দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বর্ণনা কর

প্রশ্ন (ক) দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বর্ণনা কর।

(খ) দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি কি কি?

(গ) তৃতীয় নৈপোলিয়নের পতনের কারণগুলি আলোচনা কর।

দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতন 

উত্তর।

নেপোলিয়নের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ; সেডানের যুদ্ধে পরাজয়

দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতন, সমস্ত জার্মানজাতিকে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করিবার জন্য বিসমার্ক ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা হইতে ফরাসীজাতির দৃষ্টি ফিরাইবার জন্য সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে অগ্রসর হইতে বাধ্য হন, কিন্তু সেডানের যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও পরে বন্দী হন। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতন ঘটিল।

পরোক্ষ কারণ তাঁহার রাজত্বকালের ইতিহাসে নিহিত আছে:

একমাত্র সেডানের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলেই যে তৃতীয় নেপোলিয়নের এবং দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়াছিল তাহা নহে, একটি যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের উপরই কোন সম্রাটের সম্পূর্ণ ভাগ্য নির্ভর করে না। তাঁহার পতনের কারণ তাঁহার রাজত্বকালের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী এবং তাঁহার পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তাঁহার পতনের পথকে অবশ্যম্ভাবী করিয়া তুলিতেছিল,— সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় না ঘটিলেও তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন রোধ করা যাইত না।

তাঁহার কৃতিত্ব : ফ্রান্সের সম্রাটপদ দখল:

তাঁহার রাজত্বকালের ইতিহাসে তাঁহার কৃতিত্বেরও অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। একদিক দিয়া বিচার করিলে তিনি একজন ক্ষমতাবান পুরুষ ছিলেন, কারণ ফ্রান্সের জটিল অবস্থাকে চালিত করিয়া তিনি তাঁহার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ‘নেপোলিয়ন’ নামের মোহে আকৃষ্ট ফরাসী জনসাধারণের এক বিরাট অংশের সমর্থন তিনি পাইয়াছিলেন।

দ্বিতীয় ফরাসী সাম্রাজ্যের পতন: অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে সামরিক সাফল্য:

তাঁহার রাজত্বকালের প্রথম দিকে তিনি অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি কয়েকটি অভ্যন্তরীণ গঠনমূলক সংস্কারসাধন করিয়াছিলেন এবং ফরাসী ঔপনিবেশিক বাণিজ্যিক স্বার্থবৃদ্ধি ও জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতিসাধন করিয়া তিনি দেশে কিছুটা শ্রদ্ধাও অর্জন করিতে পারিয়াছিলেন। প্রথম দিকে পররাষ্ট্রক্ষেত্রেও তিনি ফ্রান্সের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু এইসব কিছুই তাঁহাকে পতনের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই। কয়েকটি শক্তিশালী কারণ তাঁহার এই পতনকে অবশ্যম্ভাবী করিয়া তুলিয়াছিল।

(১)ফরাসি জনসাধারণ ছিল মূলত গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারের বিরোধী:

তৃতীয় নেপোলিয়নের পতনের একটি প্রধান কারণ হইতেছে এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্রের কোন স্থান ছিল না। ১৮৩০ ও ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লব দুইটি ইহাই ফরাসী জনসাধারণ ছিল মূলত প্রমাণিত করিয়াছিল যে, ফ্রান্সের জনসাধারণ স্বৈরতন্ত্রকে বেশীদিন গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারের বরদাস্ত করিতে প্রস্তুত ছিল না। কিছুদিনের জন্য নেপোলিয়ন বিরোধী বাহ্যিক আড়ম্বর ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য দ্বারা জনসাধারণকে চমৎকৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু যতই দিন যাইতে লাগিল, তাঁহার ক্ষমতা ও স্বৈরাচারী শাসনের প্রকৃত রূপ সকলের নিকট ধরা পড়িল। সুতরাং জনসাধারণের বিরোধিতা ও সম্রাটের প্রতি তাঁহাদের অনাস্থা ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল।

(২) সম্রাটসুলভ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভাব: সমস্ত শ্রেণী ও দলের বিরাগভাজন

বিভিন্ন শ্রেণীর মুখপাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির কোনটিকেই তিনি স্থায়ী ভাবে আপনার স্বপক্ষে ধরিয়া রাখিতে পারেন নাই, বিভিন্ন স্বার্থ-বিরোধী দলগুলির মধ্যে তিনি প্রায়ই সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করিতেন, ফলে তিনি কার্যত কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারেন নাই।
(ক) সমাজ-সংস্কার যথেষ্ট করা হয় নাই বলিয়া সমাজতান্ত্রিক দল স্বভাবতঃই তাঁহার বিরুদ্ধে ছিল।
(খ) তিনি অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহার অবাধ বাণিজ্যিক নীতি দেশের শিল্পপতিদের একাংশ সমর্থন করিতে পারেন নাই।
(গ) তাঁহার ইতালিয় নীতি ফরাসী যাজকশ্রেণীর মনঃপূত হয় নাই, এবং
(ঘ) জাতীয়তাবাদী দল পোল্যাণ্ড ও মেক্সিকোর ব্যাপারে তাঁহার কার্যাদির তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিল। উদারপন্থীগণ বা রক্ষণশীলগণ কেহই তাঁহার অভ্যন্তরীণ বা পররাষ্ট্রনীতিতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিল না, এবং সকলেই তাঁহার পতন কামনা করিতেছিল। আসল কথা, নেপোলিয়ন কোন রাজনৈতিক দলকেই নিজপক্ষে টানিতে পারেন নাই।

দ্বিতীয়-ফরাসী-সাম্রাজ্যের-পতনের-কারণ-বর্ণনা-কর

(৩) বোনাপার্টিস্ট আদর্শ ও কর্মপন্থার ব্যর্থতা:

তিনি প্রথম নেপোলিয়নের আদর্শ ও কর্মপন্থা ফরাসীজাতির সম্মুখে উপস্থিত করিয়া তাঁহার পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তাহাদের মনে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি সেই আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি সাধন করিতে পারেন নাই। যে পর-রাষ্ট্রনীতি দ্বারা তিনি ফরাসী জনসাধারণকে চমৎকৃত করিয়া রাখিবেন ভাবিয়াছিলেন, ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের পর হইতে তাঁহার ব্যর্থতা আরম্ভ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার জনপ্রিয়তাও কমিতে আরম্ভ করে।
(ক) তিনি স্যাভয় ও নীস দখল করিয়া ইতালিবাসী ও ইংরেজজাতির সমর্থন হারাইয়াছিলেন, এবং পাইডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সহিত চুক্তিবদ্ধ হইয়া তিনি অস্ট্রিয়াকেও বিরুদ্ধশক্তিতে পরিণত করেন।
(খ) ফরাসীজাতি পোলগণের জাতীয় আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল, কিন্তু পোলগণকে খালি মুখের সমর্থন ছাড়া কার্যক্ষেত্রে সাহায্য না করাতে তিনি একদিকে যেমন জাতীয়তাবাদীদের হতাশ করিলেন, অপর দিকে রাশিয়াকেও শত্রুতে পরিণত করিলেন।
(গ) মেক্সিকো অভিযান তাঁহার অদূরদর্শিতারই পরিচয় দেয়, এবং তাঁহার সাম্রাজ্যের ভিত্তির মূলে প্রচণ্ড আঘাত হানে।
(ঘ) অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাধিলে তাঁহার নিরপেক্ষতা অবলম্বন করিয়া থাকা তাঁহার পররাষ্ট্রনীতির চূড়ান্ত ব্যর্থতা সূচিত করে। সেই সময় স্যাডোয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া সম্পর্কে নীতি পরাজয়, পরে ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে তৃতীয় নেপোলিয়নের পরাজয়ের রাস্তা প্রস্তুত করিয়াছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন তিনি মিত্রহীন হইয়া পড়িয়াছিলেন। পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার ফলে তৃতীয়
নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পাইয়াছিল এবং পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ব্যর্থতা তাঁহার পতন সুনিশ্চিত করিয়াছিল।

পরিশেষে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ফরাসী দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনকে তীব্র করিয়া তুলিল। তৃতীয় নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা পূর্বেই কমিয়া সেডানের যুদ্ধে নেপোলিয়নের গিয়াছিল। এই পরাজয়ের ফলে তাহা ব্যাপক বিদ্বেষে পরিণত হইল। সুতরাং তৃতীয় নেপোলিয়ন ও তাঁহার সাম্রাজ্যের পতন ঘটিল এবং জনসাধারণ আর একবার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *