ২নং ধারায় এই প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে যে, পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলি (non-nuclear weapon states) কোনও রাষ্ট্রের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রযুক্তি যেমন গ্রহণ করবে না, তেমনি পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ কিংবা অস্ত্র নির্মাণের জন্য যে-কোন ধরনের সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। চুক্তি-স্বাক্ষরকারী প্রতিটি পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ কাজে আণবিক শক্তিকে ব্যবহার করছে কিনা এবং পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ বা পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে কিনা, সে সম্পর্কে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের তদারকি মেনে নিতে তারা বাধ্য থাকবে বলে এন.পি.টি-র ৩নং ধারায় বলা হয়েছে। এরূপ তদারকির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তিসংস্থা (International Atomic Energy Agency — IAEA)-র হাতে। এন.পি.টি-র ৪নং ধারাতে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে পারমাণবিক শক্তির বিকাশ সম্পর্কে গবেষণা এবং উৎপাদন ও ব্যবহার করার অহস্তান্তরযোগ্য অধিকার (inalienable right) স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

 

 

  আবার, ৫নং ধারায় পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলির শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ (peaceful nuclear explosions) -এর অধিকার স্বীকার ক’রে নেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি অবিলম্বে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের উদ্দেশে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে এন.পি.টি.র ৬নং ধারায় ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ কেউ এই ধারাটিকে এন.পি.টি-র সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আবার, ৮নং ধারায় এন.পি.টি-র লক্ষ্য কতখানি পূর্ণ হয়েছে এবং বিভিন্ন ধারা কতখানি বাস্তবায়িত হয়েছে, তা প্রতি ৫ বছর অন্তর পুনর্বীক্ষণ করার জন্য স্বাক্ষরকারী দেশগুলির সম্মেলন আহ্বান করার কথা বলা হয়। স্বাক্ষরকারী দেশগুলি ২৫ বছরের জন্য এই চুক্তি মেনে নেবে বলে ঘোষণা করেছিল।

  ৮নং ধারা অনুযায়ী ১৯৭৫, ১৯৮০, ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির পুনর্বীক্ষণ সম্মেলন (Review Conferences) অনুষ্ঠিত হয়। ঐ চারটি সম্মেলনেই পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলি এই অভিযোগ উত্থাপন করেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন চুক্তির প্রস্তাবনা ও ৬নং ধারায় উল্লিখিত দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। ফলে আনুভূমিক পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা কিছুটা ইতিবাচক হলেও উল্লম্বী অস্ত্রপ্রসার রোধের ব্যাপারে তাদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে নেতিবাচক। আবার, ঐসব সম্মেলনে জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সদিচ্ছার অভাবের কঠোর সমালোচনা ক’রে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। তারা সার্বিক পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা রোধ চুক্তি (Comprehensive Nuclear Test Ban Treaty, —CTBT) সম্পাদন এবং এন.পি.টি.-র সঙ্গে তার সংযুক্তিকরণের দাবি জানায়। 

 ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, এন.পি.টি.-তে বর্ণিত পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য একটি সার্বিক পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা রোধ চুক্তি সম্পাদন বিশেষভাবে জরুরী। * জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির এই বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় ১৯৯০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তদানীন্তন সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী এদুয়ার্দ শেভার্দনাদজে (Eduard Sheverdnadze) বলেছিলেন, অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অস্ত্র-পরীক্ষা বন্ধ হলে আমাদের বাঁচার সম্ভাবনা থাকবে; অন্যথায় সমগ্র বিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। 

 ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন (the UN – NGO International Conference on Disarmament) – এ হিরোসিমার মেয়র তাকাশি হিরাওকা (Takashi Hiraoka ) – ও প্রায় অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন।* কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুক্তি মেনে নিতে রাজী না হওয়ায় চুক্তি স্বাক্ষরকারী জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির সঙ্গে তার বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

 

অনির্দিষ্টকালের জন্য এন.পি.টি.-র মেয়াদ বৃদ্ধি:

 

পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তির মেয়াদ ছিল ২৫ বছর। স্বাভাবিকভাবে চুক্তির ১০নং  ধারা অনুসারে এন.পি.টি-র মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির সম্মেলন ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তার পূর্বে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির সপক্ষে জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন (Bill Clinton) ১৯৯৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, ১৯৯৫ সালে এন.পি.টি.-র মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল সম্প্রসারিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। ১৯৯৪ সালের ২২শে জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি একই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। ঐ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন লাভের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশগুলিকে এই প্রতিশ্রুতি দান করে যে, তারা মার্কিন প্রস্তাব মেনে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলি তাদের নিরাপত্তা রক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

  যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালের ১৭ই এপ্রিল চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির প্রতিনিধিবৃন্দ চুক্তিটির পুনর্বীক্ষণের পর তার মেয়াদ বৃদ্ধি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সমবেত হন। কিন্তু ঐ সম্মেলনে এন.পি.টি.-র মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করার প্রশ্নে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। ৫ই মে কানাডা এবং ইন্দোনেশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে যে-দু’টি প্রস্তাব পেশ করে, সেগুলি ছিল পরস্পর-বিরোধী। কানাডার প্রস্তাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ইন্দোনেশিয়া পুনরায় ২৫ বছরের জন্য চুক্তিটির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করে।

  আরব রাষ্ট্রগুলি-সহ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ কানাডার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির পক্ষ থেকে প্রতি ৫ বছর অন্তর চুক্তিটিকে কঠোরভাবে পুনর্বীক্ষণের দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে একটি স্থায়ী পুনর্বীক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাবও তারা উত্থাপন করে। আরব রাষ্ট্রগুলি শর্তাধীনে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে সম্মত হয়। ইস্রায়েল চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে তারাও চুক্তির মেয়াদের সম্প্রসারণ মেনে নেবে বলে ঘোষণা করে। আবার, পূর্বোক্ত সম্মেলনে ভোটদানের পদ্ধতি নিয়েও গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরকারী জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি-সহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র গোপন ভোট পদ্ধতি অনুসরণের দাবি জানালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি অনুসরণের জন্য চাপ

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

সৃষ্টি করে। বলা বাহুল্য, প্রকাশ্য ভোটদান পদ্ধতি অনুসৃত হলে তাদের বিরোধী রাষ্ট্রগুলিকে সনাক্ত করা এবং পরবর্তী সময়ে তাদের শাস্তিদান করা সম্ভব হবে। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের শান্ত করার জন্য পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলি এই প্রতিশ্রুতি দান করতে বাধ্য হয় যে, ১৯৯৬ সালের পূর্বেই সার্বিক পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা বন্ধের জন্য তারা একটি চুক্তি সম্পাদনের ব্যবস্থা করবে। তাছাড়া, আরব দেশগুলিকে সন্তুষ্ট করার জন্য সম্মেলনে পশ্চিম এশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ঐ অঞ্চলের সব দেশকে এন.পি.টি.-র শরিক হতে হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এমনকি, পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশগুলির ওপর যাতে পারমাণবিক আক্রমণ না হয়, সেজন্য রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করা হয়। শেষ পর্যন্ত বৃহৎ শক্তিগুলির, বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতিস্বীকার ক’রে প্রতিবাদী রাষ্ট্রগুলি এন.পি.টি.-র মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল বৃদ্ধি করার প্রস্তাবে স্বাক্ষর দান করে। ১৯৯৫ সালের ১১ই মে ভোটাভুটি ছাড়াই ১৮১টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবৃন্দ চুক্তিটি সম্প্রসারণের পক্ষে সম্মতি জ্ঞাপন করে। তবে ভারত, পাকিস্তান, কিউবা ও ইস্রায়েল পূর্বের মতোই এই চুক্তি সম্পাদন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে।

 

• মূল্যায়ন (Evaluation) :

 

 ভারত-সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি, বিশেষতঃ পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলি নানা দিক থেকে এন.পি.টি-র তীব্র সমালোচনা ক’রে থাকে। এইসব

সমালোচনাকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে :

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

  [১] বৈষম্যমূলক চুক্তি:

 

ভারত এন.পি.টি.-কে একটি বৈষম্যমূলক চুক্তি বলে মনে করে। কারণ, চুক্তিতে পারমাণবিক অস্ত্রধর ও অস্ত্রহীন রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে, তেমনি অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলি যাতে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করতে না পারে সেজন্য তদারকিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চুক্তিতে বলা হয়েছে। ভারতের মতে, এই চুক্তি কার্যতঃ কয়েকটি রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অধিকারকে বৈধতাদান করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে বিপরীত নীতি অনুসৃত হতে দেখা যায়। তাই ভারত বৈষম্যহীন পারমাণবিক নীতি গ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। ১৯৯৫ সালের ১৭ই মে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, ভারত পারমাণবিক অস্ত্র-প্রসার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না।

  কারণ, ভারত একথা বিশ্বাস করে যে, পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কেন্দ্র ও মজুত ভাণ্ডার আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্থাপন করতে সম্মত হলেই কেবল প্রকৃত অর্থে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ করা সম্ভব। সি. পি. আই. (এম) সাংসদ ড. বিপ্লব দাশগুপ্ত এন.পি.টি.-কে ‘অত্যন্ত বৈষম্যমূলক একটি চুক্তি’বলে সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রধর এবং পারমাণবিক অস্ত্রহীন—এই দু’ধরনের রাষ্ট্র তৈরি করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তান ও ইস্রায়েল এন.পি.টি-তে স্বাক্ষর না করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি যথেষ্ট নরম মনোভাব প্রদর্শন করছে। কিন্তু ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য ভারতের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সালের ১৬ই মে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পি. ভি. নরসীমা রাও লোকসভায় এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এন.পি.টি.-র মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করা হলেও এর মাধ্যমে মানব জাতির কোন উপকার সাধিত হয়নি। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলি তাদের কার্যকলাপ পূর্বের মতোই অব্যাহত রেখেছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ই মে (অর্থাৎ এন.পি.টি.-র মেয়াদ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাত্র ৪ দিন পরে) সিয়ানজিয়া প্রদেশে চীন ৪২-তম পারমাণবিক বিস্ফোরণ এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে।

 

[২] কেবল আনুভূমিক অস্ত্রপ্রসার রোধের ওপর গুরুত্ব:

 

অন্য একটি কারণেও ভারত এন.পি.টি-কে একটি বৈষম্যমলূক চুক্তি বলে চিহ্নিত করেছে। এই চুক্তি আনুভূমিক অস্ত্র-প্রসার রোধের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর বিশেষ জোর দিলেও উল্লম্বী অস্ত্র-প্রসার রোধের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে পারমাণবিক অস্ত্রধর শক্তি হিসেবে স্বীকৃত ৫টি রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কেউ পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ ঘটাতে পারবে না। আবার, ঐ চুক্তিতে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশেও পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়নের পথ কার্যতঃ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। 

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

[৩] পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ:

 

 ভারত এন.পি.টি-কেই একটি ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি বলে মনে করে। কারণ, এর মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার উদ্দেশে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়নি। কারণ, চুক্তির  ৬নং ধারায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া, চুক্তির এই শর্ত ভঙ্গ করা হলে ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, সে ব্যাপারে চুক্তিটি বিস্ময়করভাবে নীরবতা অবলম্বন করেছে। ফলে পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি কার্যতঃ তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ক’রেই চলেছে। এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয় ১৯৯৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে শিকাগো থেকে প্রকাশিত ‘বুলেটিন অব্ দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস’ (Bulletin of the Atomic Scientists), ‘সিপ্রি ইয়ার বুক’, ১৯৯১ (SIPRI Year Book, 1991), সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কর্তৃক ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘নিউক্লিয়ার আর্মস : থ্রেট টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড’ (Nuclear Arms : Threat to our World) প্রভৃতি থেকে।

  ১৯৬৮ সালে পাঁচটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মোট পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ (ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক পদার্থযুক্ত অংশ)-এর সংখ্যা ছিল ৩৯,২০২। ১৯৮৬ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬৯,৪৯০-এ দাঁড়ায়। এই সময়কালে কেবল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মজুত ভাণ্ডারের পরিমাণ ৯,৩৯৯ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫,০০০-এ দাঁড়িয়েছিল। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী পাঁচটি দেশের মজুত ভাণ্ডারে স্ট্র্যাটিজিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড’এর সংখ্যা ১৯৬৮ সালে ৫,৭২৭ থাকলেও ১৯৮৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৪,৫৪৭-এ দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্র্যাটিজিক স্টকপাইল’ (Strategic Stockpile)-এর সংখ্যা ১৯৬৮ সালে ৪,৮৩৯ ছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩,০০২-এ দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের এরূপ অস্ত্রের সংখ্যা ১৯৬৮ সালে ১,৬০৫ হলেও ১৯৮৯ সালে তা ১১,৩২০-তে দাঁড়ায়। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের একটি প্রতিবেদন (Nuclear Arms: Threat to Our World) থেকে জানা যায় যে, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশগুলির অস্ত্র-ভাণ্ডারে মজুত পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি হিরোসিমাতে যে-অ্যাটম বোমা ফেলা হয়েছিল, তার ১,৬০০,০০০ গুণ বেশি। সঞ্চিত পারমাণবিক অস্ত্রের সাহায্যে অন্ততঃ ৫০ বার সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস ক’রে দেওয়া সম্ভব। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত ‘বুলেটিন অব্ দি অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট’ থেকে জানা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলেও তার কথার সঙ্গে কাজের যে বিশেষ অসঙ্গতি রয়েছে, বিশ্বের ২৭টি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করার মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক সময় ঐসব দেশের সরকারের অজ্ঞাতসারেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কাজ সম্পাদন করেছে। 

 এইভাবে সত্তরের দশকে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র সঞ্চিত রেখেছিল। এখনও বেলজিয়াম, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি, গ্রীস, ইতালী, নেদারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে। তবে একথা সত্য যে, ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পাদিত ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ অ্যান্ড সর্ট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি’ (Intermediate Range and Short Range Nuclear Forces Treaty)-র ফলে উভয় দেশেরই ‘স্ট্র্যাটিজিক স্টকপাইলে’র সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১লা জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার এরূপ স্টকপাইলের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ৭,৮১৫ এবং ৭,২৭৪ ওভারহেডে দাঁড়িয়েছে। 

 এরপর ‘স্টার্ট-১’(Strategic Arms Reduction Treaty — START-I) নামক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্টকপাইলের সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়ে ২,০০১ সালের শেষে ৬,০০০ ওভারহেডে দাঁড়াবে বলে আশা করা যায়। এরূপ পারমাণবিক অস্ত্র-হ্রাসের পেছনে এন.পি.টি.-র কোন ভূমিকা নেই। তা সম্ভব হয়েছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এর অবসান ঘটার ফলে।

 

[4] প্রবঞ্চনামূলক প্রতিশ্রুতি:

 

 চুক্তিতে এই আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে যে, চুক্তি-স্বাক্ষরকারী পারমাণবিক অস্ত্রহীন কোন দেশ কখনও পারমাণবিক আক্রমণের মুখে পড়লে পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় এগিয়ে আসবে। এই ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রবঞ্চনার  নামান্তর মাত্র। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত একটি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তার নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা কার্যতঃ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। বরং নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলিকে এই চুক্তি পরমুখাপেক্ষী ক’রে তুলেছে। বলা বাহুল্য, এর ফলে পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কারণ, চুক্তির মধ্যে লিপিবদ্ধ এরূপ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়া সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি পারমাণবিক অস্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলির ওপর নানাভাবে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

 [৫]বিভিন্ন ধারার মধ্যে ফাঁক-ফোকর

 

  এন.পি.টি.-র বিভিন্ন ধারার মধ্যে কিছু ফাঁক-ফোকর থেকে যাওয়ার ফলে সেগুলিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি সেগুলির অপব্যবহারও ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে ১নং ধারার দ্বিতীয় অংশ কিংবা ৩নং ধারার কথা উল্লেখ করা যায়। কোন কোন পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে, বিশেষতঃ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারসংক্রান্ত প্রযুক্তির রপ্তানিকে ১নং ধারার দ্বিতীয় অংশ কর্তৃক আরোপিত বাধা-নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে মনে করে। এই ধারায় কেবল সামরিক উদ্দেশে পারমাণবিক শক্তির রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে তাদের অভিমত। এরূপ ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে কোন কোন পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র এই ধারাটিকে এড়িয়ে মিত্র রাষ্ট্রগুলিকে পারমাণবিক প্রযুক্তি রপ্তানি করতে দ্বিধাবোধ করে না। এইভাবে চীনের সহযোগিতায় পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছে। আবার, ৩নং ধারায় পারমাণবিক শক্তিহীন রাষ্ট্রগুলি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করছে কিনা, তা তদারকির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তদারকির ক্ষেত্রে পারমাণবিক

 

শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি, বিশেষতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমদৃষ্টির নীতি অনুসরণ করে না। উদাহরণ হিসেবে ইরাক ও ইস্রায়েলের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করা যায়।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

উপসংহার:

 

পরিশেষে একথা বলা যেতে পারে যে, ১৯৯৫ সালে সর্বসম্মতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য এন.পি.টি.-র মেয়াদ সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলেও এই চুক্তির প্রতি পারমাণবিক যথেষ্টঅস্ত্রধর রাষ্ট্রগুলি যে কতখানি আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার

অবকাশ রয়েছে। কারণ, এই চুক্তির প্রধান প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই হোল একটি নয়া-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। এর উদ্দেশ্য হোল—বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার। তাই নিজের কর্তৃত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনেই বৈষম্যমূলক এন.পি.টি.-কে কার্যতঃ স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা সে করেছে। বস্তুতঃ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র আজ বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী এবং এরাই কার্যতঃ বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ক’রে থাকে। 

 মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এইসব রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি বিষয়ে এদের চিন্তা-ভাবনা অভিন্ন। এরা কেউই চায় না যে, নতুন কোন পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করুক। তাই তারা বৈষম্যমূলক এন.পি.টি.-কে স্থায়িত্বদানের চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে, বহু রাষ্ট্র তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মূলতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে অনির্দিষ্টকালের জন্য এন.পি.টি-র সম্প্রসারণে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছে। ঐসব রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক এই চুক্তিটিকে আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। তাই পরমাণু বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার পেইন (Christopher Paine) ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের ঘোষিত লক্ষ্যগুলিকে শূন্যগর্ভ প্ৰতিশ্ৰুতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *